সৌদি-ইরান সম্পর্ক টেকসই হবে?
- প্রকাশের সময় : ০১:৩২:২৯ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৩ মার্চ ২০২৩
- / ৪৩ বার পঠিত
আন্তর্জাতিক দেশ : দুই দেশই একই ধর্মের অনুসারী। তবে ধর্মীয় গোষ্ঠীগত দিক দিয়ে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব চরমে। তাদের বিরোধের কারণেই সারা বিশ্বে এই ধর্মীয় গোষ্ঠী দুটিও নানা রকমের দ্বন্দ্বে জড়িত। বলা হয়, অন্য ধর্মের চেয়েও সৌদি আরব শিয়াপন্থি ইরানকে বেশি শত্রুভাবাপন্ন মনে করে। সেই দেশ দুটি দীর্ঘ সাত বছর পর কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপনে রাজি হয়েছে। খুলতে যাচ্ছে দূতাবাস। চীনের মধ্যস্থতায় হওয়া এই সমঝোতাকে স্বাগত জানিয়েছে বিশ্ব। মধ্যপ্রাচ্যে এই দুটি দেশের দ্বন্দ্বের সুবিধাভোগী যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইল স্বাগত জানায়নি। তবে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে যে, চরম বৈরী সৌদি আরব-ইরানের সম্পর্ক কতটা টেকসই হবে তা নিয়ে।
সিদ্ধান্তটা ঐতিহাসিকই বটে : ২০১৬ সালে সৌদি আরবে এক শিয়া নেতাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার পর তেহরানে সৌদি দূতাবাসে হামলা হয়। এরপর সৌদি আরব ইরানের সঙ্গে সব ধরনের কূটনৈতিক সম্পর্ক বাতিল করে। দেশ দুটি চরম শত্রুতে পরিণত হয়। ইয়েমেনে গৃহযুদ্ধে যে হাজার হাজার মানুষ মারা গেছে তা মূলত এই দুটি দেশের দ্বন্দ্বের কারণেই। তাদের সমঝোতার টেবিলে আনতে নানা চেষ্টা-তদবির চলে। ২০২১ সালের এপ্রিল থেকে তাদের মতবিরোধ দূর করার চেষ্টা হয়। কিন্তু সম্ভব হয়নি। অবশেষে গত ডিসেম্বরে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সৌদি আরব সফর এবং গত মাসে ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসিকে চীনে আমন্ত্রণ জানানো হয়। মূলত এই দুই সফরেই সমঝোতার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়।
মধ্যপ্রাচ্যের দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে বেইজিংয়ে আলোচনার বিষয়টি আগে জানানো হয়নি। চার দিন আলোচনার পর চূড়ান্ত চুক্তিতে পৌঁছানোর পর এ বিষয়ে ঘোষণা দেওয়া হয়। হোয়াইট হাউজের মুখপাত্র জন কিরবি গত শুক্রবার বলেন, এই চুক্তিতে ওয়াশিংটন সরাসরি যুক্ত ছিল না। তবে ইরানের সঙ্গে আলোচনার বিষয়টি সৌদি আরবের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে জানানো হয়েছিল।
আরোও পড়ুন। সৌদি-চীন নৈকট্য নিয়ে বিচলিত ইরানি প্রেসিডেন্ট বেইজিংয়ে
ওয়াশিংটন কেন অস্বস্তিতে : বেইজিং থেকে ইরান এবং সৌদি আরবের মধ্যে সমঝোতার খবর যখন প্রথম এলো, সেটি ওয়াশিংটনে একই সঙ্গে বিস্ময় এবং শঙ্কা তৈরি করে। এর মূল কারণ অবশ্য ইরান-সৌদি আরব সমঝোতা নয়, তাদের অস্বস্তি এবং শঙ্কার মূল কারণ এই সমঝোতায় চীন যে ভূমিকা পালন করেছে। মধ্যপ্রাচ্যে বহু দশক ধরে সব ধরনের সংঘাতে রেফারির ভূমিকায় ছিল যুক্তরাষ্ট্র। এখন তাদের সেই প্রভাব বলয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার নামে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে যেভাবে চীন ঢুকে পড়ছে—সেটি মার্কিন নীতি-নির্ধারকদের জন্য সাংঘাতিক শিরঃপীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনে সম্পর্কে গত কিছুদিন ধরে মারাত্মক টানাপোড়ন দেখা যাচ্ছে। সেই প্রেক্ষাপটে চীনের এই ভূমিকাকে বিশ্ব জুড়ে মার্কিন একাধিপত্যের প্রতি আরেকটি চ্যালেঞ্জ বলে বর্ণনা করছেন কেউ কেউ। যুক্তরাষ্ট্রের একজন সাবেক ঊর্ধ্বতন কূটনীতিক ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের ফেলো জেফরি ফেল্টম্যানের ভাষায়, বেইজিংয়ের এই ভূমিকাকে বাইডেন প্রশাসনের জন্য চাপ তৈরি করবে এবং চীন যে এক উদীয়মান শক্তি সেভাবেই দেখা হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা প্রশাসনের শীর্ষস্থানীয় কূটনীতিক ড্যানিয়েল রাসেল বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, ইরান এবং সৌদি আরবের মধ্যে এই সমঝোতায় চীন যে ভূমিকা পালন করেছে, ওয়াশিংটনের জন্য সেটির অনেক গুরুত্বপূর্ণ তাত্পর্য রয়েছে। তিনি বলেন, যে সংঘাতে চীন কোন পক্ষ নয়, সেখানে নিজ থেকে উদ্যোগী হয়ে এভাবে কূটনৈতিক সমঝোতার চেষ্টা করা খুবই ব্যতিক্রমী এক ঘটনা। তিনি বলেন, এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ভবিষ্যতে কি এরকমই আমরা দেখবো? চীনের প্রেসিডেন্ট শি যখন মস্কো সফর করবেন, তখন সেখানে রাশিয়া আর ইউক্রেনের মধ্যে মধ্যস্থতার যে চেষ্টা চীন করবে, এটা কি তার পূর্বাভাস? চীনের আসল উদ্দেশ্য নিয়ে এরই মধ্যে ওয়াশিংটনে অনেকে সন্দিহান হয়ে উঠেছেন। এধরনের মধ্যস্থতায় চীনের ক্রমবর্ধমান ভূমিকাকে কোনো কোনো বিশ্লেষক বিশ্ব বলয়ে দেশটির ক্রমবর্ধমান প্রভাব এবং যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষয়িষ্ণু শক্তির ইঙ্গিত বলে মনে করছেন। ওয়াশিংটনের সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের জন অল্টারম্যান বলেন, কোনো লুকোছাপা না করে বেইজিং যে বার্তাটা এখানে পাঠাতে চাইছে তা হলো, উপসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিশালী সামরিক শক্তির বিপরীতে চীন এক উদীয়মান এবং শক্তিশালী কূটনৈতিক শক্তি হিসেবে উপস্থিত হতে চাইছে।
টেকসই হবে তো ? : দুই দেশের মধ্যে হওয়া চুক্তি অনেক সমস্যার মাত্র একটির সমাধান বলে মনে করেন তেহরান ভিত্তিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক ডিয়াকো হোসেইন। তার মতে, সৌদি আরব এখনো ইরানের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়া নিয়ে সতর্ক অবস্থায়। কারণ দেশটি যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়তে চাইবে না। ডিয়াকো হোসেইন আলজাজিরাকে বলেন, এই চুক্তির অর্থ এই নয় যে, তাদের মধ্যে সবক্ষেত্রেই আস্থার সম্পর্ক তৈরি হয়ে যাবে। বিশেষ করে, ইয়েমেন, লেবানন, সিরিয়া এবং ইরাকে দুই দেশেরই স্বার্থ রয়েছে। ডিয়াকো হোসেইনের মতে, চুক্তিকে কিছুটা হলেও সফল বলা যাবে যদি ইয়েমেনে একটা স্থায়ী যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হতে পারে দুই দেশ। কিন্তু স্বার্থ ছাড় দিয়ে এই ধরনের সিদ্ধান্তে আসা খুবই কঠিন। তাই চুক্তিকে সফল করতে হলে উভয় দেশকেই দীর্ঘমেয়াদে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে।
আরোও পড়ুন। সৌদিতে মুক্তি পেলেন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ১৩ বছরের রাজনৈতিক বন্দি
অটোয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট স্কুল অব পাবলিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের সহযোগী অধ্যাপক টমাস জুনাউ বলেন, এই চুক্তি উত্তেজনা হয়তো কমাবে। কারণ দুই দেশের মধ্যে শত্রুতা দীর্ঘ দশকের। তার মতে, চুক্তি অনুযায়ী ইয়েমেনে ইরান হয়তো কিছুটা ছাড় দেবে। কিন্তু হুতি বিদ্রোহীদের সমর্থন দেওয়া কখনোই বন্ধ করবে না। কারণ এদের কারণেই আরব উপত্যকার দক্ষিণ-পশ্চিমে ইরান প্রভাব বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে।
আবার সম্পর্কের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েন লেগে আছে প্রায় এক শতাব্দী ধরে। বিশেষ করে ইরানে ইসলামি অভ্যুত্থানের পর সম্পর্কের অবনতি হয়। ১৯৮০ সালে ইরাকের তত্কালীন প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের ইরানে হামলাকে সমর্থন করে সৌদি আরব। যদিও পরে আবার দেশ দুটির মধ্যে সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা লক্ষ্য করা যায়। ইরানে সংস্কারপন্থি নেতা মোহাম্মদ খাতামির আমলে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক উন্নত হয়। ১৯৯৮ সালে দুই দেশের মধ্যে স্বাভাবিক সহযোগিতা সম্পর্কের চুক্তি এবং ২০০১ সালে নিরাপত্তা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ইরানের বর্তমান নিরাপত্তা বিষয়ক প্রধান আলী শামখানি ঐ সময় প্রতিরক্ষামন্ত্রী ছিলেন। বর্তমানের চুক্তিতে তিনিই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি সৌদি আরবের সর্বোচ্চ বেসামরিক পদকজয়ী। ওয়াশিংটন ডিসি ভিত্তিক সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল পলিসির অনাবাসী সিনিয়র ফেলো সিনা তুসির মতে, এবারের চুক্তিতে আগের চুক্তিগুলোর কথা উল্লেখ আছে যা ইতিবাচক। এই দিকে লক্ষ্য রেখে যদি তারা সম্পর্ক এগিয়ে নিতে পারে তাহলে ভালো কিছু ফল পাওয়া যাবে।
এদিকে জাতিসংঘ মহাসচিব হতে শুরু করে বিশ্বনেতারা বিবৃতি দিয়ে এই সমঝোতাকে স্বাগত জানিয়েছেন। তবে ব্যতিক্রম ছিল দুটি দেশের প্রতিক্রিয়া:যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইল। মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্বে দুটি দেশই ইরানকে চরম বৈরী হিসেবে দেখে, ইরানও এই দুটি দেশকে তাদের দেশের নিরাপত্তা এবং সার্বভৌমত্বের জন্য এক নম্বর হুমকি বলে বিবেচনা করে।
হোয়াইট হাউজের মুখপাত্র জন কিরবি ইরান এবং সৌদি আরবের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের সিদ্ধান্তকে ‘সতর্ক ভাষায়’ স্বাগত জানালেও এরই মধ্যে প্রশ্ন তুলেছেন এটি টিকবে কি না। জন কিরবি বলেছেন, ইরান তাদের অঙ্গীকার রক্ষা করবে কি না, সেটা দেখতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভের পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান রিপাবলিকান সদস্য মাইকেল ম্যাককল তো চীনকে শান্তির মধ্যস্থতাকার হিসেবে মানতেই নারাজ। তার ভাষায়, চীন কোনো দায়িত্বশীল শক্তি নয় এবং একজন নিরপেক্ষ এবং ন্যায্য মধ্যস্থতাকারী হিসেবে তাদের ওপর আস্থা রাখা যায় না।
মধ্যপ্রাচ্যে ইরান এবং সৌদি আরবের দ্বন্দ্বের সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী হিসেবে দেখা হয় যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইলকে। পুরো মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে বহু দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে তার ভূরাজনৈতিক স্বার্থ বজায় রাখতে পেরেছে, সেক্ষেত্রে ইরান-সৌদি দ্বন্দ্ব মারাত্মকভাবে সহায়ক হয়েছে। অন্যদিকে ইসরাইলও এই দ্বন্দ্বের সুযোগ নিয়ে ‘শত্রুর শত্রু আমাদের মিত্র’ নীতি অনুসরণ করে ইরানের বৈরী কিছু উপসাগরীয় দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলেছে। স্বাভাবিকভাবেই ইরান এবং সৌদি আরবের মধ্যে যদি কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয় এবং ভবিষ্যতে সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়, সেটি উপসাগরীয় অঞ্চলের ভূরাজনৈতিক সম্পর্কে নতুন বিন্যাস তৈরি করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইল—দুটি দেশই মনে করে, এই নতুন পরিস্থিতি কোনোভাবেই তাদের স্বার্থের অনুকূলে যাবে না। —বিবিসি ও আলজাজিরা
সুমি/হককথা