সময় ফুরিয়ে আসছে, কমছে আশা, বাড়ছে ক্ষোভ
- প্রকাশের সময় : ০১:১২:৩৪ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৯ ফেব্রুয়ারী ২০২৩
- / ৪৮ বার পঠিত
একদিকে ধ্বংসস্তূপের পাহাড় জমেছে, অন্যদিকে প্রকৃতিতে নেমে এসেছে ভয়াবহ শীত। এ কারণে চরম বিপদে পড়েছেন তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভয়াবহ ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ। ধ্বংসস্তূপের নিচে এখনো আটকে আছেন অনেকেই। ক্ষুধার পাশাপাশি প্রচণ্ড ঠান্ডার সঙ্গেও লড়তে হচ্ছে তাঁদের, উদ্ধারকর্মীদের, বেঁচে যাওয়া কিন্তু ঘর হারানো মানুষদের। চরম প্রতিকূল আবহাওয়ায় বিলম্বিত হচ্ছে উদ্ধারকাজ।
এসবের জেরে সময় যত গড়াচ্ছে, ধ্বংসস্তূপ থেকে জীবিত ব্যক্তিদের উদ্ধারের আশা ততই কমে আসছে। আর এ পরিস্থিতি ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা তৈরি করেছে। তাঁদের মতে, সরকার যথাসময়ে যথাযথভাবে সাড়া দিতে ব্যর্থ হয়েছে, হচ্ছে। এ কারণে ভূমিকম্পের পরে ধ্বংসস্তূপ থেকে যাঁদের জীবিত উদ্ধারের সম্ভাবনা রয়েছে, তাঁদেরও মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।
জাতিসংঘে সিরিয়ার রাষ্ট্রদূত বলেছেন, ভয়াবহ এই ভূমিকম্পের পর দ্রুত উদ্ধারকাজ পরিচালনার জন্য তার সরকারের সক্ষমতা এবং প্রয়োজনীয় উপকরণ ও সরঞ্জামের অভাব রয়েছে। এক দশকের বেশি সময় ধরে চলমান গৃহযুদ্ধ ও পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকায় সিরিয়া এই সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি বলেও অভিযোগ করেছেন তিনি।
নিহতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে
তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভূমিকম্পে আজ বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত ১৫ হাজার ৩৮৩ জন প্রাণ হারিয়েছেন বলে জানা গেছে। এর মধ্যে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত তুরস্কে মারা গেছেন ১২ হাজার ৩৯১ জন। আর সিরিয়ায় ২ হাজার ৯৯২ জন। ৭ দশমিক ৮ মাত্রার এ ভূমিকম্পে দুই দেশে মৃত মানুষের সংখ্যা ব্যাপকভাবে বেড়ে চলেছে। তুরস্ক ও সিরিয়া সরকারের হিসাব অনুসারে, প্রথম দিন শেষে মৃত মানুষে সংখ্যা ছিল আড়াই হাজারের বেশি। দ্বিতীয় দিন এই সংখ্যা সাড়ে ৬ হাজার ছাড়িয়েছে। এখন পর্যন্ত এ সংখ্যা ছাড়িয়ে গেল সাড়ে ১৫ হাজার। ভূমিকম্পে তুরস্কের ১০টি ও সিরিয়ার ৪টি প্রদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
মরদেহের সংখ্যার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে স্বজনহারা মানুষের কান্না; বাড়ছে ঘরবাড়ি হারানো লোকজনের দুর্ভোগও। কেননা, যে পরিমাণ ধ্বংসযজ্ঞ ভূমিকম্প রেখে গেছে, তাতে উদ্ধারকাজে এখনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। এমনকি হতাহত এবং নিখোঁজ নারী-পুরুষ ও শিশুর সঠিক সংখ্যাটিও জানা যায়নি।
কোথায় রাষ্ট্র? কোথায় সরকার? দুই দিন ধরে তারা কোথায় ছিল? আমাদের এটা (উদ্ধারকাজ) করতে দিন। আমরাই তাঁদের বের করে আনতে পারব। সাবিহা আলিনাক, তুরস্কের হাতাই প্রদেশের মালাতায়া শহরের বাসিন্দা।
এরদোয়ানের সফর ও ক্ষোভ
উদ্ধারকাজের ধীরগতি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনেরা। ভূমিকম্পের পর প্রাথমিকভাবে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া দরকার ছিল, সেসব নিতে দেরি হচ্ছে—এমন অভিযোগ তাঁদের।
মোহাম্মদ সাফা নামের জাতিসংঘের এক প্রতিনিধি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টুইটারে ছবিটি শেয়ার করেছেন
তুরস্কের হাতাই প্রদেশে ভূমিকম্পে ৩ হাজার ৩০০-এর বেশি মানুষের প্রাণ গেছে। নিখোঁজ অনেকেই। উদ্ধারকাজে ধীরগতির কারণে প্রদেশটির মালাতায়া শহরে ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে আছেন সাবিহা আলিনাকের স্বজন। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘কোথায় রাষ্ট্র? কোথায় সরকার? দুই দিন ধরে তারা কোথায় ছিল? আমাদের এটা (উদ্ধারকাজ) করতে দিন। আমরাই তাঁদের বের করে আনতে পারব।’
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানও উদ্ধারকাজে ধীরগতির এসব অভিযোগের কথা স্বীকার করেছেন। গতকাল কাহরামানমারাস শহরে যান এরদোয়ান। তখন সেখানে পুরোদমে উদ্ধারকাজ চলছিল। এ সময় এরদোয়ান সাংবাদিকদের বলেন, উদ্ধার কার্যক্রম চালাতে গিয়ে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। ভূমিকম্পের কারণে সড়ক ও বিমান যোগাযোগব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় এ সমস্যা হচ্ছে। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে উদ্ধারকাজের গতি বাড়বে।
উদ্ধারকাজে ধীরগতির চিত্র দেখা গেছে সিরিয়াতেও। দেশটির উত্তরাঞ্চলের শহর জানদারিস। সেখানকার উদ্ধারকর্মী ও বাসিন্দারা জানিয়েছেন, বেশ কয়েকটি ভবন বিধ্বস্ত হয়েছে। জানদারিস শহরের একটি ভবনে ৩২টি অ্যাপার্টমেন্ট ছিল। এই ভবনের বেশ কয়েকজন বাসিন্দা বেঁচে গেছেন। তাঁরা বলেন, ভূমিকম্পের পর এখান থেকে কাউকে জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। উদ্ধারকাজের জন্য যেসব যন্ত্রপাতি দরকার, সেগুলো না থাকায় কাজ ধীরে চলছে।
ভূমিকম্পের পর যাঁদের জীবিত উদ্ধার করা হয়, তাঁদের মধ্যে ৯০ শতাংশ উদ্ধার হন তিন দিনের মধ্যে।
ইলান কেলমান, যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের অধ্যাপক।
জাতিসংঘে সিরিয়ার রাষ্ট্রদূত বলেছেন, ভয়াবহ এই ভূমিকম্পের পর দ্রুত উদ্ধারকাজ পরিচালনার জন্য তাঁর সরকারের সক্ষমতা এবং প্রয়োজনীয় উপকরণ ও সরঞ্জামের অভাব রয়েছে। এক দশকের বেশি সময় ধরে চলমান গৃহযুদ্ধ ও পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকায় সিরিয়া এই সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি বলেও অভিযোগ করেছেন তিনি।
গুরুত্বপূর্ণ ৭২ ঘণ্টা
সময় যত গড়াচ্ছে, তুরস্ক ও সিরিয়ার ধসে যাওয়া ভবনগুলো থেকে জীবিত মানুষদের উদ্ধারের সম্ভাবনা তত কমে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূমিকম্পের পর উদ্ধারকাজের জন্য ৭২ ঘণ্টা গুরুত্বপূর্ণ। এ প্রসঙ্গে যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের অধ্যাপক ইলান কেলমান বলেন, ভূমিকম্পের পর যাঁদের জীবিত উদ্ধার করা হয়, তাঁদের মধ্যে ৯০ শতাংশ উদ্ধার হন তিন দিনের মধ্যে।
তবে এটাও নির্ভর করে ঘটনাস্থলের আবহাওয়া, কড়াঘাত ও উদ্ধারকারী দলের কাজের গতির ওপর। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব বিবেচনায় তুরস্ক ও সিরিয়া পিছিয়ে আছে। দেশ দুটিতে যেমন পর্যাপ্ত উদ্ধারকর্মী নেই, তেমনি যন্ত্রপাতির সংকট রয়েছে। আবার আবহাওয়াও বৈরী।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান তেদরোস আধানোম গেব্রেয়াসুস সতর্ক করে বলেছেন, ভূমিকম্পে আহত ও ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে থাকা মানুষের জন্য সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। সংস্থাটির আশঙ্কা, ভয়াবহ এ ভূমিকম্পে দুই দেশে মৃত মানুষের মোট সংখ্যা ২০ হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে।
১৮ মাসের মাশাল জীবিত উদ্ধার
তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলের কাহরামানমারাস প্রদেশে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিলেন কিরাচাকালি দম্পতি। সঙ্গে তাঁদের ১৮ মাস বয়সী মেয়ে মাশালও ঘুমাচ্ছিল। এ সময় হঠাৎ কেঁপে ওঠে চারপাশ। ভবন দুলতে থাকে। তরুণ দম্পতি কিছু বুঝে ওঠার আগেই ধসে পড়ে ভবনটি। ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়েন স্বামী-স্ত্রী এবং তাঁদের শিশুসন্তান।
ভূমিকম্পের কিছুক্ষণ পর ধ্বংসস্তূপ থেকে বের হন ওমের কিরাচাকালি। কিন্তু ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে থাকেন তাঁর স্ত্রী ইয়েলিজ কিরাচিকালি ও মেয়ে মাশাল। এরপর কেটেছে ৫৫ ঘণ্টা। অবশেষে গতকাল বুধবার ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে মাশালকে উদ্ধার করা হয়েছে। তবে ইয়েলিজ এখনো সেখানে। তাঁকে উদ্ধার করার চেষ্টা চলছে।
তুরস্কের সংবাদমাধ্যমের খবর, ইয়েলিজ বেঁচে আছেন। তাঁর সঙ্গে কথা হয়েছে উদ্ধারকর্মীদের। ইয়েলিজ উদ্ধারকর্মীদের জানিয়েছেন, ভূমিকম্পে ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ার পর থেকে মাশালকে নিজের বুকের দুধ খাইয়ে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করেছেন তিনি। ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত কাহরামানমারাস শহর পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান
মাশাল তেমন গুরুতর কোনো আঘাত পায়নি। গতকাল মাশালকে উদ্ধার করার সময় ঘটনাস্থলে ছিলেন তাঁর বাবা ওমের কিরাচাকালি। মাশালকে জীবিত উদ্ধারের পর তাকে তার বাবার কাছে দিয়ে দেওয়া হয়। এখন স্ত্রী ইয়েলিজ কিরাচিকালিকে কখন ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে জীবিত উদ্ধার করা হবে, সে আশায় আছেন তিনি। তথ্যসূত্র: রয়টার্স, আল-জাজিরা ও বিবিসি অবলম্বনে।