আমার স্পেশাল সন্তানই আমার সব তাই আমার ঈদ অন্য সবার মত নয়

- প্রকাশের সময় : ০২:২৩:০৩ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১০ এপ্রিল ২০২৫
- / ১৫৬ বার পঠিত
রুপা খানম: ঈদ মানে খুশী আর এই উৎসব অন্য সবার মতো করে পালন করা হয়ে উঠেনা আমার ।ঈদের দিন সকালে নামাজ পড়ে আমার বাচ্চাকে দেখার জন্য মনটা ছুটে গেল। তবুও সকালে যাই নি। আজ দেড় বছর হসপিটালে একটি আট ফিট লম্বা বিছানা তার জগৎ। ঔষধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার কারণে আজ নিজের ঘরে নিজের বিছানায় ঘুমাতে পারছে না। বুকটা ফেটে যায় ঐ হসপিটালে কয়েদীদের মত যখন রেখে আসি। ইচ্ছা করলেই ঘরে আনতে পারি না। এ যেন জেল হয়েছে ওর। আমি যেতে পারতাম ওকে দেখতে সকালেই যাই নি ওর রুটিন ভঙ্গ হবে সে কারণে। আমি আমার ছেলেকে প্রতিদিন দেখতে যাই বিকালে। আর ও তাতেই অভ্যস্ত। আমি তাই মেনে নিয়ে নিজের কষ্ট কে ধামাচাপা দিয়েছি নিজের ইচ্ছার কাছে। নাফি আমাকে সকালে পাবে না আমি কাজ করি। আমি প্রতিদিন কাজের শেষে নাফিকে দেখতে যাই সন্ধ্যায়। নিয়ম মাফিক বিকালে গেলাম হসপিটাল। যেয়ে দেখি ময়লা একটা হসপিটাল গাউন তার গায়ে। যখনই ওকে দেখতে যাই প্রাই ওর গায়ের গাউন থাকে নোংরা, বিছানার উপর নানান ধরনের খাবার পরে থাকতে দেখতে পাই। সম্ভবত নার্স সকালে একবার পরিষ্কার করে তাই দিনের শেষে তা আর পরিষ্কার থাকে না। নাফি যখন বাসায় ছিল বার বার গোসল করতে পছন্দ করত। হসপিটাল নিয়ম মাফিক একবার গোসল সে করতে পারে। আমি নাফিকে পরিষ্কার রাখার চেষ্টা করতাম। ঈদের দিন রাতেই হসপিটালে গিয়ে ওকে গোসল করিয়ে নতুন কাপড় পরালাম। সাথে একটা খেলনা কিনেছিলাম। ওর হাতে দিলাম ভীষণ খুশী ছিল নাফি। পরের দিন গিয়ে দেখি সে খেলনা আর নেই সে ভেঙে ফেলেছে ওভারস্টুমুলেট অর্থাৎ অতিরিক্ত উদ্দীপিত হয়ে। চেষ্টা করেও সফল হতে পারি না। ধৈর্য্য রাখি বার বার নানান ভাবে চেষ্টা করি খুশী রাখার। আর ভাবতে থাকলাম এ কোন ধরণের ঈদ আমাদের কোন খুশী আমার পাশে? তাকে গোসল করিয়ে পায়জামা পাঞ্জাবী পরানোর পর দুচোখ বেয়ে শুধু অশ্রæ আমার ঝড়ে পরছে। আমার স্পেশাল সন্তানটি একটি ছেলে সন্তান। মানুষ স্বপ্ন দেখে। স্বপ্ন কে ছুঁতে চায়। আর যখন স্বপ্ন আর বাস্তব মিলে যায় তখনই সেখানে থাকে তৃপ্তি। আমি ছোট বেলা থেকেই ভাবতাম বিশ্বের সেরা দেশ আমেরিকা যাব। বিল্ডিংএর শহর আলো ঝলমল রাতের ম্যানহাটন দেখব। আমার বিয়ের পর আমার সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছিল। আমি জীবনের প্রতিটি ধাপ নিয়ে ভাবতাম আমার মত কেহ আর সুখী নয়।
বিয়ের দুই বছর পর জন্ম নিল আমার আরেক স্বপ্ন আমার ছেলে সন্তান। যেদিন ওর জন্ম হলো ওর চাঁদ মুখ দেখে নিজেকে এতটাই সুখী মনে হলো ভাবলাম আর কি চাই ? সবই তো জীবনে পেলাম। হে আল্লাহ যে গর্ভে আমার সন্তানের জন্ম, যে পৃথিবীতে নাফীর জন্ম দু’জন-ই তোমার দৃশ্যমান বাস্তবতার উৎস। আর অনন্তসত্তা। মহান আল্লাহপাক মূল উৎস। তার বীজদানকারি পিতা। জন্ম থেকে দুইবছর ভালোই তো ছিল। আমি কখনো বুঝতে পারিনি সে অন্য একটি জগৎ নিয়ে থাকে। হঠাৎ বুঝতে থাকলাম সে স্বাভাবিক নয়। কথা বলতে পারে না, চোখে চোখ রেখে কথা বলে না যাকে বলে আই কন্টাক। চুবিয়ে তেমন খায় না যা ওর চোয়ালের পেশির দুর্বলতার জন্য। হাসি চলে গেল, রাত জাগা বেড়ে গেল। অল্পতেই কাঁদতো বেশী। খিট খিট ম্যাজাজ। সব কিছু মিলিয়ে সেদিন বুঝেনি অতল সাগরে আমি! একটি সুন্দর টাইটানিক জাহাজের মত ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছি গভীর পানির নীচে। মনে আছে প্রথম জন্মদিন পালন করলাম আমাদের সব প্রাপ্তির খুশী নিয়ে। নিজের বাড়ি রাস্তাঘাট লাইটিং দিয়ে আলো ঝলমল করে সাজিয়েছিলাম। তখনও বুঝতে পারছি না আমার সুখের জাহাজ নিমজ্জিত হতে যাচ্ছে আঠারো মাস পর। দুই বছর আট মাস প্রথম ওর ইভোলিউশন হলো। জানতে পারলাম নিউরোলজিষ্ট থেকে আমার ফুলের মত সন্তান পি ডি ডি। সেই থেকে সব পূর্নতা যেন শুন্য কোটায় নেমে গেল। এ যেন শেয়ার বাজারের লাভ লোকসানের মত। মিলিয়ন টাকা আমার কাগজ হয়ে গেলো যাকে নিয়ে স্বপ্ন আমার যাকে ঘিরে পূর্ণতা আসবে সেই স্থান নিল অপূর্ন আক্ষেপ। একটি সুস্থ বাচ্চা আল্লাহর অশেষ নিয়ামত। আমাকে সে কারণে শুনতে হয়েছে অজ্ঞ লোকের কাছে এটি আমার কর্ম ফল। তাই মাফ চাইতে হবে বেশী বেশী আল্লাহ কে ডাকতে হবে। দোয়া করতে হবে। হয়ত একদিন নাফি ঠিক হয়ে উঠবে। আসলেই কি আমার পাপের ফল নাফি? যদি আমি পাপী হই শুধু স্পেশাল বাচ্চার কারণে তাহলে যারা এসব বলছে সে কি ফেরেস্তা ? আর একজন ফেরেস্তা কিভাবে মনগড়া কথা অন্য একজন মাকে-কে ছুড়ে দেয়? তারপরও হাল ছাড়িনি। কষ্ট করছি অমানুষিক। প্রার্থনা করছি যিনি সৃষ্টি কর্তা তার কাছে। তিনি যা জানেন আমরা তা জানি না। উনার সৃষ্টি তিনি কেন আমার ছেলেকে এমন করেছেন তিনি তার ভাল জানেন। আমি শুধু উছিলা চেষ্টা করে যাওয়ার। ওর কষ্টে আমার কষ্ট হয় না, তা বলব না, তবে আল্লাহর সৃষ্টি রহস্য নিয়ে আমার তো কোন অভিযোগ নেই।
এবারের ঈদুল ফিতরের দিন হাসপাতালের লবিতে পুত্র নাফি’র সাথে মা লেখিকা রূপা খানম
অটিষ্টিক শিশুদের বাবা-মায়েদের অন্য স্বাভাবিক সন্তান বাবা মায়েদের মত ঈদ বা যে কন উৎসব উদযাপন করা একটু কষ্টকর হয়ে উঠে। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে সেই সন্তানের মনের ভাব বুঝে সব কিছু করতে হয়। যাকে বলে নিয়ম মাফিক করতে চাইলেও কোন কোন সময় ব্যতিক্রম ঘটে যায়। নামাজে যাওয়ার মন স্থির করেও যাওয়া হয় না। কোন বাসায় বেড়াতে যাওয়া তাও নির্ভর করে সেই সন্তানের উপর। কেহ আসলে সময় দেওয়া, আদর আপ্যায়ণ করা সেটাও নির্ভর করে সেই সন্তানটি কি সে সুযোগ দিবে? কারণ তাকে সব সময় দেখাশুনা করতে হয়। তার মানে আটচল্লিশ ঘন্টা অসমাপ্ত কাজ! বাইরে থেকে কেউ বুঝতে পারে না কতটা কঠিন এ জীবন। আমরা যে যা বলে নিজেদের সান্তনা বা প্রবোধ দেই না কেন, এটিই বাস্তব। অটিস্টিক শিশুরা দৈনিক রুটিনের মধ্যে থাকতে কমফোর্ট ফিল করে। তাই সেই রুটিন সময়ের মধ্যে কেহ আসলে বা কারো বাসায় দাওয়াত থাকলে রুটিন এলোমেলো হলেই তখনই হয় তাদের ব্যতিক্রম আচরণ। আমরা যারা তাদের দেখাশুনা করি, সারাদিনে বাসায় যাই করুন না কেন, তার যে সকল কাজ থাকে সেগুলো সময় অনুযায়ী বাস্তবায়নের চেষ্টা করা। তাই আমি মনে করি আমাদের জীবনটা যান্ত্রিক জীবন হয়ে পরে। নিজের কথা ভাবার আর সময় থাকে না। ঈদ অথবা এরকম বিশেষ দিনে চেষ্টা করি ঘরে হরেক পদের রান্না করতে। অনেকেই কিন্তু এ বিষয়টি ভুলে যান। তারা মেহমানদের মুখ্য করে রান্না করেন। কিন্ত আমার চিন্তা থাকে আমার অটিষ্টিক সন্তানের পছন্দ নিয়ে আর সে কারণে আমার বাচ্চার পছন্দের খাবারগুলোও রাখতে চেষ্টা করি।
ঈদে আমার বাচ্চাকে নতুন কাপড় দেওয়ার সাথে তার পছন্দের খেলনা রাখি যা দিয়ে সে কিছুক্ষণ খেলবে নইলে দেখা যাবে যে, আপনি সারাদিন অতিথিদের নিয়ে ব্যস্ত রয়েছেন, সন্তানকে সময় দিতে পারছেন না। সে একা হয়ে ব্যতিক্রম কিছু ঘটাবে। আগেই বলেছি সেই সন্তানকে মাথায় রেখেই সব কাজ নিয়ম এবং ছকে বাঁধা করতে হবে। আবার অনেক বাচ্চা বাসায় হৈ হুল্লোড় পছন্দ করেনা। তাই আগত অতিথিদের বিনয়ের সঙ্গে এদিকটা খেয়াল রাখার কথা বলতে হবে। সেন্সরি প্রসেস ডিজঅর্ডারের জন্য কিছু অটিস্টিক বাচ্চা মুখে শব্দ করে, হাত নাড়াতে থাকে, আঙুল নাড়া চারা করে, অযথা লাফ দেয়, এতে করে অনেক সুস্থ বাচ্চা তাকে পছন্দ করবে না। তাদের বাবা-মায়ের উচিত যে বাসায় আজ যাচ্ছে সেখানে একটি অষ্টিক শিশু আছে সে অনেক কিছুই তোমার মত হবে না। তুমি তাকে শিখাবে খুব সুন্দর করে। তার সাথে খেলার চেষ্টা করবে ধৈর্য্য ধরে। এভাবে সেই বাচ্চাও অন্যরে সাথে সুন্দর সৌহার্দ্য ব্যবহার শিখতে পারবে।
অটিস্টিক বাচ্চা একার জন্য নয় এটি একটি রাষ্ট্রীয় সমস্যা। যাকে রাষ্ট্র, সমাজ , পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয় সকলে মিলে কাজ এবং সহায্য করতে হবে। এদেশে তাই এদের জন্য উপযোগী স্পেশাল স্কুল আছে যা থেকে এরা অনেক কিছু ওদের মত শিখতে পারে।
এপ্রিল বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস। অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের দেশে-বিদেশে শারীরিক আঘাত করা থেকে বিরত থাকতে হবে। শিশুদের প্রতি ধৈর্য্য, সুন্দর সহজ, সরল ব্যবহার করতে হবে। তারা আমাদের সন্তান। তাদের খেলাধুলার ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের নিয়ে বাইরে যেতে হবে। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাÐের মাধ্যমে তাদের সুপ্ত প্রতিভা বিকাশের সুযোগ করে দিতে হবে। অটিস্টিক শিশুকে অবহেলা না করে তাদেরকে সেবাযতœ ও ভালোবাসা দিয়ে সক্ষম ও কর্মক্ষম করে তোলা সমাজের প্রতিটি মানুষের দায়িত্ব। (সাপ্তাহিক বাঙালী)