বাংলাদেশি, বাঙালি, রোহিঙ্গা প্রসঙ্গ এবার গুজরাত ভোটেও

- প্রকাশের সময় : ১১:৪৬:৫৬ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২ ডিসেম্বর ২০২২
- / ১৩৮ বার পঠিত
গুজরাতের ভালসাদে বিজেপির হয়ে ভোটের প্রচারে গিয়েছিলেন পরেশ রাওয়াল। একসময়ে বিজেপির সংসদ সদস্য হয়েছিলেন এই বলিউড অভিনেতা। কিন্তু এখন মূলত ক্রাউড পুলার হিসাবেই বিজেপির জনসভায় বক্তৃতা করেন।
এরকমই একটা জনসভার ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে গেছে, যেখানে মি. রাওয়াল বলেন যে গুজরাতের মানুষ মূল্যবৃদ্ধি সহ্য করে নেবে, কিন্তু বাংলাদেশি আর রোহিঙ্গাদের নয়। বাঙালির প্রিয় মাছ নিয়েও কটাক্ষ করেন তিনি।
এই মন্তব্যের পরে সামাজিক মাধ্যমে কড়া প্রতিক্রিয়া দেখে শুক্রবার তিনি ক্ষমা চেয়েছেন। তিনি এও বলেছেন যে বাঙালিদের কটাক্ষ করতে চান নি তিনি। অবৈধভাবে ভারতে আসা বাংলাদেশি আর রোহিঙ্গাদের বোঝাতে চেয়েছিলেন তিনি।
ক্ষমা চাইলেও মি. রাওয়ালের ওই মন্তব্যে ক্ষুব্ধ গুজরাত আর পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের একটা বড় অংশ।
পরেশ রাওয়াল ঠিক কী বলেছিলেন?
ভালসাদের নির্বাচনী জনসভায় মি. রাওয়াল কথা বলছিলেন মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে, রান্নার গ্যাসের অত্যধিক দাম নিয়ে।
সেখান থেকে হঠাৎই তিনি বলেন যে “গ্যাসের দাম বেড়েছে, কিন্তু তা আবার কমেও যাবে। মানুষ চাকরিবাকরিও পাবেন।”
পরেশ রাওয়ালের ভাষণের যে ভিডিওটি ভাইরাল হয়েছে, সেখানে তাকে বলতে শোনা যাচ্ছে যে, “কিন্তু দিল্লির মতো যদি আপনার বাড়ির চারপাশে রোহিঙ্গা আর বাংলাদেশিরা থাকতে শুরু করে, তাহলে কী করবেন? তখন গ্যাস সিলিন্ডার দিয়ে কী করবেন? ওই বাঙালিদের জন্য মাছ রান্না করে দেবেন?”
“গুজরাতের মানুষ মূল্যবৃদ্ধি সহ্য করে নেবেন, কিন্তু এটা তারা মানবেন না। … তাদের মুখের কী ভাষা! ওদের সঙ্গে থাকতে গেলে মুখে ডায়াপার লাগাতে হয়,” মন্তব্য পরেশ রাওয়ালের।
সামাজিক মাধ্যমে কড়া প্রতিক্রিয়া
বহু মানুষ সামাজিক মাধ্যমে পরেশ রাওয়ালের এই বক্তব্যের নিন্দা করেছেন।
যেমন তপন কুমার দেও নামে একব্যক্তি টুইট করেছেন “সেইজন্যই তো বাংলাদেশের অর্থনীতি আমাদের অর্থনীতির থেকেও চাঙ্গা হয়ে গেছে।”
“পরেশ রাওয়াল একজন ভাল অভিনেতা কিন্তু তার ধর্মান্ধ হৃদয়ে ঘৃণা ভরা রয়েছে,” লিখেছেন চিন্টু আলি।
অরুণ আরোরা টুইটারে মন্তব্য করেছেন, “মোদিজি দেশে রোহিঙ্গাদের ঢুকতে কী করে দিলেন? স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ কী করছিলেন?”
পরেশ রাওয়ালের বক্তব্যের প্রতিবাদ করছেন বহু বাঙালিও।
অর্ঘ্য সেনগুপ্ত মন্তব্য করেছেন, “তার ভাষণের এই অংশটা পশ্চিমবঙ্গে যেখানে তার ছবি চলবে, তার আগে দেখানো উচিত। তার এই ধোকলা খাওয়া মুখ দেখিয়েই যে রাজ্য থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা উপার্জন করেছেন তিনি।।
“যে বাঙালি সমাজ মাছ খায়, তাদেরকে লক্ষ্যবস্তু বানাচ্ছেন?” প্রশ্ন প্রভাত বোস নামে এক টুইট ব্যবহারকারীর।
ইন্দ্র দা গ্রেট নামে এক টুইটার ব্যবহারকারী লিখেছেন, “এই ব্যক্তি তো রোহিঙ্গা আর বাংলাদেশিদের কথা বলতে গিয়ে আসলে বাঙালিদেরই গালাগালি করছেন। বাঙালিদের জন্য সত্যিই কিছু করতে চাইলে এর বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করুন।”
রোহিঙ্গা, বাংলাদেশি, বাঙালিদের প্রসঙ্গ কেন?
আহমেদাবাদে বিবিসি গুজরাতি বিভাগের বর্ষীয়ান সংবাদদাতা ভার্গব পারিখ বলছিলেন, মি. রাওয়াল যখন কথাটা বলেছেন, সেটা একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক ভাবেই ছিল। কিন্তু প্রসঙ্গটা বিজেপি উত্থাপন করেছে খুব ভেবে চিন্তেই, যদিও তার ফল হয়েছে উল্টো।
“এবারের ভোটে কোনও ভাবেই রোহিঙ্গা বা বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের বিষয়টা নির্বাচনী ইস্যু ছিল না। সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক-ভাবেই মি. রাওয়াল এটা বলেছেন। তবে এটা বিজেপি যথেষ্ট ভেবেচিন্তেই বলিয়েছিল তাকে দিয়ে। যে অঞ্চলে বলিউড অভিনেতা এই ভাষণ দিচ্ছিলেন, সেখানে মূল্যবৃদ্ধি, রান্নার গ্যাসের দাম বৃদ্ধি নিয়ে মানুষের মধ্যে একটা অসন্তোষ আছে। মানুষের নজরটা সেখান থেকে ঘোরাতেই রোহিঙ্গা আর বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের বিষয়টা তারা সামনে নিয়ে এসেছে,” বলছিলেন ভার্গব পারিখ।
তার কথায়, যে কোনও সময়ে অসন্তুষ্ট মানুষের মন ঘোরাতে বিজেপি তাদের বহু পরীক্ষিত ধর্মীয় মেরুকরণের যে পথ বেছে নেয়, এখানেও সেটাই করেছিল তারা। কিন্তু এই ভাষণের উল্টো ফল হয়েছে বিজেপির জন্য।
গুজরাতের বাঙালিদের মধ্যে ক্ষোভ, বিপাকে বিজেপি
মি. পারিখ বলছিলেন,”দ্বিতীয় দফায় ভোট হবে যেখানে তার মধ্যে অন্তত ৫টি এমন আসন আছে, যেগুলিতে বাংলাভাষী ভোটাররা একটা নিয়ন্ত্রক শক্তি। তাদের ভোট কোথাও ৫ % তো কোথাও সাড়ে ৭ % ভোট আছে বাংলাভাষীদের। এদের মধ্যে একটা বড় অংশ শ্রমিকদের কাজ যেমন করেন, তেমনই অলঙ্কার শিল্পের সঙ্গেও জড়িত।”
“এদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা গেছে পরেশ রাওয়ালের ভাষণের পরে। তাই বিজেপি মি. রাওয়ালকে দিয়ে ক্ষমা চাইয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে চেষ্টা করছে,” ব্যাখ্যা করছিলেন বিবিসির ভার্গব পারিখ।
‘ভারতীয় বাঙালিদের বাংলাদেশি বলে চিহ্নিত করা হচ্ছে’
বাঙালি এবং তাদের মাছ খাওয়ার অভ্যাসকে কটাক্ষ করায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দিয়েছে নিজেদের ‘ভারতে বাঙালিদের জাতীয় সংগঠন’ বলে দাবী করা বাংলা পক্ষ।
বাংলা পক্ষের প্রধান গর্গ চ্যাটার্জী বলছিলেন, “এর আগেও তো বিজেপি নেতা কৈলাশ বিজয়বর্গীয় মন্তব্য করেছিলেন তার বাড়িতে কাজ করে যেসব শ্রমিক, তাদের মধ্যে কাউকে চিঁড়ে খেতে দেখলেই তিনি বুঝে যান যে সেই ব্যক্তি বাংলাদেশি। তো এদিন পরেশ রাওয়াল যা বলেছেন, এগুলো সবই আসলে একই সূত্রে গাঁথা।”
তিনি বলছেন, “ভুলে গেলে চলবে না ওই ভাষণে আগের বাক্যে রোহিঙ্গা আর বাংলাদেশিদের কথা বলা হয়েছে। বিজেপি আর তার সমর্থকদের ভাষ্যে রোহিঙ্গা, বাংলাদেশি আর ভারতের বাঙালি এগুলো সমার্থক এবং এর মানবেতর। গুজরাতের মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করা হচ্ছে যে আপনার সমাজটা আপনার আর থাকবে না, একটা অলীক সমাজে চারদিকটা ভরে যাবে, যেখানে বাংলাদেশি – যারা আসলে ভারতের নাগরিক বাঙালি, তারা ভরিয়ে ফেলছে।”
পরেশ রাওয়ালের ভাষণ নিয়ে বিজেপি কিছু বলতে চায় নি। তারা জানাচ্ছে যে ওই ভাষণের জন্য পরেশ রাওয়াল নিজেই তো ক্ষমা চেয়ে নিয়েছেন।