ভ্রমণ : ক্যানবেরার পথে
- প্রকাশের সময় : ১০:৫৫:৫১ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৮ মে ২০২১
- / ৬১৩ বার পঠিত
হাবিব রহমান: চমৎকার সুন্দর পিচঢালা রাস্তা দিয়ে দিয়ে ছুটে চলছে আমাদের বাস অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী ক্যানবেরার দিকে।কখনো দুধারে দিগন্ত বিস্তৃত খালি মাঠ। কখনো বা দুধারে অরণ্য। মাঝে মাঝে সাইন দিয়ে ক্যাঙ্গারুর ছবি আঁকা। অর্থাৎ এখান দিয়ে ক্যাঙ্গারু রাস্তা পারাপার হয়। ড্রাইভারের সাবধানে গাড়ী চালাতে হবে। গাড়ীর নীচে ক্যাঙ্গারু চাপা পড়লে জরিমানা গুনতে হবে।
গাইডের মাইকের শব্দে চমক ভাংলো। জানালো আমরা অল্প সময়ের মধ্যেই ক্যানবেরা সিটিতে পৌঁছে যাবো।এই সূযোগে ক্যানবেরার কিছু তথ্য আমাদের জানাতে চায়। আজকাল টিপিকাল গাইডদের এই বক্তৃতা আর কেউ শুনতে চায়না। কারণ গুগল ঘাটলে সহজেই সব তথ্য মেলে। তার পরও গাইডকে তার ডিউটি করতেই হয়। কেউ শুনুন বা না শুনুক।
পশ্চিমে বøাক মাউন্টেইন আর পূর্বে মাউন্ট অ্যান্সলি এই দুই পাহাডড়ের মাঝে গড়ে উঠেছে ক্যানবেরা শহর। এখানে একসময় মেষপালকদের একটি ক্ষুদ্র বসতি ছিল, যার নাম ছিল ‘ক্যানবেরি’। নামটি সম্ভবত অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী অধিবাসীদের মুখের এনগুন্নাওয়াল ভাষার একটি শব্দ ‘কামবেরা’ থেকে এসেছে, যার সম্ভাব্য একটি অর্থ হল ‘সম্মেলন স্থল’। কারো মতে অর অর্থ দুই স্তনের মাঝখানের স্থান। এই নামটিই পরে বিবর্তিত হয়ে ১৮৩৬ সালে ‘ক্যানবেরা’ নামটির উৎপত্তি হয় বলে ধারণা করা হয়।
অস্ট্রেলিডান পার্লামেন্ট হাউজের সামনে লেখক
এখানে রাজধানী স্থাপন নিয়ে চমৎকার একটি গল্প শোনালো গাইড।
উনিশ শতকের সূচনালগ্ন। দক্ষিণ গোলার্ধের বিশাল দ্বীপটির পৃথক পৃথক ভুখন্ডের প্রশাসকরা একমত হয়েছেন অস্ট্রেলিয়া নামের একটি ফেডারেল রাস্ট্র গঠন করবেন। গোল বেঁধেছে রাজধানী নিয়ে। বৃহত্তর দুটি শহর মেলবোর্ন এবং সিডনি তাদের কেউই এই সুযোগ ছাড়তে রাজী নয়। তারা চাইছেন তাদের ওখানেই হবে রাজধানী। অবশেষে মিমাংসা হলো দুটোর কোনটিতেই নয় রাজধানী হবে দুই নগরীর মাঝামাঝি কোন একটা স্থানে। আর এভাবেই ক্যানবেরা রাজধানীর মর্যাদা পায়। নিস্তরঙ্গ এই মফস্বল শহরটিকে সুনিদৃস্ট স্বাপত্যপরিকল্পনায় গড়ে তোলা হয় একটি আধুনিক নগর হিসাবে।
শহরটি সমুদ্র উপকূল থেকে বেশ দূরে। গ্রীস্মে সাধারণত গরম এবং শীতকালে বেশ ঠান্ডা হয়। ক্যানবেরা অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী শহর হলেও হৈ হল্লার দিক থেকে অন্যান্য শহরের চেয়ে একটু কম। সন্ধ্যার পর অধিকাংশ পানশালার বাতি নিভে যায় শুধু শনিবার ছাড়া। তবে শহর জুড়ে রয়েছে অনেক পার্ক আর লেক। সবুজের সমারোহ ঘিরে রেখেছে পুরো শহরটিকে। এর পরিপাটি রুচি সহজেই মন কাড়ে। রাজধানী শহর বলে ক্যানবেরার বেশীরভাগ লোক চাকুরিজীবি। ৮-৪টা অফিস করে ঘরে গিয়ে বিশ্রাম। তাই বেশীরভাগ দোকানপাট সন্ধার পর পরই বন্ধ হয়ে যায়। এখানে দর্শনীয় স্থান হলো পার্লামেন্ট হাউজ, ওয়ার মেমোরিয়াল, ন্যাশনাল মিউজিয়াম ইত্যাদি।
আমাদের গাড়ী এসে থামলো ক্যানবেরা শহরের কাছাকাছি অস্ট্রেলিয়ার ন্যাশনাল মিউজিয়ামে। প্রবেশ পথেই সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ের মত উজ্জল রঙচঙে আর্চযুক্ত গেট। এখানে অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী মানুষ এবং তাদের সংস্কৃতির অনেক পরিচয় রাখা আছে। ফাস্ট অস্ট্রেলিয়ান নামের একটি গ্যালারিতে আদিবাসিদের নানান স্মৃতিচিহ্ন রয়েছে। তাদের বাসগৃহের মডেল, আদিবাসী শিল্পীদের আঁকা চিত্রকর্ম, প্রাচীন বাদ্যযন্ত্র, ইত্যাদি।
দ্য গার্ডেন অব অস্ট্রেলিয়ান ড্রিমস নামের একটি চত্বরে ম্যাপের উপর হেঁটে হেঁটে চিনে নেয়া যায় দেশটির বিভিন্ন অঞ্চল। এখানে প্রতিটি অঞ্চলের নাম, তার ভু প্রকৃতি আর কৃস্টি সংস্কৃতির সংক্ষিপ্ত পরিচয় লেখা রয়েছে।
২০০১ সালের ১১ মার্চ মিউজিয়ামটি উদ্ধোধন হয়। ৬৬০০ বর্গমিটারের এই মিউজিয়ামটিতে অনেকগুলি ভবন রয়েছে। সবগুলো গ্যালারীই উজ্জল আলোয় আলোকিত। ভেতরে ঢুকার জন্য কোন ফি দিতে হয়না। ভিডিও করা নিষিদ্ধ। তবে এর ভেতরে কোন প্রদর্শনী হলে সেজন্য টিকিট কাটতে হয়।
ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব অষ্ট্রেলিয়া
আমরা ইতোমধ্যে ক্যানবেরা শহরে এসে পৌছে গেছি। সাজানো গোছানো শহর। প্রশস্ত বাঁকবিহীন সড়ক, ঝকঝকে দোকানপাঠ। শহরের বুক চিড়ে বয়ে চলেছে লেক হারালে গ্রিফিন এর ঘন নীল শান্ত আর নিস্তরঙ্গ জলধারা। অন্য দশটি আধুনিক ইউরোপীয় শহরের মতোই। গাইড আশে পাশে বড় বড়ভবনগুলির সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। এ ব্যাপারে আমার তেমন আগ্রহ ছিলোনা। কেননা এগুলি বেশীরভাগই সরকারী অফিস আদালত। তবে একটা জিনিষ আমার নজর কাড়লো। তাহলো রাস্তার এখানে সেখানে ময়ুরের ছড়াছড়ি। ক্যাঙ্গারু দেখার জন্য এদিক সেদিক তাকালেও তা চোখে পড়ছিলো না।
এ ব্যাপারে গাইডের দৃষ্টি আকর্ষন করলে সে জানালো, ময়ুর দেখতে আকর্ষনীয় হলেও এই পাখিটি এখন সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে ক্যানবেরা শহরে। প্রচুর ময়ুরের বিচরণ এখানে। তারা সড়কে স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে যেজন্য চালকদের গাড়ী চালাতে সমস্যা হচ্ছে। ময়ুরগুলি যখন তখন ঢুকে পড়ছে মানুষের বাড়ী ঘরে। খাদ্য শব্জী খেয়ে ফেলছে। ডিম পাড়ার মৌসুমে তাদের ডাকে অতিষ্ঠ হয়ে উঠছেন শহরের বাসিন্দারা। বলা যায় ক্যানবেরা শহরের বাসিন্দারা বিপাকে আছেন এই পাখীটিকে নিয়ে।
গাইড জানায়, দুই শতাব্দী আগে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকরা পোষার জন্য ময়ুর নিয়ে এসেছিলো এখানে। এখন তা বংশ বৃদ্ধি হয়ে এই শহরের বাসিন্দা হয়ে গেছে। মানুষ এই পাখিটিকে নিয়ে অতিষ্ঠ। অনেকে শহরে নির্দৃষ্ট পরিমান পাখী রেখে অতিরিক্তগুলো মেরে ফেলার জন্য দাবী জানাচ্ছেন।
গাইড জানালো, শুধু সমৃদ্ধশালী শহর নয় বসবাসকারী শহর হিসাবেও ক্যানবেরা বিশ্বে শীর্ষ স্থানীয়। সবদিক বিবেচনায় এই শহরটি পৃথিবীর বসবাস উপযোগী সর্বোত্তম স্হান হিসাবে বিবেচিত হয়েছে বেশ কয়েকবার। আয় নিরাপত্তা, শিক্ষা কর্ম স্বাস্থ্য এবং পরিবেশ ইত্যাদি এসব বিষয় এ ব্যাপারে বিবেচনা করা হয়।
আমাদের গাড়ী এসে থামলো রাজধানী ক্যানবেরার প্রাণকেন্দ্র অস্ট্রেলিয়ান পার্লামেন্ট হাউজের সামনে। পার্লামেন্ট হাউজকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে শহরের বিভিন্ন স্থাপনা। এর সামনে দাঁড়ালে পুরনো পার্লামেন্ট হাউজ এবং ওয়ার মেমোরিয়াল চোখে পড়ে। আমাদের দেশের সংসদ ভবনের মত এখানে ঢুকার জন্য কোন নিয়মকানুনের কড়াকড়ির নেই। সাথে থাকা ব্যাগটি স্কান করিয়ে সহজেই ঢুকে পরা যায় ভিতরে। দেখতে পারেন সব কিছুই। পার্লামেন্টে দুটি কক্ষ রয়েছে। একটি হলো হাউজ অব রিপ্রেজেনটেটিভ। অপরটি উচ্চ কক্ষ সিনেট। হাউজ অব রিপ্রেজেনটেটিভের চেম্বার সবুজ রংঙ্গের আর সিনেট চেম্বারের রং লাল। হাউজ অব রিপ্রেজেনটেটিভে সদস্য সংখ্য ১৫০ জন আর আপার হাউজে ৭৫ জন সদস্য রয়েছেন। এক একটি স্টেটের জন্য ১২ জন সদস্য কাজ করে থাকেন। প্রধানমন্ত্রী এবং অন্যান্য মন্ত্রীদের অফিস মিনিস্ট্রিয়াল উইং হাউজে।
গাইড জানালো অস্ট্রেলিয়ার শিশুদের রাজনীতিতে আগ্রহী করে তোলার জন্য বিভিন্ন স্টেট থেকে শিক্ষার্থীদের নিয়ে আসা হয় এখানে। এটা তাদের স্কুলের লেখা পড়ার একটি অংশ।
পার্লামেন্ট ভবনে স্পিকার বসেন মাঝখানে উপরের একটি চেয়ারে। তার সামনে রাখা ছোট টেবিলের একটিতে বসেন প্রধানমন্ত্রী। আর অপরটিতে বিরোধীদের নেতা। দোতালার আসনে আমন্ত্রিত দর্শকদের বসার ব্যবস্থা রয়েছে।
আমরা বেশ সময় নিয়ে পার্লামেন্ট ভবনটি ঘুরে ঘুরে দেখে এসে বসলাম বাসে। গাইড আমাদের নিয়ে যাবে অন্যকোন দর্শনীয় গন্তব্যে।