এইচ বি রিতা: আমেরিকান সমাজের সর্বত্র বর্ণবাদ বিরাজমান। পদ্ধতিগত বর্ণবাদ যুক্তরাষ্ট্রের সামাজিক অর্থনৈতিক ক্ষেত্রকেও প্রভাবিত করে রেখেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সাম্প্রতিক সময়ে জেগে উঠা নাগরিক আন্দোলনে বিষয়টি আবার সামনে চলে এসেছে। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস পদ্ধতিগত বর্ণবাদ অবসানের জন্য নানা প্রয়াসের কথা বলছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের আবাসন খাতে এমন বর্ণবাদের গভীরতা নিয়ে সংবাদ মাধ্যম এনপিআর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আবাসন বৈষম্যে আমেরিকান সমাজে একটি গভীর অসম আবাসন অভিজ্ঞতার সৃষ্টি করেছে। এ বৈষম্যগুলো মোকাবেলায় আমাদের সাশ্রয়ী মূল্যের আবাসনের পরিমাণ বৃদ্ধি করার পাশাপাশি, কৃষ্ণাঙ্গ এবং বাদামী চামড়ার ক্রেতাদের জন্য গৃহ ঋণের সুবিধা সম্প্রসারিত করা জরুরী বলে মনে করা হচ্ছে। আবাসন আইনগুলির সম্প্রসারণ ও আরও কার্যকর করার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করাও দরকার বলে বিশ্লেষকরা বলছেন।
আমেরিকায় ‘বø্যাক এন্ড হোয়াইট’ বাড়ির মালিকানার ব্যবধানটি আজও বিস্তৃত রয়েছে যতটা বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ছিল। প্রায় ৪৪ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গ পরিবারের তুলনায় প্রায় ৭৫ শতাংশ শ্বেতাঙ্গ পরিবার তাদের বাড়ির মালিকানাধীনে রয়েছেন। যদিও কৃষ্ণাঙ্গদের বাড়ির মালিকানার হার সাম্প্রতিক সময়ে বৃদ্ধি পেয়েছে, বিশেষত কৃষ্ণাঙ্গ এবং ল্যাটিনোদের মধ্যে বাড়ির মালিকানা বৃদ্ধিকে আমেরিকান সমাজে একটা ইতিবাচক দিক হিসেবে দেখা হচ্ছে। ল্যাটিনো এবং কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে এখন ৪৯ শতাংশ লোকজন বাড়ির মালিকানার আওতায়।
যদিও ২০২০ সালের মধ্যে এই পরিবারগুলোর অর্ধেকেরও বেশি গৃহ-মালিকানা অর্জন করেছে। যা কয়েক দশক ধরে সিস্টেমিক বর্ণবাদবিরোধী লড়াইয়ের পরে অর্জন করা সম্ভব হয়েছে বলে সংবাদ বিশ্লেষণে বলা হয়েছে।
ষাটের দশকে, যখন ব্যক্তিগত জাতি ভিত্তিক বৈষম্য আইন ছিল, তখন কৃষ্ণাঙ্গ বাড়ির মালিকানার হার সর্বনিম্ন পর্যায়ে ছিল। নব্বই এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে, কৃষ্ণাঙ্গদের গৃহঋণ আবেদনকারীদের অস্বীকৃত হওয়ার হার ছিল শ্বেতাঙ্গদের থেকে প্রায় দ্বিগুণ।
কৃষ্ণাঙ্গদের বাড়ির মালিকানা ইতিমধ্যে ২০১৯ এর দ্বিতীয় প্রান্তিকে ৪০ দশমিক ৬ শতাংশ নীচে নেমে এসেছিল। যদিও এই সংখ্যাটি ২০২০ এর দ্বিতীয় প্রান্তিকে ৪৭ শতাংশে পৌঁছেছে। ইউএস সেন্সাস ব্যুরো থেকে প্রাপ্ত তথ্য দেখায় যে, কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানরা এখনও অন্যান্য জাতিগতগোষ্ঠীর তুলনায় বাড়ির মালিকানায় সর্বনিম্ন হারে আছে। যেমন-সাদা আমেরিকানদের বাড়ির মালিকানার হার ৭৬ শতাংশ, হিস্পানিক আমেরিকানদের বাড়ির মালিকানা হার ৫১.৪ শতাংশ এবং এশিয়ান, নেটিভ হাওয়াইয়ান এবং প্যাসিফিক দ্বীপপুঞ্জের লোকজনের বাড়ি মালিকনার হার ৬১.৪ শতাংশ।
গত দুই দশকে পরিস্থিতিটি কেবল উন্নতি করতেই যে ব্যর্থ হয়েছে তা নয়, বরং আরও খারাপ হয়েছে। এই শূন্যতার প্রভাব অশ্বেতাঙ্গ আমেরিকানদের আর্থিক সম্পদ এবং স্বাস্থ্যসেবা উভয়ের জন্যই বিধ্বংসী পরিণতি ঘটেছে বলে মনে করা হচ্ছে।
একটি বাড়ির মালিকানা আমেরিকান স্বপ্নের একটি অংশ। বাড়ির মালিকানাকে সর্বদাই স্থিতিশীল একটি শক্তি হিসেবে দেখা হয়। বাড়ির মালিকদের মোট সম্পদের প্রায় অর্ধেকই আবাসনের পেছনে ব্যয় করা হয়ে থাকে। কৃষ্ণাঙ্গ এবং হিস্পানিক বাড়ির মালিকদের জন্য উপার্জনের মোটা অংশই আবাসনের পেছনে ব্যয় হয়ে থাকে। এটি এমন একটি সম্পদ, যা পরবর্তি প্রজন্মের কাছে হস্তান্তরিত হয়। ফলে বাড়ির মালিক পরিবারগুলোর পরবর্তি প্রজন্ম একটি ভিত্তির উপর তাদের জীবন শুরু করতে পারে।
আমেরিকায় বাড়ি ভাড়ার ক্ষেত্রেও বৈষম্য ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। কৃষ্ণাঙ্গ এবং ল্যাটিনোদের কাছ থেকে আবেদন ফি এবং সুরক্ষা আমানত বেশী আদায় করা হয়ে থাকে। এমন সব শর্ত দেয়া হয়, যাতে আমানত ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনাও কম থাকে।
ন্যাশনাল ব্যুরো অফ ইকোনমিক রিসার্চের তথ্য অনুসারে, ২০০৪ থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে হিস্পানিক আমেরিকান এবং কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানদের যথাক্রমে ৭৮ শতাংশ এবং ১০৫ শতাংশ হোয়াইট আমেরিকানদের চেয়ে অতিরিক্ত ব্যাংক ঋণ ছিল। এর ফলে ২০০৭ থেকে ২০১০ সালে কৃষ্ণাঙ্গ ও বাদামী চামড়ার পরিবারগুলোতে আবাসন সঙ্কটের একটি অসমসংখ্যক নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল। এই সময়ের মধ্যে প্রায় ৮ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান এবং লাতিনো পরিবারকে ফোরক্লোজারের কারণে (বকেয়া ঋণের কারণে নিলামে উঠা) ঘর ছাড়তে হয়। সাদা পরিবারদের সংখ্যা ছিল সে তুলনায় ৪.৫ শতাংশ।
গবেষণা দেখায় যে, বড় বড় মেট্রোপলিটন অঞ্চলে যেখানে কৃষ্ণাঙ্গ বাসিন্দারা এক সময় প্রভাবশালী ছিল, বাডড়ির মালিকানা হস্তান্তরিতকরণ এবং আবাসন ব্যয় বৃদ্ধির ফলে মারাত্মকভাবে পরিবর্তন হয়েছে। ন্যাশনাল কমিউনিটি রিইনভেস্টমেন্ট কোয়ালিশন অনুসারে, ২০০০ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে, সারা দেশে ২৩০টি এলাকায় ১,৩৫,০০০ এর বেশি বাসিন্দা তাদের বাড়িঘর থেকে বাসস্থানচ্যুত হয়েছিল। এনসিআরসি বলছে, এই বাসিন্দাদের বেশিরভাগই কৃষ্ণাঙ্গ এবং হিস্পানিক ছিলেন। লস অ্যাঞ্জেলেসের কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায়ের সুপরিচিত স্থানীয় মর্টগেজ ব্রোকার মার্ক অ্যালস্টন বলেন, ‘রিয়েল এস্টেট শিল্প এবং সরকারী নীতিমালা দ্বারা কৃষ্ণাঙ্গরা নিয়মতান্ত্রিকভাবে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন।’
ফেডারেল সরকার ৩০ বছরের বন্ধকের মাধ্যমে নতুন চুক্তি নিয়ে বাড়ির মালিকানা বাড়ানো এবং প্রসারিত করা শুরু করেন, তবে ‘রেডলাইনিং’ হিসাবে পরিচিত প্রক্রিয়াটির মধ্য দিয়ে কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু গোষ্ঠীগুলিকে নিয়মিতভাবে বাড়ির মালিকানধীন থেকে বাদ দেয়া হয়েছিল।
‘রেডলাইনিং’ এমন একটি প্রক্রিয়া যা নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলকে বুঝায় যা মর্টগেজের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হিসাবে চিহ্নিত হয়। আফ্রিকান আমেরিকান এবং অভিবাসীদের এমন অঞ্চলগুলিতে পুনর্বাসিত করা হয়েছিল, যা ‘গভরমেন্ট স্পন্সর ম্যাপ’ এ রেড জোন হিসাবে ধরা হয়। আজও এসব অঞ্চলগুলোতে সর্বোচ্চ দারিদ্র্যের হার অব্যাহত রয়েছে। স্বাস্থ্যের ঝুঁকিতে থাকা এসব লোকজন দীর্ঘায়ূ হতে পারেন না। এসব লক্ষ্য করে ব্যাংক ঋণ পরিচালিত হয়। খুবই সূক্ষœভাবে এসব আইন ও নিয়ম নীতি চালু আছে, যা অতিক্রম করা সময়ের ব্যাপার বলে এখনো মনে করা হচ্ছে।
হাউজিং ফাইনান্স পলিসির আরবান ইনস্টিটিউটের ভাইস প্রেসিডেন্ট অ্যালানা ম্যাককারগো বলেছেন, ‘কৃষ্ণাঙ্গদের আবাসিক মালিকানার ক্ষেত্রে আজকের পিছিয়ে পড়ার পিছনে বছরের পর বছর ধরে অন্যায় নীতি এবং বৈষম্যেও প্রতিফলন রয়েছে।’ বাড়ির মালিকানার ক্ষেত্রে বর্ণগত ব্যবধান বন্ধ করার জন্য ন্যাশনাল ফেয়ার হাউজিং জোটের সভাপতি এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা লিসা রাইস এবং ম্যাককার্গো উভয়ই বলেন, নীতি পর্যায়ে সত্যিকারের পরিবর্তনগুলি করা দরকার। (সাপ্তাহিক বাংলা পত্রিকা)