নিউইয়র্ক ০৬:৫১ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ০৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ২৫ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

সাবেক ‘র’ কর্মকর্তার চোখে বাংলাদেশের অভ্যুত্থান

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০৩:৫৫:২৪ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
  • / ২২ বার পঠিত

৫ই আগস্ট, ২০২৪। কার ভুল, কার ক্ষতি। এর পাশাপাশি বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্র, ভারতের ভূমিকা এবং বাংলাদেশের বাস্তবতা বিশ্লেষণ করেছেন ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা র-এর সাবেক স্পেশাল সেক্রেটারি অমিতাভ মাথুর। তিনি ইন্ডিয়া’স ওয়ার্ল্ড নামের আউটলেটকে দেয়া এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকারে এসব নিয়ে বিস্তারিত কথা বলেছেন। ইন্ডিয়া’স ওয়ার্ল্ডের সম্পাদকীয় উপদেষ্টা পরিষদের চেয়ারম্যান সুপরিচিত কলামনিস্ট, সাংবাদিক সি রাজা মোহন। ইন্ডিয়া’স ওয়ার্ল্ডের মালিকানা দিল্লিভিত্তিক প্রতিষ্ঠান প্যাক্সএনালাইসিস (ওপিসি) প্রাইভেট লিমিটেড। ‘র’ কর্মকর্তা অমিতাভ মাথুরের সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়েছে ইন্ডিয়া’স ওয়ার্ল্ডে। এখানে পাঠকের সুবিধার জন্য তা প্রশ্নোত্তর আকারে তুলে ধরা হলো।

প্রশ্ন: বর্তমানে বাংলাদেশে যে কথিত নতুন বাস্তবতা, তাকে আপনি কীভাবে দেখেন?
অমিতাভ মাথুর: আগেও দেখা গেছে এমন এক অনুভূতি। ১৯৭৫ সালে আমরা এমনটা দেখেছি। তখন শেখ মুজিবের সাক্ষ্য বহন করতো এমন সবকিছুকে পুরোপুরি অস্বীকার করা হয়েছিল। আর এখন ২০২৪ সালে এসে সেটা দেখেছি। এটা শুধু শেখ হাসিনাকে প্রত্যাখ্যানই নয়। আরও একবার শেখ মুজিবকে প্রত্যাখ্যান করা। আপনি দেখেছেন বাংলাদেশে সম্ভবত দু’টি বড় পরিচয় আছে। এর উৎস কেউ খুঁজে পেতে পারেন ১৯৪৭ সালে। যদিও উত্তর দিকে আমাদের বিভক্তির ইতিহাস সুপরিচিত। তবে বৃটিশরা সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে পূর্বদিকটাকে ভাগ করেছিল। তার আগে উত্তর থেকে যে ভয়াবহতা ঘটেছিল তা উত্তরের খুব কম মানুষেরই জানা বা পড়া। ১৯০৫ সালে ঢাকায় গঠন করা হয় মুসলিম লীগ। ১৯৪০-এর দশকে এ অঞ্চলে বার বার দাঙ্গার সঙ্গে মিশে যায় দুর্ভিক্ষ। ১৯৪১, ’৪৬, ’৪৭ (দেশভাগ), ’৪৮ এবং ’৫০। মহাত্মা গান্ধী কলকাতা ও নোয়াখালীতে অনশন করেন। এই নোয়াখালী এখন বাংলাদেশে। সাম্প্রদায়িকতাকে আরও বাড়িয়ে তোলা হয়েছিল। কারণ, পূর্ব বাংলায় (বা পূর্ব পাকিস্তানে) শতকরা ৯৫ ভাগ জমিদার ছিলেন হিন্দু। তাদের অধীনে যেসব মানুষ ছিলেন তারা ছিলেন মুসলিম। ফলে দেশভাগ থেকে একটি পরিচয় ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করে। এরপর আমরা ১৯৭১ সালে বাঙালি পরিচয় পাই। এটা ছিল পাকিস্তানের ভেতরে ভাষা আন্দোলনের ফল। এর মধ্যদিয়ে ইসলামিক পরিচয়কে অস্বীকার করা হয়নি। কিন্তু প্রাথমিকভাবে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এটাকে তাদের বাঙালি পরিচয় হিসেবে দেখা হয়। বাঙালি সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে গর্বভরে জোর দেয়। দীর্ঘ সময় এই দু’টি পরিচয়ের মধ্যে সংঘাত চলছে। আমরা ওইসব ঘটনা এমনকি ১৯৭১ সালে যা ঘটেছিল তা ভুলে যেতে চাই। ওই সময় পাকিস্তানের সঙ্গে থাকার পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন শতকরা ৩৫ থেকে ৪০ ভাগ বাংলাদেশি। তাই কয়েক দফা পটপরিবর্তনের পর বিএনপিকে দেখা যেতে পারে সম্ভবত তাদের উত্তরসূরি হিসেবে। একই সঙ্গে ১৯৭১ সালের বাঙালি পরিচয়টা জটিল হয়ে পড়ে (আওয়ামী লীগের সুবিধার বাইরে)। হ্যাঁ, এর মধ্যে আছেন ধর্মনিরপেক্ষ (সেক্যুলার) মুসলিম ও হিন্দুরা। এর মধ্যে আরও আছেন বিএনপি’র প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের মতো সামরিক মুক্তিযোদ্ধা। ফলে ২০২৪ সালে ক্ষমতার পালাবদলের পর আমরা নতুন এক বাস্তবতার মুখোমুখি। আমি এটাকে দেখি পরিচয়ের অব্যাহত পরিবর্তন ও সংঘাত হিসেবে। এটা বাংলাদেশে কয়েক দশক ধরে চলছে এবং সম্ভবত তা অব্যাহত থাকবে।

প্রশ্ন: তাৎক্ষণিক সুনির্দিষ্ট পরিস্থিতি, অনুঘটকের মতো, যেটাকে বিগত প্রশাসনের অধীনে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ব্যর্থতা বলা যায়?
উত্তর: আপনি একদম ঠিক। ১৯৭৫ সালে মুজিবের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান ঘটেছিল তার অপশাসনের কারণে। অনেক বিষয় ছিল তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে। কিন্তু বহু সমস্যা তিনি নিজে সৃষ্টি করেছেন। যেমন তার স্বৈরাচারী ধারা- তিনি সব রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করেছিলেন এবং ব্যবহার করেছিলেন মিলিশিয়াদের। তার (মুজিব) ভুল পদক্ষেপের পুনরাবৃত্তি করেন শেখ হাসিনা। তার সময়ে আপনি ঠিকই বলেছেন- ২০১৯ সাল পর্যন্ত সবকিছু ভালোই চলছিল। তারপর কোভিড হলো। যখন আমরা তা থেকে মুক্তি পেলাম, তখন ইউক্রেন ঘটলো। তারপর মধ্যপ্রাচ্য ঘটলো। আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট এবং অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে সব কিছু ভালো চলছিল মানে হলো তিনি ২০১৯ সাল পর্যন্ত ভালো চালাতে পেরেছেন। কিন্তু ২০২৪ সালে এসে তা আর ধরে রাখতে সক্ষম হননি।

প্রশ্ন: বর্তমানে বাংলাদেশে যে অবস্থার উদ্ভব ঘটছে তাতে ভারতের জন্য বাস্তবে নিরাপত্তা উদ্বেগ কি?
উত্তর: মিলিট্যান্টস অথবা উত্তর-পূর্ব ভারতের বিদ্রোহীরা সেখানে (বাংলাদেশে) পা রাখার বিষয়ে আলোচনা করেন সবাই। অবশ্যই এটা একটা বাস্তবতা। যদি ঢাকায় শত্রুভাবাপন্ন সরকার থাকে, তাহলে (ওইসব মিলিট্যান্টদের) জন্য সহায়ক হতে পারে তারা। অতীতে এমন ঘটনা ঘটেছে। জিয়ার সময়ে হয়েছে। এরশাদের সময়ে হয়েছে। এমনকি বিএনপি’র দ্বিতীয় প্রশাসনিক মেয়াদের সময়ে হয়েছে। যাহোক সবচেয়ে বড় সমস্যা হতে পারে সাম্প্রদায়িক সমস্যা, যা আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক এজেন্ডাকে কাজে লাগায়। বাংলাদেশের হিন্দুদের সঙ্গে যদি অসদাচরণ করা হয়, তাহলে এখানে (ভারত) উত্তেজনা দেখা দেয়। সাম্প্রদায়িকতা আসলে আরেকটা সাম্প্রদায়িকতাকে রসদ যোগায়। অন্য কথায় আমাদের রাজনৈতিক গতিবিধিতে বিঘ্ন ঘটানোও একটি বাস্তব নিরাপত্তা হুমকি। উপরন্তু, বাংলাদেশ যদি অর্থনৈতিকভাবে ভালো পারফর্ম করতে না পারে, তাহলে ভারতে অভিবাসীরা ছুটে আসবেন। আমাদের দেশে আর কোনো মানুষকে আমরা নিতে পারি না। আমাদের নিজেদের জন্যই পর্যাপ্ত সম্পদ নেই। এটা একটা নিরাপত্তা উদ্বেগ।

প্রশ্ন: চীন এবং পাকিস্তানকে আঞ্চলিক নিরাপত্তা অথবা ভূরাজনৈতিক হিসাবনিকাশের অংশ হিসেবে কীভাবে দেখেন এবং বাংলাদেশে বর্তমানে যে জটিল পরিস্থিতি, তাতে তারা কীভাবে সুবিধা নেয়ার সক্ষমতা রাখে?
উত্তর: ভালো কথা। আমি মনে করি চীন একটি ‘নিট’ সুবিধাবাদী। কারণ, তারা বাংলাদেশের অবকাঠামো এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গভীরভাবে জড়িত। কিন্তু তারা টানটান করে বাঁধা একটি রশির উপর দিয়ে হাঁটছে। এই রশি পরিচালিত হচ্ছে রাডারের অধীনে। নেপাল, বাংলাদেশে তারা ধীরে ধীরে সম্পদ গড়ছে। তা শুধু অর্থনৈতিকই নয়। একই সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পদও বৃদ্ধি করছে। সেনাবাহিনীর সঙ্গে তাদের দীর্ঘদিনের সম্পর্ক আছে। কারণ তারা অস্ত্রের একটি বড় সরবরাহকারী এবং তারা এমন সম্পর্ক আরও বৃদ্ধি করবে। বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের অংশ হতে বঙ্গোপসাগরে একটি অবস্থান পাওয়ার চেষ্টা করছে চীন। তাদের এই কর্মকাণ্ডে আমাদের অবশ্যই উদ্বিগ্ন হতে হবে। তারা এক্ষেত্রে কতোটা এগুতে পারবে তা নির্ভর করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়ার ওপর। পাকিস্তান যতটা সচেতন, গত কয়েক দশকে তারা ভারতের গোয়েন্দা নীতিকে কড়া নজরে রেখেছে। বর্তমানে তারা আর্থিক ও সামরিক দিক থেকে যখন কঠিন সংকটে পড়েছে, তারা যখন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে, তখন আমাদের বিরুদ্ধে কোনো বড় অ্যাডভেঞ্চার চালাতে পারবে না পাকিস্তান। এমনকি কাশ্মীরে অনুপ্রবেশের বিষয়েও তারা সুর নরম করতে পারে। বাংলাদেশের দেয়া সুযোগ ছেড়ে দেবে না পাকিস্তান এবং তারা হবে একটি বিঘ্ন সৃষ্টিকারী শক্তি। আমি আশা করি- ঢাকা এটা বুঝতে পারে যে, কোনো সুনির্দিষ্ট রেড লাইন অতিক্রমকে সহ্য করবে না ভারত। তবে পাকিস্তানকে সহযোগিতা করতে আগ্রহী লোকের অভাব নেই। এটা বড় একটি সমস্যা, যা আমরা মোকাবিলা করছি।

প্রশ্ন: কথিত বিপ্লবকে ফিরিয়ে আনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা আছে বলে ভীষণ আলোচনা আছে। এ বিষয়ে আপনি কি বলবেন?
উত্তর: আমি তেমনটা মনে করি না। বাংলাদেশে এই পরিবর্তন আনার পেছনে আমেরিকানদের যদি কোনো ভূমিকা থাকতো, তাহলে উপদেষ্টা পরিষদকে চকচকে দেখানোর জন্য তারা অধিক পরিমাণে সক্রিয় ভূমিকা রাখতো। কিন্তু উপদেষ্টা পরিষদের সেই চকচকে ভাব দ্রুততার সঙ্গে হারিয়েছে। আমি মনে করি আমেরিকার প্রত্যাশাকে অযথাই গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। তবে নিশ্চিতভাবেই আমেরিকানরা এর সুবিধা নিচ্ছে, অন্য যে কারও মতোই।

প্রশ্ন: কীভাবে?
উত্তর: আমি সবসময় অনুভব করেছি যে, বাংলাদেশে কোনোভাবে পা রাখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৯৮ সালে তারা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার অজুহাতে বাংলাদেশের সঙ্গে একটি স্ট্যাটাস অব ফোর্সেস এগ্রিমেন্ট স্বাক্ষর করে। এর অধীনে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাদেরকে ভিসামুক্তভাবে বাংলাদেশে আসার সুযোগ দেয়া হয়। এমনকি তাদের সঙ্গে আনা সরঞ্জাম চেক করা হতো না। বাংলাদেশি আইনে তাদেরকে দেয়া হয় দায়মুক্তি। তাদের কথা শোনা হোক এমন কোনো পোস্ট কি তারা খুঁজছিলেন? ঈশ্বরই জানেন। কিন্তু বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ সব সময়ই আছে। এ সময়ে সম্ভবত একটু বেশিই প্রকাশ্যে এসেছে।
২০১৯ সালে আমি ভেবেছি (বাংলাদেশে) তারা একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চাওয়ার বিষয়ে খুবই সক্রিয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য, তা ঘটেনি। আবারো তারা ২০২৪ সালের জানুয়ারির নির্বাচনে আরও বেশিভাবে জড়িত হতে চাইলো। কিন্তু এবারো তা ঘটলো না। কিন্তু বাংলাদেশের পটপরিবর্তনের ফলে দ্রুততার সঙ্গে তারা স্বাগত জানিয়েছে এবং তত্ত্বাবধায়ক পরিষদের কাছে তাদের লোক পাঠিয়েছে। এই মন্ত্রিপরিষদের বেশ কয়েকজন এনজিও’র। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের সুসম্পর্ক আছে। এর মধ্যদিয়ে এমন একটি আবহ সৃষ্টি করা হয়েছে যে, মার্কিনিরা নিয়ন্ত্রণ করছে এবং তারা গাইড দিচ্ছে। কিন্তু এখনো আমি মনে করি না যে, এ কথা সত্য।

প্রশ্ন: বাংলাদেশে বর্তমানে যে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তার প্রেক্ষাপটে ভারতের নীতি কী হওয়া উচিত?
উত্তর: প্রথমত, আমরা জানি না কার সঙ্গে কথা বলতে হবে, কার নিয়ন্ত্রণে আছে। তারা কি শিক্ষার্থী? আমরা কি সব ছাত্রনেতার ব্যাকগ্রাউন্ড দেখেছি? আমি মনে করি তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতি ঝুঁকে ছিল। ফলে বিভিন্ন রাজনৈতিক পর্যায় থেকে তারা এসেছেন। আমরা কি উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলবো, যাদের কিছু সদস্য এনজিও থেকে এসেছেন? আমরা কি সেনাবাহিনীর সঙ্গে কথা বলবো? আমরা কি জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে কথা বলবো? সুতরাং, আমার মনে হয় প্রথম সমস্যা হলো সেটা খুঁজে বের করা। দ্বিতীয়ত, পরিস্থিতি দ্রুত উন্মোচিত হচ্ছে। উপদেষ্টা পরিষদের প্রতি আস্থা প্রতিদিনই কমে যাচ্ছে। বিশেষ করে বেকারত্ব ও পণ্যমূল্য বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে। দৈনন্দিন জীবনযাপন কঠিন হয়ে পড়েছে। সামনেই পবিত্র রমজান। ফলে পরিস্থিতি খুব উত্তেজনার মধ্যে আছে। এর ফলে ঢাকার সঙ্গে অর্থপূর্ণ যোগাযোগ পুরোপুরি কঠিন করে তুলছে। আমি মনে করি গুরুতর ভুল করছে অন্তর্বর্তী সরকার। শুরুতেই প্রতিহিংসাকে নিয়ন্ত্রণে তারা সক্ষম হয়নি। এর ফল হিসেবে আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত এমন সবার পেছনে লেগেছে তারা। এর মধ্যে আছে বেক্সিমকো, গাজী গ্রুপের মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। বহু কারখানা এরই মধ্যে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে অথবা ভাঙচুর করা হয়েছে। পরিণামে হাজার হাজার শ্রমিক বেকার হয়েছেন। প্রতিটি দিনই বিশৃঙ্খলা দেখা দিচ্ছে। প্রতিদিনই বিক্ষোভ হচ্ছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ রেলওয়ের কর্মীরা ধর্মঘট করেন। সব ট্রেন ছিল ঠাঁয় দাঁড়ানো। আপনি প্রতিদিনই খবর পড়ছেন তৈরি পোশাক রপ্তানি ইউনিট বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তাদের কর্মীরা, যারা বেতন পাননি, তারা রাস্তা অবরোধ করছেন। ফলে তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকরা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তাদের অর্ডার পূরণ করতে সক্ষম হচ্ছেন না। এতে অর্ডার কমে যাচ্ছে। প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশের আয়ের প্রাথমিক এই উৎসটির আয় কমেছে ৪০০ কোটি ডলার। এ দেশের জন্য এটি খুব ছোট অঙ্ক নয়। রেমিট্যান্স বাড়ছে। কিন্তু ব্যাংকের বাইরে এবং ভেতরে ডলার বিনিময়ের হারে অনেক বেশি পার্থক্য। এ জন্য মানুষজন হাওলা রুটের মাধ্যমে অর্থ পাঠাচ্ছেন দেশে। ফলে সেখানে একটি অনিশ্চিত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।

প্রশ্ন: তাহলে ভারতের জবাব হওয়া উচিত…?
উত্তর: আমাদেরকে ধৈর্য ধরতে হবে এবং নজর রাখতে হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত বাংলাদেশের ভেতরের সমস্যার সমাধান না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের সঙ্গে অব্যাহতভাবে অর্থনৈতিক ও অন্যান্য যোগাযোগ অব্যাহত রাখা উচিত আমাদের। যেকোনো সম্ভাব্য ফলাফল থেকে কিছুটা দূরত্ব বজায় রাখতে হবে।

প্রশ্ন: বাংলাদেশে যদি এ বছরের শেষের দিকে নির্বাচন হয়, তাহলে আমরা এমন একটি পরিস্থিতি দেখতে পাচ্ছি- যেখানে জামায়াতে ইসলামীর সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় আসতে যাচ্ছে বিএনপি। এসব পক্ষ থেকে ভারতবিরোধী বক্তব্য আসা সত্ত্বেও কি এই নতুন সরকারের সঙ্গে সর্বান্তকরণে কাজ করা উচিত হবে ভারতের?
উত্তর: নির্লজ্জভাবে পক্ষপাতিত্বপূর্ণ অথবা পূর্ব নির্ধারিত নির্বাচন করা না হলে জনগণ যে সিদ্ধান্ত দেবেন, আমাদের উচিত হবে তাকে স্বাগত জানানো। আমি মনে করি যেকোনো সরকারকে মোকাবিলা করতে যথেষ্ট শক্তিশালী এখন ভারত। যদিও তারা কিছু ইস্যুতে চোখে চোখ রাখে না। আমার মনে হয় না যে, বিএনপি বিপর্যস্ত হবে। আমরা তাদের সঙ্গে কাজ করতে পারবো। অতীতে তাদের সঙ্গে আমরা কাজ করেছি। তবে তা নিয়ে আমাদের অভিজ্ঞতা ভালো নয়। কিন্তু আমরা অতীত থেকে শিক্ষা নিয়েছি। আমি নিশ্চিত তারাও অতীত থেকে শিক্ষা নিয়েছেন। বাংলাদেশে যদি পরিবর্তন ঘটে, তা একটি ভালো বিষয় হবে- যদি তা একটি নির্বাচিত বডির অধীনে হয়। তাদের প্রতি জনগণের ম্যান্ডেট থাকে, বৈধতা থাকে। কিন্তু উপদেষ্টা পরিষদ, নিজেরাই নিজেদেরকে নিয়োগ করেছে। তাদের সেই ম্যান্ডেট নেই। বৈধতা নেই।
ইন্ডিয়া’স ওয়ার্ল্ড: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, স্যার। সূত্র : মানবজমিন।

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

সাবেক ‘র’ কর্মকর্তার চোখে বাংলাদেশের অভ্যুত্থান

প্রকাশের সময় : ০৩:৫৫:২৪ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

৫ই আগস্ট, ২০২৪। কার ভুল, কার ক্ষতি। এর পাশাপাশি বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্র, ভারতের ভূমিকা এবং বাংলাদেশের বাস্তবতা বিশ্লেষণ করেছেন ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা র-এর সাবেক স্পেশাল সেক্রেটারি অমিতাভ মাথুর। তিনি ইন্ডিয়া’স ওয়ার্ল্ড নামের আউটলেটকে দেয়া এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকারে এসব নিয়ে বিস্তারিত কথা বলেছেন। ইন্ডিয়া’স ওয়ার্ল্ডের সম্পাদকীয় উপদেষ্টা পরিষদের চেয়ারম্যান সুপরিচিত কলামনিস্ট, সাংবাদিক সি রাজা মোহন। ইন্ডিয়া’স ওয়ার্ল্ডের মালিকানা দিল্লিভিত্তিক প্রতিষ্ঠান প্যাক্সএনালাইসিস (ওপিসি) প্রাইভেট লিমিটেড। ‘র’ কর্মকর্তা অমিতাভ মাথুরের সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়েছে ইন্ডিয়া’স ওয়ার্ল্ডে। এখানে পাঠকের সুবিধার জন্য তা প্রশ্নোত্তর আকারে তুলে ধরা হলো।

প্রশ্ন: বর্তমানে বাংলাদেশে যে কথিত নতুন বাস্তবতা, তাকে আপনি কীভাবে দেখেন?
অমিতাভ মাথুর: আগেও দেখা গেছে এমন এক অনুভূতি। ১৯৭৫ সালে আমরা এমনটা দেখেছি। তখন শেখ মুজিবের সাক্ষ্য বহন করতো এমন সবকিছুকে পুরোপুরি অস্বীকার করা হয়েছিল। আর এখন ২০২৪ সালে এসে সেটা দেখেছি। এটা শুধু শেখ হাসিনাকে প্রত্যাখ্যানই নয়। আরও একবার শেখ মুজিবকে প্রত্যাখ্যান করা। আপনি দেখেছেন বাংলাদেশে সম্ভবত দু’টি বড় পরিচয় আছে। এর উৎস কেউ খুঁজে পেতে পারেন ১৯৪৭ সালে। যদিও উত্তর দিকে আমাদের বিভক্তির ইতিহাস সুপরিচিত। তবে বৃটিশরা সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে পূর্বদিকটাকে ভাগ করেছিল। তার আগে উত্তর থেকে যে ভয়াবহতা ঘটেছিল তা উত্তরের খুব কম মানুষেরই জানা বা পড়া। ১৯০৫ সালে ঢাকায় গঠন করা হয় মুসলিম লীগ। ১৯৪০-এর দশকে এ অঞ্চলে বার বার দাঙ্গার সঙ্গে মিশে যায় দুর্ভিক্ষ। ১৯৪১, ’৪৬, ’৪৭ (দেশভাগ), ’৪৮ এবং ’৫০। মহাত্মা গান্ধী কলকাতা ও নোয়াখালীতে অনশন করেন। এই নোয়াখালী এখন বাংলাদেশে। সাম্প্রদায়িকতাকে আরও বাড়িয়ে তোলা হয়েছিল। কারণ, পূর্ব বাংলায় (বা পূর্ব পাকিস্তানে) শতকরা ৯৫ ভাগ জমিদার ছিলেন হিন্দু। তাদের অধীনে যেসব মানুষ ছিলেন তারা ছিলেন মুসলিম। ফলে দেশভাগ থেকে একটি পরিচয় ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করে। এরপর আমরা ১৯৭১ সালে বাঙালি পরিচয় পাই। এটা ছিল পাকিস্তানের ভেতরে ভাষা আন্দোলনের ফল। এর মধ্যদিয়ে ইসলামিক পরিচয়কে অস্বীকার করা হয়নি। কিন্তু প্রাথমিকভাবে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এটাকে তাদের বাঙালি পরিচয় হিসেবে দেখা হয়। বাঙালি সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে গর্বভরে জোর দেয়। দীর্ঘ সময় এই দু’টি পরিচয়ের মধ্যে সংঘাত চলছে। আমরা ওইসব ঘটনা এমনকি ১৯৭১ সালে যা ঘটেছিল তা ভুলে যেতে চাই। ওই সময় পাকিস্তানের সঙ্গে থাকার পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন শতকরা ৩৫ থেকে ৪০ ভাগ বাংলাদেশি। তাই কয়েক দফা পটপরিবর্তনের পর বিএনপিকে দেখা যেতে পারে সম্ভবত তাদের উত্তরসূরি হিসেবে। একই সঙ্গে ১৯৭১ সালের বাঙালি পরিচয়টা জটিল হয়ে পড়ে (আওয়ামী লীগের সুবিধার বাইরে)। হ্যাঁ, এর মধ্যে আছেন ধর্মনিরপেক্ষ (সেক্যুলার) মুসলিম ও হিন্দুরা। এর মধ্যে আরও আছেন বিএনপি’র প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের মতো সামরিক মুক্তিযোদ্ধা। ফলে ২০২৪ সালে ক্ষমতার পালাবদলের পর আমরা নতুন এক বাস্তবতার মুখোমুখি। আমি এটাকে দেখি পরিচয়ের অব্যাহত পরিবর্তন ও সংঘাত হিসেবে। এটা বাংলাদেশে কয়েক দশক ধরে চলছে এবং সম্ভবত তা অব্যাহত থাকবে।

প্রশ্ন: তাৎক্ষণিক সুনির্দিষ্ট পরিস্থিতি, অনুঘটকের মতো, যেটাকে বিগত প্রশাসনের অধীনে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ব্যর্থতা বলা যায়?
উত্তর: আপনি একদম ঠিক। ১৯৭৫ সালে মুজিবের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান ঘটেছিল তার অপশাসনের কারণে। অনেক বিষয় ছিল তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে। কিন্তু বহু সমস্যা তিনি নিজে সৃষ্টি করেছেন। যেমন তার স্বৈরাচারী ধারা- তিনি সব রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করেছিলেন এবং ব্যবহার করেছিলেন মিলিশিয়াদের। তার (মুজিব) ভুল পদক্ষেপের পুনরাবৃত্তি করেন শেখ হাসিনা। তার সময়ে আপনি ঠিকই বলেছেন- ২০১৯ সাল পর্যন্ত সবকিছু ভালোই চলছিল। তারপর কোভিড হলো। যখন আমরা তা থেকে মুক্তি পেলাম, তখন ইউক্রেন ঘটলো। তারপর মধ্যপ্রাচ্য ঘটলো। আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট এবং অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে সব কিছু ভালো চলছিল মানে হলো তিনি ২০১৯ সাল পর্যন্ত ভালো চালাতে পেরেছেন। কিন্তু ২০২৪ সালে এসে তা আর ধরে রাখতে সক্ষম হননি।

প্রশ্ন: বর্তমানে বাংলাদেশে যে অবস্থার উদ্ভব ঘটছে তাতে ভারতের জন্য বাস্তবে নিরাপত্তা উদ্বেগ কি?
উত্তর: মিলিট্যান্টস অথবা উত্তর-পূর্ব ভারতের বিদ্রোহীরা সেখানে (বাংলাদেশে) পা রাখার বিষয়ে আলোচনা করেন সবাই। অবশ্যই এটা একটা বাস্তবতা। যদি ঢাকায় শত্রুভাবাপন্ন সরকার থাকে, তাহলে (ওইসব মিলিট্যান্টদের) জন্য সহায়ক হতে পারে তারা। অতীতে এমন ঘটনা ঘটেছে। জিয়ার সময়ে হয়েছে। এরশাদের সময়ে হয়েছে। এমনকি বিএনপি’র দ্বিতীয় প্রশাসনিক মেয়াদের সময়ে হয়েছে। যাহোক সবচেয়ে বড় সমস্যা হতে পারে সাম্প্রদায়িক সমস্যা, যা আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক এজেন্ডাকে কাজে লাগায়। বাংলাদেশের হিন্দুদের সঙ্গে যদি অসদাচরণ করা হয়, তাহলে এখানে (ভারত) উত্তেজনা দেখা দেয়। সাম্প্রদায়িকতা আসলে আরেকটা সাম্প্রদায়িকতাকে রসদ যোগায়। অন্য কথায় আমাদের রাজনৈতিক গতিবিধিতে বিঘ্ন ঘটানোও একটি বাস্তব নিরাপত্তা হুমকি। উপরন্তু, বাংলাদেশ যদি অর্থনৈতিকভাবে ভালো পারফর্ম করতে না পারে, তাহলে ভারতে অভিবাসীরা ছুটে আসবেন। আমাদের দেশে আর কোনো মানুষকে আমরা নিতে পারি না। আমাদের নিজেদের জন্যই পর্যাপ্ত সম্পদ নেই। এটা একটা নিরাপত্তা উদ্বেগ।

প্রশ্ন: চীন এবং পাকিস্তানকে আঞ্চলিক নিরাপত্তা অথবা ভূরাজনৈতিক হিসাবনিকাশের অংশ হিসেবে কীভাবে দেখেন এবং বাংলাদেশে বর্তমানে যে জটিল পরিস্থিতি, তাতে তারা কীভাবে সুবিধা নেয়ার সক্ষমতা রাখে?
উত্তর: ভালো কথা। আমি মনে করি চীন একটি ‘নিট’ সুবিধাবাদী। কারণ, তারা বাংলাদেশের অবকাঠামো এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গভীরভাবে জড়িত। কিন্তু তারা টানটান করে বাঁধা একটি রশির উপর দিয়ে হাঁটছে। এই রশি পরিচালিত হচ্ছে রাডারের অধীনে। নেপাল, বাংলাদেশে তারা ধীরে ধীরে সম্পদ গড়ছে। তা শুধু অর্থনৈতিকই নয়। একই সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পদও বৃদ্ধি করছে। সেনাবাহিনীর সঙ্গে তাদের দীর্ঘদিনের সম্পর্ক আছে। কারণ তারা অস্ত্রের একটি বড় সরবরাহকারী এবং তারা এমন সম্পর্ক আরও বৃদ্ধি করবে। বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের অংশ হতে বঙ্গোপসাগরে একটি অবস্থান পাওয়ার চেষ্টা করছে চীন। তাদের এই কর্মকাণ্ডে আমাদের অবশ্যই উদ্বিগ্ন হতে হবে। তারা এক্ষেত্রে কতোটা এগুতে পারবে তা নির্ভর করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়ার ওপর। পাকিস্তান যতটা সচেতন, গত কয়েক দশকে তারা ভারতের গোয়েন্দা নীতিকে কড়া নজরে রেখেছে। বর্তমানে তারা আর্থিক ও সামরিক দিক থেকে যখন কঠিন সংকটে পড়েছে, তারা যখন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে, তখন আমাদের বিরুদ্ধে কোনো বড় অ্যাডভেঞ্চার চালাতে পারবে না পাকিস্তান। এমনকি কাশ্মীরে অনুপ্রবেশের বিষয়েও তারা সুর নরম করতে পারে। বাংলাদেশের দেয়া সুযোগ ছেড়ে দেবে না পাকিস্তান এবং তারা হবে একটি বিঘ্ন সৃষ্টিকারী শক্তি। আমি আশা করি- ঢাকা এটা বুঝতে পারে যে, কোনো সুনির্দিষ্ট রেড লাইন অতিক্রমকে সহ্য করবে না ভারত। তবে পাকিস্তানকে সহযোগিতা করতে আগ্রহী লোকের অভাব নেই। এটা বড় একটি সমস্যা, যা আমরা মোকাবিলা করছি।

প্রশ্ন: কথিত বিপ্লবকে ফিরিয়ে আনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা আছে বলে ভীষণ আলোচনা আছে। এ বিষয়ে আপনি কি বলবেন?
উত্তর: আমি তেমনটা মনে করি না। বাংলাদেশে এই পরিবর্তন আনার পেছনে আমেরিকানদের যদি কোনো ভূমিকা থাকতো, তাহলে উপদেষ্টা পরিষদকে চকচকে দেখানোর জন্য তারা অধিক পরিমাণে সক্রিয় ভূমিকা রাখতো। কিন্তু উপদেষ্টা পরিষদের সেই চকচকে ভাব দ্রুততার সঙ্গে হারিয়েছে। আমি মনে করি আমেরিকার প্রত্যাশাকে অযথাই গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। তবে নিশ্চিতভাবেই আমেরিকানরা এর সুবিধা নিচ্ছে, অন্য যে কারও মতোই।

প্রশ্ন: কীভাবে?
উত্তর: আমি সবসময় অনুভব করেছি যে, বাংলাদেশে কোনোভাবে পা রাখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৯৮ সালে তারা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার অজুহাতে বাংলাদেশের সঙ্গে একটি স্ট্যাটাস অব ফোর্সেস এগ্রিমেন্ট স্বাক্ষর করে। এর অধীনে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাদেরকে ভিসামুক্তভাবে বাংলাদেশে আসার সুযোগ দেয়া হয়। এমনকি তাদের সঙ্গে আনা সরঞ্জাম চেক করা হতো না। বাংলাদেশি আইনে তাদেরকে দেয়া হয় দায়মুক্তি। তাদের কথা শোনা হোক এমন কোনো পোস্ট কি তারা খুঁজছিলেন? ঈশ্বরই জানেন। কিন্তু বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ সব সময়ই আছে। এ সময়ে সম্ভবত একটু বেশিই প্রকাশ্যে এসেছে।
২০১৯ সালে আমি ভেবেছি (বাংলাদেশে) তারা একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চাওয়ার বিষয়ে খুবই সক্রিয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য, তা ঘটেনি। আবারো তারা ২০২৪ সালের জানুয়ারির নির্বাচনে আরও বেশিভাবে জড়িত হতে চাইলো। কিন্তু এবারো তা ঘটলো না। কিন্তু বাংলাদেশের পটপরিবর্তনের ফলে দ্রুততার সঙ্গে তারা স্বাগত জানিয়েছে এবং তত্ত্বাবধায়ক পরিষদের কাছে তাদের লোক পাঠিয়েছে। এই মন্ত্রিপরিষদের বেশ কয়েকজন এনজিও’র। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের সুসম্পর্ক আছে। এর মধ্যদিয়ে এমন একটি আবহ সৃষ্টি করা হয়েছে যে, মার্কিনিরা নিয়ন্ত্রণ করছে এবং তারা গাইড দিচ্ছে। কিন্তু এখনো আমি মনে করি না যে, এ কথা সত্য।

প্রশ্ন: বাংলাদেশে বর্তমানে যে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তার প্রেক্ষাপটে ভারতের নীতি কী হওয়া উচিত?
উত্তর: প্রথমত, আমরা জানি না কার সঙ্গে কথা বলতে হবে, কার নিয়ন্ত্রণে আছে। তারা কি শিক্ষার্থী? আমরা কি সব ছাত্রনেতার ব্যাকগ্রাউন্ড দেখেছি? আমি মনে করি তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতি ঝুঁকে ছিল। ফলে বিভিন্ন রাজনৈতিক পর্যায় থেকে তারা এসেছেন। আমরা কি উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলবো, যাদের কিছু সদস্য এনজিও থেকে এসেছেন? আমরা কি সেনাবাহিনীর সঙ্গে কথা বলবো? আমরা কি জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে কথা বলবো? সুতরাং, আমার মনে হয় প্রথম সমস্যা হলো সেটা খুঁজে বের করা। দ্বিতীয়ত, পরিস্থিতি দ্রুত উন্মোচিত হচ্ছে। উপদেষ্টা পরিষদের প্রতি আস্থা প্রতিদিনই কমে যাচ্ছে। বিশেষ করে বেকারত্ব ও পণ্যমূল্য বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে। দৈনন্দিন জীবনযাপন কঠিন হয়ে পড়েছে। সামনেই পবিত্র রমজান। ফলে পরিস্থিতি খুব উত্তেজনার মধ্যে আছে। এর ফলে ঢাকার সঙ্গে অর্থপূর্ণ যোগাযোগ পুরোপুরি কঠিন করে তুলছে। আমি মনে করি গুরুতর ভুল করছে অন্তর্বর্তী সরকার। শুরুতেই প্রতিহিংসাকে নিয়ন্ত্রণে তারা সক্ষম হয়নি। এর ফল হিসেবে আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত এমন সবার পেছনে লেগেছে তারা। এর মধ্যে আছে বেক্সিমকো, গাজী গ্রুপের মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। বহু কারখানা এরই মধ্যে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে অথবা ভাঙচুর করা হয়েছে। পরিণামে হাজার হাজার শ্রমিক বেকার হয়েছেন। প্রতিটি দিনই বিশৃঙ্খলা দেখা দিচ্ছে। প্রতিদিনই বিক্ষোভ হচ্ছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ রেলওয়ের কর্মীরা ধর্মঘট করেন। সব ট্রেন ছিল ঠাঁয় দাঁড়ানো। আপনি প্রতিদিনই খবর পড়ছেন তৈরি পোশাক রপ্তানি ইউনিট বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তাদের কর্মীরা, যারা বেতন পাননি, তারা রাস্তা অবরোধ করছেন। ফলে তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকরা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তাদের অর্ডার পূরণ করতে সক্ষম হচ্ছেন না। এতে অর্ডার কমে যাচ্ছে। প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশের আয়ের প্রাথমিক এই উৎসটির আয় কমেছে ৪০০ কোটি ডলার। এ দেশের জন্য এটি খুব ছোট অঙ্ক নয়। রেমিট্যান্স বাড়ছে। কিন্তু ব্যাংকের বাইরে এবং ভেতরে ডলার বিনিময়ের হারে অনেক বেশি পার্থক্য। এ জন্য মানুষজন হাওলা রুটের মাধ্যমে অর্থ পাঠাচ্ছেন দেশে। ফলে সেখানে একটি অনিশ্চিত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।

প্রশ্ন: তাহলে ভারতের জবাব হওয়া উচিত…?
উত্তর: আমাদেরকে ধৈর্য ধরতে হবে এবং নজর রাখতে হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত বাংলাদেশের ভেতরের সমস্যার সমাধান না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের সঙ্গে অব্যাহতভাবে অর্থনৈতিক ও অন্যান্য যোগাযোগ অব্যাহত রাখা উচিত আমাদের। যেকোনো সম্ভাব্য ফলাফল থেকে কিছুটা দূরত্ব বজায় রাখতে হবে।

প্রশ্ন: বাংলাদেশে যদি এ বছরের শেষের দিকে নির্বাচন হয়, তাহলে আমরা এমন একটি পরিস্থিতি দেখতে পাচ্ছি- যেখানে জামায়াতে ইসলামীর সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় আসতে যাচ্ছে বিএনপি। এসব পক্ষ থেকে ভারতবিরোধী বক্তব্য আসা সত্ত্বেও কি এই নতুন সরকারের সঙ্গে সর্বান্তকরণে কাজ করা উচিত হবে ভারতের?
উত্তর: নির্লজ্জভাবে পক্ষপাতিত্বপূর্ণ অথবা পূর্ব নির্ধারিত নির্বাচন করা না হলে জনগণ যে সিদ্ধান্ত দেবেন, আমাদের উচিত হবে তাকে স্বাগত জানানো। আমি মনে করি যেকোনো সরকারকে মোকাবিলা করতে যথেষ্ট শক্তিশালী এখন ভারত। যদিও তারা কিছু ইস্যুতে চোখে চোখ রাখে না। আমার মনে হয় না যে, বিএনপি বিপর্যস্ত হবে। আমরা তাদের সঙ্গে কাজ করতে পারবো। অতীতে তাদের সঙ্গে আমরা কাজ করেছি। তবে তা নিয়ে আমাদের অভিজ্ঞতা ভালো নয়। কিন্তু আমরা অতীত থেকে শিক্ষা নিয়েছি। আমি নিশ্চিত তারাও অতীত থেকে শিক্ষা নিয়েছেন। বাংলাদেশে যদি পরিবর্তন ঘটে, তা একটি ভালো বিষয় হবে- যদি তা একটি নির্বাচিত বডির অধীনে হয়। তাদের প্রতি জনগণের ম্যান্ডেট থাকে, বৈধতা থাকে। কিন্তু উপদেষ্টা পরিষদ, নিজেরাই নিজেদেরকে নিয়োগ করেছে। তাদের সেই ম্যান্ডেট নেই। বৈধতা নেই।
ইন্ডিয়া’স ওয়ার্ল্ড: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, স্যার। সূত্র : মানবজমিন।