ভয়-ডরহীন ক্রিকেট চাই
- প্রকাশের সময় : ০১:৪৬:৩১ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১ জুন ২০২৪
- / ৮০ বার পঠিত
চার দশক হতে চলল, ক্রীড়া সাংবাদিকতার রাস্তায় ছুটছি। ঢাকা থেকে শুরু করে জেলা শহর, শহরতলিতে ছুটেছি খেলার জন্য। ভালোলাগার জন্য। দেশের চৌহদ্দি পেরিয়ে ভিনদেশে উড়ে গিয়েছি, মেগা ইভেন্ট কভার করার জন্য। সর্বকালের সেরা ক্রীড়াবিদ মুহম্মদ আলী, ফুটবলের সর্বকালের সেরা দিয়েগো আরমান্দো মারাদোনা, মিশেল প্লাতিনি, বাতিগোল গাব্রিয়েল ওমর বাতিস্তুতা, বেবেতো, ইভান জামারানো, ক্রিকেটের গ্লামার বয় ইমরান খান, ভিভ রিচার্ডস, বিস্ময় প্রতিভা শচীন টেন্ডুলকার ও ব্রায়ান চার্লস লারা, টেনিসের পোস্টার বয় আন্দ্রে আগাসি, হকির মারাদোনা শাহবাজ আহমেদ… কত তারার সঙ্গে কথোপকথন, কত মধুর স্মৃতি জমা হয়ে আছে।
১৯৯৪ সালে বিশ্বকাপ ফুটবলের আয়োজন করেছিল, বাস্কেটবল- বেসবলের দেশ আমেরিকা। আর আমেরিকাকে আয়োজক হিসেবে বেছে নেওয়ার ক্ষণ থেকে দুনিয়া জুড়ে রব উঠেছিল—স্বাগতিক হিসেবে আমেরিকাকে বেছে নেওয়া ঠিক হয়নি। আমেরিকায় ফুটবলের তেমন কদর নেই। আমেরিকা বিশ্বকাপে দর্শক সাড়া দেবে না। ফুটবল বিশ্বকাপ তার গ্লামার হারাবে। জৌলুস হারাবে। ফিফার এমন সিদ্ধান্তের কড়া সমালোচনা করেছিল অনেকে। গা করেনি ফিফা, ফুটবলের সর্বোচ্চ সংস্থা।
যেদিন আমেরিকায় পা রেখেছি, প্রথম দর্শনে খুব একটা প্রচারণা চোখে পড়েনি বিশ্বকাপ ফুটবলের। বরং তার চেয়ে ঢের বেশি মাতামাতি এন বি এ ফাইনাল নিয়ে। নিউ ইয়র্ক নিক্স ও হিউস্টন রকেটস, পাঁচ ম্যাচের ফাইনাল নিয়ে পুরো আমেরিকা মেতেছে। যদিও ফাইনালে জায়গা করে নিতে পারেনি শিকাগো বুলস, তারপরও এন বি এর সেরা তারকাদের অন্যতম মাইকেল জর্ডানের ঢাউস সাইজের ছবি আর ছবিতে সয়লাব, হোর্ডিং আর বিলবোর্ড।
তবে বিশ্বকাপ ফুটবল মাঠে গড়ানোর পর ছবিটা পুরোপুরি বদলে যেতে দেখেছি। সমালোচকদের নির্বাক করে দিয়ে ফুটবল উন্মাদনায় গা ভাসিয়ে ছিলো পুরো আমেরিকা। শিকাগো, বষ্টন, নিউজার্সি, ডালাস, ওয়াশিংটন ডিসি এবং লস অ্যাঞ্জেলে, যেখানে গিয়েছিল স্টেডিয়াম মুখো মানুষের ঢল দেখেছি, ঢল।
ফাইনালের আগে বেভারলি হিলসে ফ্রান্স পার্টির জমকালো আয়োজনে ১৯৯৮ বিশ্বকাপ আয়োজক কমিটির নিউক্লিয়াস মিশেল প্লাতিনি সোজা-সাপটা বলেন, আমেরিকা বিশ্বকাপের তাক লাগানো আয়োজন করে চমকে দিয়েছে ফুটবল দুনিয়াকে। পাশাপাশি আমাদের কাজটা কঠিন করে দিলো। সত্যি, আমেরিকা বিশ্বকাপের সুন্দর আয়োজন প্রশংসা কুড়িয়েছিলো। এক বছর পর আটলান্টা অলিম্পিকে গিয়ে দেখেছি নজরকাড়া আয়োজন। বিশ্বকাপ ফুটবল ও অলিম্পিকের চমৎকার আয়োজন দেখে অনুমান করতে পারছি, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ক্রিকেট আয়োজনেও চমক দেবে, আমেরিকা।
ফিফা তামাম দুনিয়ায় ফুটবল ছড়িয়ে দেওয়ার পাশাপাশি ফিফার তহবিল সমৃদ্ধ করে তুলতে আমেরিকা ভারত চীনের বড় বাজারকে কাজে লাগানোর জন্য বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে। সে রাস্তায় হাঁটতে শুরু করেছে আইসিসি, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সর্বোচ্চ সংস্থা তার গ্লোবালাইজেশন প্রকল্প বাস্তবায়নের রাস্তায় হাঁটছে। পাশাপাশি আমেরিকার সুপার ডুপার অর্থবাজারে ক্রিকেট উপস্থাপন করছে, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আড়ালে। ক্রিকেট যেন এখন পুরোদস্তুর ব্যবসা, চারপাশে ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেটের পসরা সাজিয়ে বড় টাকায় জগেসরা ক্রিকেটারদের তুলে এনে মাস জুড়ে ধুম-ধারাক্কা ক্রিকেট আয়োজনে দর্শকদের মন রাঙানোর সব আয়োজন রাখছে। দর্শকরা মেতেছে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে। তারকা ক্রিকেটাররা সে রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে টেস্ট ও ওয়ানডে ক্রিকেটে খেলতে চাইছেন না। নানা বাহানা করে সরে দাঁড়াচ্ছে দেশের পতাকাতলে খেলার আগ্রহ হারাচ্ছে। অথচ নাম লেখাচ্ছে ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেটে।
চার দশকের ক্যারিয়ারে সাত সাতটি বিশ্বকাপ ফুটবল, বিশ্বকাপ ক্রিকেট, জোড়া অলিম্পিক, এশিয়ান গেমস, টেস্ট ক্রিকেট, এশিয়া কাপ ক্রিকেট কত কিছুর সঙ্গে জড়িয়েছি, সিনিয়র সিটিজেনের দরজায় দাঁড়িয়ে তার স্মৃতি হাতড়ে তুলে আনা মন্দ নয়। তবে হল্যান্ড, কেনিয়া ও মালয়েশিয়ায় আইসিসি ট্রফির টানা তিন আসরে কাছ থেকে দেখেছি আকরাম নান্নু বুলবুলদের লড়াকু মনোভাব। জয়ের খিদে। বিশ্বকাপে জায়গা করে নেওয়ার জেদ এবং অদম্য বাসনা। কিন্তু আইসিসি ট্রফি বা বিশ্বকাপ বাছাই পর্বে হল্যান্ডে শেষ চার, কেনিয়ায় সুপার সিক্স থেকে ছিটকে গিয়ে মাথা নিচু করে ডেরায় ফিরেছেন—আকরাম, বুলবুল, নান্নু, ফারুকরা। এক একটি ব্যর্থতা মনের ক্ষুধা তীব্র করে তুলেছিল, বেঙ্গল টাইগারদের। সাথে সংগঠকদের যাদুর ছোঁয়ায় সেদিনের ঢাকার ঘরোয়া ক্রিকেট স্ট্যান্ডার্ড আন্তর্জাতিক স্তরে ওপরের সারিতে জায়গা করে নিয়েছিল। ওয়াসিম আকরাম, সেলিম মালিক, ইজাজ আহমেদ, অর্জুনা রানাতুঙ্গা, সনত্ জয়সুরিয়া, গাস লোগি, নেইল ফেয়ার ব্রাদার, রিচার্ড ইলিংওয়ার্থ, ফিলিপ ডিফ্রিটাসদের বিরুদ্ধে আর পাশে খেলে খেলে ড্রেসিংরুম শেয়ার করে করে নিজেদের আত্নবিশ্বাসটা বাড়িয়ে নিয়েছিল, নান্নু, আকরাম, বুলবুলরা। সীমিত সুযোগ আর প্রচণ্ড জেদ ও বিলাসী স্বপ্নের বিশ্বকাপ অভিযানে নাম লেখানোর জন্য।
১৯৯৭ সালের ৮ এপ্রিল, সোনার হরফে লেখা দিন। কুয়ালালামপুরে ৭২ রানে স্কটল্যান্ডকে উড়িয়ে ফাইনালের পাশাপাশি স্বপ্নের বিশ্বকাপে খেলার টিকিট কনফার্ম করে, টিম টাইগার্স। কুয়ালালামপুরের উত্সবের রং ছড়িয়ে পড়ে পুরো দেশে। গোটা দেশ মেতে উঠে আনন্দ উত্সবে। আবার, ১৩ এপ্রিল রবিবার মরিস ওদুম্বে আসিফ করিমদের প্রতিরোধ গুঁড়িয়ে বৃষ্টি আইনে শেষ বলে আইসিসি ট্রফি জয় করে টিম টাইগার্স। সেদিন কুয়ালালামপুরের কিলাত ক্লাব আঙিনাকে এক টুকরো বাংলাদেশ বানিয়ে আকরাম, বুলবুল, নান্নু, সুজন, মনি, রফিক, আতহার, শান্ত, পাইলট, দুর্জয়, সানোয়ার, গুল্লা, জাহাঙ্গীর, জাকিররা দেশের ক্রিকেটের সাফল্যের যে ইতিহাস লিখেছিল, পুরো দেশ ভালোবাসায় রাঙিয়ে দেয় বিজয়ী বীরদের। ক্রিকেট সাফল্যের গল্প লেখার সেই শুরু।
আইসিসি ট্রফি জয়ের পর তর তর করে এগিয়ে চলে ক্রিকেট। পেছনে ঠেলে দেয় আকাশ ছোঁয়া উচ্চতায় ছুটতে থাকা মোনেম মুন্না, আসলাম, ওয়াসিম, সাব্বির কায়সারদের ফুটবলকে। আবার বিশ্বকাপ ক্রিকেটের মহামঞ্চে পরাশক্তি পাকিস্তানকে হারিয়ে চমকে দেয় ক্রিকেট দুনিয়াকে। এবং নিজেদের দক্ষতাকে অন্য উচ্চতায় তুলে আনেন আকরাম, নান্নুরা।
সে অনেক পুরোনো কথা, কিন্তু গর্ব করা স্মৃতি। সোনার স্মৃতি। তারপর অনেক পানি গড়িয়েছে পদ্মায়। গর্বের পদ্মা ব্রিজ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে, এক অভাবনীয় সাফল্যের স্মারক হয়ে। মাথার ওপর দিয়ে ছুটছে মেট্রোরেল দ্রুতলয়ে। চারপাশে উন্নয়নের ছোঁয়া। দিন বদলের ছাপ সুস্পষ্ট।
কিন্তু, তুলনায় স্বপ্নের ক্রিকেট?
বদলায়নি খুব একটা। বিশেষ করে টি-টোয়েন্টি ফরমেট, যেন আজও আমরা নার্সারী ক্লাসে। ঘরের মাঠ এবং চেনা পরিবেশকে কাজে লাগিয়ে ক্রিকেটের বড় বড় প্রতিপক্ষকে উড়িয়ে সাময়িক তৃপ্তি নিচ্ছি। সেই আনন্দ উৎসবের রং বিবর্ণ হয়ে ওঠে ভিনদেশের মাঠে। ভিন্ন কন্ডিশনে। আর তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, আমাদের অবস্থান ঠিক কোন জায়গায়।
মার্কিন মুল্লুকে ভয়-ডরহীন ক্রিকেটের বিশ্বকাপের দামামা বাজছে। নাজমুল শান্ত, সাকিব আল হাসান, মুস্তাফিজ, শরিফুল, লিটন, সৌম্য, মাহমুদউল্লাহ, তৌহিদ হূদয়, জাকের আলি, রিসাদদের সাদামাটা পারফরম্যান্স আন সিডেড আমেরিকার বিপক্ষে লজ্জার হার, হতাশায় ডুবিয়েছে ক্রিকেটপ্রিয়দের। আমেরিকার কাছে সিরিজ হেরে বিশ্বকাপের অভিযানে নামছে টিম টাইগার্স। চারপাশে সমালোচনার ঢেউ। দল নির্বাচন ঠিক হয়নি। যথাযথ হয়নি। নিজেদের মতো করে রং লাগিয়ে সমালোচনা মুখর ক্রিকেটপ্রিয়রা।
গা-গরমের ম্যাচ, আমেরিকার সঙ্গে সিরিজ হার, ঘরের মাঠে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সাদামাটা পারফরম্যান্স সব কিছু সরিয়ে রেখে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে সাকিব, শান্ত, মুস্তাফিজ, তাওহীদ, জাকের লিটন, সৌম্য, তামিম, তাসকিনদের কাছে ভয়-ডরহীন ক্রিকেট চাই। জয় চাই। জয়। চার ছয়ে বল ফেলবে সীমনার বাইরে। আবার ২২ গজের জমিটায় অফকাটার আর ইয়র্কার স্পিনের মায়াবী জাল বিছিয়ে টপাটপ প্রতিপক্ষের উইকেট তুলে নেবে সে ছবিটাই দেখছি। আর চাইছি। মোদ্দা কথা, জয় চাই, জয়। ১২০ বলের ধুন্ধুমার ক্রিকেটে ফেভারিট আর আন্ডার ডগ বলে কিছু নেই। নিজেদের সেরা দিনে যে কোনো দেশ যে কোনো প্রতিপক্ষকে হতাশায় ডুবিয়ে নতুন ইতিহাস লিখতে পারে। আর সে ইতিহাস লেখার মতো প্রতিভা টাইগার শিবিরে রয়েছে। ঠিক সময়ে জ্বলে উঠতে হবে, তবেই না আনন্দের উপলক্ষ্য আটলান্টিক পেরিয়ে পদ্মাপাড়ে আছড়ে পড়বে। এমন অভিলাষ শুধু আমার নয়, দেশের প্রতিটি মানুষের। সূত্র: ইত্তেফাক।