আজ ১৫ আগস্ট
শেখ মুজিব হত্যায় যুক্তরাষ্ট্রের হাত, গুজব ছড়িয়েছিল ভারত থেকে
- প্রকাশের সময় : ০২:১২:৪০ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৫ অগাস্ট ২০২৪
- / ৮১ বার পঠিত
১৯৭৫ সালের ১৯ আগস্ট। কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় এক প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। এতে পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের যুব সংগঠনের প্রধান প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির একটি উদ্ধৃতি ব্যবহার করা হয়। বক্তব্যে দাবি করা হয় ‘উপমহাদেশে সিআইএ ও চীন কতটা সক্রিয়, তা শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে প্রমাণ হলো’।
শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডে যুক্তরাষ্ট্রকে অভিযুক্ত করে দেয়া কোনো বক্তব্যের এটিই প্রথম ছাপা নিদর্শন। প্রকৃতপক্ষে এ ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের জড়িত থাকার গুজবও প্রথম ভারতেই ওঠে। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড নিয়ে সে সময় ভারতজুড়ে নানা ধরনের প্রতিবাদ-বিক্ষোভ চলছিল। নয়াদিল্লিতে এমনই এক প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করে অল ইন্ডিয়া পিস অ্যান্ড সলিডারিটি অর্গানাইজেশন। সেখানে কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়ার (সিপিআই) রাজ্যসভা সদস্য ভুপেশ গুপ্তা অভিযোগ তোলেন, সিআইএ শেখ মুজিবের হত্যাকারীদের সহযোগিতা করেছিল।
তার ভাষ্যমতে, মুজিব হত্যাকাণ্ড ছিল মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সমর্থনে সংঘটিত ডানপন্থী ষড়যন্ত্রের অংশ। সিপিআই নেতা ও অল ইন্ডিয়া ওয়ার্ল্ড পিস কাউন্সিলের জেনারেল সেক্রেটারি রমেশ চন্দ্র বলেন, ‘সিআইএ যে এমন কোনো ষড়যন্ত্র করছে, তা আমি ১৯৭৫ সালের এপ্রিলেই ঢাকা সফরে এসে বুঝতে পেরেছিলাম। এ বিষয়ে সতর্ক করা হলে মুজিব বলেছিলেন, “আমি তা জানি”।’
ভারতে কংগ্রেস ও সিপিআই এবং কিছু গণমাধ্যমে ওঠা এমন অভিযোগে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানাতে থাকে নয়াদিল্লির মার্কিন দূতাবাস। এর মধ্যেই মার্কিনদের ক্ষোভকে আরো বাড়িয়ে দেয় ভারতে তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল কংগ্রেসের মুখপত্র যুগান্তরে প্রকাশিত একটি নিবন্ধ। নভেম্বরে প্রকাশিত ওই নিবন্ধে অভিযোগ করা হয়, ঢাকায় নিযুক্ত তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেভিড বোস্টার সামরিক অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত। এ প্রতিবেদন প্রকাশের পর যুগান্তরের সম্পাদক ডি আর বোস বরাবর প্রতিবাদ পাঠান কলকাতার মার্কিন কনস্যুলেট জেনারেলের পাবলিক অ্যাফেয়ার্স অফিসার।
জবাবে ডি আর বোস দাবি করলেন, তিনি এর কিছুই জানেন না। ওই নিবন্ধ সম্পর্কে তার কোনো ধারণা নেই। এমনকি কীভাবে তা যুগান্তর পত্রিকায় ছাপা হলো সেটিও তিনি বলতে পারবেন না।
তার ভাষ্যমতে, পত্রিকা ছাপা হয়ে সবার হাতে আসার আগের দিন অর্থাৎ ১৭ নভেম্বর সন্ধ্যায় তিনি আগে আগেই অফিস ত্যাগ করেন। সদ্য ঢাকাফেরত এক ভারতীয় আগন্তুক ওই নিবন্ধ যুগান্তর পত্রিকায় নিয়ে এসেছিলেন। ওই ব্যক্তি যুগান্তরের কোনো প্রতিনিধিও নন। আবার ওই আগন্তুকের পরিচয়ও প্রকাশ করেননি ডি আর বোস। তবে জানা যায়, নিবন্ধটি ছাপার জন্য প্রস্তুত (সম্পাদনা) করেছিলেন ও অনুমোদন দিয়েছিলেন সাবএডিটর দেব কুমার ঘোষ।
ক্ষুব্ধ মার্কিন কূটনীতিকদের শান্ত করার প্রয়াস চালান কংগ্রেস মুখপাত্র যুগান্তরের সম্পাদক ডি আর বোস। তাদের সঙ্গে কথোপকথনে তিনি দাবি করেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ নিয়ে তার কাছে অনেক তথ্য আছে। কিন্তু দূতাবাস থেকে যাচাই না করে আমি কোনো কিছুই ছাপাব না।’
তিনি দাবি করেন, তার কাছে ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের সামনে ডেভিড বোস্টারের প্রত্যাহার দাবি করে সংঘটিত বিশাল এক প্রতিবাদ সমাবেশেরও তথ্য আছে। এ সময় ডি আর বোস কলকাতার মার্কিন কনস্যুলেটের প্রতিনিধিদের কাছে ওই নিবন্ধের জন্য ক্ষমা চান। একই সঙ্গে তারা কোনো কিছু চাইলে তা ছাপানোরও প্রতিশ্রুতি দেন। এ সুযোগ লুফে নেয় মার্কিন দূতাবাস। তাদের পক্ষ থেকে যুগান্তরের প্রথম পৃষ্ঠায় একটি সংশোধনী ছাপার দাবি তোলা হয়। এ সংশোধনীর ভাষ্য ছিল, ‘এ পত্রিকার ১৮ নভেম্বরের সংস্করণে বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেভিড ইউজিন বোস্টারকে নিয়ে একটি নিবন্ধ প্রকাশ হয়েছে, যা ছাপার জন্য অনুমোদিত ছিল না এবং এ বিষয়ে যুগান্তরের দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রকাশ করে না। বাংলাদেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের অসমীচীন কার্যকলাপে জড়িত থাকার অভিযোগকে যুগান্তর প্রত্যাখ্যান করছে এবং এ নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করছে।’
বিষয়টি নিয়ে এক কূটনৈতিক ওয়ারে দিল্লির মার্কিন দূতাবাস থেকে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরামর্শ ও নির্দেশনা চেয়ে বলা হয়, ‘বিষয়টি শক্তিশালী ওষুধের মতো এবং বোস এক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে পারেন। কিন্তু এ বিবৃতি ছাপানোর জন্য তাকে জোর করার কোনো ক্ষতি আমরা দেখতে পাচ্ছি না। এর একটি বিকল্প হতে পারে কনসাল জেনারেলের পক্ষ থেকে নিবন্ধে ওঠা অভিযোগগুলো অস্বীকার করে একটি প্রতিবাদলিপি পাঠানো। কিন্তু সেক্ষেত্রে এর বিশ্বাসযোগ্যতা কম হবে।’
মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দূতাবাসের এ প্রয়াসকে অনুমোদন দেয়। একই সঙ্গে দিল্লির দূতাবাস থেকে ভারত সরকারের উচ্চপর্যায়ে এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অসন্তোষের বিষয়টি জানিয়ে দেয়ারও নির্দেশনা দেয়া হয়।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পাওয়ার পর কলকাতার মার্কিন কনস্যুলেট জেনারেল বিষয়টি নিয়ে ডি আর বোসের সঙ্গে কথা বলেন। ডি আর বোস রাজিও হন। তবে তিনি এ বক্তব্য কয়েকদিনের মধ্যে বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে কোনো এক সম্পাদকীয় বা খবরের বক্তব্য হিসেবে ছাপাবেন বলে জানান।
১৯ নভেম্বরেই নয়াদিল্লিতে মার্কিন দূতাবাসের ডেপুটি চিফ অব মিশন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আমেরিকা বিষয়ক যুগ্ম সচিব জেএস তেজার সঙ্গে দেখা করে ভারতীয় গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে গুজব ছড়ানোর অভিযোগ তুলে এর প্রতিবাদ জানান। তিনি বলেন, ‘ভারতীয় প্রেসে বাংলাদেশে অভ্যুত্থানে যুক্তরাষ্ট্রের জড়িত থাকার বিষয়ে ক্রমাগত যে অভিযোগ তোলা হচ্ছে; আমরা এর দৃঢ় প্রতিবাদ জানাই। এটি পুরোপুরি অপবাদমূলক ও মিথ্যা অভিযোগ।’
শুরুতে জেএস তেজা সংবাদমাধ্যমের বক্তব্যে ভারত সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই বলে বিষয়টিকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালান। পরে এক পর্যায়ে তা কর্তৃপক্ষের গোচরে আনতে রাজি হন। সে সময় নয়াদিল্লিতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত নিজ দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কেও ওয়াশিংটনের ভারতীয় দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করে এমন পদক্ষেপ গ্রহণের পরামর্শ দেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ওয়াশিংটনের ভারতীয় দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স এপি ভেঙ্কটেশ্বরণকে বলেন, ‘রাষ্ট্রদূত ডেভিড বোস্টারের বিরুদ্ধে আনা বিদ্বেষপ্রসূত অভিযোগ পুরোপুরি দায়িত্বজ্ঞানহীন ও ভিত্তিহীন। আর কংগ্রেস পার্টির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি সংবাদমাধ্যমে এ ধরনের অভিযোগ ওঠার বিষয়টি আমাদের চোখে পরিস্থিতিকে আরো খারাপ করে তুলছে। দয়া করে নয়াদিল্লিকে জানান, আমরা এ ধরনের ভিত্তিহীন অভিযোগের বিষয়ে অত্যন্ত বিরক্ত এবং পরিস্থিতি সংশোধনে আপনাদের পদক্ষেপ গ্রহণের অপেক্ষায় আছি।’
প্রসঙ্গত, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সামরিক বাহিনীর কয়েকজন জুনিয়র অফিসারের অভ্যুত্থানে সপরিবারে নিহত হন শেখ মুজিবুর রহমান। ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে অভ্যুত্থানকারী সেনাসদস্যদের গুলিতে আরো মারা যান বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, ছোট ভাই শেখ আবু নাসের, বড় ছেলে শেখ কামাল, পুত্রবধূ সুলতানা কামাল খুকী, মেজো ছেলে শেখ জামাল, পুত্রবধূ পারভীন জামাল রোজী ও ছোট ছেলে শেখ রাসেল। ওইদিন সেখানে বঙ্গবন্ধুর সামরিক সচিব কর্নেল জামিল উদ্দিন আহমেদ (মরণোত্তর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদমর্যাদাপ্রাপ্ত) ও নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তারও মৃত্যু হয়। অভ্যুত্থানকারী সেনা কর্মকর্তারা সেদিন শেখ মুজিবের ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বাড়িতে হামলা চালায়। সেখানে আবদুর রব সেরনিয়াবাত ছাড়াও মৃত্যু হয় আরিফ সেরনিয়াবাত, বেবী সেরনিয়াবাত, শহীদ সেরনিয়াবাত, সুকান্ত আবদুল্লাহ বাবু, নাঈম খান রিন্টু, গৃহভৃত্য পোটকা ও লক্ষ্মীর মার। হামলা চালানো হয় শেখ মুজিবের ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনির বাড়িতেও। সেখানে শেখ ফজলুল হক মনি ও তার স্ত্রী আরজু মনি মারা যান।
ওই হত্যাকাণ্ডের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের রাজনীতি ব্যাপক মাত্রায় অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। আর প্রতিবেশী ভারতজুড়ে দেখা যায় নানামাত্রার প্রতিক্রিয়া, জল্পনা-কল্পনা আর গুঞ্জন। ভারতীয়দের মধ্যে কংগ্রেস ও সিপিআই নেতারা এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সংযোগ আছে বলে বিভিন্ন স্থানে বক্তব্য রাখতে থাকেন।
(এ প্রতিবেদনে উঠে আসা তথ্যের বেশির ভাগই বি জেড খসরুর ‘দ্য বাংলাদেশ মিলিটারি ক্যু অ্যান্ড সিআইএ লিংক’ বই থেকে নেয়া) সূত্র: বণিক বার্তা।