সিপিজের রিপোর্ট : সাংবাদিকদের জন্য বিশ্বের অন্যতম কারাগার হয়ে উঠেছে ইসরাইল

- প্রকাশের সময় : ০৭:১৯:৪৬ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২০ জানুয়ারী ২০২৪
- / ৬০ বার পঠিত
আন্তর্জাতিক ডেস্ক : এক মাসব্যাপী যুদ্ধের মধ্যে, ইসরাইল প্রথমবারের মতো সাংবাদিকদের জন্য বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় কারাগার হয়ে উঠেছে। ২০২৩ সালে ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৭ জন সাংবাদিককে জেলে ভরা হয়েছে। কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস’ (সিপিজে) বার্ষিক জেল শুমারি অনুসারে এই তথ্য সামনে এসেছে ।
প্রতিবেদনটি cpj.org-এ আমহারিক, আরবি, ইংরেজি, স্প্যানিশ, ফরাসি, পর্তুগিজ, রাশিয়ান, কুর্দি, চীনা এবং হিব্রু ভাষায় দেয়া হয়েছে। ১৯৯২ সালে সিপিজে সাংবাদিক গ্রেপ্তারের তথ্য নথিভুক্ত করা শুরু করার পর থেকে সর্বোচ্চ সংখ্যক ফিলিস্তিনি সাংবাদিককে আটক করেছে ইসরাইল এবং প্রথমবারের মতো ইসরাইল তালিকায় ষষ্ঠ স্থানে উঠে এসেছে। ৭ অক্টোবর থেকে ইসরাইল-গাজা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ৮০ জনেরও বেশি সাংবাদিক নিহত হওয়ার কারণে এই র্যাঙ্কিং এসেছে। ২০২৩ সালের ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী ৩২০ জন সাংবাদিককে তাদের কাজের জন্য কারারুদ্ধ করা হয়েছিল, যা সিপিজে এই ডেটা রেকর্ড করা শুরু করার পর থেকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।
পূর্ববর্তী রেকর্ডটি ২০২২ সালে সংগ্রহ করা হয়েছিল, যখন ৩৬০ টিরও বেশি ঘটনা সিপিজে- এর ডাটাবেসে উপস্থিত ছিল। ২০২৩ সালে সাংবাদিকদের জন্য শীর্ষ তিন কারাগার হয়ে ওঠে চীন (৪৪ জনকে কারাগারে পাঠানো), মায়ানমার (৪৩) এবং বেলারুশ (২৮)। এরপরেই ছিল রাশিয়া (২২) এবং ভিয়েতনাম (১৯)। এর মধ্যে আদমশুমারির দিনেই এক তৃতীয়াংশেরও বেশি (৩৫.৮%) সাংবাদিককে কারাবন্দি করা হয়েছিল।
সিপিজে-এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জোডি গিন্সবার্গ বলেছেন-” আমাদের গবেষণা দেখায় যে বিশ্বব্যাপী কর্তৃত্ববাদ কতটা বিস্তৃত , সরকারগুলি সমালোচনামূলক রিপোর্টিং বন্ধ করতে এবং জনসাধারণের জবাবদিহিতা রোধ করতে বদ্ধপরিকর । সিপিজে-এর ২০২৩ জেলের আদমশুমারিতে ইসরাইলের অবস্থান প্রমাণ করে যে ইসরাইলে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা বিপর্যস্ত।
কারণ ইসরাইল ফিলিস্তিনি সাংবাদিকদের চুপ রাখার জন্য কঠোর পদ্ধতি ব্যবহার করছে। এই অনুশীলনটি অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। ” ইসরাইলের পশ্চিম তীরে প্রশাসনিক আটকের উদাহরণ সবথেকে বেশি লক্ষ্য করা গেছে। চলমান সংঘাতের মধ্যে হাজার হাজার ফিলিস্তিনিকে বিনা অভিযোগে আটকে রাখা হয়েছে।
এটি এমন একটি বিশ্ব যেখানে সাংবাদিকরা নিয়মিতভাবে রাজনৈতিক নেতাদের দ্বারা নিন্দিত হন। তালিকাভুক্ত বেশিরভাগ সাংবাদিককে তাদের সমালোচনামূলক কভারেজের প্রতিশোধ হিসেবে ‘মিথ্যা সংবাদ এবং সন্ত্রাসবাদের মতো রাষ্ট্রবিরোধী’ অভিযোগের মুখোমুখি দাঁড় করানো হয়েছে। বিশ্বের ৬০ জনেরও বেশি সাংবাদিককে কোনো অভিযোগ ছাড়াই আটক করা হয়েছে। রাশিয়া এবং ইথিওপিয়ার মতো কিছু সরকার সাংবাদিকদের দীর্ঘস্থায়ী বিচারের আগে আটক রেখে তাদের সাথে নিষ্ঠুর আচরণ করেছে। এমনকি সীমান্তের ওপারে সাংবাদিকদের নির্যাতিত করা হয়েছে। ভিয়েতনাম, মিশর এবং অন্যান্য দেশে, এমনকি তাদের মুক্তির পরেও সাংবাদিকদের ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা চাপানোর পাশাপাশি তাদের স্বাধীনতাকে খর্ব করা হয়েছে।
গিন্সবার্গ বলছেন, ”বিশ্বজুড়ে, আমরা একটি সংকটময় মুহূর্তে পৌঁছেছি। সাংবাদিকরা যাতে স্বাধীনভাবে রিপোর্ট করতে পারে আমাদের তা নিশ্চিত করতে হবে। নয়তো আইনের বেড়াজালে সাংবাদিকদের এভাবেই নীরব করা হবে। এই নির্বাচনের বছরে, সাংবাদিকদের নীরব করলে তা গণতন্ত্রের পক্ষে ক্ষতিকর। পাশাপাশি এই প্রবণতা বিশ্ব জুড়ে কোটি কোটি ভোটারদেরও ক্ষতি করবে। ”
২০২৩ সালের জেলশুমারি অনুসারে, জেলে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক সাংবাদিকদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে এশিয়ায়। চীন, মায়ানমার এবং ভিয়েতনাম-এর শীর্ষস্থানীয় কারাগারের পাশাপাশি ভারত, আফগানিস্তান এবং ফিলিপাইনে সাংবাদিকরাও কারাগারে ছিলেন। ভারতের ২০২৪ সালের এপ্রিলের নির্বাচনটি সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে একটি বড় পরীক্ষার মুখে ফেলতে পারে যেখানে সন্ত্রাসবিরোধী অভিযোগ, বিপজ্জনক আইন এবং নিউজরুমে রেইড আদর্শ হয়ে উঠেছে। চীনে ব্যাপক সেন্সরশিপ, বছরের পর বছর ধরে সাংবাদিকদের কারাগারে নিক্ষেপ করেছে। সেখানে কারাগারে থাকা সাংবাদিকদের সঠিক সংখ্যা নির্ধারণ করা কুখ্যাতভাবে কঠিন করে তুলেছে। তা সত্ত্বেও, গণতন্ত্রপন্থী বিক্ষোভের মধ্যে বেইজিংয়ের কঠোর জাতীয় নিরাপত্তা আইন অনুসরণ করে হংকংয়ে গ্রেপ্তার সহ দেশটি তার সেন্সরশিপ শাসন অব্যাহত রেখেছে। বন্ধ হয়ে যাওয়া গণতন্ত্রপন্থী সংবাদপত্র অ্যাপল ডেইলির প্রতিষ্ঠাতা জিমি লাইকে প্রায় ১১০০ দিন কারাগারের পিছনে কাটাতে হয়েছে। তার বিরুদ্ধে বিদেশী যোগসাজশের অভিযোগ আনা হয়েছে। ইউরোপ এবং মধ্য এশিয়ায় বিশেষ করে বেলারুশ এবং রাশিয়া – অনেক সাংবাদিককে কারাগারে আটকে রেখেছে। বেলারুশিয়ান প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কোর বিতর্কিত পুনঃনির্বাচনে ব্যাপক বিক্ষোভের পর বেলারুশিয়ান কর্তৃপক্ষ ২০২০ সাল থেকে তাদের কাজের জন্য সাংবাদিকদের ক্রমবর্ধমানভাবে জেলে পাঠিয়েছে।বেলারুশের ৭০% এরও বেশি সাংবাদিক রাষ্ট্রবিরোধী অভিযোগের মুখোমুখি হয়েছেন, প্রায় অর্ধেককে পাঁচ বছর বা তার বেশি কারাদণ্ডের সাজা রয়েছে।
এর মধ্যেই রাশিয়া বিদেশী সাংবাদিকদের কারাগারে বন্দী করতে পারদর্শী হয়ে উঠেছে, ১৭ জনের মধ্যে ১২ জন বিদেশী-জাতীয় সাংবাদিককে বিশ্বব্যাপী আটক করেছে রাশিয়া প্রশাসন যার মধ্যে রয়েছেন ইভান গেরশকোভিচ এবং আলসু কুরমাশেভা। দুই মার্কিন নাগরিককে প্রাক-ট্রায়ালে আটকে রাখা হয়েছে। মস্কোর আন্তর্জাতিক দমন-পীড়নের মধ্যে অন্যান্য দেশে বসবাসরত সাংবাদিকদের জন্য গ্রেফতারি পরোয়ানাও অন্তর্ভুক্ত ছিল। সাব-সাহারান আফ্রিকায়, ২০২২ সাল থেকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বন্দী সাংবাদিকের সংখ্যা ৩১ থেকে বেড়ে ৪৭-এ দাঁড়িয়েছে। ইরিত্রিয়া, ইথিওপিয়া এবং ক্যামেরুন এই অঞ্চলের তিনটি সবচেয়ে খারাপ কারাগার হিসাবে স্থান পেয়েছে। ইরিত্রিয়ায় বন্দিদের মধ্যে রয়েছে বিশ্বজুড়ে কারাবন্দী সাংবাদিকদের দীর্ঘতম পরিচিত কিছু মামলা, যাদের কাউকেই অভিযুক্ত করা হয়নি। ইথিওপিয়া, যেটি জিবুতিতে নির্বাসিত একজন সাংবাদিককে সন্ত্রাসবাদের অভিযোগের মুখোমুখি হতে বাধ্য করেছিল, সেখানে ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত আট সাংবাদিককে আটকে রাখা হয়েছিলো। ২০২২ সালের শান্তি চুক্তির ফলে দুই বছরের গৃহযুদ্ধের অবসান হওয়া সত্ত্বেও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে।
মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকায় ২২ বছর বয়সী মাহসা আমিনির মৃত্যুর কারণে দেশব্যাপী নারী-নেতৃত্বাধীন বিক্ষোভের কভারেজের পরে সাংবাদিকদের সবচেয়ে খারাপ কারাগার হিসাবে তালিকায় স্থান পেয়েছে ইরান। ইরানের মিডিয়ার উপর অব্যাহত দমন-পীড়নের কথা তুলে ধরে ২০২২ সালের আদমশুমারিতে তালিকাভুক্ত ৬২ জন সাংবাদিকের মধ্যে অনেককে জামিনে মুক্তি দেয়া হলেও তাদের মাথার ওপর শাস্তির খাড়া ঝুলছে । মিশর, নিয়মিতভাবে বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ কারাগারের মধ্যে ২০২৩ সালের শুমারিতে বিশ্বব্যাপী অষ্টমস্থানে উঠে এসেছে। মিশর, সৌদি আরব, মরক্কো এবং ইরাকি কুর্দিস্তান সবই সাম্প্রতিক বছরগুলিতে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মিথ্যা সংবাদ, সন্ত্রাসবাদ এবং রাষ্ট্রবিরোধী অভিযোগ এনেছে। যদিও আদমশুমারির তারিখে লাতিন আমেরিকা এবং ক্যারিবিয়ানে কয়েকজন সাংবাদিককে জেলে বন্দী করা হয়েছিল – যথাক্রমে গুয়াতেমালা, নিকারাগুয়া এবং কিউবায় একজন করে। মিডিয়ার জন্য হুমকিগুলি সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ন করে চলেছে। নিকারাগুয়া থেকে গণনির্বাসন সহ সাংবাদিকদের নির্বাসনে বাধ্য করার রেকর্ড তিনটি দেশেরই রয়েছে।
গুয়াতেমালায়, জোসে রুবেন জামোরাকে অর্থ পাচারের বিষয়ে দোষী সাব্যস্ত করার পরে ২০২৩ সালের জুন মাসে আদালতের পুনঃবিচারের আদেশ সত্ত্বেও তাঁকে কারাগারে রাখা হয়েছে। জামোরাকে ২০২২ সালের জুলাই মাসে জেলে যাওয়ার পর থেকে আটবার আইনজীবী পরিবর্তন করতে বাধ্য করা হয়েছে, নির্জন কারাবাসে পাঠানো হয়েছে তাকে । সেইসঙ্গে তার ভাগ্যে জুটেছে দুর্ব্যবহার। চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে সিপিজে সাংবাদিকদের আইনি খরচের জন্য আর্থিক সহায়তা প্রদান করে, সেইসাথে সাংবাদিক এবং নিউজরুমগুলিকে আইনি হয়রানি এবং পদক্ষেপের হুমকির মোকাবেলা করতে সহায়তা করে। সংগঠনটি পূর্বে উল্লিখিত সাংবাদিকদের মুক্তির জন্য প্রচেষ্টা জারি রেখেছে । সূত্র : মানবজমিন
হককথা/নাছরিন