যে ফুটবল ম্যাচের রেশ দুই প্রতিবেশীর যুদ্ধে
- প্রকাশের সময় : ১১:১৮:২৯ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৩ জুলাই ২০১৬
- / ৬৮৬ বার পঠিত
ঢাকা: ফুটবল। শব্দটা বললেই মনে আসবে মাঠে ৯০ মিনিটজুড়ে দুই দলের প্রতিদ্বন্দ্বিতা। গোলের লড়াই। লড়াইটা সমানে-সমান হলে দুকূল ছাপানো শ্বাসরুদ্ধকর উত্তেজনা। কখনো কখনো তাতে আবেগের আতিশয্যও থাকে, থাকে ‘অ্যাড্রেনালিন রাশ’। মাঠে দুই দলের খেলোয়াড়দের হাতাহাতি, তর্কাতর্কিও তাই অনিয়মিত নয়। কিন্তু তাই বলে দুটি প্রতিবেশী দেশের যুদ্ধের পেছনে একটা ফুটবল ম্যাচের বড় ভূমিকা, এমন কখনো শুনেছেন? এমনটাই হয়েছে ঠিক ৪৭ বছর আগে। এমনই যে ম্যাচটিকে ডাকাই হয় ‘ফুটবলযুদ্ধ’! যদিও শুধু একটা ম্যাচের কারণে নয়, যুদ্ধের কারণটা ছিল অনেক গুরুতর। ঘটনাটা ১৯৬৯ সালের। বিশ্বকাপ বাছাইয়ের ম্যাচে মুখোমুখি হওয়ার কথা ছিল দুই মধ্য-আমেরিকান দেশ হন্ডুরাস ও এল সালভাদরের। অবশ্য ম্যাচের আগেই অভিবাসন সমস্যা ও ভূমির বণ্টন নিয়ে দুই দেশের মধ্যে ছিল রাজনৈতিক উত্তেজনা। ভৌগোলিকভাবে এল সালভাদরের চেয়ে পাঁচ গুণ বড় ছিল হন্ডুরাস। কিন্তু সে সময় জনসংখ্যায় আবার এল সালভাদর ছিল হন্ডুরাসের দ্বিগুণ। জনসংখ্যা বেশি, ভূমি কম—ঝামেলা এড়াতে বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই সালভাদোরিয়ানরা দেশ ছেড়ে হন্ডুরাসের উদ্দেশে পাড়ি জমাতে শুরু করে। এতে যা হলো, ১৯৬৯ সালের মধ্যেই দেখা গেল, প্রায় তিন লাখ সালভাদোরিয়ান দিব্যি হন্ডুরাসে বসতি গেড়ে বসেছে। অবশ্য এই তিন লাখও হয়েছে হন্ডুরাসের ‘ভূমি সংস্কার’ প্রকল্পের পর। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চাপের কারণে ১৯৬২ সাল থেকেই হন্ডুরাস নতুন করে নিজেদের ভূমি সংস্কার শুরু করেছিল। যে সংস্কারের কারণে পাঁচ বছরের মধ্যেই হাজারো সালভাদোরিয়ান অভিবাসীকে দেশে ফেরত পাঠায় হন্ডুরাস, আর তাদের দখলে থাকা জমি বণ্টন করে দেয় হন্ডুরানদের মধ্যে। অভিবাসন ও ভূমি বণ্টনের এই ঝামেলার কারণে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কটা কখনোই উষ্ণ ছিল না। এ কারণে ১৯৭০ বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে যখন দুই দেশ মুখোমুখি হলো, উত্তেজনা চরমে পৌঁছে যায়। প্রথম লেগ হলো হন্ডুরাসের রাজধানী তেগুচিগালপায়। ১৯৬৯ সালের ৮ জুনের সেই ম্যাচে স্বাগতিকেরা জেতে ১-০ গোলে। ওই ম্যাচেও দুই দলের সমর্থকদের মধ্যে কিছু সংঘর্ষ হয়েছিল। তবে তখনো বোঝা যায়নি, দ্বিতীয় লেগে পরিস্থিতির কী অবনতি হতে যাচ্ছে! সাত দিন পর সালভাদরের রাজধানী সান সালভাদরে অনুষ্ঠিত সেই ম্যাচের আগে হন্ডুরান খেলোয়াড়দের ভয়ংকর অভিজ্ঞতার মধ্য দিতে যেতে হয়েছিল। ১৯৭৮ সালে পোলিশ সাংবাদিক রিজার্ড কাপুসিনস্কির লেখা বই ‘ওনজা ফুতবলোয়া’ (ফুটবলযুদ্ধ) থেকে জানা যায়, হন্ডুরান খেলোয়াড়েরা ম্যাচের আগের দিন রাতে এক ফোঁটাও ঘুমোতে পারেননি। ঘুমোবেন কী করে? যে হোটেলে তাঁরা ছিলেন, পুরো রাত ধরে সেটিতে পঁচা ডিম, মৃত ইঁদুরের দেহ, দুর্গন্ধযুক্ত কাপড় ছুড়ে মেরেছিলেন সালভাদর–সমর্থকেরা। ম্যাচেও হন্ডুরান খেলোয়াড়দের ওপর ইচ্ছাকৃতভাবে ফাউলের পর ফাউল করা হয়েছিল। পুরো ম্যাচেই হন্ডুরাসের জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সংগীত নিয়ে গ্যালারি থেকে উল্টা–পাল্টা স্লোগান দিয়ে গেছে সালভাদোরিয়ানরা। দাঙ্গা–হাঙ্গামা হয়েছে ম্যাচের পরেও, যাতে প্রাণ যায় তিন সালভাদরিয়ানের। ম্যাচের ফল? সালভাদর ৩ : ০ হন্ডুরাস।
ম্যাচের পরিস্থিতিটা কী ছিল, সেটি বোঝা যায় হন্ডুরাস কোচ মারিও গ্রিফিনের কথায়, ‘এমন পরিস্থিতিতে আমার খেলোয়াড়েরা ম্যাচে মনোযোগই দিতে পারেনি। তাদের চিন্তায় ছিল তারা বেঁচে ফিরতে পারবে কি না। ভয়ংকর হলেও সত্যি, আমরা অনেক বেশি ভাগ্যবান যে আমরা হেরেছি!’
এর ১২ দিন পর, ২৭ জুন, দুই দল মেক্সিকো সিটিতে মুখোমুখি হয় প্লে-অফে। প্রতিবেশী দেশ দুটির মধ্যে উত্তেজনা এতটাই চরমে পৌঁছেছিল যে ম্যাচের দিনই এল সালভাদরের সঙ্গে সব ধরনের কূটনৈতিক সম্পর্ক বাতিল করে হন্ডুরাস। উত্তেজনা ছিল ম্যাচেও। অতিরিক্ত সময়ে গড়ানো সেই ম্যাচে ৩-২ গোলে জিতে এল সালভাদর। এরপর কনক্যাকাফ অঞ্চলের ফাইনাল প্লে-অফে হাইতিকেও হারিয়ে ১৯৭০ বিশ্বকাপের টিকিট পায় (বিশ্বকাপে অবশ্য গ্রুপ পর্বের তিন ম্যাচেই হেরে বিদায় নেয় সালভাদর, একটিও গোল করতে পারেনি)।
ওই প্লে-অফই যেন ছিল ঝড়ের আগের শেষ মুহূর্তের নিস্তব্ধতা। সীমান্তে ছোট ছোট লড়াই তো চলছিলই। কিন্তু ওই ম্যাচের ১৬ দিন পর, ১৪ জুলাই, হন্ডুরাস আক্রমণ করে বসে এল সালভাদর। শুরু হয়ে যায় যুদ্ধ, রক্তের হোলি। ছয় দিন ধরে চলা সেই যুদ্ধে প্রাণ হারায় প্রায় দুই হাজার মানুষ, আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে লাখ খানেক। আমেরিকান রাষ্ট্রগুলোর সংগঠনের (ওএএস) মধ্যস্থতায় ২০ জুলাই দুই দেশ যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়। যদিও ২ আগস্টের আগে সালভাদর তাদের সৈন্যদের হন্ডুরান সীমানা থেকে সরিয়ে নেয়নি। দুই দেশের মধ্যে শান্তিচুক্তি হয় তারও ১১ বছর পর।
যুদ্ধটা ফুটবলের কারণে হয়নি। তবে ফুটবল ম্যাচকে ঘিরেই উত্তেজনার পারদ চড়েছিল উঁচুতে। শুরু হয়েছিল রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। যে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল এই ১৪ জুলাই। ফুটবল–ইতিহাসের কলঙ্কময় অধ্যায়গুলোর একটির ৪৭তম বর্ষপূর্তি আজ। তথ্যসূত্র: গার্ডিয়ান।