গাজা যুদ্ধে শিশুরা আহত, ক্ষুধার্ত ও একা

- প্রকাশের সময় : ০৩:০৭:৪১ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১ ফেব্রুয়ারী ২০২৪
- / ১৯৬ বার পঠিত
আন্তর্জাতিক ডেস্ক : গাজা যুদ্ধে জন্ম নেওয়া এক মাস বয়সী শিশু শুয়ে আছে ইনকিউবেটরে। জন্মের পর বাবা-মায়ের আলিঙ্গন পায়নি সে, জায়গা হয়েছে ইনকিউবেটরে। শিশুটির মা হান্না ইসরায়েলি বোমার আঘাতে নিহত হয়েছেন। মৃত্যুর আগে সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে কন্যাশিশুর জন্ম দিলেও, মেয়ের নাম রাখার জন্য বাঁচতে পারেনি।
মধ্য গাজার দেইর আল-বালাহের আল-আকসা হাসপাতালে ছোট্ট নবজাতকের যত্ন নিচ্ছেন নার্স ওয়ার্দা আল-আওদা। হাসপাতালে শিশুটিকে সবাই হান্না আবু আমশার মেয়ে বলে চেনে। চলমান যুদ্ধে শিশুটির পুরো পরিবার প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। চিকিৎসক এবং উদ্ধারকারীরা শিশুটির যত্ন নেওয়ার চেষ্টা করছেন।
স্থানীয় এক নার্স জানান, ‘আমরা শিশুটির পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ হারিয়ে ফেলেছি। তাঁর আত্মীয়দের খুঁজে পায়নি, আমরা জানি না তাঁর বাবার ভাগ্যে কী ঘটেছে।’

মৃত্যুর আগে সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে কন্যাশিশুর জন্ম দিলেও মেয়ের নাম রাখার জন্য বাঁচতে পারেননি মা। ছবি : বিবিসি
গাজার ২.৩ মিলিয়ন জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক শিশু।
যাদের জীবন নৃশংস এই যুদ্ধে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। যদিও ইসরায়েল বলেছে, তারা বেসামরিক হতাহতের ঘটনা এড়াতে চেষ্টা করেছে। ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের মতে, নিহতদের মধ্যে ১১ হাজার ৬০০ জন ১৮ বছরের নিচে। সঠিক সংখ্যা পাওয়া কঠিন হলেও ‘ইউরো-মেডিটারেনিয়ান হিউম্যান রাইটস মনিটর’ তাদের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ২৪ হাজারের বেশি শিশু বাবা অথবা মা বা উভয়কেই হারিয়েছে।
মাত্র ১০ বছর বয়সী ইব্রাহিম আবু মুস।
ইসরায়েলি ক্ষেপণস্ত্রের আঘাতে সে পায়ে এবং পেটে গুরুতর আঘাত পেয়েছে। কিন্তু শিশুটি কাঁদছে তাঁর মৃত মা, দাদা এবং বোনের জন্য। মুসের বাড়িতে এই ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়েছিল। ইব্রাহিম বিবিসিকে বলেছে, ‘সবাই আমাকে বলেছিল হাসপাতালের ওপরে আমার মাকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।’ পাশেই ইব্রাহিমের বাবা তাঁর হাত ধরে ছিল। ইব্রাহিম আরো বলেন, “কিন্তু আমি যখন আমার বাবার ফোনে মায়ের ছবি দেখেছিলাম তখন সত্যটা জানতে পেরেছিলাম। সত্যিটা জানতে পেরে আমি এতটাই কেঁদেছিলাম যে, আমার পুরো শরীর ব্যথা করছিল।”
গাজা যুদ্ধে আরো এক ভুক্তভোগী শিশু হুসেন আবেদ। আগে চাচাতো ভাইয়েরা একসঙ্গে খেলত কিন্তু এখন তারা কবরের পাশে বসে থাকে, যেখানে তাদের আত্মীয়দের সমাহিত করা হয়েছে। মধ্য গাজায় একটি স্কুলে আশ্রয়স্থলে তাদের সমাহিত করা হয়েছে। তারা প্রত্যেকে বাবা অথবা মা বা উভয়কে হারিয়েছে। আল-বুরেইজ শরণার্থী শিবির এখন আবেদ হুসেনের বাসস্থান। হুসের বলে, ‘মিসাইলটি আমার মায়ের কোলে এসে পড়েছিল এবং তাঁর দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল। কয়েকদিন ধরে আমাদের বাড়ির ধ্বংসস্তূপের মধ্যে আমার মায়ের শরীরের অংশগুলো খুঁজে পেয়েছিলাম।’হুসেন আরো বলেন, “যখন জানতে পারলাম আমার ভাই, আমার চাচা এবং আমার পুরো পরিবারকে হত্যা করা হয়েছে, তখন আমার মনে হয়েছিল আমার বুকে আগুন ধরে গেছে, রক্তপাত শুরু হয়েছে।”

অসুস্থ ইব্রাহিম আবু মুস কাঁদছে তাঁর মৃত মা, দাদা এবং বোনের জন্য। ছবি : বিবিসি
হুসেন আবেদ এখন রাতে জেগে থাকে। ইসরায়েলি গোলাগুলির শব্দে ভয় পায়, একা বোধ করে। আবেদ তাঁর বাবা-মা উভয়কে হারিয়েছে। আবেদ জানায়, আমার মা-বাবা যখন বেঁচে ছিলেন, আমি ঘুমাতে পারতাম। কিন্তু তাদের মৃত্যুর পর আমি আর ঘুমাতে পারি না। আবেদ সবসময় তাঁর বাবার পাশে ঘুমাত। এখন আবেদ এবং তাঁর বেঁচে থাকা দুই ভাইবোনকে তাদের দাদি দেখাশোনা করছেন। কিন্তু দৈনন্দিন জীবন খুবই কঠিন। কোনো খাবার বা পানি নেই। আবেদ বলেন, ‘সমুদ্রের পানি পান করে আমার পেটে ব্যাথা শুরু হয়েছে।’
রুটি জন্য ময়দা কিনতে গিয়ে নিহত হন কিনজা হোসেনের বাবা। ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে তিনি নিহত হন। দাফনের জন্য বাড়িতে আনা হয়েছিল ভীবৎস মৃতদেহটি। গোলার আঘাতে তাঁকে চেনা যাচ্ছিল না। কিনজা বলেন, “বাবার চোখ ছিল না, জিহ্বা কাটা ছিল।’কিনজা দুঃখ নিয়ে জানায়, ‘আমরা চাই যুদ্ধ শেষ হোক।’
গাজার প্রায় সবার এখন ত্রাণের প্রয়োজন। জাতিসংঘের পরিসংখ্যান অনুসারে, প্রায় ১.৭ মিলিয়ন মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। নিরাপত্তার জন্য বারবার এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় ছুটছেন তারা। কিন্তু জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ বলছে, তাদের সবচেয়ে বড় উদ্বেগ হলো আনুমানিক ১৯ হাজার এতিম শিশুদের দেখাশোনা করার জন্য কোন প্রাপ্তবয়স্ক নেই।

কিনজা দুঃখ নিয়ে জানায়, ‘আমরা চাই যুদ্ধ শেষ হোক।’ ছবি : বিবিসি
ইউনিসেফ প্যালেস্টাইনের যোগাযোগের প্রধান জোনাথন ক্রিক রাফা থেকে বিবিসিকে বলেন, ‘এই শিশুদের মধ্যে অনেক শিশুকে ধ্বংসস্তূপের নিচে পাওয়া গেছে। আবার অনেকে বোমা হামলায় তাদের বাবা-মাকে হারিয়েছে। অন্যদের ইসরায়েলি চেকপয়েন্ট, হাসপাতাল এবং রাস্তায় পাওয়া গেছে।’ তিনি আরো জানায়, ‘ছোট শিশুরা তাদের নামই বলতে পারে না। ফলে তাদের বর্ধিত পরিবারের অন্য কোনো আত্নীয়কেও খুঁজে পাওয়া যায় না।’
ক্রিক বলেন, ‘তাদের আত্নীয়দের পাওয়া গেলেও শোকাহত এই শিশুদের যত্ন নেওয়ার জন্য ভালো জায়গা পাওয়া যায় না। তাদের নিজেদের সন্তাদেরও যত্ন নিতে হয়। তাদের পক্ষে এই এতিম শিশুদের যত্ন নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে, তারা খুব ভয়ানক পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যায়।’
একটি অলাভজনক সংস্থা এসওএস চিলড্রেনস ভিলেজ। তারা ইউনিসেফের সঙ্গে কাজ করছে। সংস্থাটি জানিয়েছে, যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে তারা ৫৫ টি শিশুর যত্ন নিচ্ছে, যাদের বয়স ১০ বছরের কম। তারা শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের চিকিৎসার জন্য অতিরিক্ত বিশেষজ্ঞ কর্মী নিয়োগ করেছে। ইউনিসেফ বলছে,গাজার প্রায় সব শিশুর এখন মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তার প্রয়োজন। তাদের জীবন, শৈশব ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে।
হককথা/নাছরিন