‘প্রযুক্তির প্রাণ’ সেমিকন্ডাক্টর নিয়ে কতটুকু জানি?

- প্রকাশের সময় : ০৩:৪২:২৫ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৯ নভেম্বর ২০২৩
- / ৫২ বার পঠিত

টিভি, ফ্রিজ, ওয়াশিংমেশিন, মাইক্রোওভেন, রুম হিটার, রাইস কুকার, মোবাইল, ল্যাপটপ, ট্যাব, ক্যামেরা, রেকর্ডার, কলিংবেল, স্মার্ট লক; প্রযুক্তির যে পণ্যেরই নাম নেয়া হোক না কেন প্রতিটি পণ্যের প্রাণ হিসেবে কাজ করে সেমিকন্ডাক্টর। ছবি: সংগৃহীত
হককথা ডেস্ক : বিশ্ব চলছে সেমিকন্ডাক্টরের ওপরে। সেমিকন্ডাকটারকে বলা হয় ব্রেইন অব ইলেক্ট্রনিক্স অর্থাৎ প্রযুক্তির প্রাণ। অথচ সেমিকন্ডাক্টর কী, কীভাবে কাজ করে এবং আধুনিক মানুষের জীবনে এর প্রভাব কতখানি এ বিষয়ে অধিকাংশ মানুষই জানে না।
বর্তমান সময়ে একজন মানুষ পুরোপুরি সেমিকন্ডাক্টরের ওপর নির্ভরশীল। টিভি, ফ্রিজ, ওয়াশিংমেশিন, মাইক্রোওভেন, রুম হিটার, রাইস কুকার, মোবাইল, ল্যাপটপ, ট্যাব, ক্যামেরা, রেকর্ডার, কলিংবেল, স্মার্ট লক; প্রযুক্তির যে পণ্যেরই নাম নেয়া হোক না কেন প্রতিটি পণ্যের প্রাণ হিসেবে কাজ করে সেমিকন্ডাক্টর।
সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, আধুনিক দুনিয়ার একজন মানুষ প্রতিদিন গড়ে ১১৬টি সেমিকন্ডাক্টর চিপ ব্যবহার করেন। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ পল্লী সাহিত্য প্রবন্ধে বলেছিলেন, ‘বায়ু সাগরে বাস করে আমরা বুঝি না যে বাতাসের সমুদ্রে ডুবে আছি’; তেমনি নিজেদের জীবনের আষ্টেপৃষ্ঠে সেমিকন্ডাক্টরের সঙ্গতি থাকার পরেও মানুষ এর অস্তিত্ব টের পায় না।
শুধু ব্যক্তিগত জীবন না, বৃহৎ পরিসরে বিশ্ব বাণিজ্যের একটি বড় অংশ প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে সেমিকন্ডাক্টরের ওপরে নির্ভরশীল। তাই বিশ্বরাজনীতির অনেক বিষয়ও সেমিকন্ডাক্টর বাণিজ্য ঘিরে আবর্তিত হয়।
সেমিকন্ডাক্টর কী?
সিলিকনের প্লেট; যা সেলিকন ওয়েফার নামে পরিচিত তার ওপর সাজানো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ইলেকট্রিক ট্রানজিস্টর যা ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট (আইসি) বা মাইক্রোচিপ নামে পরিচিত; এদের সম্মিলিতভাবে বলা হয় সেমিকন্ডাক্টর। পকেটে থাকা ছোট মোবাইল বা পাতলা একটি ল্যাপটপ কিংবা এলইডি টিভি এই ছোট ছোট চিপের কল্যাণেই এত নিঁখুতভাবে কাজ করে। দিন যত যাচ্ছে সেমিকন্ডাক্টর শিল্পখাত তত বেশি আধুনিক হচ্ছে।
আগেকার সময়ে মোবাইল যেখানে ছিল একমাত্র কথা বলার মাধ্যম, বর্তমান সময়ে এসে সেটি পুরোদস্তুর পকেট কম্পিউটারের কাজ করছে। আবার এক সময়ে কম্পিউটার মানে যখন ছিল বর্গাকার বিশাল একটি যন্ত্র, এখন সেটি পাতলা প্লেটের মতো ল্যাপটপের আকার ধারণ করছে। ওজন কমেছে মোবাইল, ল্যাপটপ, টিভির; ব্যবহার হয়েছে আরও সহজ, আরামদায়ক এবং আগের থেকে অনেক বেশি আধুনিক।
অনেকের মনে প্রশ্ন জাগে, ক্যালেন্ডারের মতো পাতলা একটি টিভি কীভাবে এত কাজ করে। কিংবা এত ক্ষুদ্র একটি ক্যামেরা এত নিখুঁত ছবি কীভাবে তোলে?
আধুনিক প্রযুক্তির এসব বিস্ময়কর সাফল্য এসেছে সেমিকন্ডাক্টরের মাধ্যমে। ১৯৫০ সালে নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী উইলিয়াম শকলের হাত ধরে আধুনিক সেমিকন্ডাক্টরের যাত্রা। শকলে প্রথম ট্রানজিস্টর তৈরিতে সিলিকন ব্যবহার করা শুরু করেন। শকলে গবেষণা করে দেখেন ভোল্টেজের প্রবাহ বা অ্যাম্পলিফায়িংয়ের জন্য সিলিকন একটি চমৎকার পরিবাহী। এ ছাড়া বিদ্যুৎ সিগন্যাল বহন করা এবং সুইচ গেট হিসেবেই সিলিকনের ব্যবহার অনন্য। এই সিলিকনের হাত ধরেই সেমিকন্ডাক্টর বা চিপের যাত্রা শুরু।
সিলিকন ভ্যালি
বর্তমান যুগে এসে সিলিকন ভ্যালির নাম শোনেনি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দায়। মেটা, অ্যালফাবেট, মাইক্রোসফট, অ্যাপল, টেসলা কিংবা অ্যামাজনের মতো টেক জায়ান্টদের আঁতুরঘর এই সিলিকন ভ্যালি। এসব টেক জায়ান্টদের হাত ধরে পৃথিবীতে শুরু হয় ‘ইনফরমেশন যুগ’ যেখানে তথ্যের আদান-প্রদান হয়ে ওঠে এক রকমের বালখিল্য ব্যাপার। মূলত সেমিকন্ডাক্টরের চিপে সিলিকন ওয়েফার ব্যবহারের যে বৈপ্লবিক আবিষ্কার, তার হাত ধরেই যাত্রা শুরু সিলিকন ভ্যালির।
শকলে প্রথম ক্যালিফোর্নিয়ার সান ফ্রান্সিসকোতে নিজের চিপ নির্মাণ প্রতিষ্ঠান ফায়ারচাইল্ড প্রতিষ্ঠা করেন। এই ফায়ারচাইল্ডের এলাকা ঘিরেই মাউন্টেন ভিউতে গুগলের হেডকোয়ার্টার, কুপারটিনোতে অ্যাপল এবং মেনলো পার্কে ফেসবুকের মতো প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। পরবর্তীতে আমেরিকান সাংবাদিক ডন হোয়েফ্লেয়ার এই পুরো এলাকাকে নিজের একটি প্রতিবেদনে সিলিকন ভ্যালি বলে আখ্যায়িত করেন। সেই থেকে আজ অবধি প্রযুক্তির আঁতুরঘর এই সিলিকন ভ্যালি।
ইলিয়ান হোডেনসন এবং মাইকেল রিওডার্নের বিখ্যাত বই ক্রিস্টাল ফায়ারে প্রথম সিলিকন ভ্যালি শব্দটি ব্যবহার করা হয়। বইটিতে দেখানো হয়, সেমিকন্ডাক্টরের হাত ধরে কীভাবে রাতারাতি পৃথিবী বদলে যাবে। কীভাবে বিশ্বায়ন, বিশ্ববাণিজ্য, রাজনীতি ও অর্থনীতির মেরুদণ্ড হয়ে উঠবে এই অভাবনীয় চিপ। পুরো বিশ্ব এখন একটি খোলা মাঠের মতো, যার একদিক থেকে তাকালে আরেকদিক দেখা যায়। মানুষের এই শক্তিশালী দৃষ্টির মুখ্য উৎস সেমিকন্ডাক্টর।
সেমিকন্ডাক্টরের বাজার কত বড়?
দিন যত যাচ্ছে সেমিকন্ডাক্টরের বাজার তত বাড়ছে। মহামারি, যুদ্ধ-বিগ্রহ, অর্থমন্দা, মূল্যস্ফীতি, পাল্টাপাল্টি নিষেধাজ্ঞা ও মেরুকরণের মতো ঘটনার পরও ২০২২ সালে যে পরিমাণ সেমিকন্ডাক্টর বিক্রি হয়েছে তা ২০২১ সালে তুলনায় প্রায় সাড়ে ৩ শতাংশ বেশি।
সেমিকন্ডাক্টর ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের (এসআইএ) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২২ সালে মোট ৫৭৪ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের চিপ বেচাকেনা হয়েছে, ২০২১ সালে যার পরিমাণ ছিল ৫৫৫ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার।
এসআইএর প্রধান নির্বাহী জন নিউফার বলেন, ২০২২ সালে বড় রকমের উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে সেমিকন্ডাক্টর খাত। বছরের শুরুতে সব মিলিয়ে ভালো বেচাকেনা হলেও বৈশ্বিক অস্থিরতার কারণে মাঝে এসে চিপ বিক্রিতে ভাটা পড়ে। তবে বছর শেষে আবার উত্থানের মধ্য দিয়ে আগের বছরের রেকর্ড ভেঙে নতুন লাভের রেকর্ড গড়ে এ খাত।
সেমিকন্ডাক্টর এবং বিশ্ব রাজনীতি
সিলিকন ভ্যালি যুক্তরাষ্ট্রে গড়ে উঠলেও সেমিকন্ডাক্টর প্যাকেজিংয়ের বড় একটি অংশ গড়ে উঠেছে চীন এবং তাইওয়ানকে কেন্দ্র করে। যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা দেশগুলো নিজেদের প্রযুক্তি বাঁচিয়ে রাখতে এ ব্যাপারে সরাসরি দেশ দুটোর ওপরে সিংহভাগ নির্ভরশীল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের শীতল সম্পর্ক এবং তাইওয়ানের সঙ্গে চীনের দ্বন্দ্ব আগামীর প্রযুক্তি বাজার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বড় রকমের সংশয়ের সৃষ্টি করেছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পশ্চিমারা যেভাবে জ্বালানি ঘাটতির সম্মুখীন হয়েছিল, একইভাবে চীন-তাইওয়ান যুদ্ধ শুরু হলে পশ্চিমা প্রযুক্তিখাতে বড় রকমের ধস নামার আশংকা আছে।
সেমিকন্ডাক্টর খাতে চীন যাতে একচেটিয়া প্রভাব খাটাতে না পারে তাই গত বছর অক্টোবরের শুরুর দিকে যুক্তরাষ্ট্রের বাইডেন প্রশাসন নিভিডিয়া ও ওমডির মতো বড় বড় প্রতিষ্ঠানকে চীনে উন্নত প্রযুক্তির সেমিকন্ডাক্টর রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভয়- প্যাকেজিং এবং ম্যানুফেকচারিং এর সঙ্গে সঙ্গে চীন যদি যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তিও পেয়ে যায় তাহলে চীনকে ঠেকানো মুশকিল হয়ে যাবে।
তবে সেমিকন্ডাক্টর নিয়ে এ রাজনীতির খেলায় বিশ্ব প্রযুক্তির হুমকির মুখে পড়বে উল্লেখ করে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ানে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে নিভিডিয়ার প্রধান নির্বাহী জেনসেন হুয়াং জানান, পারস্পরিক বিশ্বাসের ঘাটতির কারণে সেমিকন্ডাক্টর খাত বড় রকমের হুমকির মুখে পড়বে। ২০২২ সালের নিষেধাজ্ঞার কারণে শুধু চীন-হংকংকেন্দ্রিক বাজারে বিক্রি কমেছে প্রায় ২০ শতাংশ।
এরইমধ্যে নিজেদের সেমিকন্ডাক্টরে স্বয়ংস্বম্পূর্ণতা অর্জনে নতুন শিল্পনীতি প্রণয়ন করেছে যুক্তরাষ্ট্র। অনেকে এ শিল্পনীতিকে সত্তরের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং আমেরিকার স্পেসশিপ প্রতিযোগিতার সঙ্গে তুলনা করছেন। অনেকে আবার বলছেন, সিল্ক নিয়ে চীন যেভাবে বিশ্ব বাজারে একাধিপত্য বিরাজ করেছিল, আমেরিকাও সেদিকে হাঁটার পরিকল্পনা করছে। সূত্র : সময় সংবাদ
হককথা/নাছরিন