ফিদেল কাস্ত্রো : রক্ষিতার সন্তান থেকে সমাজতন্ত্রের চ্যাম্পিয়ন

- প্রকাশের সময় : ০৬:১৫:২২ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৬ নভেম্বর ২০১৬
- / ১০২০ বার পঠিত
ঢাকা: সারা বিশ্বে যখন কমিউনিস্ট সরকারগুলো ধসে পড়েছে ঠিক তখন কমিউনিস্ট ব্যবস্থার বৃহত্তম শত্রু বলে পরিচিত আমেরিকার দোরগোড়াতেই সমাজতন্ত্রের ধ্বজা তুলে ধরে রেখেছিলেন কাস্ত্রো। তার সমর্থকেরা তাকে সমাজতন্ত্রের চ্যাম্পিয় হিসেবে দেখতেন, যিনি জনগণের কাছে কিউবাকে ফেরত দিয়েলেন। বে বিরোধীদের প্র চরম দমন-পীড়নের অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। ১৯২৬ সালের ১৩ অগাস্ট জন্ম হয় ফিদেল আলেহান্দ্রো কাস্ত্রো রুৎজের।
স্পেন থেকে কিউবাতে আসা ধনী এক কৃষক আনহেল মারিয়া বাউতিস্তা কাস্ত্রোর অবৈধ সন্তান ছিলেন তিনি। পিতার খামারের ভৃত্য ছিলেন মা লিনা রুৎজ গনজালেজ, যিনি পরে ছিলেন তার পিতার রক্ষিতা।
ফিদেলের জন্মের পর তার মাকে স্ত্রীর মর্যাদা দেন তার পিতা। সান্টিয়াগোর ক্যাথলিক স্কুলে শিক্ষাজীবন শুরু হয় ফিদেলের। পরে তিনি যোগ দেন হাভানার কলেজ এল কলেজিও ডে বেলেন-এ। তবে খেলাধুলার দিকে বেশি মনযোগ থাকার কারণে পড়াশোনায় খুব ভালো করতে পারেননি তিনি। ১৯৪০-এর দশকে হাভানা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন পড়বার সময়ে তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন।
১৯৪৮ সালে কিউবার ধনী এক রাজনীতিবিদের কন্যা মার্টা ডিয়াজ বালার্টকে বিয়ে করেন কাস্ত্রো। এই বিয়ের মাধ্যমে দেশটির এলিট শ্রেণীতে যুক্ত হয়ে যাওয়ার সুযোগ ছিল তার, কিন্তু তার বদলে তিনি আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেলেন মার্ক্সবাদে। তিনি বিশ্বাস করতেন, কিউবার লাগামহীন পুঁজিবাদের কারণে দেশটির যাবতীয় অর্থনৈতিক সমস্যার উদ্ভব এবং একমাত্র জনগণের বিপ্লবের মাধ্যমেই এই সমস্যার সমাধান হতে পারে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট চুকানোর পর আইন পেশা শুরু করেন কিন্তু এই পেশায় তিনি সফল হতে ব্যর্থ হন। ফলে দেনায় ডুবে যান তিনি। এই পরিস্থিতিতেও রাজনীতি অব্যাহত রাখেন তিনি। প্রায়ই সহিংস বিক্ষোভে জড়িয়ে পড়তেন তিনি।
আক্রমণ: ১৯৫২ সালে ফুলগেন্সিও বাতিস্তা একটি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট কার্লোস প্রিয়র সরকারকে উচ্ছেদ করেন। বাতিস্তার সরকারের নীতি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের মতই, যা ছিল কাস্ত্রোর বিশ্বাসের পরিপন্থী। ফলে বাতিস্তা সরকারকে উৎখাতের জন্য তিনি একটি গোপন সংগঠন গড়ে তোলেন যার নাম ‘দ্য মুভমেন্ট’।
এসময় কিউবা পরিণত হয়েছিল উচ্ছৃঙ্খল ধনীদের স্বর্গরাজ্যে। যৌন ব্যবসা, জুযয়া এবং মাদক চোরাচালান চরম আকার ধারণ করেছিল।
সশস্ত্র বিপ্লবের জন্য অস্ত্র সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ১৯৫৩-র জুলাই মাসে সান্টিয়াগোর কাছে মোনাকাডা সেনা ছাউনিতে একটি আক্রমণের পরিকল্পনা করেন কাস্ত্রো। আক্রমণটি ব্যর্থ হয় এবং বহু বিপ্লবী হয় নিহত হয় নয়তো ধরা পড়ে। বন্দীদের মধ্যে কাস্ত্রোও ছিলেন। ১৯৫৩ সালে তার বিচার শুরু হয়। বিচারের শুনানিগুলো কাস্ত্রো ব্যবহার করতেন সেনাবাহিনীর দমন-পীড়নের ঘটনাবলী ফাঁস করে দেয়ার মঞ্চ হিসেবে।
এসময় শুনানিগুলোতে বিদেশী সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকার ছিল, ফলে কাস্ত্রোর জনপ্রিয়তা এসময় বেড়ে যায়। কাস্ত্রোকে অবশ্য ১৫ বছরের কারাদন্ড দেয় আদালত।
গেরিলা যুদ্ধ: সাধারণ ক্ষমার মাধ্যমে ১৯৫৫ সালের মে মাসে জেল থেকে ছাড়া পান কাস্ত্রো। জেলে থাকার সময়েই স্ত্রীকে তালাক দেন তিনি, মার্ক্সবাদে আরো ভালোভাবে জড়িয়ে পড়েন। ছাড়া পাওয়ার পর ফের গ্রেপ্তার এড়াতে মেক্সিকো পালিয়ে যান তিনি। সেখানে তার পরিচয় হয় আরেক তরুণ বিপ্লবী আরনেস্তো চে গুয়েভারার সঙ্গে।
১৯৫৬ সালের নভেম্বরে ১২জন ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি ইঞ্জিন নৌকায় ৮১জন সশস্ত্র সঙ্গীকে নিয়ে কিউবায় ফিরে আসেন ফিদেল কাস্ত্রো। তারা সিয়েরা মায়েস্ত্রা পাহাড়ে আশ্রয় নেন। এখান থেকে হাভানার সরকারের বিরুদ্ধে দু বছর ধরে গেরিলা আক্রমণ চালান। ১৯৫৯ সালের দোসরা জানুয়ারী বিদ্রোহীরা হাভানায় প্রবেশ করে। বাতিস্তা পালিয়ে যান। এসময় বাতিস্তার বহু সমর্থককে বিচারের মাধ্যমে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। এসব বিচার কার্যক্রমকে অনেক বিদেশী পর্যবেক্ষকই ‘অনিরেপক্ষ’ বলে মনে করেন।
আদর্শ: কিউবার নতুন সরকার জনগণকে সব জমি বুঝিয়ে দেবার এবং গরিবের অধিকার সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু একই সাথে দেশে একটি এক দলীয় শাসন ব্যবস্থা কায়েম করা হয়। রাজবন্দী হিসেবে বহু মানুষকে কারাগারে এবং শ্রম শিবিরে প্রেরণ করা হয়। হাজার হাজার মধ্যবিত্ত কিউবান বিদেশে পালিয়ে নির্বাসন নেন।
১৯৬০ সালের কিউবাতে থাকা সকল মার্কিন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রায়ত্ত খাতে নিয়ে নেয়া হয়। জবাবে যুক্তরাষ্ট্র কিউবার উপর একটি বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যা একবিংশ শতক পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের এক নম্বর শত্রু: বিপ্লবের সময় তৎকালীন সোভিয়েত রাশিয়া এবং এর নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভের সাথে মিত্রতা তৈরি হয় কাস্ত্রোর। ফলে কিউবা পরিণত হয় ঠান্ডা যুদ্ধের যুদ্ধক্ষেত্রে।
১৯৬১ সালের এপ্রিল মাসে যুক্তরাষ্ট্র কাস্ত্রো সরকারকে উৎখাতের চেষ্টা চালায় একদল নির্বাসিত কিউবানকে দিয়ে দ্বীপটি দখল করিয়ে নেবার মাধ্যমে। ওই চেষ্টা ব্যর্থ হয়, বহু মানুষ এসময় নিহত হয়, হাজার খানেক মানুষ ধরা পড়ে।
এই ঘটনা পরে কিউবা নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। ফিদেল কাস্ত্রো আমেরিকার এক নম্বর শত্রুতে পরিণত হন। সিআইএ তাকে হত্যার চেষ্টাও করে।
জোট নিরপেক্ষ: যদিও ওই ঠান্ডা যুদ্ধের সময়কালে মার্কিন বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা স্বত্বেও সোভিয়েত ইউনিয়নের সাহায্যই টিকিয়ে রেখেছিল কিউবাকে, কিন্তু কাস্ত্রো তখন নজর দেন নবগঠিত জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের দিকে। অবশ্য পক্ষও নিতেন মি. কাস্ত্রো। তিনি অ্যাঙ্গোলা ও মোজাম্বিকে মার্ক্সবাদী গেরিলাদের সাহায্যে সৈন্য পাঠিয়েছিলেন।
১৯৮০-র দশকে বিশ্ব রাজনীতির মোড় ঘুরতে শুরু করে। মিখাইল গর্ভাচেভের নেতৃত্বাধীন মস্কো কিউবা থেকে আর চিনি কিনতে অস্বীকৃতি জানায়। এদিকে মার্কিন নিষেধাজ্ঞাও অব্যাহত থাকায় কিউবা বিরাট বিপদে পড়ে যায়। খাদ্য ঘাটতি দেখা দেয় এসময়।
এসময় ফিদেল কাস্ত্রো ঘোষিত বিশ্বের সবচাইতে অগ্রসরমান কিউবা কার্যত মান্ধাতা যুগে ফিরে যায়।
১৯৯০ এর দশকে পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে হাজার হাজার কিউবান ভালভাবে বেঁচে থাকার আশায় সমুদ্রে পাড়ি জমায় যুক্তরাষ্ট্রে যাবার উদ্দেশ্যে। এসময় বহু মানুষ সমুদ্রে ডুবে মারা যায়। কিন্তু অনেকেই এসব মৃত্যু এবং হাজার হাজার কিউবানের আমেরিকায় পাড়ি জমানোকে দেখেছেন ফিদেল কাস্ত্রোর প্রতি অনাস্থার নিদর্শন হিসেবে।
ক্যারিবিয়ান কম্যুনিজম: কাস্ত্রোর শাসনামলে কিউবায় অবশ্য বহু অভ্যন্তরীণ উন্নয়নও হয়েছে। দেশটির প্রতিটি নাগরিকই বিনামূল্যে উন্নত চিকিৎসা সেবা পায়। বিশ্বের বহু উন্নত দেশের তুলনায় কিউবায় শিশুমৃত্যুর হার কম।
শাসনামলের শেষ দশ বছরে নিজের বিপ্লবকে বাঁচাতে মুক্ত বাণিজ্যের কিছু কিছু দিক গ্রহণ করতে বাধ্য হন মি. কাস্ত্রো।
২০০৬ সালের ৩১ জুলাই ৮০তম জন্মদিনের কয়েক দিন আগে ভাই রাউলের হাতে সাময়িক শাসনভার দিয়ে একটি জরুরী অস্ত্রোপচারে যান তিনি। এসময় তার শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকে।
২০০৮ সালের গোড়ার দিকে তিনি অবসরে যাবার ঘোষণা দেন। সূত্র : বিবিসি