ভারতে বিশ্বকাপ উন্মুক্ত
- প্রকাশের সময় : ০৮:১১:৩০ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১০ অক্টোবর ২০২৩
- / ৪৮ বার পঠিত
ক্রীড়া ডেস্ক : ভারতে আইসিসি ওয়ানডে বিশ্বকাপ শুরু হয়েছে আশঙ্কা, অনিশ্চয়তা, সম্ভাবনা এবং বিভিন্ন ধরনের অনুধ্যানকে সঙ্গী করে। ৫ অক্টোবর আহমেদাবাদে নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামে শুরু হয়েছে এশিয়ায় বহুল প্রতীক্ষিত সাদা বলের বিশ্বকাপ। ১৯ নভেম্বর আবার এই স্টেডিয়ামে ফাইনাল ম্যাচ অনুষ্ঠিত হওয়ার মাধ্যমে রোমাঞ্চকর বিশ্বকাপ উৎসব সাঙ্গ হবে। শুরু এবং সমাপনী খেলা একই স্টেডিয়ামে কেন, এর মধ্যে ভারতের রুলিং পার্টি বিজেপির রাজনীতির গন্ধ খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা হয়েছে। ওয়ানডে ক্রিকেট এখন টি-টোয়েন্টির প্রভাবে অনেক বেশি আক্রমণাত্মক। খেলার দর্শন আর উপলব্ধি পাল্টে গেছে। ভারতের বিরাট জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশের কাছে ক্রিকেট ধর্মের সমতুল্য। আর বাংলাদেশের বাঙালিদের কাছে জাতির ঐক্যের প্রতীক। খেলাটি বাঙালির জীবনে নতুন গতির সঞ্চার করেছে। ক্রিকেট দেশপ্রেমকে উসকে দিতে ভূমিকা রাখছে। ঐতিহ্যগতভাবে বাংলাদেশ সীমিত ওভারের খেলায় বেশি অভ্যস্ত। ভালো খেলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সাদা বলের ক্রিকেটে এর প্রমাণও রেখেছে।
চলমান বিশ্বকাপকে বলা হচ্ছে উন্মুক্ত বিশ্বকাপ। ফ্রেমে ধরে রাখা দলগুলোর বাইরে নতুন কোনো দলের নাম ১৯ নভেম্বর অন্তর্ভুক্ত হতে যাচ্ছে না এটি অনেকটা নিশ্চিত। এশিয়ায় অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপকে ঘিরে পণ্ডিতরা তাদের পর্যবেক্ষণে অনেক বেশি সতর্কতা অবলম্বন করেছেন। ভারতকে অধিকাংশের ‘ফেভারিট’ বলার পেছনে বড় কারণ হলো এই দলটি তাদের নিজস্ব দলীয় শক্তিকে ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। ইনজুরি এবং অফফর্মের বিষয়টি সামাল দিতে সক্ষম হয়েছে সবচেয়ে ভালোভাবে। আর তাই তারা সবচেয়ে ভারসাম্যময় দল হিসেবে চিহ্নিত হয়ে নিজ মাঠে খেলছে।
ছেচল্লিশ দিনব্যাপী ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় বৈশ্বয়িক টুর্নামেন্টে এশিয়া থেকে খেলছে পাঁচটি দেশ- ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, বাংলাদেশ এবং আফগানিস্তান। আর এশিয়ার বাইরে থেকে অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, সাউথ আফ্রিকা এবং নেদারল্যান্ডস।
কন্ডিশনের বিবেচনায় স্বাগতিক ভারত এবং এশিয়ার অপর চারটি দেশ বাইরের দেশগুলো থেকে ভালো অবস্থানে আছে। এটি বাস্তবতা। ভারতের উইকেটের আচরণের সঙ্গে এশিয়ার অন্যান্য দেশের উইকেটের যথেষ্ট মিল আছে। বাংলাদেশ এর ব্যতিক্রম নয়। ভারতের ‘কিউবেটর’ বলেছেন, এবার বিশ্বকাপে রান দেখার সুযোগ মিলবে, যা দর্শকরা চান। এ ক্ষেত্রে কিন্তু প্রতিটি দেশের ব্যাটসম্যানদের দায়িত্ব বেড়ে যাচ্ছে। বেড়ে যাচ্ছে উইকেটে পৌঁছে দায়িত্বশীল আচরণ। ভারতে চলমান ওয়ানডে বিশ্বকাপ হচ্ছে- আগের সব বিশ্বকাপ থেকে ব্যতিক্রমী। এখানে সময়ের চাহিদা পূরণ পরিলক্ষিত হবে। ক্রিকেটকে অবলম্বন করে বাণিজ্যের পুরনো রেকর্ড ভেঙে গেছে। এবারের বিশ্বকাপে বাণিজ্যের জয়জয়কার।
অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড ভারতের কন্ডিশনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য নিয়মিতভাবে ভারতে এবং আশপাশের দেশগুলোর বিপক্ষে দ্বিপাক্ষিক সিরিজ খেলেছে। কন্ডিশনের সঙ্গে অভ্যস্ত হওয়ার জন্য এটি তাদের সর্বাত্মক চেষ্টা। তবে ভারতের সব ভেন্যুর উইকেটে আচরণ কিন্তু এক রকম হবে না।
ভারত, পাকিস্তান আর শ্রীলংকা এশিয়া থেকে, আর এশিয়ার বাইরে থেকে অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজ বিশ্বকাপ ট্রফি ছোঁয়ার শিহরণ অনুভব করেছে বিগত বছরগুলোতে। গত বিশ্বকাপে ইংল্যান্ড নিজ মাটিতে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ শিরোপা জিতেছে। এবার ভারতে তারা শিরোপা ধরে রাখতে পারবে কি- এটি এখন অনেক বড় প্রশ্ন। ১৯৭৫ সালে প্রথমবারের মতো আয়োজিত আইসিসি বিশ্বকাপে ট্রফি জিতেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এর পর ১৯৭৯ সালেও তারা ট্রফি জিতেছে। তবে ভারতে অনুষ্ঠিত চলমান বিশ্বকাপে তারা নেই। তারা পারেনি সামর্থ্যরে প্রতি সুবিচার করে ‘কোয়ালিফাইং’-এর বেড়া অতিক্রম করে মূল মঞ্চে আসতে। এবার কোয়ালিফাইং রাউন্ডে সাহসের সঙ্গে ভয়ডরহীন ক্রিকেট খেলে চূড়ান্ত মঞ্চে স্থান করে নিয়েছে শ্রীলংকা এবং নেদারল্যান্ডস। সবচেয়ে বেশি পাঁচবার ওয়ানডে বিশ্বকাপ ট্রফিটি মাথার উঁচুতে তুলে ধরার সম্মানে সম্মানিত হলো ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া। বলা হয়ে থাকে তারা সব সময় জেতার মানসিকতা নিয়ে খেলে। মাঠে শেষ বল পর্যন্ত লড়াই করে। খেলার প্রতি ভালোবাসাই তাদের সাফল্যের মূলমন্ত্র। ইনজুরিকে সামাল দিয়ে অস্ট্রেলিয়া কি ভারত থেকে ট্রফি জিততে পারবে। নিউজিল্যান্ড ২০১৫ ও ২০১৯-এর বিশ্বকাপে রানার্সআপ হয়েছে। এবার বিশ্বকাপ শুরুর আগে থেকেই ইনজুরি সমস্যায় ভুগছে। শুরুর আগেও ধাক্কা খেয়েছে আবার। এতে করে দলের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। ফাস্ট ইলেভেন গঠনের চিন্তায় যখন বাধা আসে- তখন যে কোনো দল বদলি খেলোয়াড় নিয়েও সাফার করে। তবে নিউজিল্যান্ড কিন্তু সেই দল যারা ঝলসে উঠলে দুর্দান্ত ক্রিকেট খেলে। ইংল্যান্ডের জন্য নিউজিল্যান্ড বড় চ্যালেঞ্জ।
বিশ্বকাপ অনেক লম্বা একটি যাত্রা। প্রতিটি দলকে খেলতে হবে নয়টি করে খেলা। এটি অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। ফর্ম ধরে রেখে, ক্লান্তিকে দূরে সরিয়ে রেখে পারফর্ম করতে হবে। সেমিফাইনালের স্বপ্নের বন্দরে পৌঁছাতে হলে যে কোনো দলকে ছয়-সাতটি খেলায় জেতা ছাড়া কোনো উপায় নেই। বিশ্বকাপ চলাকালীন বৃষ্টির আশঙ্কা আছে। এতে করে কোনো দল ক্ষতিগ্রস্ত হবে, কেউ আবার লাভবান হবে। এটি মেনে নিয়েই সব দল খেলা হয়তো শুরু করেছে। ক্রিকেটের বড় মঞ্চে সামর্থ্যরে সঙ্গে ভাগের রঙ দরকার।
বাংলাদেশের লক্ষ্য এবার বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে খেলা। এটি অনেক বড় স্বপ্ন। বড় স্বপ্ন দেখতে হবে- পাশাপাশি বাস্তবতাকে মেনে নিতে হবে। বাংলাদেশের দলগত শক্তিতে এবার বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে খেলা সম্ভব নয়। বাংলাদেশের উচিত সবাই মিলে শুধু ক্রিকেটের মধ্যে থেকে দায়িত্বশীল ক্রিকেট খেলে যতটুকু সম্ভব সামনে এগোনো এবং বেশি ম্যাচে জয়লাভ করা।
দেশের যেসব ক্রিকেট বিশেষজ্ঞ এবং পণ্ডিতরা বিভিন্ন ধরনের স্ববিরোধিতার মধ্যে হাবুডুবু খেয়েছেন, এর পর বিভিন্ন ধরনের নিজস্ব হিসাব মাথায় রেখে লিখছেন, কথা বলছেন তাদের উচিত হবে অযথা ইনিয়েবিনিয়ে আশা না দেখানো। এতে করে পরবর্তী সময়ের সাধারণ মহলে নতুন করে হতাশার জš§ হবে। দেশের সরকারপ্রধান খেলাধুলা ভালোবাসেন, ক্রীড়াঙ্গনের সব খবর রাখেন- তাকে অযথা কেন সর্বক্ষেত্রে টেনে আনা হবে। তিনি তো সব সময় দেশের ক্রিকেটের পাশে আছেন এবং থাকবেন। সবার উচিত বিভিন্ন ধরনের বিদ্বেষ, হিংসা, নীচুমনতা, নোংরামি এবং ব্যক্তি ও সমষ্টির মতলব হাসিল থেকে বিরত থাকা। ক্রিকেটে সিন্ডিকেট সৃষ্টি, ক্রিকেট নিয়ে রাজনীতি, বিভিন্নভাবে উসকানির জš§- দেশের ক্রিকেট সংহতিতে আঘাত করে। এই বিষয়গুলোর প্রভাব পড়ে খেলোয়াড়দের মাঠের পারফরম্যান্সে। দু-তিনজন খেলোয়াড়, সংগঠক এবং টেকনিক্যাল পারসন থেকে দেশের স্বার্থ অনেক বড়। ক্রিকেটে গত কিছুদিনে অনেক কিছুই ঘটেছে। যেটা বাঞ্ছনীয় নয়। সমালোচনা এবং বিশ্লেষণ থাকবে, থাকতে হবে। সব দেশে আছে। কিন্তু আমাদের ক্রিকেটে স্কোয়ার্ড গঠন নিয়ে যেভাবে হইচই হয়েছে এবারকার বিশ্বকাপে আরও যে নয়টি দেশ অংশ নিচ্ছে তাদের এ রকম অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়নি। আমাদের উচিত- বিশ্বকাপ শুরু হয়ে গেছে, সবার দলের পেছনে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দাঁড়ানো। দেশের সতেরো কোটি মানুষের দোয়া এবং ভালোবাসা তাদের পেছনে আছে। মানুষ তখনই জ্বলে ওঠে যখন তারা খেলোয়াড়দের মধ্যে নিজ দেশকে দেখতে পায়। মানুষ এখন অনেক বেশি সচেতন, তারা বোঝেন তামিম এবং সাকিবকে বিজ্ঞাপনে কেন একসঙ্গে দেখা যায়। অথচ খেলার মাঠে কেন দেখা যাচ্ছে না।
সাকিব আল হাসানের নেতৃত্বে দলের সবাইকে লড়তে হবে সেরা সাফল্য উজাড় করে। সাকিব চাপের মুখে শুধু ভালো খেলেন না। ‘ম্যাচ রিড’ এবং দলকে ভালোভাবে নেতৃত্ব দিতে অভ্যন্ত। খেলতে হবে দলের পরিকল্পনা অনুযায়ী দায়িত্বশীল ক্রিকেট। ওপেনিং জুটি ভালোভাবে শুরু করা, পার্টনারশিপ গড়ে খেলা। ভারতের প্রতিটি উইকেটে বড় রানের ইনিংস গড়ার বিকল্প নেই। পেসার এবং স্পিনারদের লাইন, লেন্থ, ফ্লাইট ধরে রেখে মাথা খাটিয়ে বল করা। আর ত্বরিত গতিসম্পন্ন ফিল্ডিং পারবে বাংলাদেশকে বিশ্বকাপে একটি সম্মানজনক অবস্থানে স্থান করে দিতে। ১৯৯৯ সাল থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত একক বিশ্বকাপে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ তিনটির বেশি ম্যাচ জিততে পারেনি। এবার চেষ্টা হোক ধারাবাহিকতার সঙ্গে খেলে অতীতকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়া। অধৈর্য মনে যারা ভাবছেন বাংলাদেশ আর কবে বিশ্ব ক্রিকেট মঞ্চ আলোকিত করবে। না, এখনো সেই সময় হয়নি। অবশ্যই বাংলাদেশ এক সময় করবে।
ধর্মশালায় বাংলাদেশ প্রথম ম্যাচে আফগানিস্তানের বিপক্ষে দাপটের সঙ্গে ৬ উইকেটে জিতেছে। অনেকের কাছে তো এটি অবাঞ্ছনীয় ছিল। বাংলাদেশের ছেলেরা কিন্তু খেলে জিতেছে। জয় সব সময় আত্মবিশ্বাস বাড়ায়। সামনে একটির পর একটি পরীক্ষা দিতে হবে। কন্ডিশনের সঙ্গে মানিয়ে খেলতে হবে বিভিন্ন ভেন্যুতে। করতে হবে আরও ভালো ব্যাটিং, বোলিং এবং ফিল্ডিং।
ইকরামউজ্জমান : কলামিস্ট ও বিশ্লেষক; সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি, এআইপিএস এশিয়া; আজীবন সদস্য, বাংলাদেশ স্পোর্টস প্রেস অ্যাসোসিয়েশন। সূত্র : আমাদের সময়