নিউইয়র্ক ১২:৫৬ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

মাইকেল জ্যাকসন : দ্য কিং অফ পপ

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০৮:২১:০০ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬
  • / ১২৫৪ বার পঠিত

ঢাকা: বিস্ময়কর কণ্ঠ, মুগ্ধকর নাচ, উন্মাতাল উন্মাদনা- সব এক করলে যা দাঁড়ায় তার নাম মাইকেল জ্যাকসন। বিশ্ব পপ সঙ্গীতে ভিন্ন ধারা সংযোজন করেছিলেন তিনি। সঙ্গীতের বর্ণিল অধ্যায়ে ছড়িয়েছেন মুঠো মুঠো সোনা। তাকে নিয়ে ছিল ভক্ত-শ্রোতাদের তুমুল আগ্রহ। আজও আছে। মাত্র ৫০ বছর বয়সে বিংশ শতাব্দীর সাড়া জাগানো এ সঙ্গীত তারকা চিরবিদায় নেন। তুমুল জনপ্রিয় মার্কিন এ পপ গায়ক, গীতিকার, নৃত্যশিল্পী, অভিনেতার জীবনকাহিনী নিয়েই বিশেষ প্রতিবেদন।
যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা রাজ্যের গ্যারি শহরে ১৯৫৮ সালের ২৯ আগস্ট আফ্রো-আমেরিকান এক গরিব পরিবারে জন্ম হয় মাইকেল জ্যাকসনের। তার পুরো নাম মাইকেল জোসেফ জ্যাকসন। পরিচিত ছিলেন মাইকেল জ্যাকসন নামে। বিশ্ববাসী তাকে ডাকত ‘কিং অফ পপ’ নামে। বাবা জো জ্যাকসন পেশায় ছিলেন ইস্পাত শ্রমিক। মুষ্টিযোদ্ধাও ছিলেন তিনি। পাশাপাশি স্থানীয় একটি ব্যান্ড দলে গিটার বাজাতেন। মা ক্যাথরিন জ্যাকসন পিয়ানো বাজানোতে সিদ্ধহস্ত ছিলেন। বাড়তি কিছু উপার্জনের জন্য খন্ডকালীন চাকরি করতেন তিনি। ১০ ভাইবোনের মধ্যে অষ্টম ছিলেন মাইকেল জ্যাকসন। অবশ্য তার যমজ দুই ভাই জন্মের কিছুক্ষণ পরই মৃত্যুবরণ করেছিলেন।
মাইকেল পাঁচ ভাই ও তিন বোনের সঙ্গে একটি কৃষ্ণাঙ্গ শ্রমিক এলাকায় বড় হন। এরপরও সাফল্যের শিখরে উঠেছিলেন জ্যাকসন। মাত্র ৫ বছর বয়সে পেশাদার সঙ্গীত শিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। তিনি তখন ‘দ্য জ্যাকসন ফাইভ’ নামে ব্যান্ডের সদস্য হিসেবে গান গাইতেন।
দ্য জ্যাকসন ফাইভ
বাবা জো জ্যাকসন খুব ছোটবেলা থেকেই তার সন্তানদের তারকা হিসেবে তৈরি করতে চেয়েছিলেন। তাই ১৯৬৪ সালে পাঁচ ছেলে- জেরমাইন, জ্যাকি, টিটো, মেরলন ও মাইকেলকে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন ‘দ্য জ্যাকসন ফাইভ’ সঙ্গীত গোষ্ঠী। কনিষ্ঠতম মাইকেলের অসাধারণ সঙ্গীত ও নৃত্য পরিবেশনা দৃষ্টি আকর্ষণ করে অসংখ্য সঙ্গীত রসিকদের। ১৯৬৯ সালে কিংবদন্তি সোল-লেবেল রেকর্ড কোম্পানি ‘মোটাউন’-এর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয় এই গ্রুপ। ‘দ্য জ্যাকসন ফাইভ’ সঙ্গীত গোষ্ঠী পেয়েছিল আন্তর্জাতিক খ্যাতি। মাইকেল ছিলেন এই গোষ্ঠীর প্রধান গায়ক।
একক পথচলা
১৯৭১ সাল থেকে মাইকেল একক শিল্পী হিসেবে গান গাইতে শুরু করেন। ভিন্ন ধরনের নাচ আর গায়কীতে পপ সঙ্গীতে নতুন ধারার সংযোজন হয় তার হাত ধরে। ১৯৮২ সালে মাইকেল জ্যাকসনের প্রথম একক অ্যালবাম ‘থ্রিলার’ বের হয়, যার দশ কোটি ৮০ লাখ কপি বিক্রি হয়। অ্যালবামটির ব্যবসায়িক সাফল্য সঙ্গীত জগতে সৃষ্টি করে এক নতুন রেকর্ড আর মাইকেল জ্যাকসনকে বলা হতে থাকে ‘পপ সম্রাট’। পরবর্তী সময়ে ‘ব্যাড’-এর ৩ কোটি আর ‘ডেঞ্জারাস’-এর দেড় কোটি কপি বিক্রি হয়। ১৯৮০ এর দশক থেকে মাইকেল সঙ্গীতশিল্পীদের মধ্যে জনপ্রিয়তার শীর্ষে অবস্থান করেন। এ সময় ‘বিট ইট’, ‘বিলিজিনি’, ‘থ্রিলার’ গানগুলো বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তার রেকর্ড সৃষ্টি করে। পেয়েছিলেন সঙ্গীত জগতের সবচেয়ে বড় পুরস্কার ‘গ্র্যামি’- তাও আবার ১৩ বার।
জনপ্রিয়তায় সবাইকে ছাড়িয়ে
তিনিই প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ মার্কিন সঙ্গীতশিল্পী যিনি এমটিভিতে বিপুল জনপ্রিয়তা পান। বলা হয়ে থাকে, তার গাওয়া গানের ভিডিওর মাধ্যমেই এমটিভির প্রসার ঘটেছিল। গানের তালে তালে তার নাচের কৌশলগুলোও ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। মাইকেলের জনপ্রিয় নাচের মধ্যে রয়েছে রোবট ও মুনওয়াক। মুনওয়াক হল সামনের দিকে হাঁটার দৃষ্টিভ্রম সৃষ্টি করে পেছনে যাওয়ার ভঙ্গি। এ নাচ তিনি সুনিপুণ অভিনয় করে দেখিয়েছিলেন গানের পাশাপাশি। এমন নাচের জন্য আজও সারা বিশ্বের সব নৃত্যশিল্পী মাইকেল জ্যাকসনকে শ্রদ্ধা জানিয়ে থাকেন।
নতুন মাইকেল
ব্যক্তিজীবনে নানা এক্সপেরিমেন্ট করেছেন তিনি নিজের ওপর। চেহারার প্লাস্টিক সার্জারি করেও আলোচিত-সমালোচিত হয়েছেন। ১৯৭৯ সালে মাইকেল জ্যাকসন তার প্রথম কসমেটিক অপারেশনটি করান। এবং তার পরপরই একটি অ্যাক্সিডেন্টে তার নাক ভেঙে যায়। তিনি ত্বকের সমস্যাতেও ভুগছিলেন। নিজে কৃষ্ণাঙ্গ ত্বকের জন্য গর্বিত হলেও, ক্রমশই তার ত্বক সাদা হতে থাকে। এর পর থেকে প্রায়ই তাকে মুখোশ পরা অবস্থায় দেখা যেত, ছোঁয়াচে রোগে আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে।
১৯৯৩ সালে জ্যাকসনের বিরল চর্মরোগ ভিটিলিগোর কথা জানান তার ত্বক বিশেষজ্ঞ। মাত্র এক থেকে দুই শতাংশ মানুষ এই রোগে ভোগে। এ রোগের কারণে ত্বকের কোষের স্বাভাবিক রঞ্জন প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়।
প্রথম বিয়ে
অনেকের মনে তখন প্রশ্ন জেগেছিল তার বিয়েটা কি ভালোবাসার নাকি শুধুই লোক দেখানো? ১৯৯৪ সালে পপ সম্রাট মাইকেল জ্যাকসন বিয়ে করেন এলভিস প্রিসলির কন্যা লিসা মারি প্রিসলিকে। এ বিয়ে মাত্র ২০ মাস টিকেছিল। তাই এটা কি শুধুই লোক দেখানো নাকি অভিনয়- এমন প্রশ্ন উঠেছিল মিডিয়ায়। এমনকি প্রকাশ্যে তাদের প্রথম চুম্বনটিও নাকি ছিল ম্যানেজারের শিখিয়ে দেয়া। এর উত্তরে লিসা অবশ্য বলেছিলেন, ‘আমি গভীরভাবে মাইকেলের প্রেমে পড়েছিলাম।’
অতঃপর দ্বিতীয় বিয়ে
লিসা মারি প্রিসলির সঙ্গে ডিভোর্সের পর মাইকেল জ্যাকসন তার ডাক্তারের সহকারী ডেবি রোকে বিয়ে করেন। এবং পিতৃত্বের সুখ লাভ করেন। কিন্তু এই দাম্পত্য নাকি ছিল ব্যবসায়িক কারণে। অর্থাৎ মাইকেল জ্যাকসন সন্তানের পিতা হতে চেয়েছিলেন বলেই বিয়ে করা। মাইকেল ছিলেন তিন সন্তানের জনক।
মাইকেলের ওয়ার্ল্ড ট্যুর
দু’বার ‘রক অ্যান্ড রোল’ হল অফ ফেইম নির্বাচিত হওয়া এই মানুষটি ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস অনুসারে সর্বকালের সবচেয়ে সফল শিল্পী। ১৯৯৬-৯৭ সালে মাইকেল জ্যাকসন শেষবারের মতো কনসার্ট করতে ‘ওয়ার্ল্ড ট্যুর’-এ বের হন। ‘হিস্টরি’ অ্যালবামটি নিয়ে ৫৮টি শহরে ৮২টি কনসার্ট করেন। মাতিয়ে রাখেন প্রায় ৪ দশমিক ৫ মিলিয়ন ভক্তকে। সে সময় দারুণ সফল জ্যাকসন ভারতেও আসেন। গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস অনুযায়ী তিনিই ছিলেন সর্বকালের সবচেয়ে সফল শিল্পী।
মানুষের পাশে মাইকেল
দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের জন্য কোটি কোটি ডলার দান করেছেন তিনি। নিজস্ব অর্থায়নে গড়েছিলেন লিউকেমিয়া এবং ক্যান্সার ইন্সটিটিউট। ১৯৯৬ সালে তার আয়ের অর্থ দিয়ে প্রায় ২ লাখ ৭০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়। সমাজসেবায় উদ্বুদ্ধ মাইকেল শিশুদের সাহায্যার্থে প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘হিল দ্য ওয়ার্ল্ড’। তার জীবদ্দশায় প্রায় ৩০ কোটি ডলার দান করেছেন ৩৯টি সাহায্য সংস্থার বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে।
অভিযুক্ত জ্যাকসন
মাইকেল জ্যাকসনের বিরুদ্ধে দু-দু’বার শিশু যৌন হয়রানির অভিযোগ আনা হয়। প্রথম অভিযোগ আনা হয়েছিল ১৯৯৪ সালে। তবে যারা অভিযোগ করেছিল, সেই পরিবারকে এক মিলিয়ন ডলার দেয়াতে জ্যাকসনের বিরুদ্ধে কোনো মামলা হয়নি। ২০০৩ সালে একই অভিযোগ আবারও আসে। কোর্টে নির্দোষ প্রমাণিত হলেও সম্মান ছারখার হয়ে যায়। মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন পপ সম্রাট। যার ছাপ তার জীবনে পড়েছিল গভীরভাবে।
আবারও মঞ্চে
মানসিক টানাপড়েন থাকলেও ২০০৯ সালের মার্চে আবার মঞ্চে ফিরে আসার ঘোষণা দিয়ে ভক্তদের অবাক করে দেন মাইকেল। তিনি আবারও আগের মতো ‘পারফর্ম’ করতে পারবেন কিনা- তা নিয়ে সন্দেহ থাকলেও ‘দিস ইজ ইট’ শোয়ের টিকিট বিক্রি প্রত্যাশাকে ছাড়িয়ে যায়। লন্ডনে প্রথম শো করার কথা ছিল তার। কিন্তু শোয়ের ঠিক ১৮ দিন আগেই সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে তার মৃত্যুসংবাদ। যে খবরে সারা বিশ্ব হতভম্ব হয়ে পড়ে। ২০০৯ সালের ২৫ জুন ‘কিং অফ পপ’ মাইকেল জ্যাকসন তার লাখ লাখ ভক্তকে কাঁদিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
মরণের পরও
মৃত্যুর পর ‘এস্কেপ’-সহ দুটো অ্যালবাম বেরিয়েছে মাইকেল জ্যাকসনের। ফর্বস ম্যাগাজিন অনুযায়ী, মৃত্যুর পরও এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার রোজগার করেছেন তিনি, যা সব জীবিত শিল্পীদের চেয়ে বেশি। এখনও তার রয়েছে অসংখ্য ভক্ত। ‘দ্য কিং অফ পপ’ এভাবেই বেঁচে থাকবেন চিরদিন ভক্তদের অন্তরে। মাইকেলের গাওয়া ৫টি সঙ্গীত অ্যালবাম বিশ্বের সর্বাধিক বিক্রীত রেকর্ডের মধ্যে রয়েছে- অফ দ্য ওয়াল ১৯৭৯, থ্রিলার ১৯৮২, ব্যাড ১৯৮৭, ডেঞ্জারাস ১৯৯১ এবং হিস্টরি ১৯৯৫।
মাইকেল জ্যাকসনের টুকিটাকি
* কৌতুক খুবই পছন্দ করতেন মাইকেল জ্যাকসন। জনপ্রিয় কমেডি সিরিজ ‘দ্য থ্রি স্টুজেস’-এর ভক্ত ছিলেন জ্যাকসন।
* জ্যাকসনের ডাকনাম ছিল ওয়াকো জ্যাকো। কিন্তু নামটি খুবই অপছন্দ করতেন তিনি।
* বিশাল আকৃতির ও ভয়ংকর প্রকৃতির সাপ বোয়া কন্সট্রিক্টর ছিল জ্যাকসনের। তিনি সাপটির নাম রেখেছিলেন মাসলস। এ ছাড়া ক্রাশার নামে একটি অজগর সাপও ছিল তার।
* মাইকেল জ্যাকসন ছিলেন নিরামিষভোজী। শাকসবজি ও ফলমূল খেয়ে থাকতেন তিনি।
* অক্সিজেন চেম্বারে ঘুমাতেন মাইকেল জ্যাকসন। সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু পাওয়ার জন্য তিনি এ পন্থা বেছে নিয়েছিলেন। একবার তিনি দাবি করেছিলেন, অক্সিজেন চেম্বারে ঘুমানোর জন্য অন্তত ১৫০ বছর বাঁচবেন তিনি।
* শিশুদের উপন্যাস ‘দ্য ওয়ান্ডারফুল উইজার্ড অব ওজে’ অবলম্বনে নির্মিত ‘দ্য উইজ’ (১৯৭৮) ছবিতে স্কেয়ারক্রো চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন মাইকেল জ্যাকসন।
* ১৯৮৪ সালে পেপসির একটি বিজ্ঞাপনচিত্রের শুটিং করতে গিয়ে অল্পের জন্য অগ্নিদগ্ধ হননি জ্যাকসন। ওই দুর্ঘটনায় তার মাথার চুল পুড়ে গিয়েছিল। (দৈনিক যুগান্তর)

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

About Author Information

মাইকেল জ্যাকসন : দ্য কিং অফ পপ

প্রকাশের সময় : ০৮:২১:০০ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬

ঢাকা: বিস্ময়কর কণ্ঠ, মুগ্ধকর নাচ, উন্মাতাল উন্মাদনা- সব এক করলে যা দাঁড়ায় তার নাম মাইকেল জ্যাকসন। বিশ্ব পপ সঙ্গীতে ভিন্ন ধারা সংযোজন করেছিলেন তিনি। সঙ্গীতের বর্ণিল অধ্যায়ে ছড়িয়েছেন মুঠো মুঠো সোনা। তাকে নিয়ে ছিল ভক্ত-শ্রোতাদের তুমুল আগ্রহ। আজও আছে। মাত্র ৫০ বছর বয়সে বিংশ শতাব্দীর সাড়া জাগানো এ সঙ্গীত তারকা চিরবিদায় নেন। তুমুল জনপ্রিয় মার্কিন এ পপ গায়ক, গীতিকার, নৃত্যশিল্পী, অভিনেতার জীবনকাহিনী নিয়েই বিশেষ প্রতিবেদন।
যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা রাজ্যের গ্যারি শহরে ১৯৫৮ সালের ২৯ আগস্ট আফ্রো-আমেরিকান এক গরিব পরিবারে জন্ম হয় মাইকেল জ্যাকসনের। তার পুরো নাম মাইকেল জোসেফ জ্যাকসন। পরিচিত ছিলেন মাইকেল জ্যাকসন নামে। বিশ্ববাসী তাকে ডাকত ‘কিং অফ পপ’ নামে। বাবা জো জ্যাকসন পেশায় ছিলেন ইস্পাত শ্রমিক। মুষ্টিযোদ্ধাও ছিলেন তিনি। পাশাপাশি স্থানীয় একটি ব্যান্ড দলে গিটার বাজাতেন। মা ক্যাথরিন জ্যাকসন পিয়ানো বাজানোতে সিদ্ধহস্ত ছিলেন। বাড়তি কিছু উপার্জনের জন্য খন্ডকালীন চাকরি করতেন তিনি। ১০ ভাইবোনের মধ্যে অষ্টম ছিলেন মাইকেল জ্যাকসন। অবশ্য তার যমজ দুই ভাই জন্মের কিছুক্ষণ পরই মৃত্যুবরণ করেছিলেন।
মাইকেল পাঁচ ভাই ও তিন বোনের সঙ্গে একটি কৃষ্ণাঙ্গ শ্রমিক এলাকায় বড় হন। এরপরও সাফল্যের শিখরে উঠেছিলেন জ্যাকসন। মাত্র ৫ বছর বয়সে পেশাদার সঙ্গীত শিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। তিনি তখন ‘দ্য জ্যাকসন ফাইভ’ নামে ব্যান্ডের সদস্য হিসেবে গান গাইতেন।
দ্য জ্যাকসন ফাইভ
বাবা জো জ্যাকসন খুব ছোটবেলা থেকেই তার সন্তানদের তারকা হিসেবে তৈরি করতে চেয়েছিলেন। তাই ১৯৬৪ সালে পাঁচ ছেলে- জেরমাইন, জ্যাকি, টিটো, মেরলন ও মাইকেলকে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন ‘দ্য জ্যাকসন ফাইভ’ সঙ্গীত গোষ্ঠী। কনিষ্ঠতম মাইকেলের অসাধারণ সঙ্গীত ও নৃত্য পরিবেশনা দৃষ্টি আকর্ষণ করে অসংখ্য সঙ্গীত রসিকদের। ১৯৬৯ সালে কিংবদন্তি সোল-লেবেল রেকর্ড কোম্পানি ‘মোটাউন’-এর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয় এই গ্রুপ। ‘দ্য জ্যাকসন ফাইভ’ সঙ্গীত গোষ্ঠী পেয়েছিল আন্তর্জাতিক খ্যাতি। মাইকেল ছিলেন এই গোষ্ঠীর প্রধান গায়ক।
একক পথচলা
১৯৭১ সাল থেকে মাইকেল একক শিল্পী হিসেবে গান গাইতে শুরু করেন। ভিন্ন ধরনের নাচ আর গায়কীতে পপ সঙ্গীতে নতুন ধারার সংযোজন হয় তার হাত ধরে। ১৯৮২ সালে মাইকেল জ্যাকসনের প্রথম একক অ্যালবাম ‘থ্রিলার’ বের হয়, যার দশ কোটি ৮০ লাখ কপি বিক্রি হয়। অ্যালবামটির ব্যবসায়িক সাফল্য সঙ্গীত জগতে সৃষ্টি করে এক নতুন রেকর্ড আর মাইকেল জ্যাকসনকে বলা হতে থাকে ‘পপ সম্রাট’। পরবর্তী সময়ে ‘ব্যাড’-এর ৩ কোটি আর ‘ডেঞ্জারাস’-এর দেড় কোটি কপি বিক্রি হয়। ১৯৮০ এর দশক থেকে মাইকেল সঙ্গীতশিল্পীদের মধ্যে জনপ্রিয়তার শীর্ষে অবস্থান করেন। এ সময় ‘বিট ইট’, ‘বিলিজিনি’, ‘থ্রিলার’ গানগুলো বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তার রেকর্ড সৃষ্টি করে। পেয়েছিলেন সঙ্গীত জগতের সবচেয়ে বড় পুরস্কার ‘গ্র্যামি’- তাও আবার ১৩ বার।
জনপ্রিয়তায় সবাইকে ছাড়িয়ে
তিনিই প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ মার্কিন সঙ্গীতশিল্পী যিনি এমটিভিতে বিপুল জনপ্রিয়তা পান। বলা হয়ে থাকে, তার গাওয়া গানের ভিডিওর মাধ্যমেই এমটিভির প্রসার ঘটেছিল। গানের তালে তালে তার নাচের কৌশলগুলোও ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। মাইকেলের জনপ্রিয় নাচের মধ্যে রয়েছে রোবট ও মুনওয়াক। মুনওয়াক হল সামনের দিকে হাঁটার দৃষ্টিভ্রম সৃষ্টি করে পেছনে যাওয়ার ভঙ্গি। এ নাচ তিনি সুনিপুণ অভিনয় করে দেখিয়েছিলেন গানের পাশাপাশি। এমন নাচের জন্য আজও সারা বিশ্বের সব নৃত্যশিল্পী মাইকেল জ্যাকসনকে শ্রদ্ধা জানিয়ে থাকেন।
নতুন মাইকেল
ব্যক্তিজীবনে নানা এক্সপেরিমেন্ট করেছেন তিনি নিজের ওপর। চেহারার প্লাস্টিক সার্জারি করেও আলোচিত-সমালোচিত হয়েছেন। ১৯৭৯ সালে মাইকেল জ্যাকসন তার প্রথম কসমেটিক অপারেশনটি করান। এবং তার পরপরই একটি অ্যাক্সিডেন্টে তার নাক ভেঙে যায়। তিনি ত্বকের সমস্যাতেও ভুগছিলেন। নিজে কৃষ্ণাঙ্গ ত্বকের জন্য গর্বিত হলেও, ক্রমশই তার ত্বক সাদা হতে থাকে। এর পর থেকে প্রায়ই তাকে মুখোশ পরা অবস্থায় দেখা যেত, ছোঁয়াচে রোগে আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে।
১৯৯৩ সালে জ্যাকসনের বিরল চর্মরোগ ভিটিলিগোর কথা জানান তার ত্বক বিশেষজ্ঞ। মাত্র এক থেকে দুই শতাংশ মানুষ এই রোগে ভোগে। এ রোগের কারণে ত্বকের কোষের স্বাভাবিক রঞ্জন প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়।
প্রথম বিয়ে
অনেকের মনে তখন প্রশ্ন জেগেছিল তার বিয়েটা কি ভালোবাসার নাকি শুধুই লোক দেখানো? ১৯৯৪ সালে পপ সম্রাট মাইকেল জ্যাকসন বিয়ে করেন এলভিস প্রিসলির কন্যা লিসা মারি প্রিসলিকে। এ বিয়ে মাত্র ২০ মাস টিকেছিল। তাই এটা কি শুধুই লোক দেখানো নাকি অভিনয়- এমন প্রশ্ন উঠেছিল মিডিয়ায়। এমনকি প্রকাশ্যে তাদের প্রথম চুম্বনটিও নাকি ছিল ম্যানেজারের শিখিয়ে দেয়া। এর উত্তরে লিসা অবশ্য বলেছিলেন, ‘আমি গভীরভাবে মাইকেলের প্রেমে পড়েছিলাম।’
অতঃপর দ্বিতীয় বিয়ে
লিসা মারি প্রিসলির সঙ্গে ডিভোর্সের পর মাইকেল জ্যাকসন তার ডাক্তারের সহকারী ডেবি রোকে বিয়ে করেন। এবং পিতৃত্বের সুখ লাভ করেন। কিন্তু এই দাম্পত্য নাকি ছিল ব্যবসায়িক কারণে। অর্থাৎ মাইকেল জ্যাকসন সন্তানের পিতা হতে চেয়েছিলেন বলেই বিয়ে করা। মাইকেল ছিলেন তিন সন্তানের জনক।
মাইকেলের ওয়ার্ল্ড ট্যুর
দু’বার ‘রক অ্যান্ড রোল’ হল অফ ফেইম নির্বাচিত হওয়া এই মানুষটি ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস অনুসারে সর্বকালের সবচেয়ে সফল শিল্পী। ১৯৯৬-৯৭ সালে মাইকেল জ্যাকসন শেষবারের মতো কনসার্ট করতে ‘ওয়ার্ল্ড ট্যুর’-এ বের হন। ‘হিস্টরি’ অ্যালবামটি নিয়ে ৫৮টি শহরে ৮২টি কনসার্ট করেন। মাতিয়ে রাখেন প্রায় ৪ দশমিক ৫ মিলিয়ন ভক্তকে। সে সময় দারুণ সফল জ্যাকসন ভারতেও আসেন। গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস অনুযায়ী তিনিই ছিলেন সর্বকালের সবচেয়ে সফল শিল্পী।
মানুষের পাশে মাইকেল
দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের জন্য কোটি কোটি ডলার দান করেছেন তিনি। নিজস্ব অর্থায়নে গড়েছিলেন লিউকেমিয়া এবং ক্যান্সার ইন্সটিটিউট। ১৯৯৬ সালে তার আয়ের অর্থ দিয়ে প্রায় ২ লাখ ৭০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়। সমাজসেবায় উদ্বুদ্ধ মাইকেল শিশুদের সাহায্যার্থে প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘হিল দ্য ওয়ার্ল্ড’। তার জীবদ্দশায় প্রায় ৩০ কোটি ডলার দান করেছেন ৩৯টি সাহায্য সংস্থার বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে।
অভিযুক্ত জ্যাকসন
মাইকেল জ্যাকসনের বিরুদ্ধে দু-দু’বার শিশু যৌন হয়রানির অভিযোগ আনা হয়। প্রথম অভিযোগ আনা হয়েছিল ১৯৯৪ সালে। তবে যারা অভিযোগ করেছিল, সেই পরিবারকে এক মিলিয়ন ডলার দেয়াতে জ্যাকসনের বিরুদ্ধে কোনো মামলা হয়নি। ২০০৩ সালে একই অভিযোগ আবারও আসে। কোর্টে নির্দোষ প্রমাণিত হলেও সম্মান ছারখার হয়ে যায়। মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন পপ সম্রাট। যার ছাপ তার জীবনে পড়েছিল গভীরভাবে।
আবারও মঞ্চে
মানসিক টানাপড়েন থাকলেও ২০০৯ সালের মার্চে আবার মঞ্চে ফিরে আসার ঘোষণা দিয়ে ভক্তদের অবাক করে দেন মাইকেল। তিনি আবারও আগের মতো ‘পারফর্ম’ করতে পারবেন কিনা- তা নিয়ে সন্দেহ থাকলেও ‘দিস ইজ ইট’ শোয়ের টিকিট বিক্রি প্রত্যাশাকে ছাড়িয়ে যায়। লন্ডনে প্রথম শো করার কথা ছিল তার। কিন্তু শোয়ের ঠিক ১৮ দিন আগেই সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে তার মৃত্যুসংবাদ। যে খবরে সারা বিশ্ব হতভম্ব হয়ে পড়ে। ২০০৯ সালের ২৫ জুন ‘কিং অফ পপ’ মাইকেল জ্যাকসন তার লাখ লাখ ভক্তকে কাঁদিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
মরণের পরও
মৃত্যুর পর ‘এস্কেপ’-সহ দুটো অ্যালবাম বেরিয়েছে মাইকেল জ্যাকসনের। ফর্বস ম্যাগাজিন অনুযায়ী, মৃত্যুর পরও এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার রোজগার করেছেন তিনি, যা সব জীবিত শিল্পীদের চেয়ে বেশি। এখনও তার রয়েছে অসংখ্য ভক্ত। ‘দ্য কিং অফ পপ’ এভাবেই বেঁচে থাকবেন চিরদিন ভক্তদের অন্তরে। মাইকেলের গাওয়া ৫টি সঙ্গীত অ্যালবাম বিশ্বের সর্বাধিক বিক্রীত রেকর্ডের মধ্যে রয়েছে- অফ দ্য ওয়াল ১৯৭৯, থ্রিলার ১৯৮২, ব্যাড ১৯৮৭, ডেঞ্জারাস ১৯৯১ এবং হিস্টরি ১৯৯৫।
মাইকেল জ্যাকসনের টুকিটাকি
* কৌতুক খুবই পছন্দ করতেন মাইকেল জ্যাকসন। জনপ্রিয় কমেডি সিরিজ ‘দ্য থ্রি স্টুজেস’-এর ভক্ত ছিলেন জ্যাকসন।
* জ্যাকসনের ডাকনাম ছিল ওয়াকো জ্যাকো। কিন্তু নামটি খুবই অপছন্দ করতেন তিনি।
* বিশাল আকৃতির ও ভয়ংকর প্রকৃতির সাপ বোয়া কন্সট্রিক্টর ছিল জ্যাকসনের। তিনি সাপটির নাম রেখেছিলেন মাসলস। এ ছাড়া ক্রাশার নামে একটি অজগর সাপও ছিল তার।
* মাইকেল জ্যাকসন ছিলেন নিরামিষভোজী। শাকসবজি ও ফলমূল খেয়ে থাকতেন তিনি।
* অক্সিজেন চেম্বারে ঘুমাতেন মাইকেল জ্যাকসন। সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু পাওয়ার জন্য তিনি এ পন্থা বেছে নিয়েছিলেন। একবার তিনি দাবি করেছিলেন, অক্সিজেন চেম্বারে ঘুমানোর জন্য অন্তত ১৫০ বছর বাঁচবেন তিনি।
* শিশুদের উপন্যাস ‘দ্য ওয়ান্ডারফুল উইজার্ড অব ওজে’ অবলম্বনে নির্মিত ‘দ্য উইজ’ (১৯৭৮) ছবিতে স্কেয়ারক্রো চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন মাইকেল জ্যাকসন।
* ১৯৮৪ সালে পেপসির একটি বিজ্ঞাপনচিত্রের শুটিং করতে গিয়ে অল্পের জন্য অগ্নিদগ্ধ হননি জ্যাকসন। ওই দুর্ঘটনায় তার মাথার চুল পুড়ে গিয়েছিল। (দৈনিক যুগান্তর)