মধ্যপ্রাচ্যে ঐক্যের সুর, যুক্তরাষ্ট্র–ইসরায়েলের কপালে ভাঁজ
- প্রকাশের সময় : ১২:১১:১৮ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৩
- / ৯০ বার পঠিত
আন্তর্জাতিক ডেস্ক : মধ্যপ্রাচ্য মানেই বহুধা বিভক্ত এক উত্তপ্ত পৃথিবী। এই অঞ্চলে সংঘাত লেগেই আছে। আন্তর্জাতিক পরাশক্তিরা খনিজ সমৃদ্ধ এই অঞ্চলকে ঘিরে নানা পরিকল্পনার ছক আঁটে। নিজেদের মাঝে অনৈক্য আর আন্তর্জাতিক মোড়লদের কূটচালে এ অঞ্চলে স্থিতিশীলতা কামনা করাও যেন অলীক কল্পনা! তবে সাম্প্রতিক সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তনের আভাস মিলছে।
দীর্ঘদিনের আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী ইরানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে চমক দিয়েছে সৌদি আরব। শুধু ইরান নয় সিরিয়ার সঙ্গেও কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনস্থাপনের ঘোষণা এসেছে। ফলে বিষয়টি খুবই স্পষ্ট যে, যুক্তরাষ্ট্রের বলয় থেকে বের হয়ে উপসাগরীয় প্রতিবেশীদের নিয়ে নতুন বলয় গড়ার চেষ্টা করছে সৌদি আরব। এ ক্ষেত্রে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে রয়েছে চীন ও রাশিয়ার মতো পরাশক্তি। সৌদি-ইরান সম্পর্কে মধ্যস্থতা করেছে চীন, আর সৌদি-সিরিয়া সম্পর্কে মধ্যস্থতা করেছে রাশিয়া। দৃশ্যপটে যে শুধু সৌদি-ইরান ও সিরিয়াই রয়েছে বিষয়টি এমন নয়। সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের তালিকায় যোগ হয়েছে কাতার ও বাহরাইন। গত ১২ এপ্রিল কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের ঘোষণা দিয়েছে দেশ দুটি। আর এই ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছে সৌদি আরব।
সৌদির নতুন বলয় গড়ার চেষ্টা ও চীন-রাশিয়ার মতো পরাশক্তির আগমনে মধ্যপ্রাচ্যে তাই ধীরে ধীরে কর্তৃত্ব হারাতে বসেছে যুক্তরাষ্ট্র। বিবৃতিতে সৌদি–ইরান সম্পর্ককে স্বাগত জানালেও বিষয়টি যে তাঁদের জন্য সুখকর নয় সেটি দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। ২০১৮ সালে সাংবাদিক জামাল খাসোগিকে হত্যা নিয়ে সৌদি আরবের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে চিড় ধরে। এরপর চীনের মধ্যস্থতায় সৌদি–ইরান সম্পর্ক পুনঃস্থাপনে এগিয়ে আসায় মধ্যপ্রাচ্যে একরকম কোণঠাসাই হয়ে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃত্ব হারালে মধ্যপ্রাচ্যে প্রধান মিত্র ইসরায়েলের প্রভাব প্রতিপত্তিও কমে আসবে। এমনিতেই ইসরায়েল অভ্যন্তরীণ নানা ইস্যুতে চাপে রয়েছে। সরকার বিরোধী বিক্ষোভ ক্রমেই জোরাল হচ্ছে। ফলে মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিতে নতুন সমীকরণ দানা বাঁধছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আপাতদৃষ্টিতে সবচেয়ে স্বস্তির বিষয়টি হলো, নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়ায় রক্তপাত কমার একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে এই ঐক্যের প্রচেষ্টা ইয়েমেন ও সিরিয়ায় যুদ্ধ বন্ধে ইতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকেরা।
মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে চীনের প্রভাব
মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি নিজেদের কবজায় রাখতে জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে চীন। গত ১০ মার্চ হঠাৎ করেই সৌদি-ইরানের সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের বিষয়টি সামনে আসে। এরপর গত ১৩ এপ্রিল দীর্ঘ ৭ বছর পর সৌদি আরবে ইরানের দূতাবাসের দরজা খোলা হয়েছে বলে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়। মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব বিস্তার নিয়ে সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে দীর্ঘ দিনের বিরোধ। ২০১৬ সালে ইরানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে সৌদি আরব। আঞ্চলিক নানা ইস্যুতে দেশ দুটির মধ্যে দ্বন্দ্ব সবার জানা। সৌদি-ইরানের বৈরিতা অবসানে দূতিয়ালী করেছে চীন। বেইজিংয়ে গত ১০ মার্চ বৈঠকের পর সৌদি-ইরান পুনরায় দূতাবাস চালুর বিষয়ে একমত হয়। এটিকে নিঃসন্দেহে চীনের কূটনৈতিক বিজয়। এই অঞ্চলে প্রভাব বলয় বিস্তারে চীনের এত তোড়জোড়!
সৌদি-ইরান সম্পর্কের বরফ গলছে, চালু হচ্ছে দূতাবাসসৌদি-ইরান সম্পর্কের বরফ গলছে, চালু হচ্ছে দূতাবাস
সবকিছু মিলিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে চীন একধাপ এগিয়ে রয়েছে এ কথা বলাই যায়। একদিকে তারা মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাকে খর্ব করতে পেরেছে, অন্যদিকে এই অঞ্চলকে কেন্দ্র করে বাণিজ্য সম্প্রসারণের পরিকল্পনা শুরু হয়েছে। একটি পরিসংখ্যানেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে—১৯৯০ সালে সৌদি আরবের সঙ্গে চীনের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমান ছিল ৪১৭ মিলিয়ন ডলার, ২০২০ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ৬৫ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারে। সে হিসাবে ২০২০ সালে সৌদিতে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে প্রায় তিন গুন বেশি বাণিজ্য করেছে চীন।
আরোও পড়ুন । যুক্তরাষ্ট্রের আদলে ড্রোন তৈরি করছে ভারত
এদিকে সৌদি আরব ‘সংলাপ সহযোগী’ হিসেবে চীনা নেতৃত্বাধীন নিরাপত্তা জোট সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনে যোগ দিতে সম্মত হয়েছে। এটি চীনের সঙ্গে সৌদি আরবের সম্পর্ক আরও নিবিড় করার সর্বশেষ ইঙ্গিত। পশ্চিমা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিযোগী রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা সংগঠন হিসেবে সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন প্রতিষ্ঠিত হয় ২০০১ সালে। চীন ছাড়াও এ সংগঠনে রয়েছে—ভারত, পাকিস্তান, রাশিয়া, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, উজবেকিস্তান ও তাজিকিস্তান। চীনের মধ্যস্থতায় সৌদি-ইরান কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠার তিন সপ্তাহের কম সময়ের মধ্যে বেইজিং ব্লকের সঙ্গে রিয়াদের সহযোগী হওয়ার বিষয়টি সামনে আসে।
ইয়েমেন ও সিরিয়ায় সংঘাত অবসানের আশা
চলতি বছরের মার্চে ইরানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের ঘোষণা আসার কিছুদিন পরই সিরিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের বিষয়টি সামনে আসে। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ মস্কো সফর করেন। সে সময় সৌদি-সিরিয়া সম্পর্ক পুনঃস্থাপনে মধ্যস্থতা করে রাশিয়া। গত ১২ এপ্রিল সৌদি আরব ও সিরিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ে বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে মাদক পাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করতে এবং সিরিয়াকে আরব ছাতার নিচে ফিরে আসায় সহযোগিতা করতে সম্মত হয়েছে সৌদি আরব।
প্রায় ১১ বছর ধরে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ চলছে। প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ বিরোধী বিক্ষোভের মধ্য দিয়ে ২০১১ সালে এই গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। এক দশকের বেশি সময় ধরে চলা এই গৃহযুদ্ধে এখন পর্যন্ত অন্তত ৩ লাখ ৮০ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়েছে অন্তত ৬০ লাখ। গৃহযুদ্ধের শুরুতে সৌদি আরব, কাতার, যুক্তরাষ্ট্র ও তার বেশ কয়েকটি আঞ্চলিক মিত্র সিরিয়ার বিদ্রোহী গোষ্ঠীকে সমর্থন দেয়। প্রেসিডেন্ট আসাদ অবশ্য ইরান ও রাশিয়ার সহায়তা নিয়ে বেশির ভাগ বিদ্রোহী গ্রুপকে পরাস্ত করেছেন। সৌদি-সিরিয়া সম্পর্ক নতুন মাত্রা পাওয়ায় এবার দেশটিতে সংঘাত থামবে বলে আশা প্রকাশ করা হচ্ছে। শোনা যাচ্ছে, আগামী ১৯ মে আরব লিগের শীর্ষ সম্মেলন, যেটা অনুষ্ঠিত হবে সৌদি আরবে—আসাদকে সেই সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানানোর পরিকল্পনা করছে সৌদি আরব। এই পদক্ষেপ আনুষ্ঠানিকভাবে সিরিয়ার আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নতার অবসান ঘটাবে। যদিও বিষয়টিতে আরব ঐকমত্য আছে কি না, তা স্পষ্ট নয়।
সিরিয়ার সঙ্গে সৌদির কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের পদক্ষেপকে অবশ্য ভালো চোখে দেখছে না যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র পররাষ্ট্র দপ্তরের একজন মুখপাত্র বলেছেন, ‘অন্যান্য দেশকে আসাদের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে যুক্তরাষ্ট্র উৎসাহিত করবে না। কারণ আসাদ সরকার সেখানে এক দশকের বেশি সময় ধরে বর্বরতা চালাচ্ছে। এই সংকটের রাজনৈতিক সমাধান হওয়া প্রয়োজন।’এদিকে শুধু সিরিয়া নয় ইয়েমেনের দিকেও মীমাংসার হাত বাড়িয়েছে সৌদি আরব। স্থায়ী যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছানোর লক্ষ্যে তারা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। হুতি বিদ্রোহীদের সঙ্গে আলোচনা করছে। এমনকি হুতিদের সঙ্গে আলোচনা করতে সৌদি আরবের একটি দল রাজধানী সানায় অবস্থান করছে বলে সংবাদমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে।
২০১৫ সাল থেকে ইয়েমেন সরকারকে হটিয়ে রাজধানী সানার নিয়ন্ত্রণ নেয় হুতি বিদ্রোহীরা। এরপর থেকেই হুতিদের সঙ্গে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটের যুদ্ধ শুরু হয়। ক্ষমতাচ্যুত সরকারের পক্ষ নিয়ে হুতিদের বিরুদ্ধে হামলা শুরু করে সৌদি আরব। এদিকে হুতিদের আশ্রয় দিয়ে আসছিল ইরান। সৌদি-ইরান সম্পর্ক নতুন মোড় পাওয়ায় এখন যুদ্ধ থামার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। তবে হুতিদের সঙ্গে সৌদির আলোচনা ফলপ্রসূ হয়েছে নাকি ভেস্তে গেছে সেটি স্পষ্ট নয়। ধারণা করা হচ্ছে, রমজানের শেষ দিকে সৌদি-হুতি বৈঠক থেকে আশানুরূপ ফল আসবে। গত ১৬ এপ্রিল ইয়েমেনের সরকার ও বিদ্রোহী হুতি দু’পক্ষের মধ্যে তিন দিনব্যাপী বন্দী বিনিময় কার্যক্রম শেষ হয়েছে। এ সময় উভয়পক্ষে প্রায় ৯০০ বন্দী বিনিময় হয়। বন্দী বিনিময় কার্যক্রম পরিচালনা করে ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অব রেড ক্রস (আইসিআরসি)। তারা জানায়, তাদের বিমানগুলো ইয়েমেন ও সৌদি আরবের ছয়টি শহরের মধ্যে মুক্তিপ্রাপ্ত বন্দীদের নিয়ে যাওয়ার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। ইয়েমেনের সরকার ও বিদ্রোহী হুতি উভয় পক্ষই ভবিষ্যতে আরও বেশি সংখ্যক বন্দী বিনিময়ের আশা প্রকাশ করেছে। তথ্যসূত্র : আরব নিউজ, রয়টার্স, এএফপি, আল জাজিরা ও ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল
বেলী / হককথা