যুক্তরাষ্ট্রকে এড়িয়ে কতদিন সস্তায় রুশ তেল কিনতে পারবে ভারত?

- প্রকাশের সময় : ০৩:২৩:৫০ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৯ নভেম্বর ২০২৩
- / ১৩৩ বার পঠিত
হককথা ডেস্ক : ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে পশ্চিমাদের আরোপিত জ্বালানি রফতানি নিষেধাজ্ঞাকে এতদিন তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিচ্ছিল রাশিয়া। নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রেকর্ড পরিমাণ তেল বিক্রি করে আসছিল মস্কো। চীনসহ আফ্রিকা মহাদেশের বিভিন্ন দেশের পাশাপাশি এমনকি পশ্চিমা মিত্র হিসেবে পরিচিত ভারতও রেকর্ড পরিমাণে অপরিশোধিত তেল আমদানি করছে রাশিয়া থেকে।
নিষেধাজ্ঞার কারণে আন্তর্জাতিক বাজারদরের থেকে অনেক কম মূল্যে পাওয়া যাচ্ছে রাশিয়ার তেল। তবে শেষ পর্যন্ত দেশগুলোর সস্তায় এই রুশ তেল পাওয়ার লোভনীয় বাণিজ্যে ছেদ পড়তে যাচ্ছে বলে খবর দিয়েছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম রয়টার্স। এর কারণ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে রুশ তেলের ক্রেতাদেশগুলোর বিনিময় মূল্য হিসেবে আমেরিকান ডলারের বিকল্প আন্তর্জাতিক মুদ্রা খুঁজে পাওয়ার ব্যর্থতাকে। আর এতে সবচেয়ে বেশি ভুগতে হচ্ছে রুশ তেলের অন্যতম বৃহৎ ক্রেতা ভারতকে। রয়টার্স জানিয়েছে, তেলের বিনিময় মূল্য হিসেবে রাশিয়ার কাছে ভারতের মুদ্রা রুপি আকর্ষণীয় নয়। কারণ, রুশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতে, যেহেতু ভারতের বাইরে রুপির চাহিদা খুব বেশি নয়, তাই রুপিতে তেল বিক্রি তাদের জন্য অনেকটাই অর্থহীন।
আন্তর্জাতিক তেল বাণিজ্যের ডলার নির্ভরতা
দশকের পর দশক ধরে আন্তর্জাতিক তেল বাণিজ্যে বিভিন্ন দেশের মধ্যে লেনদেন হয়ে আসছে আমেরিকান মুদ্রা ডলার। হঠাৎ করেই ডলারের ওপর এই নির্ভরতা থেকে বের হয়ে আসা যে অনেক কঠিন, তা এরই মধ্যে টের পেতে শুরু করেছে রুশ তেলের ক্রেতা অনেক দেশ। আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং চ্যানেল থেকে রাশিয়াকে একঘরে করে দেয়ার পর ভারত চীনের মতো রুশ তেলের ক্রেতারা মস্কোকে তেলের দাম পরিশোধ করে আসছিল নিজস্ব মুদ্রা রুপি কিংবা ইউয়ানে। পাশাপাশি সংযুক্ত আরব আমিরাতের মুদ্রা দিরহামেও হয় কিছু লেনদেন। তবে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র নজরদারি আরও কঠোর করায় অনেকটাই কঠিন হয়ে পড়েছে রুশ তেলের বিনিময় মূল্য হিসেবে এসব মুদ্রায় লেনদেন। এতে সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছে বর্তমানে সমুদ্রপথে রাশিয়ার সবচেয়ে বেশি তেল ক্রয়কারী দেশ ভারত। ২০২২ সালে ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাশিয়ার তেল থেকে নিজেদের সরিয়ে নেয়ার পর বিশ্বে সমুদ্রপথে মস্কোর সরবরাহ করা তেলের সবচেয়ে বড় গ্রাহকে পরিণত হয় নয়াদিল্লি। কিন্তু গত জুলাই মাসে রাশিয়াকে তেলের বিনিময় মূল্য রুপিতে পরিশোধের উদ্যোগে নেয় ভারত। আর মূলত এর পর থেকেই দুদেশের তেল বাণিজ্যে ভাটা পড়েছে বলে জানিয়েছে রয়টার্স। রুশ জ্বালানি খাতসংশ্লিষ্ট সূত্রের বরাত দিয়ে আন্তর্জাতিক এই সংবাদমাধ্যম জানায়, ভারতের এই সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে রুশ কেন্দ্রীয় ব্যাংক নাকি অনানুষ্ঠানিকভাবে রুশ জ্বালানি কোম্পানিগুলোকে ভারতীয় রুপি গ্রহণ না করার কথা জানিয়ে দেয়।
ভারতের বাইরে বিশ্বে মূল্য নেই রুপির
অবশ্য রুশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই অবস্থানের পেছনে রয়েছে কিছু বাস্তবতা। রাশিয়া ভারতে বহু বিলিয়ন ডলারের তেল রফতানি করলেও বিনিময়ে ভারত থেকে প্রায় কিছুই আমদানি করে না তারা। দুদেশের বাণিজ্য ঘাটতি বর্তমানে আকাশ-পাতাল। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে ভারত রাশিয়া থেকে প্রায় ৫০ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ পণ্য আমদানি করলেও বিপরীতে রাশিয়ায় রফতানি করতে পারে মাত্র ৩ বিলিয়ন ডলার। এই পরিসংখ্যানই বলে দেয় দুই দেশের বাণিজ্যের ভারসাম্য কতখানি অসম। ভারত থেকে রাশিয়ার আমদানি করার মতো তেমন কিছুই নেই। যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল ও ইলেকট্রনিকস যন্ত্রপাতির জন্য রাশিয়া বরং চীনের ওপর বেশি নির্ভরশীল। এ পরিস্থিতিতে তেলের বিনিময় মূল্য হিসেবে রুপি গ্রহণ করতে চাইছে না রুশ কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কারণ, ভারতের বাইরে বিশ্বের কোথাও রুপির এত বিপুল পরিমাণ চাহিদা নেই যেখানে তেল রফতানির বিনিময়ে পাওয়া রুপি খরচ করতে পারে রাশিয়া।
তেলের মূল্য পরিশোধ নিয়ে রুশ-ভারত টানাপোড়েন
এদিকে রয়টার্সের দেয়া তথ্যানুযায়ী, রুপিতে তেলের মূল্য পরিশোধ সংক্রান্ত ভারতের অবস্থানে অচলাবস্থা তৈরি হয় ভারত ও রাশিয়ার মধ্যে। এমন অবস্থায় দাঁড়ায় যে গত আগস্ট মাসে ভারতমুখী প্রায় এক মিলিয়ন টন তেলবাহী ডজনখানেক অয়েল ট্যাংকার ভারতের বদলে অন্য গন্তব্যে পাঠানোর হুমকি দেয় রাশিয়ার দুটি প্রধান জ্বালানি কোম্পানি। তবে শেষ পর্যন্ত চীনা মুদ্রা ইউয়ান ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মুদ্রা দিরহামে এসব তেলের মূল্য পরিশোধে রাজি হয় ভারত। তবে সাময়িকভাবে এই সমস্যার সমাধান হলেও এতে দীর্ঘস্থায়ী কোনো সমাধানের পথ খোলা নেই উল্লেখ করে রয়টার্স জানিয়েছে, ভারতের পক্ষে চীনা মুদ্রা ইউয়ানে লেনদেন করা অস্বস্তিকর। কারণ, আঞ্চলিক রাজনীতিতে বেইজিংয়ের প্রবল প্রতিপক্ষ নয়াদিল্লি।
রাশিয়ার তেল বাণিজ্যে যুক্তরাষ্ট্রের নজরদারি বৃদ্ধি
অবশ্য রুশ তেলের ক্রেতা হিসেবে ভারত একাই এ ধরনের সমস্যায় পড়ছে না, তুরস্ক ও আফ্রিকার কিছু দেশ যারা রুশ তেলের ক্রেতা তারাও একই ধরনের সমস্যার মুখোমুখি। তবে ভারতের সমস্যাটাই সবচেয়ে বেশি। কারণ, সমুদ্রপথে রাশিয়ার রফতানি হওয়া মোট তেলের ৬০ ভাগেরই গন্তব্য দেশটি। পরিস্থিতি আরও গুরুতর হয় যখন সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র রুশ তেল বহনকারী দুটি তেলবাহী জাহাজের মালিকপক্ষের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। গত বছর নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা দেয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের তা বাস্তবায়নের উদাহরণ এই প্রথম
চীনা মুদ্রা ইউয়ানে লেনদেনে ভারতের অনীহা
রয়টার্স জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের শ্যেন দৃষ্টি এড়াতে রুশ জ্বালানি কোম্পানিগুলো তেলের বিনিময় মূল্য ইউয়ানে পরিশোধের জন্য তাদের ভারতীয় প্রতিপক্ষকে চাপ দিয়ে আসছিল। কারণ, রাশিয়ার জন্য চীনের মুদ্রা ইউয়ান আন্তর্জাতিক মুদ্রা হিসেবে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য। তবে রাশিয়ার এই প্রস্তাবে সাড়া দিতে আপত্তি রয়েছে ভারতের। ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিষয়টি ভারতের জন্য অত্যন্ত স্পর্শকাতর। কারণ, আঞ্চলিক রাজনীতিতে ভারত প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে চীনকে বিবেচনা করে থাকে। যদিও নিরুপায় হয়ে বেশ কিছু ভারতীয় বেসরকারি জ্বালানি রিফাইনারি চীনা মুদ্রা ইউয়ানেই তেলের মূল্য পরিশোধ করে। এ পরিস্থিতিতে বিকল্প হিসেবে সংযুক্ত আরব আমিরাতের মুদ্রা দিরহামকে তেলের বিনিময় মূল্য হিসেবে অধিক গ্রহণযোগ্য মনে করছে ভারত। তবে সেখানেও বিপত্তি রয়েছে উল্লেখ করে রয়টার্স জানিয়েছে, আমেরিকান নিষেধাজ্ঞার ভয়ে সম্প্রতি সংযুক্ত আরব আমিরাতের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এ ধরনের লেনদেনের ঝুঁকিতে যেতে চাচ্ছে না। বিশেষ করে রাশিয়ার স্বার্থসংশ্লিষ্ট লেনদেনগুলোতে বেশি বিধিনিষেধ আরোপ করেছে দেশটির ব্যাংকগুলো। এ পরিস্থিতিতে ভারতের জন্য অবাধে রুশ তেল আমদানি করা ভবিষ্যতে দিন দিন কঠিন হয়ে পড়বে বলে মনে করা হচ্ছে।
হককথা/নাছরিন