ইসলাম যেভাবে শিল্প-বাণিজ্যের অনুপ্রেরণা দেয়
- প্রকাশের সময় : ০৭:৫০:৪৪ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৭ অক্টোবর ২০২৩
- / ৫৪ বার পঠিত
হককথা ডেস্ক : শিল্প এক ধরনের কর্মপ্রচেষ্টা, যা প্রকৃতি থেকে সম্পদ আহরণ করে তার উন্নত রূপান্তর ঘটিয়ে মানুষের ব্যবহার উপযোগী করে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও শিল্পায়ন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ইসলামে শিল্পায়নের প্রতি সবিশেষ তাগিদ দেওয়া হয়েছে। শিল্প-বাণিজ্যে জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ নিয়োজিত আছে।
যুগে যুগে প্রেরিত নবী-রাসুলরা শুধু ধর্মের বাণী দিয়েই ক্ষান্ত হননি, বরং শিল্প ও ব্যবসার ময়দানে তাঁদের বিশাল অবদান আছে। প্রথমেই আসা যাক দাউদ (আ.)-এর প্রসঙ্গে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে : ‘আমি (আল্লাহ) তাকে [দাউদ (আ.)] বর্ম নির্মাণ শিক্ষা দিয়েছিলাম, যাতে তা যুদ্ধে তোমাদের রক্ষা করে।’ (সুরা : আম্বিয়া, আয়াত : ৮০)
দাউদ (আ.)-এর আগে বর্ম তৈরি হতো; কিন্তু তা হতো স্বাভাবিক পাতের, কড়া ও শিকলহীন।
দাউদ (আ.) সর্বপ্রথম কড়া ও শিকলবিশিষ্ট বর্ম তৈরি করেন। (ইবনে কাসির)
লোহা দাউদ (আ.)-এর হাতে মোমের মতো নরম হয়ে যেত। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তার জন্য নমনীয় করেছিলাম লোহা, যাতে তুমি পূর্ণ মাপের বর্ম তৈরি করতে এবং বুননে পরিমাণ রক্ষা করতে পারো।’ (সুরা : সাবা, আয়াত : ১০-১১)
লোহাকে আগুন দিয়ে গলানো ও হাতুড়ি দিয়ে পেটানো ছাড়াই তা মোম, ছানা আটা এবং ভেজা মাটির মতো যেভাবে চাইতেন ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে ইচ্ছামতো জিনিস-পত্র তৈরি করতেন।
(তাফসিরে তাবারি)
সুলাইমান (আ.)-কে তামার প্রবাহিত ঝরনা দেওয়া হয়েছিল, যাতে তামা পদার্থ দ্বারা তিনি অনায়াসে ইচ্ছামতো পাত্র ইত্যাদি বানাতে পারেন। আল্লাহ বলেন, ‘আর আমি সুলাইমানের জন্য বাতাসকে অনুগত করে দিয়েছিলাম, যা সকালে এক মাসের পথ এবং সন্ধ্যায় এক মাসের পথ অতিক্রম করত। আর আমি তার জন্য গলিত তামার প্রস্রবণ প্রবাহিত করেছিলাম। আর কতিপয় জিন তার রবের অনুমতিক্রমে তার সামনে কাজ করত। তাদের মধ্যে যে আমার নির্দেশ থেকে বিচ্যুত হয় তাকে আমি জ্বলন্ত আগুনের আজাব আস্বাদন করাব।
’ (সুরা : সাবা, আয়াত : ১২)
এই আয়াত থেকে জানা যায়, জিনেরা সুলাইমান (আ.)-এর ইচ্ছানুযায়ী তাঁর জন্য প্রাসাদ তৈরি করত। বড় বড় দালানের তুলনায় ছোট ইমারত-ভাস্কর্য শিল্প প্রস্তুত করত, আর হাউসসদৃশ বৃহদাকার রান্না করার পাত্র তৈরি করত। জাকারিয়া (আ.) আল্লাহর নবী এবং মারিয়াম (আ.)-এর লালন-পালনকারী ছিলেন। তিনি কাঠ দিয়ে নানা ধরনের আসবাব তৈরি করতেন। তাঁর এই শিল্পকর্ম তাঁর মর্যাদা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। জাকারিয়া (আ.)-এর মর্যাদা বিষয়ে হাদিসে এসেছে, আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, জাকারিয়া (আ.) কাঠমিস্ত্রি ছিলেন। (মুসলিম, হাদিস : ৫৯৪৭)
হুদ (আ.)-এর জাতি হলো আদ জাতি। তাদের সুউচ্চ প্রাসাদ ও টাওয়ার ছিল। এ বিষয়ে মহান আল্লাহ বলেন, ‘তুমি কি দেখনি, তোমার রব আদ জাতির ইরাম গোত্রের প্রতি কী (আচরণ) করেছেন—যারা ছিল সুউচ্চ প্রাসাদের অধিকারী, যার সমতুল্য (প্রাসাদ) কোনো দেশে নির্মিত হয়নি।’ (সুরা : ফাজর, আয়াত : ৬-৮)
মহান আল্লাহ সালেহ (আ.)-এর সময় সামুদ সম্প্রদায়কে শিল্পদক্ষতা দান করেছিলেন। সৌদি আরবের প্রত্নতাত্ত্বিক নগরী হিজরে আগমন করেছিলেন নবী সালেহ (আ.)। ইসলাম-পূর্ব আরব সভ্যতায় নাবতিয়ানদের প্রতিষ্ঠিত এই শহর বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ, যা মদিনা থেকে ২৫০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত। পবিত্র কোরআনে শহরটিকে ‘আসহাবুল হিজর’ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। সামুদ জাতি শিল্প ও সংস্কৃতিতে পৃথিবীতে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। আদ জাতির পর আল্লাহ তাআলা তাদের পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি সমৃদ্ধি দান করেছেন। এ বিষয়ে পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘স্মরণ করো, আদ জাতির পর তিনি তোমাদের (সামুদ জাতিকে) তাদের স্থলাভিষিক্ত করেছেন এবং তিনি তোমাদের পৃথিবীতে এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন যে তোমরা নরম ভূমিতে প্রাসাদ এবং পাহাড় কেটে বাসগৃহ নির্মাণ করছ। সুতরাং আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ করো এবং পৃথিবীতে বিপর্যয় ঘটিয়ো না।’ (সুরা : আরাফ, আয়াত : ৭৪)
আরো উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, নুহ (আ.)-এর নৌকা বানানোর কৌশলের কথা। মহান আল্লাহ নুহ (আ.)-কে নৌকা তৈরির নির্দেশ দেন। আল্লাহ বলেন, ‘তুমি আমার তত্ত্বাবধানে এবং আমার ওহি অনুযায়ী নৌকা নির্মাণ করো।’ (সুরা : হুদ, আয়াত : ৩৭; সুরা : মুমিনুন, আয়াত : ২৭)
নৌকা তৈরির প্রয়োজনীয় উপকরণ ও নির্মাণকৌশল জিবরাঈল (আ.) নুহ (আ.)-কে শিক্ষা দিয়েছিলেন। নুহ (আ.)-এর হাতে নৌকা ও জাহাজ নির্মাণ শিল্প আলোর মুখ দেখতে পায়।
ইদরিস (আ.) এমন এক ব্যক্তি ছিলেন, যাঁকে মুজিজা হিসেবে জ্যোতির্বিজ্ঞান ও অঙ্কবিদ্যা দান করা হয়েছে। (তাফসিরে বাহরে মুহিত)
ইদরিস (আ.) প্রথম সেলাই করা কাপড় পরিধান করেন। তিনি নিজেই নিজের কাপড় সেলাই করতেন। তিনি ছিলেন জগতের প্রথম দর্জি। তিনি মানুষের কাপড়ও সেলাই করতেন। (তাফসিরে মা’আরেফুল কোরআন)
বর্তমানে গার্মেন্টস সেক্টর শিল্প-বাণিজ্যের অন্যতম প্রভাবক শাখা। পোশাকশিল্প মহান আল্লাহ তাঁর বিশেষ নিয়ামত হিসেবে উল্লেখ করেছেন। পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘আর (আল্লাহ) ব্যবস্থা করেছেন পোশাকের, যা তোমাদের গরম থেকে রক্ষা করে এবং বর্মেরও ব্যবস্থা করেছেন, যা তোমাদের রক্ষা করে তোমাদের যুদ্ধে। এভাবেই তিনি তোমাদের ওপর তাঁর নিয়ামতকে পূর্ণ করবেন, যাতে তোমরা অনুগত হও।’ (সুরা : নাহাল, আয়াত : ৮১)
নৌপথে পণ্য আমদানি-রপ্তানির প্রচলন প্রাচীনকালেই ঘটে। পবিত্র কোরআনের একাধিক আয়াতে নৌবাণিজ্যের অনুপ্রেরণা পাওয়া যায়। ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ সাগর তোমাদের কল্যাণে নিয়োজিত করেছেন, যাতে তাঁর আদেশে তাতে নৌযানগুলো চলাচল করতে পারে এবং যাতে তোমরা তাঁর অনুগ্রহ অনুসন্ধান করতে পারো। যেন তোমরা তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ হও।’ (সুরা : জাসিয়া, আয়াত : ১২)
আল্লামা ইবনে কাসির (রহ.) বলেন, উল্লিখিত আয়াতে ‘অনুগ্রহ অনুসন্ধান’ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো নৌবাণিজ্য ও সামুদ্রিক সম্পদ সংগ্রহ করা। (তাফসিরে ইবনে কাসির)
স্থলপথে বাণিজ্য কাফেলা পরিচালনা করা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সবচেয়ে প্রাচীন পদ্ধতি। এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘যেহেতু কুরাইশের আসক্তি আছে, আসক্তি আছে তাদের শীত ও গ্রীষ্মের সফরের। অতএব, তারা ইবাদত করুক এই ঘরের মালিকের, যিনি তাদের ক্ষুধায় আহার দিয়েছেন এবং ভয় থেকে তাদের নিরাপদ করেছেন।’ (সুরা : কুরাইশ, আয়াত : ১-৪)
তাফসিরবিদরা একমত যে এখানে বাণিজ্যিক সফরের কথা বলা হয়েছে।
এভাবে ওহির মাধ্যমে বিভিন্ন শিল্পের গোড়াপত্তন হয় এবং শিল্প-বাণিজ্যে অনুপ্রেরণা লাভ করা যায়। সূত্র : কালেরকণ্ঠ