নিউইয়র্ক ০৪:১৮ অপরাহ্ন, শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫, ২১ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

যুদ্ধবিধ্বস্ত লিবিয়ায় নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০৬:৪২:৫৩ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৫ ডিসেম্বর ২০২১
  • / ৭০ বার পঠিত

আন্তর্জাতিক ডেস্ক : মধ্যপ্রাচ্যে এক সময়কার সবচেয়ে সমৃদ্ধ দেশ লিবিয়া আজ যুদ্ধবিধ্বস্ত অবস্থায়। গৃহযুদ্ধ শুরুর এক দশক পর এবার সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক পদক্ষেপ নেওয়া হলো। বিভিন্ন খণ্ডে বিভক্ত শক্তিগুলোর মধ্যে সমঝোতার পরিপ্রেক্ষিতে ২৪ ডিসেম্বর নির্বাচনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে এই নির্বাচন আয়োজন কোনোভাবেই যে সহজ নয়, তা বলাই বাহুল্য। বহুধা বিভক্ত এক সমাজে নির্বাচন প্রশ্নে তৈরি হয়েছে শঙ্কা। খবর সাম্প্রতিক দেশকাল

উল্লেখ্য, এক দশক আগে আরব বসন্তের প্রভাবে লিবিয়ায় মুয়াম্মার গাদ্দাফির স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে জনগণ। সামরিক কায়দায় এ বিক্ষোভ দমন করতে গিয়ে তিনি নিজেকে যেমন জনগণ থেকে আরও বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন, তেমনি দেশকে ঠেলে দেন গৃহযুদ্ধের দিকে। এক পর্যায়ে ইঙ্গ-মার্কিন-ফরাসি নেতৃত্বাধীন ন্যাটো বাহিনীর আগ্রাসনে গাদ্দাফি যুগের সমাপ্তি হয়। বিদ্রোহীদের হাতে আটক হওয়ার পর এক সময়ের অবিসংবাদিত নেতা গাদ্দাফিকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

গাদ্দাফির ছেলে সাইফ আল ইসলাম এবং খলিফা হাফতার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ঘোষণা দেওয়ার পর সৃষ্ট বিতর্ক লিবিয়ায় এক জটিল পরিস্থিতি তৈরি করেছে। তবে নির্বাচনে লড়তে পারছেন না দেশটির প্রয়াত শাসকের ছেলে। প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিসেবে তার মনোনয়নপত্র বাতিল করেছে দেশটির নির্বাচন কমিশন। লিবিয়ার নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় নির্বাচনী আইন অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট পদে লড়াই করার যোগ্যতা হারিয়েছেন সাইফ আল-ইসলাম। ২০১৫ সালে তার অবর্তমানে ত্রিপোলির একটি আদালত সাইফ আল-ইসলামের নামে আমৃত্যু কারাদণ্ড ঘোষণা করেন। তার বিরুদ্ধে গাদ্দাফির আমলে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ ছিল। ওই সময় সাইফ আল-ইসলাম প্রথমে পালিয়ে যান। পরবর্তীতে আটক করে তাকে কারাগারে রাখা হয়। পরে মুক্তি পান তিনি।

লিবিয়ার রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, সাইফ আল-ইসলাম ভোটের ময়দানে তার বাবার শাসনামলের ইতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরার সুযোগ পেতেন। যদিও অনেকেই মনে করেছিলেন, ভোটে নিজেদের পক্ষে অনেক বেশি সমর্থকদের একত্র করা সাইফ আল-ইসলাম ও গাদ্দাফি শাসনামলের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের পক্ষে কঠিন হয়ে যেত। কেননা গাদ্দাফির নিষ্ঠুর শাসন এখনো অনেক লিবিয়র মনে আছে। এবারের নির্বাচনে সাইফ আল-ইসলামসহ মোট ৯৮ জন প্রার্থী প্রেসিডেন্ট পদে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন। এই তালিকায় রয়েছেন লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক বাহিনীর কমান্ডার খলিফা হাফতার, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী আবদুল হামিদ আল দিবাহ, পার্লামেন্টের স্পিকার আজুলা সালেহ প্রমুখ।

প্রেসিডেন্ট পদের জন্য লড়াইয়ের তালিকা থেকে সাইফ আল-ইসলামসহ ২৫ প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল করা হয়েছে। এই তালিকায় রয়েছেন লিবিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী আলি জেইদান ও সাবেক সাংসদ নৌরি আবুসাহমাইন। যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব রয়েছে, এমন অভিযোগে মনোনয়ন বাতিল করা হয়েছে খলিফা হাফতারের।

গাদ্দাফি যুগের অবসানের পর লিবিয়াজুড়ে যে সংঘাত চলছে, এই নির্বাচনকে সেই সংঘাত থামানোর মাধ্যম মনে করা হচ্ছে। সম্প্রতি প্যারিসে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে বিশ্বনেতারা একমত হয়েছেন যে, যারা লিবিয়ার ভোটকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করবে, তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে। তবে নতুন সরকারের কার্যপ্রণালিবিধি, ভোটের সময়সূচিসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে এখনো বিতর্ক রয়েছে। ফলে ওই ভোট নির্ধারিত সময়ে হবে কি-না, তা নিয়ে এখনো সন্দেহ রয়েছে।

তবে নির্বাচনে বিতর্কিত রাজনৈতিক শক্তির উত্থানের সম্ভাবনার কথাও বিশ্লেষকরা বলছেন। বিতর্কিত প্রার্থীরা নির্বাচনের ফল মেনে না নিলে এ নিয়ে সৃষ্ট বিতর্কে আবারও দুই বা ততোধিক সমান্তরাল সরকার লিবিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।

লিবিয় এবং অ-লিবিয় একাধিক পক্ষই তাদের এই আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। লিবিয়ায় নিযুক্ত সাবেক আন্তর্জাতিক দূত তারেক মিত্রি বলেন, ‘সবাই লিবিয়াতে নির্বাচন চায় বা দাবি করে; কিন্তু ক্ষমতা ভাগাভাগি ও শুধু নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে সমঝোতা দেশের ঐক্য ও শান্তির নিশ্চয়তা দেয় না। কারণ কোটারি প্রতিরোধকারী জাতীয় লক্ষ্য একটি নতুন সামাজিক চুক্তি এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান নির্মাণের চুক্তির জাতীয় ঐক্যমত্যের প্রতিস্থাপন করে না।’

লিবিয়ায় নিযুক্ত অন্য এক দূত ঘাসান সালামেহ বলেছেন যে, ‘নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করা এবং সহিংসতার মাধ্যমে তা ক্ষুণ্ণ করার চেষ্টার চেয়ে গণতন্ত্রের জন্য খারাপ আর কিছু নেই। এর উদাহরণ আজ ইরাক ও ইথিওপিয়া। আর এর আগে এমন অনেক দেশের দৃষ্টান্ত রয়েছে, যাদের ব্যালট বাক্সে পরাজিতরা শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল আর এতে সৃষ্ট গৃহযুদ্ধে তাদের দেশ ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে গেছে অথবা বিভক্ত শাসনে ছিটকে পড়েছে। এতে স্টেডিয়াম ধ্বংসের মাধ্যমে শেষ হওয়া ম্যাচে সবাই হেরে গেছে।’

২০১১ সালের পশ্চিমা আগ্রাসন লিবিয়াকে ঠেলে দেয় আরও রক্তক্ষয়ী ও ধ্বংসাত্মক গৃহযুদ্ধের দিকে, যা চলেছে গত এক দশক ধরে। লিবিয়া হয়ে উঠেছে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন শক্তির যুদ্ধক্ষেত্র। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বরাবরই গভর্নমেন্ট অব ন্যাশনাল অ্যাকর্ড (জিএনএ) ও এর প্রধানমন্ত্রী ফায়েজ আল-সারাজকে সমর্থন করে যাচ্ছে। ত্রিপোলি আপাতত তাদের দখলেই আছে।

অন্যদিকে, পূর্বাঞ্চল এবং দক্ষিণাঞ্চলের নিয়ন্ত্রণে থাকা জেনারেল খলিফা হাফতারের লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মিকে (এলএনএ) সমর্থন দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার সমর্থিত বিভিন্ন আঞ্চলিক শক্তি। লিবিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রে অস্ত্র সরবরাহ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অত্র অঞ্চলে এক ‘ছায়া যুদ্ধের’ আবির্ভাব ঘটেছে।

লিবিয়ার যুদ্ধে ইউরোপ আর যুক্তরাষ্ট্র যেমন যুদ্ধরত দুই পক্ষের একেকটাকে সমর্থন দিচ্ছে, ঠিক তেমনি আঞ্চলিক শক্তি তুরস্ক এবং মিসরও এ কাজই করছে। ইউরোপ চিন্তিত রয়েছে লিবিয়ার স্থিতিশীলতা নিয়ে। কারণ লিবিয়ার অস্থিতিশীলতা পুরো উত্তর আফ্রিকাকে সমস্যায় ফেলেছে, যার সুযোগ নিচ্ছে মানব পাচারকারীরা। লিবিয়ার যুদ্ধ ইউরোপের জন্য শরণার্থী সমস্যা আরও প্রকট করেছে। ইউরোপ চাইছে জিএনএ লিবিয়ার ক্ষমতায় আসীন হয়ে ইউরোপের শরণার্থী সমস্যায় সহায়তা করুক; কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ দ্বারা প্রশিক্ষিত জেনারেল হাফতার ইউরোপের লক্ষ্যের সঙ্গে একমত নন।

গাদ্দাফির ছেলে ও জেনারেল হাফতারের প্রার্থিতা বাতিলের পর তারা যে সহিংসতা থেকে বিরত থাকবে, এমনটা মনে করার কোনো সুযোগ নেই। পশ্চিমা ও মধ্যপ্রাচ্যে সাইফ আল-ইসলামেরও সমর্থক গোষ্ঠী রয়েছে।

লিবিয়ায় নির্বাচন নিয়ে হতাশার কারণ শুধু পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে লিবিয়ার রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানে অব্যাহত বিভাজনই নয়, নির্বাচনে যাওয়ার প্রস্তুতির জন্য বিবদমান দলগুলোর মধ্যে ন্যূনতম রাজনৈতিক ঐক্যমত্যের অনুপস্থিতিও এর কারণ। আইনগতভাবে এই নির্বাচনগুলির জন্য একটি সাংবিধানিক ভিত্তির অনুপস্থিতিও রয়েছে, সেই সঙ্গে এই নির্বাচন নিয়ে এখনো বহু কঠিন প্রশ্ন রয়ে গেছে।

লিবিয়ায় এখনো দুই বিরোধী পক্ষের মধ্যে এক তীক্ষ্‌ণ বিভাজন রয়ে গেছে। বিদেশি বাহিনী এবং ভাড়াটে সৈন্যরা লিবিয়ার মাটি ছেড়ে যায়নি। বাইরের একটি পক্ষের লক্ষ্যই হলো, মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশে গণতন্ত্র বা নিয়মতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠা বা চলমান থাকতে না দেওয়া। গণতন্ত্র সফল হলে তা রাজতন্ত্র বা একনায়কতান্ত্রিক সরকারগুলোর জন্য সংকট নিয়ে আসতে পারে। এই শক্তিটি মিসরে হস্তক্ষেপ করে সামরিক একনায়কত্ব ফিরিয়ে এনেছে।

Tag :

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

যুদ্ধবিধ্বস্ত লিবিয়ায় নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা

প্রকাশের সময় : ০৬:৪২:৫৩ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৫ ডিসেম্বর ২০২১

আন্তর্জাতিক ডেস্ক : মধ্যপ্রাচ্যে এক সময়কার সবচেয়ে সমৃদ্ধ দেশ লিবিয়া আজ যুদ্ধবিধ্বস্ত অবস্থায়। গৃহযুদ্ধ শুরুর এক দশক পর এবার সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক পদক্ষেপ নেওয়া হলো। বিভিন্ন খণ্ডে বিভক্ত শক্তিগুলোর মধ্যে সমঝোতার পরিপ্রেক্ষিতে ২৪ ডিসেম্বর নির্বাচনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে এই নির্বাচন আয়োজন কোনোভাবেই যে সহজ নয়, তা বলাই বাহুল্য। বহুধা বিভক্ত এক সমাজে নির্বাচন প্রশ্নে তৈরি হয়েছে শঙ্কা। খবর সাম্প্রতিক দেশকাল

উল্লেখ্য, এক দশক আগে আরব বসন্তের প্রভাবে লিবিয়ায় মুয়াম্মার গাদ্দাফির স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে জনগণ। সামরিক কায়দায় এ বিক্ষোভ দমন করতে গিয়ে তিনি নিজেকে যেমন জনগণ থেকে আরও বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন, তেমনি দেশকে ঠেলে দেন গৃহযুদ্ধের দিকে। এক পর্যায়ে ইঙ্গ-মার্কিন-ফরাসি নেতৃত্বাধীন ন্যাটো বাহিনীর আগ্রাসনে গাদ্দাফি যুগের সমাপ্তি হয়। বিদ্রোহীদের হাতে আটক হওয়ার পর এক সময়ের অবিসংবাদিত নেতা গাদ্দাফিকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

গাদ্দাফির ছেলে সাইফ আল ইসলাম এবং খলিফা হাফতার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ঘোষণা দেওয়ার পর সৃষ্ট বিতর্ক লিবিয়ায় এক জটিল পরিস্থিতি তৈরি করেছে। তবে নির্বাচনে লড়তে পারছেন না দেশটির প্রয়াত শাসকের ছেলে। প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিসেবে তার মনোনয়নপত্র বাতিল করেছে দেশটির নির্বাচন কমিশন। লিবিয়ার নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় নির্বাচনী আইন অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট পদে লড়াই করার যোগ্যতা হারিয়েছেন সাইফ আল-ইসলাম। ২০১৫ সালে তার অবর্তমানে ত্রিপোলির একটি আদালত সাইফ আল-ইসলামের নামে আমৃত্যু কারাদণ্ড ঘোষণা করেন। তার বিরুদ্ধে গাদ্দাফির আমলে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ ছিল। ওই সময় সাইফ আল-ইসলাম প্রথমে পালিয়ে যান। পরবর্তীতে আটক করে তাকে কারাগারে রাখা হয়। পরে মুক্তি পান তিনি।

লিবিয়ার রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, সাইফ আল-ইসলাম ভোটের ময়দানে তার বাবার শাসনামলের ইতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরার সুযোগ পেতেন। যদিও অনেকেই মনে করেছিলেন, ভোটে নিজেদের পক্ষে অনেক বেশি সমর্থকদের একত্র করা সাইফ আল-ইসলাম ও গাদ্দাফি শাসনামলের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের পক্ষে কঠিন হয়ে যেত। কেননা গাদ্দাফির নিষ্ঠুর শাসন এখনো অনেক লিবিয়র মনে আছে। এবারের নির্বাচনে সাইফ আল-ইসলামসহ মোট ৯৮ জন প্রার্থী প্রেসিডেন্ট পদে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন। এই তালিকায় রয়েছেন লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক বাহিনীর কমান্ডার খলিফা হাফতার, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী আবদুল হামিদ আল দিবাহ, পার্লামেন্টের স্পিকার আজুলা সালেহ প্রমুখ।

প্রেসিডেন্ট পদের জন্য লড়াইয়ের তালিকা থেকে সাইফ আল-ইসলামসহ ২৫ প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল করা হয়েছে। এই তালিকায় রয়েছেন লিবিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী আলি জেইদান ও সাবেক সাংসদ নৌরি আবুসাহমাইন। যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব রয়েছে, এমন অভিযোগে মনোনয়ন বাতিল করা হয়েছে খলিফা হাফতারের।

গাদ্দাফি যুগের অবসানের পর লিবিয়াজুড়ে যে সংঘাত চলছে, এই নির্বাচনকে সেই সংঘাত থামানোর মাধ্যম মনে করা হচ্ছে। সম্প্রতি প্যারিসে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে বিশ্বনেতারা একমত হয়েছেন যে, যারা লিবিয়ার ভোটকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করবে, তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে। তবে নতুন সরকারের কার্যপ্রণালিবিধি, ভোটের সময়সূচিসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে এখনো বিতর্ক রয়েছে। ফলে ওই ভোট নির্ধারিত সময়ে হবে কি-না, তা নিয়ে এখনো সন্দেহ রয়েছে।

তবে নির্বাচনে বিতর্কিত রাজনৈতিক শক্তির উত্থানের সম্ভাবনার কথাও বিশ্লেষকরা বলছেন। বিতর্কিত প্রার্থীরা নির্বাচনের ফল মেনে না নিলে এ নিয়ে সৃষ্ট বিতর্কে আবারও দুই বা ততোধিক সমান্তরাল সরকার লিবিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।

লিবিয় এবং অ-লিবিয় একাধিক পক্ষই তাদের এই আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। লিবিয়ায় নিযুক্ত সাবেক আন্তর্জাতিক দূত তারেক মিত্রি বলেন, ‘সবাই লিবিয়াতে নির্বাচন চায় বা দাবি করে; কিন্তু ক্ষমতা ভাগাভাগি ও শুধু নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে সমঝোতা দেশের ঐক্য ও শান্তির নিশ্চয়তা দেয় না। কারণ কোটারি প্রতিরোধকারী জাতীয় লক্ষ্য একটি নতুন সামাজিক চুক্তি এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান নির্মাণের চুক্তির জাতীয় ঐক্যমত্যের প্রতিস্থাপন করে না।’

লিবিয়ায় নিযুক্ত অন্য এক দূত ঘাসান সালামেহ বলেছেন যে, ‘নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করা এবং সহিংসতার মাধ্যমে তা ক্ষুণ্ণ করার চেষ্টার চেয়ে গণতন্ত্রের জন্য খারাপ আর কিছু নেই। এর উদাহরণ আজ ইরাক ও ইথিওপিয়া। আর এর আগে এমন অনেক দেশের দৃষ্টান্ত রয়েছে, যাদের ব্যালট বাক্সে পরাজিতরা শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল আর এতে সৃষ্ট গৃহযুদ্ধে তাদের দেশ ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে গেছে অথবা বিভক্ত শাসনে ছিটকে পড়েছে। এতে স্টেডিয়াম ধ্বংসের মাধ্যমে শেষ হওয়া ম্যাচে সবাই হেরে গেছে।’

২০১১ সালের পশ্চিমা আগ্রাসন লিবিয়াকে ঠেলে দেয় আরও রক্তক্ষয়ী ও ধ্বংসাত্মক গৃহযুদ্ধের দিকে, যা চলেছে গত এক দশক ধরে। লিবিয়া হয়ে উঠেছে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন শক্তির যুদ্ধক্ষেত্র। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বরাবরই গভর্নমেন্ট অব ন্যাশনাল অ্যাকর্ড (জিএনএ) ও এর প্রধানমন্ত্রী ফায়েজ আল-সারাজকে সমর্থন করে যাচ্ছে। ত্রিপোলি আপাতত তাদের দখলেই আছে।

অন্যদিকে, পূর্বাঞ্চল এবং দক্ষিণাঞ্চলের নিয়ন্ত্রণে থাকা জেনারেল খলিফা হাফতারের লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মিকে (এলএনএ) সমর্থন দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার সমর্থিত বিভিন্ন আঞ্চলিক শক্তি। লিবিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রে অস্ত্র সরবরাহ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অত্র অঞ্চলে এক ‘ছায়া যুদ্ধের’ আবির্ভাব ঘটেছে।

লিবিয়ার যুদ্ধে ইউরোপ আর যুক্তরাষ্ট্র যেমন যুদ্ধরত দুই পক্ষের একেকটাকে সমর্থন দিচ্ছে, ঠিক তেমনি আঞ্চলিক শক্তি তুরস্ক এবং মিসরও এ কাজই করছে। ইউরোপ চিন্তিত রয়েছে লিবিয়ার স্থিতিশীলতা নিয়ে। কারণ লিবিয়ার অস্থিতিশীলতা পুরো উত্তর আফ্রিকাকে সমস্যায় ফেলেছে, যার সুযোগ নিচ্ছে মানব পাচারকারীরা। লিবিয়ার যুদ্ধ ইউরোপের জন্য শরণার্থী সমস্যা আরও প্রকট করেছে। ইউরোপ চাইছে জিএনএ লিবিয়ার ক্ষমতায় আসীন হয়ে ইউরোপের শরণার্থী সমস্যায় সহায়তা করুক; কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ দ্বারা প্রশিক্ষিত জেনারেল হাফতার ইউরোপের লক্ষ্যের সঙ্গে একমত নন।

গাদ্দাফির ছেলে ও জেনারেল হাফতারের প্রার্থিতা বাতিলের পর তারা যে সহিংসতা থেকে বিরত থাকবে, এমনটা মনে করার কোনো সুযোগ নেই। পশ্চিমা ও মধ্যপ্রাচ্যে সাইফ আল-ইসলামেরও সমর্থক গোষ্ঠী রয়েছে।

লিবিয়ায় নির্বাচন নিয়ে হতাশার কারণ শুধু পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে লিবিয়ার রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানে অব্যাহত বিভাজনই নয়, নির্বাচনে যাওয়ার প্রস্তুতির জন্য বিবদমান দলগুলোর মধ্যে ন্যূনতম রাজনৈতিক ঐক্যমত্যের অনুপস্থিতিও এর কারণ। আইনগতভাবে এই নির্বাচনগুলির জন্য একটি সাংবিধানিক ভিত্তির অনুপস্থিতিও রয়েছে, সেই সঙ্গে এই নির্বাচন নিয়ে এখনো বহু কঠিন প্রশ্ন রয়ে গেছে।

লিবিয়ায় এখনো দুই বিরোধী পক্ষের মধ্যে এক তীক্ষ্‌ণ বিভাজন রয়ে গেছে। বিদেশি বাহিনী এবং ভাড়াটে সৈন্যরা লিবিয়ার মাটি ছেড়ে যায়নি। বাইরের একটি পক্ষের লক্ষ্যই হলো, মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশে গণতন্ত্র বা নিয়মতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠা বা চলমান থাকতে না দেওয়া। গণতন্ত্র সফল হলে তা রাজতন্ত্র বা একনায়কতান্ত্রিক সরকারগুলোর জন্য সংকট নিয়ে আসতে পারে। এই শক্তিটি মিসরে হস্তক্ষেপ করে সামরিক একনায়কত্ব ফিরিয়ে এনেছে।