নিউইয়র্ক ০৬:০৮ অপরাহ্ন, রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

ফিলিস্তিন-ইসরায়েল যুদ্ধে চীন কী চায়?

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০৮:৫৬:০৩ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৫ নভেম্বর ২০২৩
  • / ৪০ বার পঠিত

ছবি : সংগৃহীত

আর্ন্তজাতিক ডেস্ক : ইসরায়েল এবং হামাসের মধ্যে সংঘাত তীব্র হওয়ার পর চীন শান্তি নিয়ে ‘দালালের’ ভূমিকা পালন করছে। তবে এমনটা করে তারা যা অর্জন করতে পারে তাতে কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে।

চীনের শীর্ষ কূটনীতিক ওয়াং ই বড় ধরনের আঞ্চলিক যুদ্ধের আশঙ্কায় ওয়াশিংটনের কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনা করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তারা সমাধান খোঁজার চেষ্টায় চীনের সাথে কাজ করবে।

চীনের বিশেষ দূত আরব নেতাদের সাথে মধ্যপ্রাচ্যে দেখা করতে গিয়ে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনি প্রতিপক্ষের সাথেও কথা বলেছেন। এ ছাড়া জাতিসংঘের বৈঠকে যুদ্ধবিরতির অন্যতম সোচ্চার আহ্বানও ছিল এটি।

ইরানের সঙ্গে চীনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের মাধ্যমে গাজায় হামাস এবং লেবাননের হিজবুল্লাহর হামলা কমে আসবে এমনটা ভাবা হয়। ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস জানায়, কর্মকর্তারাও স্পষ্টত ওয়াংকে ইরানিদের ‘শান্ত করতে’ চাপ দিয়েছিলেন।

চীন ইরানের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য সহযোগী। তেহরান জানিয়েছে, তারা গাজার পরিস্থিতি সমাধানে ‘চীনের সাথে যোগাযোগ জোরদার করতে প্রস্তুত’।

যুক্তরাষ্ট্র প্রতিরক্ষা বিভাগের অধীনস্থ ন্যাশনাল ওয়ার কলেজের সহযোগী অধ্যাপক ডন মারফি বলেন, যেহেতু চীনা সরকারের সঙ্গে সমস্ত পক্ষের তুলনামূলক ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে, তাই চীনকে একটি সৎ দালাল হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।

তিনি বলেন, ‘চীনা সরকারের সঙ্গে ফিলিস্তিনি, আরব, তুরস্ক ও ইরানের ইতিবাচক সম্পর্ক রয়েছে।ইসরায়েলের সঙ্গে সুসম্পর্কে আবদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে তারা সব পক্ষকে টেবিলে আনতে পারে।’ তবে অন্যান্য পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে চীন একটি ছোটখাটো খেলোয়াড়।

মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে চীনের সম্পর্কবিষয়ক বিশেষজ্ঞ এবং আটলান্টিক কাউন্সিলের একজন অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো জোনাথন ফুলটন বলেন, ‘চীন এ ইস্যুতে বড় ক্রীড়ানক নয়। এ অঞ্চলের চারপাশের মানুষের সাথে কথা বলে বোঝা যায়, কেউই আশা করে না যে চীন সমাধানে অবদান রাখবে’।

সংঘাতের বিষয়ে চীনের প্রথম বিবৃতি ইসরায়েলকে বেশ ক্ষুব্ধ করেছিল। চীন হামাসের নিন্দা করেনি বা ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকারের কথা উল্লেখ করেনি বলে ‘গভীর হতাশা’ প্রকাশ করে দেশটি।

হামাস যোদ্ধারা ৭ অক্টোবর গাজা উপত্যকা থেকে ইসরায়েলের ওপর একটি নজিরবিহীন আক্রমণ শুরু করে। এতে ১,৪০০ জনেরও বেশি মানুষকে হত্যা করা হয় এবং কমপক্ষে ২৩৯ জনকে জিম্মি করে। তারপর থেকে ইসরায়েল গাজায় প্রতিশোধমূলক হামলা চালিয়ে আসছে। হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, হামলায় ৯ হাজারেরও এরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। ইসরায়েল এখনও ওই অঞ্চলে সেনা ও ট্যাঙ্ক পাঠানো অব্যাহত রেখেছে।

চীনের প্রথম বিবৃতি নিয়ে ক্ষোভের পর ওয়াং ইসরায়েলকে বলেছিলেন ‘সব দেশেরই আত্মরক্ষার অধিকার আছে’- তবে তিনি অন্যত্রও এটাও বলেছেন, ইসরায়েলের পদক্ষেপগুলো ‘আত্মরক্ষার সুযোগের বাইরে’ চলে গেছে। এদিকে দীর্ঘদিন ধরে ফিলিস্তিনের প্রতি প্রকাশ্যে সহানুভূতি দেখানোয় চীন বেশ কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে।

চীনের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা মাও সেতুং- বিশ্বজুড়ে তথাকথিত ‘জাতীয় মুক্তি’ আন্দোলনের সমর্থনে ফিলিস্তিনিদের কাছে অস্ত্র পাঠিয়েছিলেন। মাও ইসরায়েলকে তাইওয়ানের সাথে তুলনা করেছেন- কেননা তারা উভয়ই পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের কেন্দ্রস্থল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থক।

পরে দশকগুলোতে চীন ইসরায়েলের সাথে অর্থনৈতিকভাবে এবং স্বাভাবিক সম্পর্ক উন্মুক্ত করে। ইসরায়েলের সঙ্গে এখন চীনের বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য রয়েছে। তবে চীন স্পষ্ট করে দিয়েছে, তারা ফিলিস্তিনিদের সমর্থন অব্যাহত রেখেছে। সাম্প্রতিক সংঘাত নিয়ে মন্তব্যে চীনা কর্মকর্তারা এমনকি প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছেন।

বেইজিংয়ে ইসরায়েলি দূতাবাসের এক কর্মীর পরিবারের সদস্যের ছুরিকাঘাতের ঘটনাও অস্বস্তি বাড়িয়েছে। চীনে অনলাইনে জাতীয়তাবাদী ব্লগারদের মাধ্যমে অনুপ্রাণিত হয়ে ইহুদি-বিদ্বেষ বেড়েছে। চীনা সোশ্যাল মিডিয়ায় কেউ কেউ ফিলিস্তিনিদের ওপর গণহত্যা চালানোর অভিযোগ এনে ইসরায়েলের পদক্ষেপকে নাৎসিবাদের সাথে তুলনা করেছে। বেইজিংয়ে জার্মান দূতাবাস এসব ঘটনায় তিরস্কার জানিয়েছে।

ইসরায়েলি সরকারের সঙ্গে সমঝোতায় ‍আসার চেষ্টায়রত চীনের জন্য এসব ভালো ফলাফল নাও আনতে পারে।

কেন চীন অনিশ্চয়তায় জড়িয়ে পড়ছে?

যার একটি কারণ হলো মধ্যপ্রাচ্যে অর্থনৈতিক স্বার্থ, যা সংঘাত বিস্তৃত হলে বিপন্ন হবে। বেইজিং এখন তেলের জন্য বিদেশি আমদানির ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। বিশ্লেষকরা অনুমান করেন, এর প্রায় অর্ধেক উপসাগর থেকে আসে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হয়ে উঠেছে। এটা চীনের বৈদেশিক ও অর্থনৈতিক নীতির ভিত্তি।

এ সংঘাত বেইজিংয়ের জন্য তার সুনাম মেরামতের সুযোগ হিসেবে প্রতিভাত হচ্ছে।

ডন মারফি মনে করেন- চীন বিশ্বাস করে, ‘ফিলিস্তিনিদের পক্ষে দাঁড়ানোর অর্থ আরব দেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব। এই যুদ্ধটি এমন এক সময়ে শুরু হয়েছে যখন চীন নিজেকে বিশ্বের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে ভালো সমঝোতাকারী হিসেবে উপস্থাপন করছে।’ চলতি বছরের শুরু থেকে এ যুদ্ধকে যুক্তরাষ্ট্র ‘আধিপত্যবাদী’ নেতৃত্বের ব্যর্থতা হিসেবে দেখে তার সমালোচনা করেছে চীন।

আনুষ্ঠানিকভাবে চীন ইসরায়েলকে সমর্থন করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে আক্রমণ করা থেকে বিরত রয়েছে। কিন্তু একই সময়ে চীনের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম ‘জাতীয়তাবাদী প্রতিক্রিয়া’ চালু রেখেছে।

চীনা সামরিক সংবাদপত্র পিএলএ ডেইলি যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ‘আগুনে ঘি ঢালার’ অভিযোগ করেছে। বেইজিং ইউক্রেন যুদ্ধে কিয়েভকে সাহায্য করার জন্য ওয়াশিংটনের সমালোচনা করেছে। রাষ্ট্র পরিচালিত ইংরেজি ভাষার সংবাদপত্র দ্য গ্লোবাল টাইমস রক্তাক্ত হাতে আঙ্কেল স্যামের একটি কার্টুন প্রকাশ করেছে।

পর্যবেক্ষকদের মধ্যে জনপ্রিয় একটি মতামত হলো, পশ্চিমা প্রতিদ্বন্দ্বীর বৈশ্বিক অবস্থানকে দমিয়ে দিতে বেইজিং যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তার চিরায়ত অবস্থান থেকে সরে দাঁড়াচ্ছে বলে হচ্ছে। কিন্তু স্পষ্টভাবে হামাসকে নিন্দা না করে চীন তার নিজের অবস্থানকে ক্ষুণ্ন করার ঝুঁকিতে ফেলেছে। ফলে চীনের দীর্ঘমেয়াদি উচ্চাকাঙ্ক্ষার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি হচ্ছে।

যার আরেকটি কারণ হলো, চীনের নিজস্ব ট্র্যাক রেকর্ডের সাথে দেশটির কূটনৈতিক অবস্থানের মিল কমছে। চীন মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর সাথে সংহতি প্রকাশ করেছে। এ ছাড়া ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের দখলের বিরোধিতা করেছে। তবে বেইজিংয়ের বিরুদ্ধে উইঘুর মুসলিম সংখ্যালঘুদের গণহত্যা, অধিকার লঙ্ঘন এবং তিব্বতে জোরপূর্বক আত্তীকরণে অভিযোগ রয়েছে। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, চীন আরব বিশ্বের সঙ্গে দৃঢ় সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। এতে সম্ভবত বড় সমস্যা হবে না।

সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো বেইজিং নিজেকে বিভিন্ন বিষয়ে জড়িত করে তার অব্স্থানকে দুর্বল করছে। ইসরায়েল-হামাস দ্বন্দ্বকে পুঁজি করে তা নিজের স্বার্থ হাসিল করছে বললেও অত্যুক্তি হবে না।  ড. ফুলটন বলেন, ‘চীন ধরেই নিচ্ছে ফিলিস্তিনকে সমর্থন করার অর্থ আরব দেশগুলোর সমর্থন পাওয়া। বলা বাহুল্য, এমন বিভাজনকারী ইস্যুতে আরব রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে কোনো ঐক্যবদ্ধ কণ্ঠস্বর নেই।’

যদিও ওয়াং দাবি করেছেন, চীন কেবল মধ্যপ্রাচ্যের জন্য শান্তি চায় এবং ‘ফিলিস্তিন প্রশ্নে চীনের কোনো স্বার্থপরতা নেই’। তবে চ্যালেঞ্জ হবে গোটা বিশ্বকে এটা সত্য তা বোঝানো।

তেসা ওং : (এশিয়া ডিজিটাল রিপোর্টার, বিবিসি নিউজ) ভাষান্তর : সরকার জারিফ

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]

হককথা/নাছরিন

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

ফিলিস্তিন-ইসরায়েল যুদ্ধে চীন কী চায়?

প্রকাশের সময় : ০৮:৫৬:০৩ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৫ নভেম্বর ২০২৩

আর্ন্তজাতিক ডেস্ক : ইসরায়েল এবং হামাসের মধ্যে সংঘাত তীব্র হওয়ার পর চীন শান্তি নিয়ে ‘দালালের’ ভূমিকা পালন করছে। তবে এমনটা করে তারা যা অর্জন করতে পারে তাতে কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে।

চীনের শীর্ষ কূটনীতিক ওয়াং ই বড় ধরনের আঞ্চলিক যুদ্ধের আশঙ্কায় ওয়াশিংটনের কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনা করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তারা সমাধান খোঁজার চেষ্টায় চীনের সাথে কাজ করবে।

চীনের বিশেষ দূত আরব নেতাদের সাথে মধ্যপ্রাচ্যে দেখা করতে গিয়ে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনি প্রতিপক্ষের সাথেও কথা বলেছেন। এ ছাড়া জাতিসংঘের বৈঠকে যুদ্ধবিরতির অন্যতম সোচ্চার আহ্বানও ছিল এটি।

ইরানের সঙ্গে চীনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের মাধ্যমে গাজায় হামাস এবং লেবাননের হিজবুল্লাহর হামলা কমে আসবে এমনটা ভাবা হয়। ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস জানায়, কর্মকর্তারাও স্পষ্টত ওয়াংকে ইরানিদের ‘শান্ত করতে’ চাপ দিয়েছিলেন।

চীন ইরানের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য সহযোগী। তেহরান জানিয়েছে, তারা গাজার পরিস্থিতি সমাধানে ‘চীনের সাথে যোগাযোগ জোরদার করতে প্রস্তুত’।

যুক্তরাষ্ট্র প্রতিরক্ষা বিভাগের অধীনস্থ ন্যাশনাল ওয়ার কলেজের সহযোগী অধ্যাপক ডন মারফি বলেন, যেহেতু চীনা সরকারের সঙ্গে সমস্ত পক্ষের তুলনামূলক ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে, তাই চীনকে একটি সৎ দালাল হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।

তিনি বলেন, ‘চীনা সরকারের সঙ্গে ফিলিস্তিনি, আরব, তুরস্ক ও ইরানের ইতিবাচক সম্পর্ক রয়েছে।ইসরায়েলের সঙ্গে সুসম্পর্কে আবদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে তারা সব পক্ষকে টেবিলে আনতে পারে।’ তবে অন্যান্য পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে চীন একটি ছোটখাটো খেলোয়াড়।

মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে চীনের সম্পর্কবিষয়ক বিশেষজ্ঞ এবং আটলান্টিক কাউন্সিলের একজন অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো জোনাথন ফুলটন বলেন, ‘চীন এ ইস্যুতে বড় ক্রীড়ানক নয়। এ অঞ্চলের চারপাশের মানুষের সাথে কথা বলে বোঝা যায়, কেউই আশা করে না যে চীন সমাধানে অবদান রাখবে’।

সংঘাতের বিষয়ে চীনের প্রথম বিবৃতি ইসরায়েলকে বেশ ক্ষুব্ধ করেছিল। চীন হামাসের নিন্দা করেনি বা ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকারের কথা উল্লেখ করেনি বলে ‘গভীর হতাশা’ প্রকাশ করে দেশটি।

হামাস যোদ্ধারা ৭ অক্টোবর গাজা উপত্যকা থেকে ইসরায়েলের ওপর একটি নজিরবিহীন আক্রমণ শুরু করে। এতে ১,৪০০ জনেরও বেশি মানুষকে হত্যা করা হয় এবং কমপক্ষে ২৩৯ জনকে জিম্মি করে। তারপর থেকে ইসরায়েল গাজায় প্রতিশোধমূলক হামলা চালিয়ে আসছে। হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, হামলায় ৯ হাজারেরও এরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। ইসরায়েল এখনও ওই অঞ্চলে সেনা ও ট্যাঙ্ক পাঠানো অব্যাহত রেখেছে।

চীনের প্রথম বিবৃতি নিয়ে ক্ষোভের পর ওয়াং ইসরায়েলকে বলেছিলেন ‘সব দেশেরই আত্মরক্ষার অধিকার আছে’- তবে তিনি অন্যত্রও এটাও বলেছেন, ইসরায়েলের পদক্ষেপগুলো ‘আত্মরক্ষার সুযোগের বাইরে’ চলে গেছে। এদিকে দীর্ঘদিন ধরে ফিলিস্তিনের প্রতি প্রকাশ্যে সহানুভূতি দেখানোয় চীন বেশ কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে।

চীনের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা মাও সেতুং- বিশ্বজুড়ে তথাকথিত ‘জাতীয় মুক্তি’ আন্দোলনের সমর্থনে ফিলিস্তিনিদের কাছে অস্ত্র পাঠিয়েছিলেন। মাও ইসরায়েলকে তাইওয়ানের সাথে তুলনা করেছেন- কেননা তারা উভয়ই পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের কেন্দ্রস্থল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থক।

পরে দশকগুলোতে চীন ইসরায়েলের সাথে অর্থনৈতিকভাবে এবং স্বাভাবিক সম্পর্ক উন্মুক্ত করে। ইসরায়েলের সঙ্গে এখন চীনের বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য রয়েছে। তবে চীন স্পষ্ট করে দিয়েছে, তারা ফিলিস্তিনিদের সমর্থন অব্যাহত রেখেছে। সাম্প্রতিক সংঘাত নিয়ে মন্তব্যে চীনা কর্মকর্তারা এমনকি প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছেন।

বেইজিংয়ে ইসরায়েলি দূতাবাসের এক কর্মীর পরিবারের সদস্যের ছুরিকাঘাতের ঘটনাও অস্বস্তি বাড়িয়েছে। চীনে অনলাইনে জাতীয়তাবাদী ব্লগারদের মাধ্যমে অনুপ্রাণিত হয়ে ইহুদি-বিদ্বেষ বেড়েছে। চীনা সোশ্যাল মিডিয়ায় কেউ কেউ ফিলিস্তিনিদের ওপর গণহত্যা চালানোর অভিযোগ এনে ইসরায়েলের পদক্ষেপকে নাৎসিবাদের সাথে তুলনা করেছে। বেইজিংয়ে জার্মান দূতাবাস এসব ঘটনায় তিরস্কার জানিয়েছে।

ইসরায়েলি সরকারের সঙ্গে সমঝোতায় ‍আসার চেষ্টায়রত চীনের জন্য এসব ভালো ফলাফল নাও আনতে পারে।

কেন চীন অনিশ্চয়তায় জড়িয়ে পড়ছে?

যার একটি কারণ হলো মধ্যপ্রাচ্যে অর্থনৈতিক স্বার্থ, যা সংঘাত বিস্তৃত হলে বিপন্ন হবে। বেইজিং এখন তেলের জন্য বিদেশি আমদানির ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। বিশ্লেষকরা অনুমান করেন, এর প্রায় অর্ধেক উপসাগর থেকে আসে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হয়ে উঠেছে। এটা চীনের বৈদেশিক ও অর্থনৈতিক নীতির ভিত্তি।

এ সংঘাত বেইজিংয়ের জন্য তার সুনাম মেরামতের সুযোগ হিসেবে প্রতিভাত হচ্ছে।

ডন মারফি মনে করেন- চীন বিশ্বাস করে, ‘ফিলিস্তিনিদের পক্ষে দাঁড়ানোর অর্থ আরব দেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব। এই যুদ্ধটি এমন এক সময়ে শুরু হয়েছে যখন চীন নিজেকে বিশ্বের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে ভালো সমঝোতাকারী হিসেবে উপস্থাপন করছে।’ চলতি বছরের শুরু থেকে এ যুদ্ধকে যুক্তরাষ্ট্র ‘আধিপত্যবাদী’ নেতৃত্বের ব্যর্থতা হিসেবে দেখে তার সমালোচনা করেছে চীন।

আনুষ্ঠানিকভাবে চীন ইসরায়েলকে সমর্থন করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে আক্রমণ করা থেকে বিরত রয়েছে। কিন্তু একই সময়ে চীনের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম ‘জাতীয়তাবাদী প্রতিক্রিয়া’ চালু রেখেছে।

চীনা সামরিক সংবাদপত্র পিএলএ ডেইলি যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ‘আগুনে ঘি ঢালার’ অভিযোগ করেছে। বেইজিং ইউক্রেন যুদ্ধে কিয়েভকে সাহায্য করার জন্য ওয়াশিংটনের সমালোচনা করেছে। রাষ্ট্র পরিচালিত ইংরেজি ভাষার সংবাদপত্র দ্য গ্লোবাল টাইমস রক্তাক্ত হাতে আঙ্কেল স্যামের একটি কার্টুন প্রকাশ করেছে।

পর্যবেক্ষকদের মধ্যে জনপ্রিয় একটি মতামত হলো, পশ্চিমা প্রতিদ্বন্দ্বীর বৈশ্বিক অবস্থানকে দমিয়ে দিতে বেইজিং যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তার চিরায়ত অবস্থান থেকে সরে দাঁড়াচ্ছে বলে হচ্ছে। কিন্তু স্পষ্টভাবে হামাসকে নিন্দা না করে চীন তার নিজের অবস্থানকে ক্ষুণ্ন করার ঝুঁকিতে ফেলেছে। ফলে চীনের দীর্ঘমেয়াদি উচ্চাকাঙ্ক্ষার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি হচ্ছে।

যার আরেকটি কারণ হলো, চীনের নিজস্ব ট্র্যাক রেকর্ডের সাথে দেশটির কূটনৈতিক অবস্থানের মিল কমছে। চীন মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর সাথে সংহতি প্রকাশ করেছে। এ ছাড়া ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের দখলের বিরোধিতা করেছে। তবে বেইজিংয়ের বিরুদ্ধে উইঘুর মুসলিম সংখ্যালঘুদের গণহত্যা, অধিকার লঙ্ঘন এবং তিব্বতে জোরপূর্বক আত্তীকরণে অভিযোগ রয়েছে। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, চীন আরব বিশ্বের সঙ্গে দৃঢ় সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। এতে সম্ভবত বড় সমস্যা হবে না।

সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো বেইজিং নিজেকে বিভিন্ন বিষয়ে জড়িত করে তার অব্স্থানকে দুর্বল করছে। ইসরায়েল-হামাস দ্বন্দ্বকে পুঁজি করে তা নিজের স্বার্থ হাসিল করছে বললেও অত্যুক্তি হবে না।  ড. ফুলটন বলেন, ‘চীন ধরেই নিচ্ছে ফিলিস্তিনকে সমর্থন করার অর্থ আরব দেশগুলোর সমর্থন পাওয়া। বলা বাহুল্য, এমন বিভাজনকারী ইস্যুতে আরব রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে কোনো ঐক্যবদ্ধ কণ্ঠস্বর নেই।’

যদিও ওয়াং দাবি করেছেন, চীন কেবল মধ্যপ্রাচ্যের জন্য শান্তি চায় এবং ‘ফিলিস্তিন প্রশ্নে চীনের কোনো স্বার্থপরতা নেই’। তবে চ্যালেঞ্জ হবে গোটা বিশ্বকে এটা সত্য তা বোঝানো।

তেসা ওং : (এশিয়া ডিজিটাল রিপোর্টার, বিবিসি নিউজ) ভাষান্তর : সরকার জারিফ

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]

হককথা/নাছরিন