নিউইয়র্ক ০৫:২৮ অপরাহ্ন, রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

ভারত-মালদ্বীপ বিতর্কের পেছনে ভূ-রাজনীতি

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০৬:২৫:৪৫ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৮ জানুয়ারী ২০২৪
  • / ৫৫ বার পঠিত

চীন সফরে দেশটির প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুইজ্জু। ছবি : রয়টার্স

আন্তর্জাতিক ডেস্ক : কয়েক মাস আগে শিখ খলিস্তান আন্দোলনের এক নেতা নিহত হওয়ার পর ভারতের সঙ্গে কানাডার কূটনৈতিক বিতর্ক শুরু হয়। সেই বিতর্ক এখনো চলছে। দুই পক্ষই নিজেদের অবস্থানে অনড়। এবার প্রতিবেশী দেশ মালদ্বীপের সঙ্গে কূটনৈতিক দ্বন্দ্বে জড়িয়েছে ভারত। কূটনীতিকরা বলছেন, আরও অনেক প্রতিবেশীর মতো মালদ্বীপও ভারত থেকে খানিকটা চীনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। ভারতের সেনাবাহিনীকে মালদ্বীপ থেকে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। দেশটির প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুইজ্জু ভারতবিরোধী ও চীনপন্থি বলে পরিচিত। চীন সফর থেকে ফিরেই তিনি ভারতের বিরুদ্ধে সুর চড়িয়েছেন। এতে এ বিতর্কে ভূ-রাজনৈতিক সম্পর্ক আরও স্পষ্ট হয়েছে।

নতুন বছরের শুরুতে লাক্ষাদ্বীপ সফরে গিয়েছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এই সফরের ছবিগুলো তার অফিসিয়াল এক্স হ্যান্ডেলে পোস্ট করা হয়। ছবি পোস্ট করে মোদি লিখেছেন, ‘যারা দুঃসাহসকে আলিঙ্গন করতে চায় তাদের জন্য লাক্ষাদ্বীপ আপনার তালিকায় থাকতেই হবে।’ আরব সাগরের বুকে ৩৬টি দ্বীপ-সংবলিত লাক্ষা দ্বীপপুঞ্জ দক্ষিণ ভারতের কেরালা রাজ্যের উপকূলে অবস্থিত। এর পশ্চিমে রয়েছে মালদ্বীপ, যা এক হাজার ১৯২টি দ্বীপের সমষ্টি। লাক্ষাদ্বীপ ও মালদ্বীপ উভয়ই পর্যটকদের পছন্দ, তবে ধনীদের কাছে মালদ্বীপই বেশি পছন্দের। কার্যত ভারতের প্রধানমন্ত্রী লাক্ষাদ্বীপের পর্যটনের প্রচারই করেছেন। এরপর উগ্রপন্থি ভারতীয় ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা ছুটি কাটাতে মালদ্বীপ ছেড়ে লাক্ষাদ্বীপে যাওয়ার প্রচার চালাতে থাকে।

মোদি তার পোস্টে মালদ্বীপের কোনো উল্লেখ করেননি। যা হোক, লাক্ষাদ্বীপ নিয়ে তার পোস্টের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মোদির কিছু সমর্থক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দাবি করেন, তার এ সফর পর্যটকদের কাছে দ্বীপমালাটির আকর্ষণ বাড়াবে। এমনকি তারা লাক্ষাদ্বীপকে মালদ্বীপের বিকল্প পর্যটনস্থল হিসেবেও দাবি করেন। কেউ কেউ মালদ্বীপের বদনামও করতে থাকেন। যেমন ‘মিস্টার সিনহা’ নামে একটি অ্যাকাউন্টে, যিনি এক্সে নিজেকে একজন ‘ভারতীয় রাজনৈতিক বক্তা’, ‘হিন্দু অধিকার কর্মী’ এবং ‘গর্বিত ভারতীয়’ হিসেবে বর্ণনা করেন। মোদির চমৎকার পদক্ষেপের প্রশংসা করে তিনি লেখেন, ‘এর ফলে লাক্ষাদ্বীপে পর্যটন উৎসাহিত হবে। এটি মালদ্বীপে চীনের নতুন পুতুল সরকারের জন্য একটি বড় ধাক্কা।’ পোস্টটি ৩২ লাখ বার দেখা হয়েছে।

মুহূর্তের মধ্যে ভারত ও মালদ্বীপের নাগরিকদের পোস্টের ঢেউ, যাদের অনেকেই মোদি বা মুইজ্জু সরকারের সমর্থক, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যে মালদ্বীপের যুব ক্ষমতায়ন, তথ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের তিনজন উপমন্ত্রী– মরিয়ম শিউনা, মালশা শরিফ ও মাহজুম মজিদ এ কাদা ছোড়াছুড়িতে জড়িয়ে পড়েন। শিউনা মোদিকে ‘লাইফ জ্যাকেট পরা ডুবুরি’ বলে উপহাস করেন এবং তাকে ‘ক্লাউন’, ‘সন্ত্রাসী’ এবং ‘ইসরায়েলের পুতুল’ হিসেবেও বর্ণনা করেন। একই পোস্টে তিনি ভারতকে গোবরের সঙ্গে তুলনা করেন। এ সবই ভারতকে ক্ষেপিয়ে তোলে।

এদিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয় যখন ভারত ও মালদ্বীপের লোকেরা একে অন্যকে অপমান করতে থাকে। ভারতীয় চলচ্চিত্র তারকা, ক্রিকেটার এবং অন্য সাধারণ মানুষ ভারতীয়দের প্রতি মালদ্বীপকে বয়কট করতে এবং ভারতীয় পর্যটন স্পটে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে পোস্টের পর পোস্ট করতে থাকেন। দ্রুত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ বয়কট ট্রেন্ড শুরু হয়ে যায়।

কোনো দেশের প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে অন্য দেশের দায়িত্বশীল মন্ত্রী এ ধরনের মন্তব্য করতে পারেন না। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ভারত তার তীব্র নিন্দা করেছে। মালদ্বীপের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে পাঠানো হয়েছে। মালদ্বীপ একবার নয়, বারবার স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছে, তারা এ ধরনের মন্তব্য স্বীকার করে না। যাদের বিরুদ্ধে কুরুচিকর মন্তব্যের অভিযোগ উঠেছিল, দ্রুত তাদের সকলকে বরখাস্ত করা হয়েছে।

পর্যটন হলো মালদ্বীপের বৃহত্তম শিল্প। এটি দেশটির জিডিপির ২৮ শতাংশ এবং বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ৬০ শতাংশ জোগান দেয়। মালদ্বীপের পর্যটন মন্ত্রণালয় প্রকাশিত সাম্প্রতিক তথ্য অনুসারে, গত বছর ১৮ লাখ বিদেশি পর্যটক মালদ্বীপে গিয়েছিলেন; এর মধ্যে ১১.২ শতাংশ ছিল ভারতের। তার পর ছিল রাশিয়া, ১১.১ শতাংশ এবং চীন, ১০ শতাংশ। এখন পর্যন্ত একটি প্রধান অনলাইন ভ্রমণ বুকিং পোর্টাল ইজমাই ট্রিপ মালদ্বীপে ফ্লাইট টিকিট বিক্রি স্থগিত করেছে। ইন্ডিয়ান চেম্বার অব কমার্সের (আইসিসি) এভিয়েশন অ্যান্ড ট্যুরিজম কমিটির একটি বিবৃতিতে পর্যটন বাণিজ্য সংস্থাগুলোর প্রতি ‘মালদ্বীপের মন্ত্রীদের ভারতবিরোধী মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে মালদ্বীপের প্রচার বন্ধ করা’র আহ্বান জানানো হয়েছে। এটি বিমান সংস্থাগুলোকে মালদ্বীপে কার্যক্রম স্থগিত করারও আহ্বান জানিয়েছে। যদিও এখন পর্যন্ত ভারতীয় বিমান সংস্থাগুলো মালদ্বীপে ফ্লাইট আগের মতোই রেখেছে, তবে বিতর্ক শুরু হওয়ার পর বুকিং কমে গেছে বলে জানা গেছে। মালদ্বীপে ভারতীয় হাইকমিশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে দুই লাখ ৪১ হাজার এবং ২০২৩ সালে প্রায় দুই লাখ মানুষ মালদ্বীপ ঘুরতে গিয়েছিলেন।

২০২৩ সালের নভেম্বরে মুইজ্জু প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর থেকে মালদ্বীপ ও ভারতের সম্পর্কের সমীকরণ বদলেছে। দুই দেশের মধ্যে তিক্ততা বেড়েছে। তার আগে মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট ছিলেন ইব্রাহিম মোহাম্মদ সলিহ। সে সময়ে সরকার ‘ইন্ডিয়া ফার্স্ট’ নীতি অনুসরণ করেছে। অন্যদিকে মুইজ্জু ‘ইন্ডিয়া আউট’ স্লোগান দিয়েই ভোটে লড়েন। অর্থাৎ দেশকে ভারতের প্রভাবমুক্ত করা। সে জন্য জেতার পরেই তিনি সে দেশে অবস্থিত ৭৫ ভারতীয় সেনাকে ফেরত যাওয়ার নির্দেশ দেন।

ওই সেনারা চুক্তি অনুযায়ী মালদ্বীপে রয়েছেন বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত ভারতের দেওয়া বিমান ও হেলিকপ্টার পরিষেবা চালু রাখার জন্য। বিশেষত প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মোকাবিলা, উদ্ধারকাজ ও পণ্য সরবরাহের জন্য ওই পরিষেবা। সে দেশের সমুদ্র ও তার সম্পদের নানা গবেষণার জন্য দুই দেশের মধ্যে যে চুক্তি হয়েছিল, চলতি বছরের জুনে তার মেয়াদ বৃদ্ধি না করার সিদ্ধান্তও নতুন প্রেসিডেন্ট নিয়েছেন। এতেই ভারত ভাবছে, মুইজ্জু চীনের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। ভারত চায় না, ভারত মহাসাগরে তার ঘরের কাছে এই দ্বীপমালায় চীন ঘাঁটি গাড়ুক।

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মনে করছে, প্রধানত মুইজ্জুর জন্যই দুই দেশের সম্পর্ক এই অস্বস্তিকর অবস্থায় পৌঁছেছে। নভেম্বরে নির্বাচিত হওয়ার পর ভারত সফরে আসা নিয়ে ভারতের সঙ্গে মালদ্বীপ কথা বলেছিল। সে দেশের প্রেসিডেন্টরা সব সময় সফরের প্রথম দেশ হিসেবে ভারতকে বেছে নিয়েছেন। কথা চলাকালে মুইজ্জু প্রথম সফরে যান তুরস্কে, যে দেশ ভারতের কাশ্মীরনীতি ও মানবাধিকার রক্ষার কড়া সমালোচক। এরপরই তিনি চলে যান চীনে।

চীন সফরে ফুজিয়ান প্রদেশের মালদ্বীপ বিজনেস ফোরামে দেওয়া বক্তব্যে দ্বীপরাষ্ট্রটির ‘ঘনিষ্ঠ মিত্র’ উল্লেখ করে চীনকে আরও বেশি পর্যটক পাঠানোর উদ্যোগ নিতে আহ্বান জানান মুইজ্জু। চীনে পাঁচ দিনের রাষ্ট্রীয় সফর শেষে দেশে ফিরে ভারতের বিরুদ্ধে আরও কড়া ভাষা ব্যবহার করেছেন মুইজ্জু। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশ ছোট হতে পারে, তবে আমাদের ধমক দেওয়ার লাইসেন্স কারও নেই। আমাদের এই মহাসাগরে বেশকিছু ছোট ছোট দ্বীপ রয়েছে। আমাদের ৯ লাখ বর্গকিলোমিটারের একটি বিশাল একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল আছে। এই মহাসাগরের সবচেয়ে বড় অংশের দেশগুলোর মধ্যে মালদ্বীপ অন্যতম।’

এ সময় ভারতকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ‘এই মহাসাগরটি একটি নির্দিষ্ট দেশের নয়। এই মহাসাগরটি এখানে অবস্থিত সব দেশের অন্তর্ভুক্ত। আমরা কারও বাড়ির উঠানে নেই। আমরা একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র।’ চীনে পাঁচ দিনের ওই সফরে গিয়ে দেশটির প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে বৈঠক করেন মুইজ্জু। এই সফরে দুই দেশের মধ্যে অন্তত ২০টি দ্বিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষর হয়। সূত্র : সমকাল

হককথা/নাছরিন

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

ভারত-মালদ্বীপ বিতর্কের পেছনে ভূ-রাজনীতি

প্রকাশের সময় : ০৬:২৫:৪৫ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৮ জানুয়ারী ২০২৪

আন্তর্জাতিক ডেস্ক : কয়েক মাস আগে শিখ খলিস্তান আন্দোলনের এক নেতা নিহত হওয়ার পর ভারতের সঙ্গে কানাডার কূটনৈতিক বিতর্ক শুরু হয়। সেই বিতর্ক এখনো চলছে। দুই পক্ষই নিজেদের অবস্থানে অনড়। এবার প্রতিবেশী দেশ মালদ্বীপের সঙ্গে কূটনৈতিক দ্বন্দ্বে জড়িয়েছে ভারত। কূটনীতিকরা বলছেন, আরও অনেক প্রতিবেশীর মতো মালদ্বীপও ভারত থেকে খানিকটা চীনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। ভারতের সেনাবাহিনীকে মালদ্বীপ থেকে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। দেশটির প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুইজ্জু ভারতবিরোধী ও চীনপন্থি বলে পরিচিত। চীন সফর থেকে ফিরেই তিনি ভারতের বিরুদ্ধে সুর চড়িয়েছেন। এতে এ বিতর্কে ভূ-রাজনৈতিক সম্পর্ক আরও স্পষ্ট হয়েছে।

নতুন বছরের শুরুতে লাক্ষাদ্বীপ সফরে গিয়েছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এই সফরের ছবিগুলো তার অফিসিয়াল এক্স হ্যান্ডেলে পোস্ট করা হয়। ছবি পোস্ট করে মোদি লিখেছেন, ‘যারা দুঃসাহসকে আলিঙ্গন করতে চায় তাদের জন্য লাক্ষাদ্বীপ আপনার তালিকায় থাকতেই হবে।’ আরব সাগরের বুকে ৩৬টি দ্বীপ-সংবলিত লাক্ষা দ্বীপপুঞ্জ দক্ষিণ ভারতের কেরালা রাজ্যের উপকূলে অবস্থিত। এর পশ্চিমে রয়েছে মালদ্বীপ, যা এক হাজার ১৯২টি দ্বীপের সমষ্টি। লাক্ষাদ্বীপ ও মালদ্বীপ উভয়ই পর্যটকদের পছন্দ, তবে ধনীদের কাছে মালদ্বীপই বেশি পছন্দের। কার্যত ভারতের প্রধানমন্ত্রী লাক্ষাদ্বীপের পর্যটনের প্রচারই করেছেন। এরপর উগ্রপন্থি ভারতীয় ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা ছুটি কাটাতে মালদ্বীপ ছেড়ে লাক্ষাদ্বীপে যাওয়ার প্রচার চালাতে থাকে।

মোদি তার পোস্টে মালদ্বীপের কোনো উল্লেখ করেননি। যা হোক, লাক্ষাদ্বীপ নিয়ে তার পোস্টের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মোদির কিছু সমর্থক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দাবি করেন, তার এ সফর পর্যটকদের কাছে দ্বীপমালাটির আকর্ষণ বাড়াবে। এমনকি তারা লাক্ষাদ্বীপকে মালদ্বীপের বিকল্প পর্যটনস্থল হিসেবেও দাবি করেন। কেউ কেউ মালদ্বীপের বদনামও করতে থাকেন। যেমন ‘মিস্টার সিনহা’ নামে একটি অ্যাকাউন্টে, যিনি এক্সে নিজেকে একজন ‘ভারতীয় রাজনৈতিক বক্তা’, ‘হিন্দু অধিকার কর্মী’ এবং ‘গর্বিত ভারতীয়’ হিসেবে বর্ণনা করেন। মোদির চমৎকার পদক্ষেপের প্রশংসা করে তিনি লেখেন, ‘এর ফলে লাক্ষাদ্বীপে পর্যটন উৎসাহিত হবে। এটি মালদ্বীপে চীনের নতুন পুতুল সরকারের জন্য একটি বড় ধাক্কা।’ পোস্টটি ৩২ লাখ বার দেখা হয়েছে।

মুহূর্তের মধ্যে ভারত ও মালদ্বীপের নাগরিকদের পোস্টের ঢেউ, যাদের অনেকেই মোদি বা মুইজ্জু সরকারের সমর্থক, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যে মালদ্বীপের যুব ক্ষমতায়ন, তথ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের তিনজন উপমন্ত্রী– মরিয়ম শিউনা, মালশা শরিফ ও মাহজুম মজিদ এ কাদা ছোড়াছুড়িতে জড়িয়ে পড়েন। শিউনা মোদিকে ‘লাইফ জ্যাকেট পরা ডুবুরি’ বলে উপহাস করেন এবং তাকে ‘ক্লাউন’, ‘সন্ত্রাসী’ এবং ‘ইসরায়েলের পুতুল’ হিসেবেও বর্ণনা করেন। একই পোস্টে তিনি ভারতকে গোবরের সঙ্গে তুলনা করেন। এ সবই ভারতকে ক্ষেপিয়ে তোলে।

এদিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয় যখন ভারত ও মালদ্বীপের লোকেরা একে অন্যকে অপমান করতে থাকে। ভারতীয় চলচ্চিত্র তারকা, ক্রিকেটার এবং অন্য সাধারণ মানুষ ভারতীয়দের প্রতি মালদ্বীপকে বয়কট করতে এবং ভারতীয় পর্যটন স্পটে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে পোস্টের পর পোস্ট করতে থাকেন। দ্রুত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ বয়কট ট্রেন্ড শুরু হয়ে যায়।

কোনো দেশের প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে অন্য দেশের দায়িত্বশীল মন্ত্রী এ ধরনের মন্তব্য করতে পারেন না। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ভারত তার তীব্র নিন্দা করেছে। মালদ্বীপের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে পাঠানো হয়েছে। মালদ্বীপ একবার নয়, বারবার স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছে, তারা এ ধরনের মন্তব্য স্বীকার করে না। যাদের বিরুদ্ধে কুরুচিকর মন্তব্যের অভিযোগ উঠেছিল, দ্রুত তাদের সকলকে বরখাস্ত করা হয়েছে।

পর্যটন হলো মালদ্বীপের বৃহত্তম শিল্প। এটি দেশটির জিডিপির ২৮ শতাংশ এবং বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ৬০ শতাংশ জোগান দেয়। মালদ্বীপের পর্যটন মন্ত্রণালয় প্রকাশিত সাম্প্রতিক তথ্য অনুসারে, গত বছর ১৮ লাখ বিদেশি পর্যটক মালদ্বীপে গিয়েছিলেন; এর মধ্যে ১১.২ শতাংশ ছিল ভারতের। তার পর ছিল রাশিয়া, ১১.১ শতাংশ এবং চীন, ১০ শতাংশ। এখন পর্যন্ত একটি প্রধান অনলাইন ভ্রমণ বুকিং পোর্টাল ইজমাই ট্রিপ মালদ্বীপে ফ্লাইট টিকিট বিক্রি স্থগিত করেছে। ইন্ডিয়ান চেম্বার অব কমার্সের (আইসিসি) এভিয়েশন অ্যান্ড ট্যুরিজম কমিটির একটি বিবৃতিতে পর্যটন বাণিজ্য সংস্থাগুলোর প্রতি ‘মালদ্বীপের মন্ত্রীদের ভারতবিরোধী মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে মালদ্বীপের প্রচার বন্ধ করা’র আহ্বান জানানো হয়েছে। এটি বিমান সংস্থাগুলোকে মালদ্বীপে কার্যক্রম স্থগিত করারও আহ্বান জানিয়েছে। যদিও এখন পর্যন্ত ভারতীয় বিমান সংস্থাগুলো মালদ্বীপে ফ্লাইট আগের মতোই রেখেছে, তবে বিতর্ক শুরু হওয়ার পর বুকিং কমে গেছে বলে জানা গেছে। মালদ্বীপে ভারতীয় হাইকমিশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে দুই লাখ ৪১ হাজার এবং ২০২৩ সালে প্রায় দুই লাখ মানুষ মালদ্বীপ ঘুরতে গিয়েছিলেন।

২০২৩ সালের নভেম্বরে মুইজ্জু প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর থেকে মালদ্বীপ ও ভারতের সম্পর্কের সমীকরণ বদলেছে। দুই দেশের মধ্যে তিক্ততা বেড়েছে। তার আগে মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট ছিলেন ইব্রাহিম মোহাম্মদ সলিহ। সে সময়ে সরকার ‘ইন্ডিয়া ফার্স্ট’ নীতি অনুসরণ করেছে। অন্যদিকে মুইজ্জু ‘ইন্ডিয়া আউট’ স্লোগান দিয়েই ভোটে লড়েন। অর্থাৎ দেশকে ভারতের প্রভাবমুক্ত করা। সে জন্য জেতার পরেই তিনি সে দেশে অবস্থিত ৭৫ ভারতীয় সেনাকে ফেরত যাওয়ার নির্দেশ দেন।

ওই সেনারা চুক্তি অনুযায়ী মালদ্বীপে রয়েছেন বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত ভারতের দেওয়া বিমান ও হেলিকপ্টার পরিষেবা চালু রাখার জন্য। বিশেষত প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মোকাবিলা, উদ্ধারকাজ ও পণ্য সরবরাহের জন্য ওই পরিষেবা। সে দেশের সমুদ্র ও তার সম্পদের নানা গবেষণার জন্য দুই দেশের মধ্যে যে চুক্তি হয়েছিল, চলতি বছরের জুনে তার মেয়াদ বৃদ্ধি না করার সিদ্ধান্তও নতুন প্রেসিডেন্ট নিয়েছেন। এতেই ভারত ভাবছে, মুইজ্জু চীনের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। ভারত চায় না, ভারত মহাসাগরে তার ঘরের কাছে এই দ্বীপমালায় চীন ঘাঁটি গাড়ুক।

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মনে করছে, প্রধানত মুইজ্জুর জন্যই দুই দেশের সম্পর্ক এই অস্বস্তিকর অবস্থায় পৌঁছেছে। নভেম্বরে নির্বাচিত হওয়ার পর ভারত সফরে আসা নিয়ে ভারতের সঙ্গে মালদ্বীপ কথা বলেছিল। সে দেশের প্রেসিডেন্টরা সব সময় সফরের প্রথম দেশ হিসেবে ভারতকে বেছে নিয়েছেন। কথা চলাকালে মুইজ্জু প্রথম সফরে যান তুরস্কে, যে দেশ ভারতের কাশ্মীরনীতি ও মানবাধিকার রক্ষার কড়া সমালোচক। এরপরই তিনি চলে যান চীনে।

চীন সফরে ফুজিয়ান প্রদেশের মালদ্বীপ বিজনেস ফোরামে দেওয়া বক্তব্যে দ্বীপরাষ্ট্রটির ‘ঘনিষ্ঠ মিত্র’ উল্লেখ করে চীনকে আরও বেশি পর্যটক পাঠানোর উদ্যোগ নিতে আহ্বান জানান মুইজ্জু। চীনে পাঁচ দিনের রাষ্ট্রীয় সফর শেষে দেশে ফিরে ভারতের বিরুদ্ধে আরও কড়া ভাষা ব্যবহার করেছেন মুইজ্জু। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশ ছোট হতে পারে, তবে আমাদের ধমক দেওয়ার লাইসেন্স কারও নেই। আমাদের এই মহাসাগরে বেশকিছু ছোট ছোট দ্বীপ রয়েছে। আমাদের ৯ লাখ বর্গকিলোমিটারের একটি বিশাল একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল আছে। এই মহাসাগরের সবচেয়ে বড় অংশের দেশগুলোর মধ্যে মালদ্বীপ অন্যতম।’

এ সময় ভারতকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ‘এই মহাসাগরটি একটি নির্দিষ্ট দেশের নয়। এই মহাসাগরটি এখানে অবস্থিত সব দেশের অন্তর্ভুক্ত। আমরা কারও বাড়ির উঠানে নেই। আমরা একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র।’ চীনে পাঁচ দিনের ওই সফরে গিয়ে দেশটির প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে বৈঠক করেন মুইজ্জু। এই সফরে দুই দেশের মধ্যে অন্তত ২০টি দ্বিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষর হয়। সূত্র : সমকাল

হককথা/নাছরিন