জয়ার প্রশ্ন : আমাদের দয়ামায়া কি সব কর্পূরের মতো উরে গেল?
- প্রকাশের সময় : ০২:৩৮:৪৭ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৪ মে ২০২৩
- / ৪৫ বার পঠিত
বিনোদন ডেস্ক : অভিনেত্রী পরিচয়ের বাইরে জয়া আহসানকে আলাদা করা যায় একজন প্রাণীপ্রেমী হিসেবে। নিজের বাসায় তো বটে, বাইরেও তিনি বিভিন্ন প্রাণীর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করেন। প্রাণীপ্রেমের জন্য পেয়েছেন সম্মাননাও। সেই জয়া যখন খবর পেলেন, রাজধানীতে দিনেদুপুরে আস্ত একটি হস্তীশাবক ট্রেনের ধাক্কায় নির্মমভাবে মারা গেছে, তখন তার হৃদয়ে বিষাদের বজ্রপাত হয়েছে। সপ্তাহ পেরিয়ে সেই ক্ষত এখনও তাকে পোড়াচ্ছে, ভাবাচ্ছে।
ঘটনা পরিষ্কার করা যাক। গত ১৭ মে দুপুরে রাজধানীর উত্তরার কোর্টবাড়ি এলাকায় চট্টলা এক্সপ্রেসের ধাক্কায় একটি হস্তীশাবক মারা যায়। ওই সময় হস্তীশাবকের সঙ্গে মা হাতিও ছিল। যার পিঠে বসে ছিলেন মাহুত। ট্রেনের হুইসেল শুনে মা হাতিকে আটকে রাখতে পারলেও শাবককে আটকে রাখতে পারেননি তিনি। অবলা শাবক রেললাইনে ছুটতে থাকে, আর ট্রেনের ধাক্কায় প্রাণ হারায়। এ ঘটনার পর অনেক শিল্পী সোশ্যাল হ্যান্ডেলে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। একাধিক সংগঠন মানবন্ধনও করেছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তেমন কোনও পদক্ষেপের খবর এখনও পাওয়া যায়নি।
বিষণ্ণ মনে বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ জানালেন জয়া আহসান। কেননা রক্তাক্ত সেই হস্তীশাবকের নিথর অবস্থার ছবি এখনও তার চোখে-মনে ভাসছে। দুই বাংলাজয়ী এ অভিনেত্রী বললেন, ‘এক সপ্তাহ পার হয়ে গেল, কিন্তু উত্তরায় বেঘোরে মারা পড়া হাতির বাচ্চাটার কথা মন থেকে কোনওভাবেই সরিয়ে দিতে পারছি না। সেই কিশোরীবেলা থেকে হাতি আমার মনোরম কল্পনার প্রাণী। শুধু আমার কেন, হাতির ছানাকে কে ভালোবেসে বড় হয়নি ? কোনও প্রাণীকে দেখে আমরা ভয় পাই, কোনও প্রাণীর সৌন্দর্যে বিস্মিত হয়ে থাকি। কিন্তু হাতি ? হাতি তো সব সময়েই আমাদের প্রাণী। হাতির ছানা তো আরও। রূপকথায়, মেঘের আকারে, অ্যানিমেশনে বন্ধু হিসেবে হাতিকে মনের রঙিন কল্পনায় মধ্যে জায়গা দিতে দিতে আমরা বড় হয়েছি। এমন একটি আদুরে হাতির ছানা কী মর্মান্তিকভাবেই না মারা পড়ল গত ১৭ মে।’
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে জয়া বলেছেন, ‘উত্তরায় রেললাইনের পাশে মা হাতির সঙ্গে ছানাটিও কলাগাছ খাচ্ছিল। এমন সময় ট্রেন এসে পড়ে। ট্রেনের চালক কাওছার হোসেন বলেছেন, একশ মিটার দূরে থাকতে হাতিটি তাদের নজরে আসে। তখন তারা হুইসিল বাজিয়ে ট্রেন থামানোর চেষ্টা করেন। ট্রেন থামতে দুইশ থেকে তিনশ মিটার জায়গা লাগে। ফলে দুর্ঘটনাটি এড়ানো যায়নি। হুইসিলের শব্দে হাতির শাবকটি ভয় পেয়ে দৌড় দিতে শুরু করে। কিন্তু যন্ত্রসভ্যতার আইনকানুন বেচারা জানবে কোত্থেকে ? সে দৌড়াতে শুরু করে রেললাইনেরই ওপর দিয়ে। ট্রেন ওর ওপরে এসে পড়ে। ওকে হিঁচড়ে নিয়ে যায় বহুদূর পর্যন্ত। শহরে অচেনা এই আগন্তুক লাশ হয়ে যায়।’
ট্রেনচালকের সঙ্গে সুর মিলিয়ে জয়ার বলেন, “ট্রেনচালক কাওছার হোসেন প্রশ্ন করেছেন, ‘বন্য প্রাণী কেন রেললাইনে থাকবে? হাতির তো লোকালয়ে আসারই কথা নয়।’ এটা আমাদেরও প্রশ্ন। যার ঘুরে বেড়ানোর কথা অরণ্যের সবুজে, ওর আপন পৃথিবীতে, সে কেন ওর অচেনা লোকালয়ে আসবে? আইইউসিএন (প্রকৃতি সংরক্ষণের আন্তর্জাতিক সংস্থা) বলছে, এশিয়ান হাতি তাদের লাল তালিকায় থাকা মহাবিপদাপন্ন প্রাণী। যত্ন না নিলে ম্যামথের মতো এক দিন হারিয়ে যাবে তারা। হাতি টিকে থাকবে শুধু গল্পগাঁথার অস্পষ্ট স্মৃতির ভেতরে। তেমন পৃথিবীই কি আমরা চাই ?’ বন্যপ্রাণী হলেও হাতিকে লোকালয়ে দেখা যায়। এর পেছনে রয়েছে ২০১২ সালের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইনের ২ উপধারা। সেখানে বলা হয়েছে, সনদ নিয়ে হাতি লালন–পালন করা যাবে। তবে সনদ নেওয়ার আগে নিশ্চিত হতে হবে, পালনকারীর হাতি পালন করার মতো পর্যাপ্ত জ্ঞানগম্যি এবং হাতির বেঁচে থাকার মতো পুরো সুযোগ–সুবিধা দেওয়ার সক্ষমতা আছে।
আরোও পড়ুন। সানাইয়ের বিচ্ছেদের ইঙ্গিত
এ প্রসঙ্গেই জয়ার প্রশ্ন, ‘সনদ দেওয়ার পরে কী হবে ? এই যে হাতি হাতবদল হয়ে যাচ্ছে, শারীরিক যন্ত্রণা দিয়ে ওদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে, চাঁদা তোলার কাজে শহরের প্রতিকূল রাজপথে চরিয়ে বেড়ানো হচ্ছে, সেটা কে দেখবে? এসব দৃশ্য তো আমরা চলতে–ফিরতে হরহামেশা দেখতে পাচ্ছি। দায়িত্বে যারা আছেন, তাদের কি মোটেই চোখে পড়ছে না? তারা কি ঠিকমতো সনদ দিচ্ছেন? সনদ দেওয়ার পর কি আদৌ খোঁজ করে দেখছেন, নিয়ম পালিত হচ্ছে কিনা? হচ্ছে যে না, পথে পথে আমাদের নিজ চোখে দেখা অভিজ্ঞতাই তার প্রমাণ। আমাদের গাফিলতিই অবশেষে এই হাতির মৃত্যুর কারণ হলো। দুর্ঘটনা একটা ছুতো মাত্র।’
ওই আইনটি বাতিলের দাবি জানিয়ে জয়া বললেন, ‘বন্যপ্রাণীদের নিয়ে পৃথিবীজুড়ে ভাবনা বদলে যাচ্ছে। আমরা কি একগুঁয়ের মতো পৃথিবীর বাইরে থাকতে চাই ? মহাবিপদাপন্ন একটি প্রাণীকে কোনওভাবেই আমরা তাদের নিজস্ব পরিবেশের বাইরে এনে আটকে রাখতে পারি না। তাই এই আইনটি এখন বাতিল করার সময় এসেছে। এ ব্যাপারে আওয়াজ তোলার জন্য আমি দেশের প্রাণীবিদদের, প্রাণী অধিকারকর্মী আর সব সংবেদনশীল মানুষকে অনুরোধ করছি।’
সবশেষে জয়ার মন্তব্য, ‘মাঝেমধ্যেই আমরা হাতি আর মানুষের সংঘর্ষের কথা শুনছি। এর জের পড়ছে দুই দিকেই। মানুষও ক্ষতির শিকার হচ্ছে, মারা পড়ছে হাতিও। অথচ এর মূল দায় তো আমাদেরই। আমরা বন উজাড় করছি। হাতির বুনো চলাচলের পথ বন্ধ করে আবাস করছি। হাতির বেঁচে থাকার কোনও জায়গাই অবশিষ্ট রাখছি না। পৃথিবীর বিচিত্র প্রাণসত্তার রঙিন সৌন্দর্য টিকে থাকবে কিনা, সেটা নির্ভর করছে আমাদের দয়ার ওপর। আমাদের দয়ামায়া কি সব কর্পুরের মতো উবে গেল?’ প্রসঙ্গত, ২০২০ সালে করোনা মহামারির সময়ে যখন লকডাউন চলছিল, তখন নিজ বাসায় রান্না করে সেই খাবার রাস্তায় ঘুরে ঘুরে কুকুরদের খাইয়েছেন জয়া আহসান। তার সেই প্রাণবিক ভূমিকা সবার প্রশংসা পেয়েছিল। ২০২১ সালের অক্টোবরে প্রাণীদের নিয়ে কাজ করা সংগঠন ‘দ্য পিপল ফর অ্যানিমেল ওয়েলফেয়ার’ (পাও) থেকে ‘প্রাণবিক বন্ধু’ সম্মাননা পেয়েছিলেন এ অভিনেত্রী। সূত্র : বাংলা ট্রিবিউন
সুমি/হককথা