প্রবাসে শ্রমিকের মৃত্যুর কারণ আড়ালে থাকছে
- প্রকাশের সময় : ০৭:৩৯:৩৫ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৩০ ডিসেম্বর ২০২২
- / ৭১ বার পঠিত
হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুরের রুকন উদ্দিন (২৫) সৌদি আরব গিয়েছিলেন ২০১৮ সালে। অসুস্থ অবস্থায় এ বছরের ১০ অক্টোবর দেশে ফেরার সময় বিমানে তাঁর মৃত্যু হয়। ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে লাশের সঙ্গে আসা প্রতিবেদনে লেখা ছিল, স্বাভাবিক মৃত্যু।
রুকন উদ্দিনের বাবা কালের কণ্ঠকে জানান, মৃত্যুর পাঁচ দিন আগে রুকনের সঙ্গে কথা হয়েছিল।
বলেছিলেন, নভেম্বরে দেশে ফিরবেন। এর তিন দিন পর তাঁর এক রুমমেট ফোনে জানান, সিলিন্ডার গ্যাস বিস্ফোরণে গুরুতর আহত হয়েছেন রুকন। এরপর তাঁকে অসুস্থ অবস্থায় বিমানে উঠিয়ে দেওয়া হয়।
চলতি বছর জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে লাশ আসে দুই হাজার ৮৪৭ প্রবাসীর। মধ্যপ্রাচ্যের পাঁচ দেশে মৃত্যু হয় এক হাজার ৯৮৭ জনের। এর মধ্যে এক সৌদি আরবেই মারা যান এক হাজার ১৯৩ জন। কুয়েতে মারা যান ২০৪ জন, আরব আমিরাতে ২৪৭ জন, কাতারে ১২৩ জন ও ওমানে ২২০ জন।
বাংলাদেশে অভিবাসন খাত নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, তাঁরা বলছেন, প্রবাসে মারা যাওয়া শ্রমিকদের বড় একটি অংশের মৃত্যু ঘটে স্ট্রোকে। এরপর রয়েছে হৃদরোগ ও কিডনির সমস্যা। এরপর রয়েছে কর্মক্ষেত্রে মৃত্যু ও সড়ক দুর্ঘটনা, অসুস্থতা, আগুনে পুড়ে মৃত্যু, আত্মহত্যা বা খুন। তবে প্রবাসীদের এমন আকস্মিক মৃত্যুর কারণ বাংলাদেশ থেকে যাচাই করা হয় না। এ জন্য লাশের সঙ্গে আসা মেডিক্যাল রিপোর্টে মৃত্যুর কারণ হিসেবে যা উল্লেখ করা হয়, সেটাই মেনে নিতে হয়। শারীরিক কোনো জখম বা চিহ্ন দেখে মৃত্যুর কারণ নিয়ে প্রশ্ন জাগলে এ ব্যাপারে সঠিক উত্তর পাওয়ার কোনো সুযোগ থাকে না। এভাবে অনেক ক্ষেত্রে আড়ালে থেকে যাচ্ছে মৃত্যুর সঠিক কারণ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ তৌহিদুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দূতাবাস থেকে প্রবাসীদের মৃত্যুর কারণ উল্লেখ করে থাকেন সাধারণত সেখানকার হাসপাতালের চিকিৎসকরা। যখন কোনো দুর্ঘটনা বা নিপীড়নের কারণে প্রবাসীর মৃত্যু হয়, তখন দেখা যায় তিনি যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন, তারা তাদের পক্ষে মেডিক্যাল রিপোর্ট প্রকাশের জন্য নানাভাবে প্রভাব বিস্তার করে। এমন ঘটনায় প্রবাসীর পরিবারের পক্ষ হয়ে লড়ার কথা সেখানকার বাংলাদেশি দূতাবাসের কর্মকর্তাদের। কিন্তু এই জায়গাটিতেই আমাদের সবচেয়ে বেশি জটিলতা। ’
তৌহিদুল হক বলেন, ‘পরিবার থেকে ভিন্ন কথা বলা হলেও দূতাবাসগুলো সে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে না। সেটি গ্রহণ না করার পেছনেও নানা প্রেক্ষাপট রয়েছে। কারণ বিদেশে দক্ষ মানবসম্পদ পাঠানোর ক্ষেত্রে আমাদের শতভাগ পেশাদারি, নৈতিকতা, মানবিক মূল্যবোধ ও বিচার-বিবেচনা দিয়ে যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার কথা, আমরা সেটি করছি না। ফলে প্রবাসী শ্রমিকরা যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন, সে প্রতিষ্ঠানগুলো এর সুযোগ নিচ্ছে। ’
রুকনের মতো পরিবারে সচ্ছলতার আশায় সৌদি গিয়েছিলেন সিরাজগঞ্জের ফাতেমা বেগম। লাশ হয়ে দেশে ফেরেন গত ৪ অক্টোবর। ফাতেমার স্বামী শের আলী কালের কণ্ঠকে জানান, লাশের সঙ্গে আসা প্রতিবেদনে মৃত্যুর কারণ উল্লেখ রয়েছে সড়ক দুর্ঘটনা। কিন্তু তাঁর শরীরজুড়ে অনেক আঘাতের চিহ্ন ছিল।
শের আলী বলেন, তাঁর স্ত্রীর মৃত্যুর ঘটনায় ওই দেশের চাকরিদাতা এজেন্সির পক্ষ থেকে প্রথমে ১২ লাখ টাকার লোভ দেখিয়ে বলা হয়, লাশ দেশে নেওয়ার দরকার নেই। তিনি বলেন, ‘আমাদের অনেক চেষ্টার পর ঘটনার ১৫ দিন পর তারা লাশ দেশে পাঠায়। কবর দেওয়ার আগে কয়েকজনকে দেখতে বলা হলে তারা লাশের শরীরে আঘাতের চিহ্ন পায়। ’
ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্রবাসীকল্যাণ ডেস্কের সহকারী পরিচালক ফখরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দূতাবাস থেকে যে অনাপত্তিপত্র (এনওসি) ইস্যু করে এবং সেখানে যা লেখা থাকে, আমরা হুবহু তাই লিখে থাকি। এর বাইরে আমাদের লেখার কোনো সুযোগ নেই। দূতাবাসের নথিতে বেশির ভাগ মৃত্যুকে স্বাভাবিক মৃত্যু হিসেবে উল্লেখ করা হয়। ’
কোন বছর কত মরদেহ : প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড ও তিন বিমানবন্দরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত এক দশকে ৩৩ হাজার ৯৯৮ প্রবাসী শ্রমিক মারা যান। এর মধ্যে ২০১২ সালে দুই হাজার ৮৭৮ জন, ২০১৩ সালে তিন হাজার ৭৬ জন, ২০১৪ সালে তিন হাজার ৩৩৫ জন, ২০১৫ সালে তিন হাজার ৩০৭ জন, ২০১৬ সালে তিন হাজার ৪৭৮ জন, ২০১৭ সালে তিন হাজার ৩৮৫ জন, ২০১৮ সালে তিন হাজার ৮১১ জন, ২০১৯ সালে চার হাজার ৩৪ জন, ২০২০ সালে তিন হাজার ১৯ জন এবং ২০২১ সালে তিন হাজার ৬৭৫ জনের মরদেহ এসেছে। ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত এক হাজার ৭৪৫ জন প্রবাসীর মরদেহ এসেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মধ্যপ্রাচ্যে প্রচণ্ড গরমে প্রতিকূল পরিবেশে অদক্ষ এই বাংলাদেশিরা ঝুঁকিপূর্ণ বিভিন্ন কাজে যুক্ত থাকেন। একদিকে প্রতিকূল পরিবেশ, আরেকদিকে অমানুষিক পরিশ্রম, ১২ থেকে ১৮ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করা, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে গাদাগাদি করে থাকা, দীর্ঘদিন স্বজনদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা এবং সব মিলিয়ে মানসিক চাপের কারণেই সাধারণত স্ট্রোক বা হৃদরোগের মতো ঘটনা ঘটে।
বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান কালের কণ্ঠকে বলেন, ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে আসা ৩০৭ জন প্রবাসীর লাশের মৃত্যুর কারণ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ১৭৬ জনই (৫৬ শতাংশ) মারা গেছেন স্ট্রোকে, যাঁরা তরুণ বা মধ্যবয়সী। এরপর ৬২ জনের (২০ শতাংশ) মৃত্যু হয়েছে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে। কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা ও অন্যান্য দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৫৭ জন (১৮ শতাংশ)। সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ১২ জন (৪ শতাংশ)। আত্মহত্যা করেছেন তিনজন। খুন হয়েছেন দুজন। গত ১৪ বছরের বিভিন্ন সময়ের মৃত্যুর কারণ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, কারণগুলো একই রকম।
শরিফুল হাসান বলেন, মৃত্যুর কারণগুলো নিয়ে যদি রাষ্ট্রীয়ভাবে কাজ করা হয় এবং সঠিক কারণ জানা যায়, তাহলে সে অনুযায়ী বিদেশ যাওয়ার আগেই প্রবাসীদের সচেতন করলে মৃত্যু কিছুটা হলেও কমিয়ে আনা যাবে।