নিউইয়র্ক ০৭:২১ অপরাহ্ন, শনিবার, ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৩ ভাদ্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

গ্লোবাল টাইমসের দৃষ্টিতে যখনই দক্ষিণ এশিয়ার কোনো নেতা চীন সফরে যান তখনই ভারত নানা অজুহাত খাঁড়া করে

হককথা ডেস্ক
  • প্রকাশের সময় : ০৪:২০:০৪ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৪ জুলাই ২০২৪
  • / ৫০ বার পঠিত

চীন ও বাংলাদেশ তাদের সম্পর্ককে কৌশলগত সহযোগিতামূলক অংশীদারিত্বে উন্নীত করেছে। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেইজিংয়ের বৈঠকে এ ঘোষণা দেন। বিশেষজ্ঞরা হাসিনার চীন সফরকে সহযোগিতা ও বন্ধুত্বের সফর হিসেবে বর্ণনা করেছেন। যদিও কিছু ভারতীয় মিডিয়া এই সফর নিয়ে আপাতদৃষ্টিতে উদ্বিগ্ন। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন যে, চীন-বাংলাদেশ সম্পর্কের উন্নয়ন কোনো তৃতীয় পক্ষকে লক্ষ্য করে না, বরং দক্ষিণ এশিয়ায় সামগ্রিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য সহায়ক হবে।

সাম্প্রতিক বৈঠকে শি জিনপিং শেখ হাসিনাকে বলেন, চীন ও বাংলাদেশ এমন প্রতিবেশী যারা একে অপরকে ভালোভাবে জানে এবং হাজার বছর ধরে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের আদান-প্রদান করেছে। কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার পর থেকে দুই দেশ সর্বদা একে অপরকে সম্মান ও সমর্থন করেছে। একে অপরকে সমান চোখে দেখেছে এবং সহযোগিতা করেছে। বন্ধুত্বের আদান প্রদান এবং পারস্পরিক সহযোগিতার উদাহরণ স্থাপন করেছে, বিশেষ করে ‘গ্লোবাল সাউথে’ ।

চীন নিজের ও বাংলাদেশের পুরনো প্রজন্মের নেতাদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত গভীর বন্ধুত্বকে লালন করে এবং আগামী বছর কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ৫০তম বার্ষিকীকে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের ( বিআরআই ) অধীনে উচ্চমানের যৌথ নির্মাণ প্রকল্পকে আরও গভীর করতে ইচ্ছুক। বিআরআই এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতার হাত বাড়াতে চান চীনা প্রেসিডেন্ট শি। তিনি জোর দেন যে, চীন একটি স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি মেনে চলার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে সমর্থন করে।

উভয়েই জাতীয় সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা ও আঞ্চলিক অখণ্ডতাকে রক্ষা করে। কোনো বহিরাগত হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করে উন্নয়নের পথকে অনুসরণ করে। শেখ হাসিনা জানান, বাংলাদেশ দৃঢ়ভাবে এক-চীন নীতি মেনে চলে। তাইওয়ান প্রশ্নে চীনের অবস্থানকে সমর্থন করে, চীনের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বহিরাগত শক্তির হস্তক্ষেপের দৃঢ় বিরোধিতা করে এবং চীনের মূল স্বার্থ রক্ষাকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে।

এর আগে বুধবার চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াংও শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা অনুসারে, দুই দেশ দুটি পুনর্নবীকরণ সমঝোতা স্মারক সহ ২১ টি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে এবং আরও সাতটি প্রকল্প ঘোষণা করেছে। লি ও হাসিনার মধ্যে আলোচনায় মূলত বাণিজ্য ও বিনিয়োগের পাশাপাশি বিভিন্ন আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিষয় প্রাধান্য পেয়েছে। অর্থনৈতিক ও ব্যাংকিং খাতে সহযোগিতা, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, ডিজিটাল অর্থনীতি, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সহায়তা, ৬ষ্ঠ ও ৯ম বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু নির্মাণ, বাংলাদেশ থেকে কৃষিপণ্য রপ্তানি এবং জনসংযোগের বিষয়ে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক সম্পর্ক

বেইজিংয়ে থাকাকালীন শেখ হাসিনা ‘বাংলাদেশ-চীন বিজনেস, ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট সামিটে’ যোগ দেন এবং একটি বক্তৃতা দেন। CGTN অনুযায়ী, ‘হাসিনা চীনের ব্যবসায়ী সম্প্রদায়কে বাংলাদেশের প্রধান খাতগুলো যেমন জ্বালানি, নবায়নযোগ্য জ্বালানি এবং লজিস্টিক কেন্দ্রগুলো বিবেচনা করতে উৎসাহিত করেছেন। হাসিনা বলেছেন, ‘বাংলাদেশ চীনে আরও পণ্য রপ্তানি করতে আগ্রহী, যেমন টেক্সটাইল, গার্মেন্টস, চামড়া এবং অন্যান্য পণ্য। অনুষ্ঠানে, শিল্প জায়ান্ট হুয়াওয়ে এবং চায়না ন্যাশনাল কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ কর্পোরেশন বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের সাথে একটি সহযোগিতা স্মারক স্বাক্ষর করে।

সিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজি ইনস্টিটিউটের গবেষণা বিভাগের পরিচালক কিয়ান ফেং বলেন, হাসিনার এই সফর দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের জন্য অতীত ও ভবিষ্যতের মধ্যে একটি যোগসূত্র, বিশেষ করে অর্থনীতি ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে উচ্চ পর্যায়ের সহযোগিতার উন্নয়নে। কিয়ান বলেন, দুই দেশের মধ্যে ভবিষ্যতে আরও অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য সহযোগিতা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। দু’জনের মধ্যে কৌশলগত সহযোগিতামূলক সম্পর্ক আরও গভীর হবে। চীনের জেনারেল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অফ কাস্টমস এর প্রকাশিত সর্বশেষ বাণিজ্য তথ্যে জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত চীন-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৭৪.৯১ বিলিয়ন ইউয়ান (১০.৩০ বিলিয়ন ডলার ), যা বছরে ০.২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। চীন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার। চীন দক্ষিণ এশিয়ার দেশটিতে বিনিয়োগের অন্যতম উৎস। বাংলাদেশে চীনা দূতাবাসের মতে, ২০২৩ সালের শেষ নাগাদ, বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগের স্টক প্রায় ১.৪ বিলিয়ন ডলার বেড়েছে। বাংলাদেশে প্রায় ৭০০টি চীনা-অর্থায়িত কোম্পানি রয়েছে, যা ৫ লাখ ৫০ হাজারেরও বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে।

সাংহাই একাডেমি অফ সোশ্যাল সায়েন্সেসের ইনস্টিটিউট অফ ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনের রিসার্চ ফেলো হু ঝিয়াং বলেছেন, হাসিনার চীন সফর দুই দেশের মধ্যে ঐতিহ্যপূর্ণ বন্ধুত্বকে আরও গভীর করবে। হু বলেন, বিগত বছরগুলোতে সহযোগিতার মাধ্যমে বাংলাদেশ স্পষ্টভাবে দেখেছে যে, চীনের উন্নয়নমূলক দৃষ্টিভঙ্গি এবং অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেছে। বিশেষ করে, বাংলাদেশের অবকাঠামো নির্মাণে চীনা উদ্যোগের অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা, বাংলাদেশে স্থানীয় চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য পেশাদারদের প্রশিক্ষণে চীনের সহায়তা এবং দুই দেশের জনগণের মধ্যে আদান-প্রদানের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে । কিয়ান মনে করেন, দুই দেশের মধ্যে এই সহযোগিতা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোর কাছে তুলে ধরেছে চীন এক ‘ভালো-প্রতিবেশী’, দায়িত্বশীল প্রধান শক্তি হিসেবে চীনের ভাবমূর্তি তাদের কাছে আজ স্পষ্ট।

ভারসাম্য এবং সুযোগ

চীনের শীর্ষ রাজনৈতিক উপদেষ্টা ওয়াং হুনিংয়ের সঙ্গেও কথা বলেছেন শেখ হাসিনা। চাইনিজ পিপলস পলিটিক্যাল কনসালটেটিভ কনফারেন্সের (সিপিপিসিসি) জাতীয় কমিটির চেয়ারম্যান ওয়াং বলেন, দুই দেশের নেতাদের কৌশলগত দিকনির্দেশনায় চীন ও বাংলাদেশ পরস্পরকে সম্মান করে এবং একে অপরকে সমান চোখে দেখে বন্ধুত্বপূর্ণ সহাবস্থানের একটি ভালো উদাহরণ স্থাপন করে। কিন্তু কিছু ভারতীয় মিডিয়া আউটলেট হাসিনার চীন সফরকে দুই মূল খেলোয়াড়কে খুশি রাখার জন্য একটি ভারসাম্যমূলক পদক্ষেপ হিসাবে দেখেছে। কারণ তার ক্ষমতায় থাকার জন্য ভারত এবং অর্থনৈতিক সহায়তার জন্য চীনকে প্রয়োজন। কিছু ভারতীয় গণমাধ্যম বেইজিং ও ঢাকার মধ্যে সহযোগিতার কথাও বলেছে। শেখ হাসিনার বেইজিং সফর তার নয়াদিল্লি সফরের পরপরই সংঘটিত হয়। শেখ হাসিনা ২১ থেকে ২২ জুন ভারতে দুই দিনের সফর করেন। এই সময় উভয় পক্ষ সামুদ্রিক নিরাপত্তা, মহাসাগরীয় অর্থনীতি, মহাকাশ এবং টেলিযোগাযোগ খাতে সহযোগিতা সম্প্রসারণের চুক্তি স্বাক্ষর করে। হাসিনার চীন সফরের আগে, বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং দেশের সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ৬ জুলাই দুই বৃহৎ শক্তির সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন যে, ‘ভারত বাংলাদেশের রাজনৈতিক বন্ধু এবং চীন উন্নয়ন সহযোগী’ ।

কিছু বিশ্লেষক বলেছেন , ক্রমবর্ধমান ভূ-রাজনৈতিক খেলার সাথে সাথে বাংলাদেশের মতো দক্ষিণ এশিয়ার কিছু দেশ একটি কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছে। তারা যদি দ্রুত অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন অর্জন করতে চায় তবে তাদের চীনের সাথে সহযোগিতা করতে হবে। চীনের সাথে ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক সহযোগিতা অনিবার্যভাবে ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলো থেকে রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত চাপ তৈরি করবে। হু মনে করেন, ‘দক্ষিণ এশিয়ার কোনো নেতা যখনই চীন সফরে যান ভারত সবসময় বাধা দেয়ার জন্য বিভিন্ন অজুহাত খাঁড়া করে। তবে চীনের সঙ্গে অন্যান্য দেশের সম্পর্ক তৈরি হলে তা ভারতের সঙ্গে তাদের সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করবে বলে ভারতের উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত নয়।’

শেখ হাসিনার সফর চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উন্নয়নের পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়ার সার্বিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য সহায়ক হবে বলে মনে করেন হু । কিয়ান মনে করিয়ে দেন, চীন-বাংলাদেশ সম্পর্কের উন্নয়ন কোনো তৃতীয় পক্ষকে লক্ষ্য করে না। চীন লাভ-লোকসানে বিশ্বাস না করে পারস্পরিক সহযোগিতার পক্ষে অবস্থান করে। আর তাই জটিল ভূ-রাজনীতির পটভূমিতে চীন বাংলাদেশের কৌশলগত পছন্দকে সম্মান করে এবং অন্যান্য দেশের সাথে বাংলাদেশ বন্ধুত্বপূর্ণ ও সহযোগিতামূলক সম্পর্ক গড়ে তুললে তার কোনো আপত্তি নেই। ভারতের চাপের মুখে চীন-বাংলাদেশ সম্পর্কের উন্নয়ন ঢাকাকে তার কূটনৈতিক স্বাধীনতা এবং উন্নয়নের সুযোগগুলো আরও ভালোভাবে খতিয়ে দেখার জন্য একটি মূল্যবান সুযোগ প্রদান করে। সূত্র: মানবজমিন।

Tag :

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

গ্লোবাল টাইমসের দৃষ্টিতে যখনই দক্ষিণ এশিয়ার কোনো নেতা চীন সফরে যান তখনই ভারত নানা অজুহাত খাঁড়া করে

প্রকাশের সময় : ০৪:২০:০৪ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৪ জুলাই ২০২৪

চীন ও বাংলাদেশ তাদের সম্পর্ককে কৌশলগত সহযোগিতামূলক অংশীদারিত্বে উন্নীত করেছে। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেইজিংয়ের বৈঠকে এ ঘোষণা দেন। বিশেষজ্ঞরা হাসিনার চীন সফরকে সহযোগিতা ও বন্ধুত্বের সফর হিসেবে বর্ণনা করেছেন। যদিও কিছু ভারতীয় মিডিয়া এই সফর নিয়ে আপাতদৃষ্টিতে উদ্বিগ্ন। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন যে, চীন-বাংলাদেশ সম্পর্কের উন্নয়ন কোনো তৃতীয় পক্ষকে লক্ষ্য করে না, বরং দক্ষিণ এশিয়ায় সামগ্রিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য সহায়ক হবে।

সাম্প্রতিক বৈঠকে শি জিনপিং শেখ হাসিনাকে বলেন, চীন ও বাংলাদেশ এমন প্রতিবেশী যারা একে অপরকে ভালোভাবে জানে এবং হাজার বছর ধরে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের আদান-প্রদান করেছে। কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার পর থেকে দুই দেশ সর্বদা একে অপরকে সম্মান ও সমর্থন করেছে। একে অপরকে সমান চোখে দেখেছে এবং সহযোগিতা করেছে। বন্ধুত্বের আদান প্রদান এবং পারস্পরিক সহযোগিতার উদাহরণ স্থাপন করেছে, বিশেষ করে ‘গ্লোবাল সাউথে’ ।

চীন নিজের ও বাংলাদেশের পুরনো প্রজন্মের নেতাদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত গভীর বন্ধুত্বকে লালন করে এবং আগামী বছর কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ৫০তম বার্ষিকীকে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের ( বিআরআই ) অধীনে উচ্চমানের যৌথ নির্মাণ প্রকল্পকে আরও গভীর করতে ইচ্ছুক। বিআরআই এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতার হাত বাড়াতে চান চীনা প্রেসিডেন্ট শি। তিনি জোর দেন যে, চীন একটি স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি মেনে চলার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে সমর্থন করে।

উভয়েই জাতীয় সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা ও আঞ্চলিক অখণ্ডতাকে রক্ষা করে। কোনো বহিরাগত হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করে উন্নয়নের পথকে অনুসরণ করে। শেখ হাসিনা জানান, বাংলাদেশ দৃঢ়ভাবে এক-চীন নীতি মেনে চলে। তাইওয়ান প্রশ্নে চীনের অবস্থানকে সমর্থন করে, চীনের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বহিরাগত শক্তির হস্তক্ষেপের দৃঢ় বিরোধিতা করে এবং চীনের মূল স্বার্থ রক্ষাকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে।

এর আগে বুধবার চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াংও শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা অনুসারে, দুই দেশ দুটি পুনর্নবীকরণ সমঝোতা স্মারক সহ ২১ টি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে এবং আরও সাতটি প্রকল্প ঘোষণা করেছে। লি ও হাসিনার মধ্যে আলোচনায় মূলত বাণিজ্য ও বিনিয়োগের পাশাপাশি বিভিন্ন আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিষয় প্রাধান্য পেয়েছে। অর্থনৈতিক ও ব্যাংকিং খাতে সহযোগিতা, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, ডিজিটাল অর্থনীতি, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সহায়তা, ৬ষ্ঠ ও ৯ম বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু নির্মাণ, বাংলাদেশ থেকে কৃষিপণ্য রপ্তানি এবং জনসংযোগের বিষয়ে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক সম্পর্ক

বেইজিংয়ে থাকাকালীন শেখ হাসিনা ‘বাংলাদেশ-চীন বিজনেস, ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট সামিটে’ যোগ দেন এবং একটি বক্তৃতা দেন। CGTN অনুযায়ী, ‘হাসিনা চীনের ব্যবসায়ী সম্প্রদায়কে বাংলাদেশের প্রধান খাতগুলো যেমন জ্বালানি, নবায়নযোগ্য জ্বালানি এবং লজিস্টিক কেন্দ্রগুলো বিবেচনা করতে উৎসাহিত করেছেন। হাসিনা বলেছেন, ‘বাংলাদেশ চীনে আরও পণ্য রপ্তানি করতে আগ্রহী, যেমন টেক্সটাইল, গার্মেন্টস, চামড়া এবং অন্যান্য পণ্য। অনুষ্ঠানে, শিল্প জায়ান্ট হুয়াওয়ে এবং চায়না ন্যাশনাল কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ কর্পোরেশন বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের সাথে একটি সহযোগিতা স্মারক স্বাক্ষর করে।

সিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজি ইনস্টিটিউটের গবেষণা বিভাগের পরিচালক কিয়ান ফেং বলেন, হাসিনার এই সফর দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের জন্য অতীত ও ভবিষ্যতের মধ্যে একটি যোগসূত্র, বিশেষ করে অর্থনীতি ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে উচ্চ পর্যায়ের সহযোগিতার উন্নয়নে। কিয়ান বলেন, দুই দেশের মধ্যে ভবিষ্যতে আরও অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য সহযোগিতা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। দু’জনের মধ্যে কৌশলগত সহযোগিতামূলক সম্পর্ক আরও গভীর হবে। চীনের জেনারেল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অফ কাস্টমস এর প্রকাশিত সর্বশেষ বাণিজ্য তথ্যে জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত চীন-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৭৪.৯১ বিলিয়ন ইউয়ান (১০.৩০ বিলিয়ন ডলার ), যা বছরে ০.২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। চীন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার। চীন দক্ষিণ এশিয়ার দেশটিতে বিনিয়োগের অন্যতম উৎস। বাংলাদেশে চীনা দূতাবাসের মতে, ২০২৩ সালের শেষ নাগাদ, বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগের স্টক প্রায় ১.৪ বিলিয়ন ডলার বেড়েছে। বাংলাদেশে প্রায় ৭০০টি চীনা-অর্থায়িত কোম্পানি রয়েছে, যা ৫ লাখ ৫০ হাজারেরও বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে।

সাংহাই একাডেমি অফ সোশ্যাল সায়েন্সেসের ইনস্টিটিউট অফ ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনের রিসার্চ ফেলো হু ঝিয়াং বলেছেন, হাসিনার চীন সফর দুই দেশের মধ্যে ঐতিহ্যপূর্ণ বন্ধুত্বকে আরও গভীর করবে। হু বলেন, বিগত বছরগুলোতে সহযোগিতার মাধ্যমে বাংলাদেশ স্পষ্টভাবে দেখেছে যে, চীনের উন্নয়নমূলক দৃষ্টিভঙ্গি এবং অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেছে। বিশেষ করে, বাংলাদেশের অবকাঠামো নির্মাণে চীনা উদ্যোগের অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা, বাংলাদেশে স্থানীয় চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য পেশাদারদের প্রশিক্ষণে চীনের সহায়তা এবং দুই দেশের জনগণের মধ্যে আদান-প্রদানের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে । কিয়ান মনে করেন, দুই দেশের মধ্যে এই সহযোগিতা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোর কাছে তুলে ধরেছে চীন এক ‘ভালো-প্রতিবেশী’, দায়িত্বশীল প্রধান শক্তি হিসেবে চীনের ভাবমূর্তি তাদের কাছে আজ স্পষ্ট।

ভারসাম্য এবং সুযোগ

চীনের শীর্ষ রাজনৈতিক উপদেষ্টা ওয়াং হুনিংয়ের সঙ্গেও কথা বলেছেন শেখ হাসিনা। চাইনিজ পিপলস পলিটিক্যাল কনসালটেটিভ কনফারেন্সের (সিপিপিসিসি) জাতীয় কমিটির চেয়ারম্যান ওয়াং বলেন, দুই দেশের নেতাদের কৌশলগত দিকনির্দেশনায় চীন ও বাংলাদেশ পরস্পরকে সম্মান করে এবং একে অপরকে সমান চোখে দেখে বন্ধুত্বপূর্ণ সহাবস্থানের একটি ভালো উদাহরণ স্থাপন করে। কিন্তু কিছু ভারতীয় মিডিয়া আউটলেট হাসিনার চীন সফরকে দুই মূল খেলোয়াড়কে খুশি রাখার জন্য একটি ভারসাম্যমূলক পদক্ষেপ হিসাবে দেখেছে। কারণ তার ক্ষমতায় থাকার জন্য ভারত এবং অর্থনৈতিক সহায়তার জন্য চীনকে প্রয়োজন। কিছু ভারতীয় গণমাধ্যম বেইজিং ও ঢাকার মধ্যে সহযোগিতার কথাও বলেছে। শেখ হাসিনার বেইজিং সফর তার নয়াদিল্লি সফরের পরপরই সংঘটিত হয়। শেখ হাসিনা ২১ থেকে ২২ জুন ভারতে দুই দিনের সফর করেন। এই সময় উভয় পক্ষ সামুদ্রিক নিরাপত্তা, মহাসাগরীয় অর্থনীতি, মহাকাশ এবং টেলিযোগাযোগ খাতে সহযোগিতা সম্প্রসারণের চুক্তি স্বাক্ষর করে। হাসিনার চীন সফরের আগে, বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং দেশের সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ৬ জুলাই দুই বৃহৎ শক্তির সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন যে, ‘ভারত বাংলাদেশের রাজনৈতিক বন্ধু এবং চীন উন্নয়ন সহযোগী’ ।

কিছু বিশ্লেষক বলেছেন , ক্রমবর্ধমান ভূ-রাজনৈতিক খেলার সাথে সাথে বাংলাদেশের মতো দক্ষিণ এশিয়ার কিছু দেশ একটি কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছে। তারা যদি দ্রুত অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন অর্জন করতে চায় তবে তাদের চীনের সাথে সহযোগিতা করতে হবে। চীনের সাথে ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক সহযোগিতা অনিবার্যভাবে ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলো থেকে রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত চাপ তৈরি করবে। হু মনে করেন, ‘দক্ষিণ এশিয়ার কোনো নেতা যখনই চীন সফরে যান ভারত সবসময় বাধা দেয়ার জন্য বিভিন্ন অজুহাত খাঁড়া করে। তবে চীনের সঙ্গে অন্যান্য দেশের সম্পর্ক তৈরি হলে তা ভারতের সঙ্গে তাদের সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করবে বলে ভারতের উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত নয়।’

শেখ হাসিনার সফর চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উন্নয়নের পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়ার সার্বিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য সহায়ক হবে বলে মনে করেন হু । কিয়ান মনে করিয়ে দেন, চীন-বাংলাদেশ সম্পর্কের উন্নয়ন কোনো তৃতীয় পক্ষকে লক্ষ্য করে না। চীন লাভ-লোকসানে বিশ্বাস না করে পারস্পরিক সহযোগিতার পক্ষে অবস্থান করে। আর তাই জটিল ভূ-রাজনীতির পটভূমিতে চীন বাংলাদেশের কৌশলগত পছন্দকে সম্মান করে এবং অন্যান্য দেশের সাথে বাংলাদেশ বন্ধুত্বপূর্ণ ও সহযোগিতামূলক সম্পর্ক গড়ে তুললে তার কোনো আপত্তি নেই। ভারতের চাপের মুখে চীন-বাংলাদেশ সম্পর্কের উন্নয়ন ঢাকাকে তার কূটনৈতিক স্বাধীনতা এবং উন্নয়নের সুযোগগুলো আরও ভালোভাবে খতিয়ে দেখার জন্য একটি মূল্যবান সুযোগ প্রদান করে। সূত্র: মানবজমিন।