মালয়েশিয়ার অনিন্দ্য এক ভুতুড়ে শহর ‘ফরেস্ট সিটি’
- প্রকাশের সময় : ০৩:৪৬:০৫ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৯ ফেব্রুয়ারী ২০২৪
- / ১১৪ বার পঠিত
আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ভূতের কথা শুনলেই গা-টা ছমছম করে উঠবে এটাই স্বাভাবিক। এই ভূতের বিষয়ে যদি বলা হয় মালয়েশিয়ার মতো আধুনিক দেশের কথা? আপনি ভাববেন, বিজ্ঞানের এই যুগে আবার ভূত টুত, ধুর! মালয়েশিয়ায় আবার ভূতের শহর! এবার বিষয়টি যদি মানুষের তৈরি অত্যাধুনিক নির্মাণশৈলীর হয় তবে আপনি কি বিশ্বাস করবেন?
ফরেস্ট সিটি মূলত মালয়েশিয়া-সিঙ্গাপুর সমুদ্রতীরবর্তী রাজ্য জোহরের বুকে নির্মিত অনিন্দ্য এক শহর। চীনা ওয়ান বেল্টের সিল্ক রোডের আওতায় আধুনিক মালয়েশিয়ার এই প্রকল্পটি ২০০৬ সালে হাতে নেয়া হয় এবং প্রকল্পটির মেয়াদকাল ধরা হয় ২০ বছর। দীর্ঘ সাত বছর পর চীনা জায়ান্ট কান্ট্রি গার্ডেন হোল্ডিং লিমিটেড নামে একটি রিয়েল এস্টেট কোম্পানি ২০১৩ সালে ফরেস্ট সিটি নামে একটি আধুনিক শহর তৈরির কাজ শুরু করে। টু হান্ড্রেড (২০০) বিলিয়ন ডলারের গ্রীন ও স্মার্ট এই সিটিকে বলা হয় ফরেস্ট সিটি। আর এই সিটিটি এমন একটি শহর হবে যেখানে আধুনিক সকল সুযোগ-সুবিধা থাকবে এবং ফরেস্ট সিটি আধুনিক শহর হলেও শহরটি হবে মূলত স্মার্ট অ্যান্ড গ্রীন। যা এশিয়া, আফ্রিকা এবং ইউরোপের সঙ্গে যৌথ চীনা ওয়ান বেল্টের সিল্ক রোডের সঙ্গে কানেক্টেড থাকবে।
দূর থেকে দিনের আলোতে এই সিটিটি অনিন্দ্য সুন্দর দেখালেও, ভেতরে রাতের অন্ধকারের মতো ফরেস্ট সিটি অন্ধকারের চাদরে ঢেকে যায়। প্রত্যক্ষদর্শীদের চোখে, এই সিটিটির প্রত্যেক ব্লকে শত শত অ্যাপার্টমেন্ট রয়েছে, কিন্তু আধা ডজনের চেয়ে বেশি অ্যাপার্টমেন্টে বাতি জ্বলতে দেখা যায় না। এখানে যে মানুষ বাস করে, সেটি বিশ্বাস করাই কঠিন। ৭ হাজার একর জায়গা জুড়ে নির্মিত এই ভুতুড়ে শহরের হাউজিং ইউনিটের সংখ্যা প্রায় ২৬ হাজার।
মোট ৭ লাখ লোকের বসবাস উপযোগী এই সিটিটিতে বর্তমানে বাস করেন মাত্র ৯ হাজার মানুষ! যার প্রায় ৯৯% সম্পূর্ণ ফাঁকা। আর এই ফাঁকা পড়ে থাকা শহরটিই এখন ‘গোস্ট সিটি’ বা ভূতের শহর নামে পরিচিত। বিশেষ করে চীন সরকারের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের আওতায় যে পরিমাণ বিনিয়োগ এবং দেশি, চীনা বা বিদেশি ক্রেতা পাবে বলে ধারণা করেছিল কান্ট্রি গার্ডেন কিন্তু চীন সরকারের বৈদেশিক বিনিয়োগের বিধি-নিষেধের কারণে প্রত্যাশিত বিনিয়োগ পেতে ব্যর্থ এবং সেই থেকে বর্তমানে ক্রেতা কম বলে ভূতের বেগার মনে করা হচ্ছে এই সিটিটিকে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে এত বড় প্রকল্প মুখ থুবড়ে পড়লো কেন? মালয়েশিয়ার ডেভেলপমেন্ট গ্রাফ বলছে, ২০১৬ সালে মালয়েশিয়ার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক জোহরের সুলতানের অনুমোদনে ফরেস্ট সিটির উদ্বোধন করেন এবং ফ্ল্যাট বিক্রি শুরু করলেও আশানুরূপ সাড়া পায়নি কান্ট্রি গার্ডেন। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে আসে মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদের একটি বক্তব্য। তিনি ২০১৮ সালে এক বক্তব্যে বিদেশিদের এখানে বসবাসের জন্য ভিসা না দেয়ার কথা জানালে।
এ ছাড়া মনে করা হয়, স্থানটির একটি ফ্ল্যাটের সর্বনিম্ন মূল্য ৭ লাখ ৪০ হাজার মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত, যা টাকার হিসেবে যা প্রায় ১ কোটি ৭০ লাখ টাকা। যেখানে জোহর রাজ্যে আধুনিক একটি ফ্ল্যাট কিনতে সাধারণত গড়ে ৩ লাখ ৫০ হাজার রিঙ্গিত বা ৮২ লাখ টাকা খরচ করতে হয়। সে তুলনায় ফরেস্ট সিটিতে ফ্ল্যাট কেনা বেশ ব্যয়বহুল এবং চীনা বলয় দুর্বল করতে স্থানীয় লোকজনও এখানে বসবাস করার ব্যাপারে আগ্রহী হয়নি।
তবে এত ধূসর চিত্রের পরেও মাস খানেক আগে কাতারভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম আল জাজিরাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে আশার কথা শোনান ফরেস্ট সিটির আঞ্চলিক ভাইস প্রেসিডেন্ট সিয়ারুল ইসলাম সারিফুদ্দিন। তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছে এটা এখনো ম্যানেজ করার পর্যায়ে আছে। আমরা এখনো প্রতি মাসে দুই-তিনটা হাউজ বিক্রি করছি।’
ফরেস্ট সিটির ওয়েবসাইটের তথ্যমতে, প্রকল্পটির ৬০ শতাংশের অংশীদার চীনভিত্তিক রিয়েল এস্টেট কোম্পানি কান্ট্রি গার্ডেন। বাকি অংশীদারদের মধ্যে সুলতান ইব্রাহিম ইস্কান্দারের নামও উল্লেখযোগ্য। বর্তমানে সুলতান ইব্রাহিম সমগ্র মালয়েশিয়ার রাজা নির্বাচিত হয়েছেন। মালয়েশিয়ার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম এ বছরের আগস্টের দিকে ফরেস্ট সিটিতে স্পেশাল ফাইন্যান্সিয়াল জোন করার ঘোষণা দিয়েছেন। আর এ সিটি থেকে সিঙ্গাপুর যেতে সময় লাগে মাত্র ২০ মিনিট। বর্তমানে সিঙ্গাপুরে বসবাস অনেক ব্যয়বহুল, তাই অনেকেই ফরেস্ট সিটিতে বসবাসে আগ্রহী হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ ছাড়া গত বছরের অক্টোবরে আনোয়ার ইব্রাহিম সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী লী সিয়েন লুং- এর সঙ্গে মিলে জোহর-সিঙ্গাপুর বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার কথা বলেছেন। ফলে, আলোর মুখ দেখতে পারে এ সিটিটি।
তবে এতকিছুর মাঝে সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তার বিষয় হচ্ছে ফরেস্ট সিটি প্রকল্পটি সম্পূর্ণ করতে পারবে কিনা চীনা জায়ান্ট কান্ট্রি গার্ডেন। প্রায় ১৮৬ বিলিয়ন ডলার দেনার দায়ে ডুবে থাকা চীনা কোম্পানিটির পক্ষে এই প্রকল্প শেষ করা নিঃসন্দেহে ‘ভূতের গলি’র মতো কঠিন হবে নিশ্চয়ই।
হককথা/নাছরিন