সংকটকালে শাসক ও জনগণের প্রতি ইসলামের পাঁচ নির্দেশনা
- প্রকাশের সময় : ০৬:২০:৪৮ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৩
- / ৪৫ বার পঠিত
হককথা ডেস্ক : ইসলাম সাধারণ মানুষকে শাসকদের ন্যায্য সমালোচনার অধিকার দিয়েছে। শাসকদের নির্দেশ দিয়েছে সাধারণ মানুষের কথা শোনার। তবে রাজনৈতিক প্রতিবাদের নামে সমাজ ও রাষ্ট্রে অস্থিতিশীলতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অবকাশ নেই। ইসলাম উভয় পক্ষকে সংযত ও সহনশীল হতে বলেছে। সংঘাতময় পরিস্থিতি এড়াতে দলনিরপেক্ষ মানুষেরও দায় আছে।
শাসকদের প্রতি নির্দেশনা
ইসলাম জনসাধারণের প্রতিবাদকে সংযম ও সহনশীলতার সঙ্গে দেখার নির্দেশ দেয়। তাঁরা বিষয়টিকে এভাবে দেখতে পারেন :
১. প্রতিবাদ মানুষের অধিকার : প্রত্যেক নাগরিক সমাজ ও রাষ্ট্রের যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার অধিকার রাখে, বরং অন্যায়ের প্রতিবাদ করা মুসলমানের ঈমানি দায়িত্ব। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে বৎস! নামাজ কায়েম কোরো, সৎকাজের নির্দেশ দাও আর অসৎকাজে নিষেধ কোরো এবং আপদে-বিপদে ধৈর্য ধারণ কোরো।
এটাই তো দৃঢ়সংকল্পের কাজ।’ (সুরা : লোকমান, আয়াত : ১৭)
২. সমালোচনায়ই কল্যাণ : রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সমালোচনা ও প্রতিবাদ শাসকদের জন্য কল্যাণকর। কেননা এর মাধ্যমে রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রনায়করা নিজেদের ভুল সংশোধনের সুযোগ পান। ইরশাদ হয়েছে, ‘তারা আল্লাহ এবং শেষ দিনে বিশ্বাস করে, সৎকাজের নির্দেশ দেয়, অসৎকাজে নিষেধ করে এবং তারা কল্যাণকর কাজে প্রতিযোগিতা করে।
তারাই সজ্জনদের অন্তর্ভুক্ত।’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১১৪)
৩. প্রতিবাদ ছেড়ে দিলেই ক্ষতি : কোনো সমাজে যদি অন্যায়ের প্রতিবাদ না হয়, তবে সে সমাজে কল্যাণের ধারা অব্যাহত থাকবে না। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তারা যেসব অন্যায় কাজ করত তা থেকে তারা পরস্পরকে বারণ করত না। তারা যা করত তা কতই না নিকৃষ্ট।’ (সুরা : মায়িদা, আয়াত : ৭৯)
৪. কণ্ঠরোধকারী জালিম : যারা মানুষের ন্যায্যা দাবি শুনতে রাজি নয়, তারা জালিম সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত।
বিশেষত যখন কণ্ঠরোধ করতে ভয়ভীতি দেখানো হয়। আল্লাহ বলেন, ‘অতঃপর জাদুকররা সিজদাবনত হলো ও বলল, আমরা হারুন ও মুসার প্রতিপালকের প্রতি ঈমান আনলাম। ফিরাউন বলল, কী, আমি তোমাদের অনুমতি দেওয়ার আগেই তোমরা মুসাতে বিশ্বাস স্থাপন করলে।…সুতরাং আমি তোমাদের হাত-পা বিপরীত দিক থেকে কেটে দেব এবং তোমাদেরকে খেজুরগাছের কাণ্ডে শূলবিদ্ধ করবই এবং তোমরা অবশ্যই জানতে পারবে আমাদের মধ্যে কার শাস্তি কঠোরতর ও অধিক স্থায়ী।’ (সুরা : তাহা, আয়াত : ৭০-৭১)
৫. বিরোধীদের প্রতি নমনীয় হওয়া : ইসলাম সমালোচকের কঠোর আচরণ ও ভাষার বিপরীতে নম্র আচরণ করতে বলে। ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা উভয়ে নম্র ভাষায় কথা বোলো। হয়তো সে শিক্ষা গ্রহণ করবে অথবা ভয় পাবে।’ (সুরা : ত্বহা, আয়াত : ৪৪)
বিরোধীদের প্রতি নির্দেশনা
ইসলাম রাষ্ট্রকে যেমন সংযত আচরণ করার নির্দেশ দেয়, তেমনি প্রতিবাদকারীকেও নির্ধারিত সীমার মধ্যে থাকার নির্দেশ দেয়। যেমন :
১. সহিংসতা নয় : রাজনৈতিক প্রতিবাদের ক্ষেত্রে প্রতিবাদকারীকে অবশ্যই সহিংসতার পথ পরিহার করতে হবে। কেননা সহিংসতা কারো জন্যই কল্যাণ বয়ে আনে না। আল্লাহও সহিংস ও ধ্বংসাত্মক কাজ পছন্দ করেন না। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তারা দুনিয়ায় ধ্বংসাত্মক কাজ করে বেড়ায়; আল্লাহ ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্তদের ভালোবাসেন না।’ (সুরা : মায়িদা, আয়াত : ৬৪)
২. জান-মালের ক্ষতি নয় : মুসলমানের জীবন ও সম্পদ অপর মুসলমানের কাছে আমানতস্বরূপ। তাই রাজনৈতিক প্রতিবাদের নামে জনগণের জান-মালের ক্ষতি করা যাবে না। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, তোমাদের জীবন, সম্পদ ও মান-সম্মান অন্য মুসলমানের জন্য এ শহরে এ দিনের মতোই হারাম (মর্যাদাসম্পন্ন)। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১০৫)
৩. দাবি ন্যায্য হওয়া : বিরোধীপক্ষের দাবি ন্যায্য হওয়া আবশ্যক। ঠিক যেমন কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘কিন্তু যা ঘটার ছিল আল্লাহ তা সম্পন্ন করলেন, যাতে যে কেউ ধ্বংস হওয়ার সে যেন সত্যাসত্য স্পষ্ট প্রকাশের পর ধ্বংস হয় এবং যে জীবিত থাকবে সে যেন সত্যাসত্য স্পষ্ট প্রকাশের পর জীবিত থাকে। আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।’ (সুরা : আনফাল, আয়াত : ৪২)
৪. সমঝোতাকে প্রাধান্য দেওয়া : মুসলমানরা পারস্পরিক বিরোধ নিষ্পত্তিতে সমঝোতার পথকে প্রাধান্য দেবে। সমঝোতার দুয়ার খোলা থাকলে প্রতিবাদ ও বিবাদের পথ পরিহার করবে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তারা যদি সন্ধির দিকে ঝুঁকে পড়ে, তবে তুমিও সন্ধির দিকে ঝুঁকবে এবং আল্লাহর প্রতি নির্ভর করবে। তিনিই সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।’ (সুরা : আনফাল, আয়াত : ৬১)
৫. মিথ্যাচার ও চরিত্রহরণ নয় : রাজনৈতিক নেতাদের ভেতরে প্রতিপক্ষের চরিত্রহরণের প্রবণতা দেখা যায়, এমনকি তাঁরা মিথ্যাচারেরও আশ্রয় নেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, একজন মানুষের মন্দ হওয়ার জন্য এতটুকু যথেষ্ট যে সে তার মুসলিম ভাইকে হেয় মনে করে। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৬৪৩৫)
নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের দায়িত্ব
যখন রাজনৈতিক দল ও পক্ষগুলো পারস্পরিক বিরোধ মেটাতে ব্যর্থ হয়, তখন সমাজের নিরপেক্ষ ও মান্যবর ব্যক্তিরা সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেবেন। দলনিরপেক্ষ ব্যক্তিদের প্রতি ইসলামের নির্দেশনা নিম্নরূপ :
১. কল্যাণের পথে আহ্বান করা : জাতি ও সমাজের বিবেক হিসেবে বিবেচিত ব্যক্তিরা সমাজ ও রাষ্ট্রকে কল্যাণের পথে আহ্বান করবে। যেমনটি ইরশাদ হয়েছে, ‘নগরীর প্রান্ত থেকে এক ব্যক্তি ছুটে এলো এবং সে বলল, হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা রাসুলদের অনুসরণ কোরো। অনুসরণ কোরো তাদের, যারা তোমাদের কাছে কোনো প্রতিদান চায় না এবং যারা সৎপথপ্রাপ্ত।’ (সুরা : ইয়াসিন, আয়াত : ২১)
২. সংলাপের ব্যবস্থা করা : সংলাপ করা নবী-রাসুলদের বৈশিষ্ট্য। সংলাপের মাধ্যমে গুরুতর রাজনৈতিক সংকট নিরসনের বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে। কোরআনে ইবরাহিম, মুসা, নুহ (আ.)-সহ একাধিক নবীর সংলাপ বর্ণিত হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘তুমি ফেরাউনের কাছে যাও, সে তো সীমালঙ্ঘন করেছে, এবং বলো, তোমার কি আগ্রহ আছে যে তুমি পবিত্র হও আর আমি তোমাকে তোমার প্রতিপালকের দিকে পথপ্রদর্শন করি, যাতে তুমি তাঁকে ভয় করো। (সুরা : নাজিয়াত, আয়াত : ১৭-১৯)
৩. সমঝোতার উদ্যোগ নেওয়া : মুমিনের দায়িত্ব হলো পরস্পর বিবাদে লিপ্ত দুই মুমিনের ভেতর সমঝোতার উদ্যোগ নেওয়া। আল্লাহ বলেন, ‘মুমিনদের দুই দল দ্বন্দ্বে লিপ্ত হলে তোমরা তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দেবে।’ (সুরা : হুজরাত, আয়াত : ৯)
আল্লাহ সর্বপ্রকার রাজনৈতিক সংকট থেকে প্রিয় মাতৃভূমিকে রক্ষা করুন। আমিন। সূত্র : কালের কণ্ঠ
হককথা/নাছরিন