নিউইয়র্ক ০৯:০২ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ০৬ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ২৪ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

প্রিন্স ফিলিপের জীবনাবসান

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০৪:২৪:৫৯ অপরাহ্ন, রবিবার, ১১ এপ্রিল ২০২১
  • / ৫১ বার পঠিত

হককথা ডেস্ক: প্রিন্স ফিলিপ, ব্রিটেনের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের স্বামী মারা গেছেন। প্রায় এক মাস আগে হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা শেষে গত মাসেই বাড়ি ফিরেছিলেন প্রিন্স ফিলিপ। ফেরার সময় গাড়িতে বসে হাসিমুখে হাত নেড়েছিলেন ক্যামেরার দিকে। শুক্রবার (৯ এপ্রিল) সকালে উইন্ডসর প্রাসাদে সেই হাসিমুখের মানুষটির জীবনাবসান ঘটে। ছেলে প্রিন্স চার্লসের ১৬তম বিবাহ বার্ষিকীর দিনেই তিনি না ফেরার দেশে চলে গেলেন। তার মৃত্যুর মাধ্যমে স্ত্রী রানি এলিজাবেথের সঙ্গে ৭৩ বছরের দাম্পত্যের ইতি ঘটলো। তাকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে বাকিংহাম প্রাসাদের কাছে মানুষের ভিড় বাড়ছে। তার মৃত্যুতে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ বিশ্বের নেতারা গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। খবর বিবিসি ও ডেইলি মেইলের।
শুক্রবার বাকিংহাম প্রাসাদ এক ঘোষণায় জানায়, রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের স্বামী প্রিন্স ফিলিপ ৯৯ বছরে মারা গেছেন। প্রাসাদ থেকে দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়েছে, মহামান্য রানি খুবই দুঃখের সাথে তার প্রিয় স্বামী প্রিন্স ফিলিপ, ডিউক অব এডিনবরার মৃত্যু ঘোষণা করেছেন। ডিউক উইন্ডসর ক্যাসেলে শান্তিপূর্ণভাবে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেছেন। রাজ পরিবারের অন্য সদস্যদেরও প্রিন্সের মৃত্যুর কথা জানানো হয়েছে। তার শেষকৃত্য সম্পর্কে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু ঘোষণা হয়নি। সময় মতো সব কিছু প্রকাশ্যে আনা হবে বলে জানানো হয়েছে। তবে জীবিত অবস্থায় প্রিন্স ফিলিপ জানিয়েছিলেন, তার শেষকৃত্যু সাড়ম্বরপূর্ণ হোক তা তিনি চান না। ওয়েস্ট মিনিস্টার হলেও সমাধিস্থ হতে চান না বলে ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন প্রিন্স ফিলিপ। সেই মতো ফ্রগমোর কটেজের বাগানেই তাকে সমাধিস্থ করা হতে পারে বলে রাজ পরিবার সূত্রে খবর।
শ্রদ্ধা জানাচ্ছে ব্রিটিশরা
ডিউক অব এডিনবরার প্রতি শ্রদ্ধায় দেশের সর্বত্র জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখার সিদ্ধান্ত নেয় ব্রিটিশ সরকার। প্রাসাদ কর্তৃক মৃত্যুর ঘোষণার পরই বাকিংহাম প্রাসাদের কাছে মানুষের ভিড় বাড়তে থাকে। ছোট বাচ্চা থেকে শুরু করে বয়স্করাও প্রাসাদের গেটে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। এই গেটেই প্রিন্সের মৃত্যুর ঘোষণা টাঙানো রয়েছে। প্রিন্স ফিলিপের জীবনযাপন নিয়ে মানুষের মধ্যে ভিন্নমত থাকলেও তার মৃত্যুতে সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে চোখের পানি ঝরাচ্ছেন। প্রিন্স ফিলিপের মৃত্যু এমন সময় ঘটলো যখন করোনা ভাইরাসের কারণে ব্রিটেনসহ বিশ্ব বিপর্যস্ত। এছাড়া তার নাতি প্রিন্স হ্যারি এবং প্রিন্সেস মেগান মার্কেলের এক সাক্ষাৎকার রাজপরিবারকে সংকটের মধ্যে ফেলে দেয়। জানা গেছে, প্রিন্স হ্যারি ব্রিটেনের উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্র ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তবে মেগান মার্কেল ব্রিটেনে ফিরবেন কিনা তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শোক
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্রিটেনের রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের স্বামী প্রিন্স ফিলিপ, ডিউক অব এডিনবার্গের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন। শুক্রবার এক শোকবার্তায় প্রধানমন্ত্রী প্রিন্স ফিলিপের বিদেহি আত্মার শান্তি কামনা করেন এবং শোক-সন্তপ্ত রাজ-পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
অন্যান্য বিশ্ব নেতাদের শোক
প্রিন্স ফিলিপের মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। শোক বার্তায় তিনি বলেন, তিনি (ফিলিপ) অগণিত তরুণকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং ফার্স্ট লেডি জিল বাইডেন এক শোক বার্তায় বলেছেন, প্রিন্স ফিলিপ তার ৯৯ বছরের জীবনে অনেক পরিবর্তন দেখেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, কমনওয়েলথ এব বিশ্বের বিভিন্ন কর্মকালে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। প্রেসিডেন্ট বাইডেন তার শোকাহত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন। সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ডবিøউ বুশ তার বার্তায় বলেছেন, ডিউক অব এডিনবরা এক দীর্ঘ ও অনন্য জীবন যাপন করেছেন এবং নিজেকে তিনি নানা মহৎ কাজ ও অন্যদের জন্য উৎসর্গ করেছিলেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তার বার্তায় প্রিন্স ফিলিপ সামরিক বাহিনীতে এবং জনসেবামূলক কাজে যে অবদান রেখেছেন তার প্রশংসা করেন। কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো ডিউক অব এডিনবারাকে একজন মহান নিষ্ঠাবান ব্যক্তি হিসেবে বর্ণনা করেন। অস্ট্রেলাির প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন বলেন, তিনি এমন একটি প্রজন্মকে ধারণ করেছিলেন যা আমরা আর কখনোই দেখতে পাবো না। নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা আরডার্ন তার দেশের জনগণের পক্ষ থেকে রানি এলিজাবেথ ও রাজপরিবারের সবার প্রতি তার শোক ও সহমর্মিতা জানান।
লন্ডনে জার্মানীর রাষ্ট্রদূত প্রিন্স ফিলিপের প্রশংসা করে বলেন, তিনি এক ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে সহায়তা করেছেন। উল্লেখ্য, ইউরোপের বেশ কয়েকটি বর্তমান ও সাবেক রাজপরিবারের সাথে প্রিন্স ফিলিপের রক্তের সম্পর্ক আছে। প্রিন্স ফিলিপের মৃত্যুতে বেলজিয়ামের রাজা ফিলিপ শোক প্রকাশ করেছেন। নেদারল্যান্ডসের রাজা উইলেম-আলেক্সান্ডার এক বার্তায় বলেছেন, প্রিন্স ফিলিপ তার দীর্ঘ জীবন ব্রিটিশ জনগণের সেবার জন্য উৎসর্গ করেছিলেন, এবং তার প্রাণবন্ত ব্যক্তিত্বের ছাপ কখনো ভোলার নয়। সুইডেনের রাজা কার্ল গুস্তাফ বলেছেন, ডিউক অব এডিনবরা ছিলেন একজন অনুপ্রেরণা। সুইডিশ রাজপরিবারের দীর্ঘদিনের বন্ধু এবং এ সম্পর্ককে তারা অত্যন্ত মূল্যবান মনে করেন।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন রানি এলিজাবেথের কাছে এক টেলিগ্রাম বার্তা পাঠিয়েছেন। এতে তিনি বলেন, প্রিন্স ফিলিপ ছিলন একজন আন্তর্জাতিকভাবে সম্মানিত ব্যক্তি। ফ্রান্সের ইউরোপ বিষয়ক মন্ত্রী ক্লিমেন্ট ব্যোন প্রিন্স ফিলিপকে যুক্তরাজ্যের জন্য শতাব্দীকালের অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব বলেন বর্ণনা করেন। এয়াড়া আয়ারল্যান্ড, মাল্টা এবং ইসরাইলসহ বিভিন্ন দেশে সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান প্রিন্স ফিলিপের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন।
জন্ম ও লেখাপড়া
ডিউক অফ এডিনবারার জন্ম গ্রিসের রাজ পরিবারে ১৯২১ সালের ১০ জুন। গ্রিসের কর্ফু দ্বীপ যেখানে তার জন্ম, সেখানে তার জন্মসনদে অবশ্য তারিখ নথিভুক্ত আছে ২৮ মে ১৯২১। এর কারণ গ্রিস তখনও গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার গ্রহণ করেনি। তার পিতা ছিলেন গ্রিসের প্রিন্স অ্যান্ড্রুর আর মা ব্যাটেনবার্গের প্রিন্সেস অ্যালিস। বাবা মায়ের সন্তানদের মধ্যে তিনিই ছিলেন একমাত্র ছেলে। খুবই আদরে কেটেছে তার শিশুকাল। তার জন্মের এক বছর পর ১৯২২ সালে এক অভ্যুত্থানের পর বিপ্লবী এক আদালতের রায়ে প্রিন্স ফিলিপের পিতার পরিবারকে গ্রিসের ওই দ্বীপ থেকে নির্বাসনে পাঠানো হয়। তার কাজিন রাজা পঞ্চম জর্জ তাদের উদ্ধার করে আনতে একটি ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজ পাঠান, যে জাহাজে করে সেখান থেকে তাদের নিয়ে যাওয়া হয় ফ্রান্সে। ফ্রান্সে লেখাপড়া শুরু করার পর সাত বছর বয়সে তিনি ইংল্যান্ডে মাউন্টব্যাটেন পরিবারে তার আত্মীয়স্বজনদের কাছে চলে আসেন এবং এরপর তার স্কুল জীবন কাটে ইংল্যান্ডে। এ সময় তার মা মানসিক রোগে আক্রান্ত হলে তাকে মানসিক রোগের হাসপাতালে রাখা হয় এবং তখন কিশোর ফিলিপকে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হতো না। এরপর প্রিন্স ফিলিপ তার লেখাপড়া শেষ করেন জার্মানি ও স্কটল্যান্ডে। স্কটিশ একটি বোর্ডিং স্কুল গর্ডনস্টোনে তিনি লেখাপড়া করেন। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময় তিনি সামরিক বাহিনীতে ক্যারিয়ার গড়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং চাকরি নেন রয়্যাল নেভিতে।
সংক্ষিপ্ত কেরিয়ার
বিবাহিত জীবনের শুরুটা ছিল খুবই আনন্দঘন। এক সময় রয়্যাল নেভিতেও সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে তার কেরিয়ার, বিয়ের পর তার পোস্টিং হয় মাল্টায় কিন্তু এই জীবন খুব বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। তাদের প্রথম সন্তান প্রিন্স চার্লসের জন্ম হয় বাকিংহাম প্রাসাদে ১৯৪৮ সালে। তার দু’বছর পর ১৯৫০ সালে জন্ম হয় কন্যা প্রিন্সেস অ্যানের।
১৯৫০ সালে নৌবাহিনীতে তরুণ ফিলিপ তার কেরিয়ারের তুঙ্গে। এসময় রাজা ষষ্ঠ জর্জের স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটতে থাকায় তার কন্যাকে আরো বেশি করে রাজার দায়িত্ব কাঁধে নিতে হয়। ফিলিপের তখন স্ত্রী এলিজাবেথের পাশে থাকা প্রয়োজন হয়ে পড়ে। ১৯৫১ সালে জুলাইয়ে রয়্যাল নেভি ছেড়ে দেন প্রিন্স ফিলিপ। ক্ষোভ পুষে রাখার মানুষ ছিলেন না তিনি। তবে পরবর্তী জীবনে তাকে বলতে শোনা গিয়েছিল নেভিতে তার কেরিয়ার আরো এগিয়ে নেওয়ার সুযোগ না পাওয়া তাকে দু:খ দিয়েছিল। ১৯৫২ সালে রাজ দম্পতি কমনওয়েলথ সফরে যান। ওই সফরে প্রথমে যাওয়ার কথা ছিল রাজা এবং রানির। ওই সফরে ফেব্রæয়ারীতে তারা যখন কেনিয়ায় শিকারীদের একটি বাসস্থানে ছিলেন, তখন খবর আসে হূদরোগে আক্রান্ত হয়ে রাজা ষষ্ঠ জর্জ মারা গেছেন। মৃত্যুর খবর ফিলিপই পৌঁছে দেন এলিজাবেথের কাছে।
প্রিন্স ফিলিপের একজন বন্ধু পরে বলেছিলেন, এই খবর শুনে ফিলিপের মনে হয়েছিল ‘তার মাথায় অর্ধেক পৃথিবী ভেঙে পড়েছে’। রানির অভিষেকের সময় রাজ পরিবার থেকে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয় যে রানির পর সব কিছুতেই সবার আগে থাকবে ফিলিপের স্থান, কিন্তু সংবিধানে তার কোনো স্থান থাকবে না। রাজ পরিবারকে আধুনিক করে তোলার এবং জাঁকজমক সংকুচিত করার অনেক চিন্তাভাবনা ছিল ডিউকের, কিন্তু প্রাসাদের নিয়মনীতির রক্ষক যারা ছিলেন, তাদের অব্যাহত বিরোধিতায় তিনি ক্রমশ উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন।
শেষ জীবন
২০১১ সালের জুনে নব্বইতম জন্মদিনের সময় প্রিন্স ফিলিপ খুব খোলামেলাভাবেই তার বয়স বেড়ে যাওয়ার বাস্তবতার কথা স্বীকার করেছিলেন। বিবিসিকে তিনি বলেন যে, তিনি তার কাজের চাপ কমিয়ে আনছেন। ‘আমি মনে করি আমার কাজটা আমি করেছি। এখন নিজের জীবন কিছুটা উপভোগ করতে চাই। কম দায়দায়িত্ব, কম দৌড়াদৌড়ি, তারপর কী বলতে হবে সেটা নিয়েও কম ভাবতে হবে। তার ওপরে স্মৃতিশক্তি তো দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। অনেক কিছুই আমি মনে করতে পারি না। আমিতো অনেকটাই নিজেকে গুটিয়ে আনছি।’
প্রিন্স ফিলিপ শারীরিক অসুস্থতার কারণে লন্ডনের কিং এডওয়ার্ড হাসাপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন ১৬ ফেব্রæয়ারী। পরে লন্ডনের সেন্ট বার্থলোমিউ হাসপাতালে তার পুরনো হৃদযন্ত্রের সমস্যার কারণে তার সফল অস্ত্রোপচারও হয়েছিল। প্রায় এক মাস চিকিৎসার পর তিনি উইন্ডসর কাসেলে ফিরে যান। সেখানেই শুক্রবার তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। (দৈনিক ইত্তেফাক)

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

প্রিন্স ফিলিপের জীবনাবসান

প্রকাশের সময় : ০৪:২৪:৫৯ অপরাহ্ন, রবিবার, ১১ এপ্রিল ২০২১

হককথা ডেস্ক: প্রিন্স ফিলিপ, ব্রিটেনের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের স্বামী মারা গেছেন। প্রায় এক মাস আগে হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা শেষে গত মাসেই বাড়ি ফিরেছিলেন প্রিন্স ফিলিপ। ফেরার সময় গাড়িতে বসে হাসিমুখে হাত নেড়েছিলেন ক্যামেরার দিকে। শুক্রবার (৯ এপ্রিল) সকালে উইন্ডসর প্রাসাদে সেই হাসিমুখের মানুষটির জীবনাবসান ঘটে। ছেলে প্রিন্স চার্লসের ১৬তম বিবাহ বার্ষিকীর দিনেই তিনি না ফেরার দেশে চলে গেলেন। তার মৃত্যুর মাধ্যমে স্ত্রী রানি এলিজাবেথের সঙ্গে ৭৩ বছরের দাম্পত্যের ইতি ঘটলো। তাকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে বাকিংহাম প্রাসাদের কাছে মানুষের ভিড় বাড়ছে। তার মৃত্যুতে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ বিশ্বের নেতারা গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। খবর বিবিসি ও ডেইলি মেইলের।
শুক্রবার বাকিংহাম প্রাসাদ এক ঘোষণায় জানায়, রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের স্বামী প্রিন্স ফিলিপ ৯৯ বছরে মারা গেছেন। প্রাসাদ থেকে দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়েছে, মহামান্য রানি খুবই দুঃখের সাথে তার প্রিয় স্বামী প্রিন্স ফিলিপ, ডিউক অব এডিনবরার মৃত্যু ঘোষণা করেছেন। ডিউক উইন্ডসর ক্যাসেলে শান্তিপূর্ণভাবে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেছেন। রাজ পরিবারের অন্য সদস্যদেরও প্রিন্সের মৃত্যুর কথা জানানো হয়েছে। তার শেষকৃত্য সম্পর্কে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু ঘোষণা হয়নি। সময় মতো সব কিছু প্রকাশ্যে আনা হবে বলে জানানো হয়েছে। তবে জীবিত অবস্থায় প্রিন্স ফিলিপ জানিয়েছিলেন, তার শেষকৃত্যু সাড়ম্বরপূর্ণ হোক তা তিনি চান না। ওয়েস্ট মিনিস্টার হলেও সমাধিস্থ হতে চান না বলে ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন প্রিন্স ফিলিপ। সেই মতো ফ্রগমোর কটেজের বাগানেই তাকে সমাধিস্থ করা হতে পারে বলে রাজ পরিবার সূত্রে খবর।
শ্রদ্ধা জানাচ্ছে ব্রিটিশরা
ডিউক অব এডিনবরার প্রতি শ্রদ্ধায় দেশের সর্বত্র জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখার সিদ্ধান্ত নেয় ব্রিটিশ সরকার। প্রাসাদ কর্তৃক মৃত্যুর ঘোষণার পরই বাকিংহাম প্রাসাদের কাছে মানুষের ভিড় বাড়তে থাকে। ছোট বাচ্চা থেকে শুরু করে বয়স্করাও প্রাসাদের গেটে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। এই গেটেই প্রিন্সের মৃত্যুর ঘোষণা টাঙানো রয়েছে। প্রিন্স ফিলিপের জীবনযাপন নিয়ে মানুষের মধ্যে ভিন্নমত থাকলেও তার মৃত্যুতে সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে চোখের পানি ঝরাচ্ছেন। প্রিন্স ফিলিপের মৃত্যু এমন সময় ঘটলো যখন করোনা ভাইরাসের কারণে ব্রিটেনসহ বিশ্ব বিপর্যস্ত। এছাড়া তার নাতি প্রিন্স হ্যারি এবং প্রিন্সেস মেগান মার্কেলের এক সাক্ষাৎকার রাজপরিবারকে সংকটের মধ্যে ফেলে দেয়। জানা গেছে, প্রিন্স হ্যারি ব্রিটেনের উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্র ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তবে মেগান মার্কেল ব্রিটেনে ফিরবেন কিনা তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শোক
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্রিটেনের রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের স্বামী প্রিন্স ফিলিপ, ডিউক অব এডিনবার্গের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন। শুক্রবার এক শোকবার্তায় প্রধানমন্ত্রী প্রিন্স ফিলিপের বিদেহি আত্মার শান্তি কামনা করেন এবং শোক-সন্তপ্ত রাজ-পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
অন্যান্য বিশ্ব নেতাদের শোক
প্রিন্স ফিলিপের মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। শোক বার্তায় তিনি বলেন, তিনি (ফিলিপ) অগণিত তরুণকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং ফার্স্ট লেডি জিল বাইডেন এক শোক বার্তায় বলেছেন, প্রিন্স ফিলিপ তার ৯৯ বছরের জীবনে অনেক পরিবর্তন দেখেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, কমনওয়েলথ এব বিশ্বের বিভিন্ন কর্মকালে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। প্রেসিডেন্ট বাইডেন তার শোকাহত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন। সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ডবিøউ বুশ তার বার্তায় বলেছেন, ডিউক অব এডিনবরা এক দীর্ঘ ও অনন্য জীবন যাপন করেছেন এবং নিজেকে তিনি নানা মহৎ কাজ ও অন্যদের জন্য উৎসর্গ করেছিলেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তার বার্তায় প্রিন্স ফিলিপ সামরিক বাহিনীতে এবং জনসেবামূলক কাজে যে অবদান রেখেছেন তার প্রশংসা করেন। কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো ডিউক অব এডিনবারাকে একজন মহান নিষ্ঠাবান ব্যক্তি হিসেবে বর্ণনা করেন। অস্ট্রেলাির প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন বলেন, তিনি এমন একটি প্রজন্মকে ধারণ করেছিলেন যা আমরা আর কখনোই দেখতে পাবো না। নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা আরডার্ন তার দেশের জনগণের পক্ষ থেকে রানি এলিজাবেথ ও রাজপরিবারের সবার প্রতি তার শোক ও সহমর্মিতা জানান।
লন্ডনে জার্মানীর রাষ্ট্রদূত প্রিন্স ফিলিপের প্রশংসা করে বলেন, তিনি এক ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে সহায়তা করেছেন। উল্লেখ্য, ইউরোপের বেশ কয়েকটি বর্তমান ও সাবেক রাজপরিবারের সাথে প্রিন্স ফিলিপের রক্তের সম্পর্ক আছে। প্রিন্স ফিলিপের মৃত্যুতে বেলজিয়ামের রাজা ফিলিপ শোক প্রকাশ করেছেন। নেদারল্যান্ডসের রাজা উইলেম-আলেক্সান্ডার এক বার্তায় বলেছেন, প্রিন্স ফিলিপ তার দীর্ঘ জীবন ব্রিটিশ জনগণের সেবার জন্য উৎসর্গ করেছিলেন, এবং তার প্রাণবন্ত ব্যক্তিত্বের ছাপ কখনো ভোলার নয়। সুইডেনের রাজা কার্ল গুস্তাফ বলেছেন, ডিউক অব এডিনবরা ছিলেন একজন অনুপ্রেরণা। সুইডিশ রাজপরিবারের দীর্ঘদিনের বন্ধু এবং এ সম্পর্ককে তারা অত্যন্ত মূল্যবান মনে করেন।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন রানি এলিজাবেথের কাছে এক টেলিগ্রাম বার্তা পাঠিয়েছেন। এতে তিনি বলেন, প্রিন্স ফিলিপ ছিলন একজন আন্তর্জাতিকভাবে সম্মানিত ব্যক্তি। ফ্রান্সের ইউরোপ বিষয়ক মন্ত্রী ক্লিমেন্ট ব্যোন প্রিন্স ফিলিপকে যুক্তরাজ্যের জন্য শতাব্দীকালের অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব বলেন বর্ণনা করেন। এয়াড়া আয়ারল্যান্ড, মাল্টা এবং ইসরাইলসহ বিভিন্ন দেশে সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান প্রিন্স ফিলিপের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন।
জন্ম ও লেখাপড়া
ডিউক অফ এডিনবারার জন্ম গ্রিসের রাজ পরিবারে ১৯২১ সালের ১০ জুন। গ্রিসের কর্ফু দ্বীপ যেখানে তার জন্ম, সেখানে তার জন্মসনদে অবশ্য তারিখ নথিভুক্ত আছে ২৮ মে ১৯২১। এর কারণ গ্রিস তখনও গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার গ্রহণ করেনি। তার পিতা ছিলেন গ্রিসের প্রিন্স অ্যান্ড্রুর আর মা ব্যাটেনবার্গের প্রিন্সেস অ্যালিস। বাবা মায়ের সন্তানদের মধ্যে তিনিই ছিলেন একমাত্র ছেলে। খুবই আদরে কেটেছে তার শিশুকাল। তার জন্মের এক বছর পর ১৯২২ সালে এক অভ্যুত্থানের পর বিপ্লবী এক আদালতের রায়ে প্রিন্স ফিলিপের পিতার পরিবারকে গ্রিসের ওই দ্বীপ থেকে নির্বাসনে পাঠানো হয়। তার কাজিন রাজা পঞ্চম জর্জ তাদের উদ্ধার করে আনতে একটি ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজ পাঠান, যে জাহাজে করে সেখান থেকে তাদের নিয়ে যাওয়া হয় ফ্রান্সে। ফ্রান্সে লেখাপড়া শুরু করার পর সাত বছর বয়সে তিনি ইংল্যান্ডে মাউন্টব্যাটেন পরিবারে তার আত্মীয়স্বজনদের কাছে চলে আসেন এবং এরপর তার স্কুল জীবন কাটে ইংল্যান্ডে। এ সময় তার মা মানসিক রোগে আক্রান্ত হলে তাকে মানসিক রোগের হাসপাতালে রাখা হয় এবং তখন কিশোর ফিলিপকে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হতো না। এরপর প্রিন্স ফিলিপ তার লেখাপড়া শেষ করেন জার্মানি ও স্কটল্যান্ডে। স্কটিশ একটি বোর্ডিং স্কুল গর্ডনস্টোনে তিনি লেখাপড়া করেন। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময় তিনি সামরিক বাহিনীতে ক্যারিয়ার গড়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং চাকরি নেন রয়্যাল নেভিতে।
সংক্ষিপ্ত কেরিয়ার
বিবাহিত জীবনের শুরুটা ছিল খুবই আনন্দঘন। এক সময় রয়্যাল নেভিতেও সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে তার কেরিয়ার, বিয়ের পর তার পোস্টিং হয় মাল্টায় কিন্তু এই জীবন খুব বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। তাদের প্রথম সন্তান প্রিন্স চার্লসের জন্ম হয় বাকিংহাম প্রাসাদে ১৯৪৮ সালে। তার দু’বছর পর ১৯৫০ সালে জন্ম হয় কন্যা প্রিন্সেস অ্যানের।
১৯৫০ সালে নৌবাহিনীতে তরুণ ফিলিপ তার কেরিয়ারের তুঙ্গে। এসময় রাজা ষষ্ঠ জর্জের স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটতে থাকায় তার কন্যাকে আরো বেশি করে রাজার দায়িত্ব কাঁধে নিতে হয়। ফিলিপের তখন স্ত্রী এলিজাবেথের পাশে থাকা প্রয়োজন হয়ে পড়ে। ১৯৫১ সালে জুলাইয়ে রয়্যাল নেভি ছেড়ে দেন প্রিন্স ফিলিপ। ক্ষোভ পুষে রাখার মানুষ ছিলেন না তিনি। তবে পরবর্তী জীবনে তাকে বলতে শোনা গিয়েছিল নেভিতে তার কেরিয়ার আরো এগিয়ে নেওয়ার সুযোগ না পাওয়া তাকে দু:খ দিয়েছিল। ১৯৫২ সালে রাজ দম্পতি কমনওয়েলথ সফরে যান। ওই সফরে প্রথমে যাওয়ার কথা ছিল রাজা এবং রানির। ওই সফরে ফেব্রæয়ারীতে তারা যখন কেনিয়ায় শিকারীদের একটি বাসস্থানে ছিলেন, তখন খবর আসে হূদরোগে আক্রান্ত হয়ে রাজা ষষ্ঠ জর্জ মারা গেছেন। মৃত্যুর খবর ফিলিপই পৌঁছে দেন এলিজাবেথের কাছে।
প্রিন্স ফিলিপের একজন বন্ধু পরে বলেছিলেন, এই খবর শুনে ফিলিপের মনে হয়েছিল ‘তার মাথায় অর্ধেক পৃথিবী ভেঙে পড়েছে’। রানির অভিষেকের সময় রাজ পরিবার থেকে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয় যে রানির পর সব কিছুতেই সবার আগে থাকবে ফিলিপের স্থান, কিন্তু সংবিধানে তার কোনো স্থান থাকবে না। রাজ পরিবারকে আধুনিক করে তোলার এবং জাঁকজমক সংকুচিত করার অনেক চিন্তাভাবনা ছিল ডিউকের, কিন্তু প্রাসাদের নিয়মনীতির রক্ষক যারা ছিলেন, তাদের অব্যাহত বিরোধিতায় তিনি ক্রমশ উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন।
শেষ জীবন
২০১১ সালের জুনে নব্বইতম জন্মদিনের সময় প্রিন্স ফিলিপ খুব খোলামেলাভাবেই তার বয়স বেড়ে যাওয়ার বাস্তবতার কথা স্বীকার করেছিলেন। বিবিসিকে তিনি বলেন যে, তিনি তার কাজের চাপ কমিয়ে আনছেন। ‘আমি মনে করি আমার কাজটা আমি করেছি। এখন নিজের জীবন কিছুটা উপভোগ করতে চাই। কম দায়দায়িত্ব, কম দৌড়াদৌড়ি, তারপর কী বলতে হবে সেটা নিয়েও কম ভাবতে হবে। তার ওপরে স্মৃতিশক্তি তো দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। অনেক কিছুই আমি মনে করতে পারি না। আমিতো অনেকটাই নিজেকে গুটিয়ে আনছি।’
প্রিন্স ফিলিপ শারীরিক অসুস্থতার কারণে লন্ডনের কিং এডওয়ার্ড হাসাপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন ১৬ ফেব্রæয়ারী। পরে লন্ডনের সেন্ট বার্থলোমিউ হাসপাতালে তার পুরনো হৃদযন্ত্রের সমস্যার কারণে তার সফল অস্ত্রোপচারও হয়েছিল। প্রায় এক মাস চিকিৎসার পর তিনি উইন্ডসর কাসেলে ফিরে যান। সেখানেই শুক্রবার তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। (দৈনিক ইত্তেফাক)