পাকিস্তানে সেনা স্থাপনায় হামলা কার শেষের শুরু?

- প্রকাশের সময় : ১১:২৬:১৫ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৪ মে ২০২৩
- / ১১০ বার পঠিত
আন্তর্জাতিক ডেস্ক : জন্ম থেকেই রাজনৈতিক সংকটে জর্জরিত পাকিস্তান। দেশটির প্রভাবশালী গণমাধ্যম ডনের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, মামলা, বিচার ও গ্রেফতারের ঘটনা রাজনীতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং রাজনীতিকদের এটাই যেন নিয়তি। ক্রিকেটার থেকে রাজনীতিক বনে যাওয়া ইমরান খানও ব্যতিক্রম নন। এর আগে অন্য প্রধানমন্ত্রীদেরও এমন কঠিন পরীক্ষা দিতে হয়েছে। সাহসিকতার সঙ্গে তারা উতরে গেছেন। তবে ইমরান খানের ক্ষেত্রে একেবারেই ব্যতিক্রম মনে হচ্ছে। এর আগে অন্য কোনো প্রধানমন্ত্রী দেশটির ক্ষমতাধর সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে এভাবে প্রকাশ্যে রাখঢাক ছাড়াই অভিযোগ এবং সমালোচনা করেননি। ফলে তিনি দেশের অর্থনীতিরও বড় খেলোয়াড় সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে গিয়ে কতদূর যেতে পারবেন তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
ইমরান খানের লড়াই, টিকে থাকা কঠিন
পাকিস্তানে একটি অপ্রচলিত প্রবাদ আছে, কেউ যদি দেশটির রাজনীতিতে উন্নতি করতে চান তাহলে তাকে থ্রি ‘এ’-এর সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হবে—‘আমেরিকা, আর্মি এবং আল্লাহ’। ২০১৮ সালের নির্বাচনে জিতে যখন ইমরান খান ক্ষমতায় আসেন তখন মনে করা হয়েছিল যে, ইমরান খান এই তিনটিরই আশীর্বাদপুষ্ট। এরপর গত বছর যখন পার্লামেন্টে অনাস্থা ভোটে ক্ষমতাচ্যুত হন, তখন মনে করা হয়, ইমরান খান প্রথম দুটির আশীর্বাদ হারিয়েছেন। আর ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তিনি সরাসরি এজন্য আমেরিকা এবং সেনাবাহিনীকেই একের পর এক দায়ী করে আসছিলেন।
গত মঙ্গলবার ইমরান খানকে ইসলামাবাদ হাইকোর্ট চত্বর থেকে গ্রেফতার করা হয়। বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্ট ইমরান খানের গ্রেফতারকে বেআইনি আখ্যা দিয়ে দ্রুত মুক্তির নির্দেশ দেয় এবং ঐ রাত সুপ্রিম কোর্টের হেফাজতে রাখে। শুক্রবার ইমরান খানকে গ্রেফতার হওয়া আলকাদির ট্রাস্ট মামলায় দুই সপ্তাহের জামিন দেয় হাইকোর্ট। হাইকোর্টে থাকা অবস্থায়ই বাইরে গুলি এবং ১১ ঘণ্টার নানা নাটকীয়তার পর লাহোরে নিজ বাসভবন জামান পার্কে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। ‘মুক্ত’ হয়ে ইমরান খান জাতির উদ্দেশে যে ভাষণ দেন তার তাৎপর্যটা কেবল পাকিস্তানের জন্যই নয়, বাংলাদেশের জন্যও বটে। তিনি বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে অত্যাচার করেও ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে পারেনি তৎকালীন সামরিক সরকার। শেষ পর্যন্ত সেখানে পতন হয় এবং ৯৩ হাজার সৈন্য আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। এখনো পাকিস্তানে সেই ধারাবাহিকতা চলছে। পাকিস্তানিরা এতদিন পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) অত্যচার আর নির্যাতনের কথা অস্বীকার করে আসছে। অথচ দেশটির এক প্রধানমন্ত্রীই স্বাধীনতার ৫২ বছর পর সেটা স্বীকার করে নিলেন। অথচ একদিন আগে প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ তার বক্তব্যে ঢাকার পতন এবং এ সময়ও এমন সহিংসতা হয়নি বলে উল্লেখ করেন। ইসলামাবাদের পতনকে তিনি ঢাকার পতন বলে আখ্যায়িত করেন। এমনকি একজন প্রধানমন্ত্রী হয়ে সালটাও তিনি ঠিকভাবে বলেননি। ১৯৭১ না বলে ১৯৭৩ সালের কথা উল্লেখ করেন।
ইমরান খানকে গ্রেফতারের পর যে ধরনের সহিংসতা হয়েছে তা দেশটির ইতিহাসে কখনো ঘটেনি। সেনাবাহিনীর সদরদপ্তরে পর্যন্ত হামলা চালিয়েছে একদল নাগরিক। এমনকি সেনাবাহিনীর কর্পস কমান্ডারের বাসভবনেও হামলা চালিয়েছে একদল। যদিও অনেক বিশ্লেষকের ধারণা, এই হামলা যে পিটিআই করেছে তা নিশ্চিত করে বলা যাবে না। কারণ সেখানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা দেখে এটা ধারণা করা যেতে পারে যে, হামলার সুযোগটাই করে দেওয়া হয়েছে। সামরিক আইন জারি করে ক্ষমতা গ্রহণের জন্যই হয়তো সেনাবাহিনীর মতো একটা সুশৃঙ্খল বাহিনীর দপ্তরে এভাবে হামলা চালানোর সুযোগ দেওয়া হয়েছে। কারণ যে দেশটিতে নাগরিকরা সবসময় সেনাবাহিনীকে ক্ষমতায় স্বাগত জানিয়েছে এমনকি প্রশাসন ও অর্থনীতিতে সেনাবাহিনীর প্রচুর ক্ষমতা রয়েছে, সেখানে এ ধরনের হামলা কল্পনারও অতীত ছিল। ১৯৯৯ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোকে সমাবেশে হত্যার পরও এমন সহিংস বিক্ষোভ দেখেনি পাকিস্তান।
আরোও পড়ুন। এবার ইমরান খানের দলের মহাসচিব গ্রেপ্তার
পাকিস্তানে প্রধানমন্ত্রী কিংবা রাজনীতিকদের গ্রেফতারের ঘটনা এটাই প্রথম নয়। এর আগে জুলফিকার আলী ভুট্টো, তার মেয়ে বেনজির ভুট্টো, জামাতা আসিফ আলি জারদারি, নওয়াজ শরিফ ও তার ভাই শাহবাজ শরিফসহ মোটামুটি সবাই নানা মামলায় গ্রেফতার হয়েছেন। তারা তখনই গ্রেফতার হয়েছেন যখন তারা সেনাবাহিনীর সঙ্গে কঠিন করে খেলতে গেছেন। অর্থাৎ সেনাবাহিনীর আশীর্বাদই পাকিস্তানে ক্ষমতায় যাওয়ার প্রধান উৎস।
মনে হতে পারে যে, গত বৃহস্পতিবার ইমরান খানকে সুপ্রিম কোর্ট স্বস্তি দিয়েছে এবং তিনি মুক্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন। কিন্তু সেই ধারণা ভুল। কারণ তার মাথার ওপর ১২১টি মামলা ঝুলছে। সন্ত্রাসবাদ ও ধর্ম অবমাননা থেকে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই মামলায় জড়ানো হয়েছে তাকে। তিনি হয়তো একটি মামলায় সাময়িক স্বস্তি পেয়েছেন। সুপ্রিম কোর্ট তার সঙ্গে ছিল বলেই এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। সেনাবাহিনী এবং ডিপ স্টেটের সঙ্গে সম্পর্ক না থাকলে তিনি অন্যসব মামলায় স্বস্তি পাবেন এমন নিশ্চয়তা নেই।
ভারতের গণমাধ্যম ফার্স্টপোস্ট এবং নিউজ১৮-এর মতামত বিষয়ক সম্পাদক উৎপল কুমারের মতে, সেনাবাহিনী যদি একবার লক্ষ্মণরেখা ইমরান খানের জন্য এঁকে দেয়, তাহলে তিনি সঙ্গে খুব কম প্রভাবশালীকেই পাবেন। এমনকি বিচার বিভাগও তার কাছ থেকে দূরে সরে যেতে পারে। কারণ সেনা স্থাপনায় হামলার জন্য দায়ী করা হচ্ছে ইমরান খানের দলের কর্মীদেরই। হামলার আগে পর্যন্ত সেনাবাহিনীর একটা গ্রুপের সহানুভূতি ছিল ইমরান খানের প্রতি। কিন্তু এই ধরনের হামলার পর সেনাবাহিনীর সবাই যে ঐক্যবদ্ধ হতে পারেন সেটা ধারণা করা যায়। যদিও সেনাবাহিনীতে বিভেদ সৃষ্টি হয়েছে বলেই জানা গেছে। এমনকি পদত্যাগের ঘটনাও ঘটছে। তবে সেনাবাহিনী সেটা অস্বীকার করেছে। সেনাবাহিনীতে বিভক্তির বড় কারণ, বর্তমান সেনাপ্রধান জেনারেল অসিম মুনিরের ২০২২ সালের ২৭ নভেম্বর অবসরে যাওয়ার কথা ছিল যা তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়ার অবসরের দুই দিন আগে। ফলে বিভক্তি দূর করতেই সেনা স্থাপনায় হামলা চালানো হতে পারে বলে ধারণা করা হয়। ইমরান সমর্থকরা হয়তো সেই ফাঁদে পা দিয়েছেন। সন্দেহের আরো কারণ আছে, লাহোরের কর্পস কমান্ডার এক সপ্তাহ আগেই তার বাসভবন ছেড়েছেন। উৎপল কুমারের মতে, ইমরান খানের সমর্থকরা হয়তো মনে করছেন যে, তারা সেনা সদরদপ্তরে এবং কর্পস কমান্ডারের বাসভবনে হামলা চালিয়ে বীরত্ব দেখিয়েছেন এবং সেনাবাহিনীকে পিছু হটতে বাধ্য করেছেন, তাহলে ভুল হবে। এর মাধ্যমে হয়তো রাজনীতিতে ইমরান খানের শেষ শয্যাও হতে পারে।
সম্পাদক উৎপল কুমার বলছেন, যারা পাকিস্তানের রাজনীতি এবং সেনাবাহিনী সম্পর্কে জানেন না তারা হয়তো বলবেন যে, সেনাবাহিনী ব্যারাকে ফিরে যাবে। আর ইমরান খানের নেতৃত্বে রাজনীতিকরা সব গুলি চালাবেন। মূলত পাকিস্তান রাষ্ট্রটির জন্ম হয়েছে ইসলামের নাম করে। ভারতবিরোধিতাই তাদের মূল লক্ষ্য। তার শিক্ষা-দীক্ষা থেকে শুরু করে সবই ভারত বিরোধিতার মধ্যে সীমাবদ্ধ। দেশটিতে এসব আদর্শকে টিকিয়ে রাখাই সেনাবাহিনীর মূল লক্ষ্য। এমনকি ইমরান খানও তার ‘পাকিস্তান : অ্যা পারসোনাল হিস্টোরি’ বইয়ে লিখেছেন—আমি বিস্মিত হই যে, পাকিস্তানে যারা ইসলামি মূল্যবোধের পক্ষে দাঁড়ায় তাদেরকে ডানপন্থি বা মৌলবাদী বলে আখ্যা দেওয়া হয়। অথচ ইসলামি মূল্যবোধ তো অনেকটা বামপন্থার মতো সমাজে সমতা আনতে সহায়তা করে এবং মানুষের মঙ্গল বয়ে আনে।
সেনাবাহিনী বর্তমান পরিস্থিতিতেও কেন ক্ষমতা নিচ্ছে না তা নিয়ে হয়তো প্রশ্ন উঠতে পারে। মূল কারণ দেশটির ভঙ্গুর অর্থনীতি। এই পর্যায়ে ক্ষমতায় এসে সেনাবাহিনী তার হাত পোড়াতে চায় না। সবকিছু ম্যানেজ করা সম্ভব হলেও অর্থনীতিকে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় ফিরিয়ে আনা সামরিক বাহিনীর পক্ষে সম্ভব হবে না। আবার এটাও ঠিক যে, ক্রিকেটার হয়েও ইমরান খান কিছুটা হলেও সেনাবাহিনীকে কর্নারে ঠেলে দিয়েছেন। শাহবাজ শরিফকে হয়তো অর্থনীতিই বাঁচিয়ে দিয়েছে। ইমরান খানকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলি ভুট্টোর কথা স্মরণ করতে হবে। বিরোধিতার মাধ্যমে তাকে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলতে হয়েছিল। পাকিস্তানে যারা ইতিহাসকে বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন তারাই জেলে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন। তবে ইমরান খান যদি লড়াইয়ে টিকে যান তাহলে হয়তো দেশটিতে গণতন্ত্রের আকাশটাই উজ্জ্বল হবে। সেক্ষেত্রে হয়তো সামরিক বাহিনীর প্রভাবের অবসান হবে এবং রাজনীতিকদের ক্ষমতা চালানোর স্বাধীন পথটা প্রসারিত হবে। ইমরান খান যদি টিকে থাকেন তাহলে প্রশ্ন উঠবে তার সঙ্গে জনগণ, নাকি বিদেশি কোনো শক্তি আছে। সূত্র : দৈনিক ইত্তেফাক
সুমি/হককথা