সংঘাত নয় চাই শান্তির রাজনীতি
- প্রকাশের সময় : ০২:২৬:০৮ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৬ অক্টোবর ২০১৮
- / ৫৩৫ বার পঠিত
কাফি কামাল: ষাট-সত্তর দশকের কিংবদন্তি ছাত্রনেতা ও পরিবেশবাদী আতিকুর রহমান সালু। কবি, লেখক ও সমাজকর্মী। বাংলাদেশ বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক এ সভাপতি বর্তমানে আন্তর্জাতিক ফারাক্কা কমিটি, নিউইয়র্ক ইনক-এর চেয়ারম্যান। ঢাকার রাজপথ কাঁপানো সাবেক এই ছাত্রনেতা এক সময় রাজনীতির মাঠ ছেড়ে পাড়ি জমান সুদূর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। তিন দশকের প্রবাসজীবন শেষে ফিরে এসেছেন মাতৃভূমি বাংলাদেশে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ছাত্রনেতা হিসেবে আন্দোলন-সংগ্রাম, আর মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে রাষ্ট্রের জন্মে ভূমিকা রেখেছিলেন সেই স্বাধীন বাংলাদেশেই কাটাতে চান জীবনের বাকিটা সময়। সংগ্রামমুখর রাজপথে বেড়ে উঠা আতিকুর রহমান সালু আবারও ফিরতে চান রাজনীতির ময়দানে। সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি হলে জনপ্রতিনিধি হতে অংশ নিতে চান ভোটের লড়াইয়ে।
দৈনিক মানবজমিনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি তুলে ধরেছেন তার ছাত্রজীবনের উজ্জ্বল রাজনৈতিক পর্ব, প্রবাসজীবনে অভিন্ন নদীর জলপ্রবাহের ন্যায্য হিস্যা আদায় আন্দোলন এবং আগামী দিনের স্বপ্নের কথা।
টাঙ্গাইলের এক রাজনৈতিক পরিবারে আতিকুর রহমান সালুর জন্ম। অবিভক্ত বৃটিশ ভারতের শাসনতান্ত্রিক পরিষদের সদস্য ছিলেন তার পিতা নূরুর রহমান খান ইউসুফজাই। রাজনীতিতে হাতেখড়ি প্রগতিশীল ছাত্ররাজনীতির মাধ্যমে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অবিভক্ত ছাত্র ইউনিয়নের টাঙ্গাইল মহকুমার স্থানীয় পর্যায়ের একজন নেতা ছিলেন তিনি। পরবর্তীতে ছাত্র ইউনিয়নের (এপসু) কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হন। ছাত্র ইউনিয়ন দুইগ্রুপে বিভক্ত হওয়ার পর তিনি কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হন মেনন গ্রুপের। মোস্তফা জামাল হায়দার ও ড. মাহবুব উল্লাহ সে কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের পর হিড়িক পড়েছিল ছাত্র সংগঠনগুলোর নাম পরিবর্তনের। তখন ছাত্র ইউনিয়ন মেনন গ্রুপের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়- ‘বাংলাদেশ বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন’। আতিকুর রহমান সালু পরবর্তীকালে সে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন।
ষাটের দশকের ছাত্র আন্দোলনের গৌরবোজ্জ্বল সময়ের স্মৃতিচারণ করে আতিকুর রহমান সালু বলেন- ‘ষাটের দশকের প্রথমদিকে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন একসঙ্গে আন্দোলন করেন শরিফ শিক্ষা কমিশন ও আইয়ুবশাহী বিরোধী আন্দোলনসহ ছাত্রদের অধিকার ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য। উত্তাল সে সময়ে ৬ দফা, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ১৯৬৮ সালে মওলানা ভাসানীর হাট হরতাল, বন্দি শেখ মুজিবর রহমানের মুক্তি দাবি এবং দেশের দক্ষিণাঞ্চলে ১৯৭০ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে ১৫ লাখ আদম সন্তানের মৃত্যু এবং ক্ষতিগ্রস্তদের ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকারের অবহেলাকে কেন্দ্র করে তুমুল আন্দোলনের দিনগুলোতে মিছিলের অগ্রভাগে থেকেছি। ১১ দফা আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের সভাগুলোতে ছাত্র ইউনিয়নের হয়ে বিভিন্ন সময়ে প্রতিনিধিত্ব করেছি।
ইয়াহিয়া আমলে ১৯৭০ সালের ২২ ফেব্রুয়ারী ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে লাখো লোকের জনসভায় আয়োজন করেছিল ছাত্র ইউনিয়ন। সেদিন ছাত্র সমাজের পক্ষ থেকে প্রথম স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ববাংলা কায়েমের প্রস্তাব ও কর্মসূচি উত্থাপন করা হয়েছিল। ছাত্র ইউনিয়নের সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে সেদিন প্রস্তাবটি উত্থাপনের বিরল সুযোগটি পেয়েছিলাম।’ তিনি জানান, ছাত্র ইউনিয়নের তৎকালীন সভাপতি মোস্তফা জামাল হায়দারের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক ড. মাহবুব উল্লাহর পরিচালনায় সমাবেশে বক্তব্য দিয়েছিলেন তৎকালীন প্রখ্যাত প্রমিক নেতা কাজী জাফর আহমেদ ও সাবেক ডাকসু ভিপি রাশেদ খান মেনন। সে ঘটনায় ইয়াহিয়ার সামরিক সরকার কাজী জাফর ও রাশেদ খান মেননকে ৭ বছর করে, মোস্তফা জামাল হায়দার ও মাহবুব উল্লাহকে ১ বছর করে সশ্রম কারাদন্ড দিয়েছিল। আমার নামেও ওয়ারেন্ট জারি হয়েছিল।
আইয়ুব খানের সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে আতিকুর রহমান সালু জননিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তারের পর কারাভোগ করেছেন দীর্ঘ সময়। সে সময় ঢাকা ও ময়মনসিংহ কেন্দ্রীয় কারাগারে তার জেলসঙ্গীদের মধ্যে ছিলেন- প্রয়াত কাজী জাফর আহমেদ, প্রয়াত আবদুর রাজ্জাক, রাশেদ খান মেনন, পংকজ ভট্টাচার্য, সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক, আসমত আলী সিকদার, শহীদুল হক মুন্সী, ফেরদৌস আহমেদ কোরেশী, হায়দার আকবর খান রনো, আইয়ুব রেজা চৌধুরী, বদিউজ্জামান বড় লস্কর, এস এম রেজা, আল মুজাহিদী, আবদুল লতিফ সিদ্দিকী, শেখ ফজলুল করিম মিঠু ও ফজলুর রহমান ফারুক প্রমুখ কিংবদন্তির নেতারা।
মুক্তিযুদ্ধকে জীবনের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় হিসেবে বিবেচনা করেন তৎকালীন শীর্ষস্থানীয় ছাত্রনেতা আতিকুর রহমান সালু। বলেন, ‘আমাকে যদি প্রশ্ন করা হয়- জীবনে সবচেয়ে গর্বের বিষয় কি? আমি বলবো ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং সুমহান মুক্তিযুদ্ধ। যে যুদ্ধ সংঘটিত করার কাজে অংশ নিতে পেরে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমি গর্ববোধ করি।’ মুক্তিযুদ্ধের পর মওলানা ভাসানীর ভক্ত-অনুরক্ত হিসেবে তার রাজনৈতিক নীতি ও আদর্শ অনুসরণ ও ১৯৭৬ সালে তার নেতৃত্বে ফারাক্কামুখী যে ঐতিহাসিক লংমার্চ হয়েছিল সেখানেও সংগঠক হিসেবে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন সালু।
আতিকুর রহমান সালু
আশির দশকের প্রথমদিকে শুরু হয় আতিকুর রহমান সালুর প্রবাসজীবন। যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে তিনি যুক্ত হন শিক্ষকতা পেশায়। কিন্তু রক্তে যার রাজনীতির নেশা টগবগ করে তিনি তো চুপচাপ বসে থাকতে পারেন না। সমমনাদের নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গড়ে তোলেন পরিবেশবাদী সংগঠন। বাংলাদেশের অভিন্ন নদীর পানির অধিকার ও পরিবেশ নিয়ে জনমত গঠনসহ বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন শুরু করেন যুক্তরাষ্ট্রে। তিনি বর্তমানে আন্তর্জাতিক ফারাক্কা কমিটি, নিউইয়র্ক ইনক-এর চেয়ারম্যান। দলমতের ঊর্ধ্বে পরিবেশবাদী এ সংগঠনে বিভিন্ন মতপথের লোকজন যুক্ত রয়েছেন। এ সংগঠনের মাধ্যমে কয়েক দশক ধরে দেশে-বিদেশে সেমিনার, মতবিনিময়, সভা-সমাবেশের মাধ্যমে বাংলাদেশের নদীর পানির অধিকার ও পরিবেশ নিয়ে সাংগঠনিক তৎপরতা, প্রচার-প্রচারণা ও আন্দোলনে সক্রিয় রয়েছেন। ফারাক্কা অভিমুখী ঐতিহাসিক লংমার্চের অনুপ্রেরণায় উজানের পানিতে ন্যায্য হিস্যার দাবিতে ২০০৫ সালের ৪ মার্চ ৫ লক্ষাধিক লোকের সমাবেশ আয়োজন করেছিলেন কুড়িগ্রামের চিলমারীতে ব্রহ্মপুত্র নদ-এর চরে। সালু বলেন- ‘আমার সৌভাগ্য যে, আমি মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর অত্যন্ত স্নেহধন্য ছিলাম।
১৯৭০ সালে আমার আব্বার ইন্তেকালের কথা শুনে জানাজায় উপস্থিত হয়েছিলেন তিনি। আমি মওলানা ভাসানীর একনিষ্ঠ ভক্ত।’ দেশের বড় রাজনৈতিক দল ও জোটগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়ে আতিকুর রহমান সালু বলেন, ‘এই মুহূর্তে নির্বাচনমুখী রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আমাদের আহ্বান হচ্ছে- আপনাদের নির্বাচনী ম্যানিফেস্টোতে নদী ও পানির অধিকারের বিষয়টি জোরালোভাবে উল্লেখ করুন। এই ক্ষেত্রে আঞ্চলিক সহযোগিতা ও সার্কের চেতনায় আমার উজানের নদ-নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা নিয়ে যে সমস্যা তা আলোচনার মাধ্যমে নিষ্পত্তি হবে বলে এখনো বিশ্বাস করি।’
জীবন-যৌবনের সোনালী দিনগুলো ব্যয় করেছেন সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্নে রাজপথে। ব্যক্তিগতভাবে না হলেও পূরণ হয়েছে তার যৌবনের সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের স্বপ্ন। একদা যে স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখতেন সেই দেশের গর্বিত নাগরিক তিনি। কিন্তু স্বাধীন দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়ে তার মন বেদনাভারাক্রান্ত। আতিকুর রহমান সালু বলেন- ‘বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আমার মন অত্যন্ত বেদনা ভারাক্রান্ত। হানাহানি-মারামারি, হিংসা-প্রতিহিংসার এই ধরনের রাজনীতি স্বাধীন দেশে কাম্য ছিল না। স্বাধীন দেশের মানুষ স্বাধীনভাবে বুক ফুলিয়ে চলবে এটাই ছিল আমাদের স্বপ্ন।’ দেশের প্রচলিত রাজনৈতিক পরিবেশের পরিবর্তন দেখতে চান তিনি।
হিংসার বিপরীতে ভালোবাসার রাজনীতি দেখার স্বপ্ন ও প্রত্যাশা ব্যক্ত করে আতিকুর রহমান সালু বলেন- ‘বর্তমান রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে আমার বক্তব্য- সংঘাত নয়, চাই শান্তির রাজনীতি। হিংসার বিপরীতে চাই মানুষকে ভালোবাসার রাজনীতি। চাই সহমর্মিতার রাজনীতি। ভালোবাসা ছাড়া রাজনীতি বাঁচবে না। রাজনীতি সম্পর্কে আমার ধ্যান-ধারণা হচ্ছে-সাংস্কৃতিক রুচিবোধ ছাড়া ভালো রাজনীতিক হওয়া যায় না। আর স্বাধীনতা সংগ্রামে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যার যার অবদান। মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শহীদ জিয়াউর রহমান- যার যার অঙ্গনে প্রত্যেকেই এক একটি উদিত সূর্যের মতো। তাদের নিয়ে কোনো ধরনের বিতর্ক সমীচীন নয়।’ তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন রাজনীতিতে হিংসা-বিদ্বেষ না থাকলে এতদিনে ‘আমেরিকা’কে ছাড়িয়ে যেতো বাংলাদেশ।
ছাত্র রাজনীতিতে শীর্ষপদে নেতৃত্ব দিয়েছেন একটি আদর্শবাদী সংগঠনের। কিন্তু ভোটের রাজনীতি করা হয়নি। ছাত্র রাজনীতিতে তার শিষ্য-অনুসারীরা যখন এমপি-মন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন তখন তিনি বাংলাদেশের অধিকার ও স্বার্থের প্রশ্নে সরব ছিলেন বিদেশ-বিভূঁইয়ে। আতিকুর রহমান সালু বলেন, ‘সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি হলে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণের চিন্তা আছে। আর সুষ্ঠু নির্বাচন হলেই কেবল দেশ বাঁচবে। সুষ্ঠু নির্বাচন ছাড়া দেশের টেকসই উন্নয়ন-অগ্রগতি ও গণতন্ত্রকে সুপ্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব নয়।’
ছাত্র রাজনীতি শেষে আতিকুর রহমান সালু এক সময় জড়িয়েছিলেন সাংবাদিকতা পেশায়। প্রবাসে দীর্ঘদিন শিক্ষকতা শেষে বর্তমানে যাপন করছেন অবসর জীবন। তার সহধর্মিণী শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রে। আতিকুর রহমান সালু দুই মেয়ে ও এক ছেলের গর্বিত পিতা। তার একমাত্র ছেলে আমেরিকা ও বড় মেয়ে অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী। ছোট মেয়ে একটি সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রে। আতিকুর রহমান সালু রাজনীতির পাশাপাশি সাহিত্যচর্চা করেন।