নতুন প্রধানমন্ত্রীর অধীনে কেমন হবে ব্রিটেনের নীতি
- প্রকাশের সময় : ০৯:৩৭:৩৯ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২২
- / ৪৯ বার পঠিত
আন্তর্জাতিক ডেস্ক : লিজ ট্রাসকে নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পেল ব্রিটেন। বরিস জনসন তার প্রধানমন্ত্রিত্ব ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই ট্রাস তার দায়িত্ব নেন। গুরুত্বপূর্ণ পশ্চিমা আদর্শিক রাষ্ট্রের সরকারপ্রধান হিসেবে ট্রাসের নীতি কেমন হবে তা নিয়ে অনেক আলোচনা চলছে।
তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটের বাড়িতে এক সংবাদ সম্মেলনে তার সরকারের প্রাথমিক তিনটা লক্ষ্যের কথা উল্লেখ করেন। প্রথমত তিনি ব্রিটিশ সরকারকে আবারও কার্যকর করবেন। দ্বিতীয়ত তিনি জ্বালানি সংকটের মোকাবিলা করবেন এবং তৃতীয়ত তিনি নিশ্চিত করবেন যাতে জনগণ সরকারের স্বাস্থ্য সেবা সুষ্ঠুভাবে পায়।
লিজ ট্রাস ইতোমধ্যেই ঘোষণা দিয়েছেন, তিনি ব্রিটেনের সামরিক বাজেট বর্তমানে জিডিপির ২ দশমিক ১ শতাংশ থেকে ২০৩০ সালের মাঝে ৩ শতাংশে উন্নীত করতে চান। ব্রিটিশ থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের (রুসি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এর অর্থ হলো সামরিক বাজেটে প্রায় ৬০ শতাংশ বৃদ্ধি। অর্থাৎ সামরিক খাতে ব্যয়ের জন্যে ব্রিটিশ সরকারকে আগামী ৮ বছরে অতিরিক্ত প্রায় ১৮০ বিলিয়ন ডলার জোগাড় করতে হবে। এই বাজেট বৃদ্ধির অর্থ হতে পারে সামরিক সদস্যদের সংখ্যা বর্তমান এক লাখ ৪৮ হাজার থেকে বাড়িয়ে ২০৩০ সালের মধ্যে এক লাখ ৯০ হাজারে উন্নীত করা।
এই বাজেটের সংকুলান করতে গিয়ে আয়কর ৫ শতাংশ বৃদ্ধি করতে হবে অথবা মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট বর্তমান ২০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৫ শতাংশে উন্নীত করতে হবে। আর সেটা সম্ভব না হলে সরকারি বাজেটের অন্যান্য খাতে খরচ কমাতে হবে; যার মধ্যে বিভিন্ন সরকারি সেবা ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন খরচ থাকতে পারে। সামরিক বাজেট বৃদ্ধিতে লিজ ট্রাসকে নিঃসন্দেহেই জনগণকে মোকাবিলা করতে হবে; যা খুব একটা সহজ হবে না। সামরিক বাজেট বৃদ্ধি করতে হলে আগামী ৮ বছরের মাঝে অন্যান্য বড় সরকারি খাতে খরচ কমাতে হবে; যেমন- স্বাস্থ্য ও সামাজিক সেবা, শিক্ষা, আইনশৃঙ্খলা, ব্যবসা, জ্বালানি ও পরিবহন।
ব্রিটিশ থিঙ্কট্যাঙ্ক চ্যাটহ্যাম হাউসের অ্যাসোসিয়েট ফেলো কুয়েন্টিন পিল ডয়েচে ভেলেকে বলেন, ট্রাস তার নির্বাচনের আগে বলেছেন, তিনি কর কমাবেন ও ভর্তুকি বাদ দেবেন। অথচ জ্বালানির মূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে হলে তাকে বিশাল ভর্তুকি দিতেই হবে। একই সঙ্গে সামরিক বাজেট বৃদ্ধি ও স্বাস্থ্য খাতে সেবা নিশ্চিত করতে ট্রাসকে সরকারের খরচ যথেষ্টই বাড়াতে হবে। তবে ট্রাসের সামনে আরেকটা বড় চ্যালেঞ্জ হলো কনজারভেটিভ পার্টিকে একত্রে রাখা। কারণ ঋষি সুনাকের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের হাড্ডাহাড্ডি প্রতিযোগিতা অনেক ক্ষেত্রেই দলকে বিভক্ত করেছে। আর নির্বাচনেও ট্রাস কনজারভেটিভ পার্টির অর্ধেক সদস্যের ভোটই জোগাড় করতে পারেননি এবং যারা পার্লামেন্টের সদস্য, তাদের সমর্থনও তিনি খুব একটা পাননি। তবে গত নির্বাচনে বরিস জনসন পার্লামেন্টে যে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছেন, সেটার উপরে ভর করেই তাকে এগোতে হবে। অপরদিকে জনসনের তুলনায় আশেপাশের মানুষকে প্রভাবিত করার মতো ক্ষমতা ট্রাসের অপেক্ষাকৃতভাবে কম।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, ট্রাস সামরিক বাজেট যতটা বাড়াতে চাইছেন, শান্তিকালীন সময়ে তেমন উদাহরণ খুব কমই রয়েছে। ১৯৩৪ থেকে ১৯৩৮ সালের মাঝে জার্মানির চাপে সামরিক বাজেট জিডিপির আড়াই শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৬ শতাংশ করা হয়। আর ১৯৫০ থেকে ১৯৫২ সালের মাঝে সোভিয়েত ইউনিয়নের চাপে সামরিক বাজেট জিডিপির ৬ দশমিক ৬ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৯ দশমিক ৬ শতাংশ করা হয়েছিল। তবে ১৯৫০-এর দশকের পর থেকে ব্রিটেন সামরিক বাজেট কমিয়ে স্বাস্থ্য ও পেনশন খাতে খরচ বৃদ্ধি করতে পেরেছিল।
রুসির বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে, গত সাত দশকে ‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতা না থাকায় ব্রিটেন তার সামরিক বাজেট কমিয়ে রাখতে পেরেছিল। ১৯৯১ সালের পর থেকে ন্যাটো দেশগুলো, এমনকি চীন ও রাশিয়াও সামরিক বাজেট কর্তন করে। কিন্তু গ্রেট পাওয়ার প্রতিযোগিতা ও উচ্চ মূল্যস্ফীতির বাস্তবতায় এখন হয়তো বাজেটের প্রধান খাতগুলোর বণ্টন নিয়েই চিন্তা করতে হবে। তবে যদি ব্রিটিশ নিরাপত্তার প্রতি হুমকি বাড়তে থাকে এবং সামরিক বাজেট বৃদ্ধির পক্ষে যথেষ্ট রাজনৈতিক সমর্থন জোগাড় করা সম্ভব হয়, তাহলে ২০৩০ সালের পর জিডিপির ৩ শতাংশের বেশিও প্রতিরক্ষা খাতে খরচ করা সম্ভব হতে পারে।
ভয়েস অব আমেরিকা বলছে, গত সাত বছরে চতুর্থ প্রধানমন্ত্রী ব্রিটেনের রাজনৈতিক কলহকেই দেখিয়ে দেয়। আর মাত্র ৮১ হাজার পার্টি সদস্যের ভোট পেয়ে নির্বাচিত হওয়া ট্রাসের ভিত শক্ত নয়। নিজ দেশে ব্যাপক অর্থনৈতিক সমস্যা সত্ত্বেও ট্রাস ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা দিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন; যা এখন পর্যন্ত ঠেকেছে ৩ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলারে। এছাড়াও ট্রাস পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকার সময় চীনের ব্যাপারে জনসনের চাইতে কট্টর নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। কাজেই তার প্রধানমন্ত্রিত্বের সময় চীনকে হুমকি হিসেবেই দেখা হবে। চ্যাটহ্যাম হাউসের বিশ্লেষক জন কাম্ফনার বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রেও চ্যালেঞ্জ থাকবে; কারণ ওয়াশিংটনকে সর্বদাই ভাবতে হচ্ছে- তারা ইউরোপের সঙ্গে থাকবে, নাকি ব্রিটেনের সঙ্গে থাকবে।
কুয়েন্টিন বলছেন, ট্রাস হয়তো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তার আগের সরকারের নীতিই অনুসরণ করবেন। তবে যে জায়গায় দ্বন্দ্ব হতে পারে তা হলো ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সঙ্গে সম্পর্ক। জনসনের সরকারে থাকার সময় তিনি ইইউর সঙ্গে কঠোর নীতিতে যাওয়ার পক্ষে ছিলেন। সেই নীতি এখন বাস্তবায়ন করতে গেলে ইইউর সঙ্গে সম্পর্ক নিঃসন্দেহে খারাপ হবে। ট্রাসের কথাতে আদর্শের উপস্থিতি থাকলেও তিনি এর আগেও বেশ কয়েকবার বিভিন্ন ইস্যুতে তার মত পরিবর্তন করেছিলেন। অপরদিকে রুসি বলছে, সামনের দিনগুলোতে ব্রিটেন হয়তো তার কৌশলগত নৌ ও দূরপাল্লার আকাশ শক্তিকে শুধু রাশিয়ার বিরুদ্ধে তাক না করে চীনের দিকেও নিয়ে আসতে পারে।
হককথা/এমউএ