কিয়েভে হঠাৎ প্রাণের ছোঁয়া!
- প্রকাশের সময় : ০১:৩৬:২০ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৩
- / ১০৫ বার পঠিত
আন্তর্জাতিক ডেস্ক : শুক্রবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) সকালে ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের আকাশ ছিল একদম ঝকঝকে নীল। বাতাসে মিষ্টি রোদের সুবাস। কামানের গোলার গর্জন, বন্দুকের গুলির শব্দ কিংবা আকাশ ফুঁড়ে উড়ে আসা বিমানের ভয় জাগানিয়া শব্দও ছিল না। এমন শান্ত স্নিগ্ধ ফুরফুরে সকাল বহুদিন প্রত্যক্ষ করেনি কিয়েভবাসী।
অবশ্য এক বছর আগেও ইউক্রেনের মানুষের জীবনযাত্রা ছিল এমন সহজ ও স্বাভাবিক। কিন্তু ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ভোররাতে রাশিয়ার সম্মিলিত আক্রমণে ইউক্রেনের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ছেদ পড়ে। এর পর একটি বছর ক্রমাগত হামলায় ইউক্রেনের বহু শহর পরিণত হয় ধ্বংসস্তূপে।
এতে চিরতরে নিভে গেছে ৮ হাজার প্রাণ। সাড়ে ১৩ হাজারের মতো মানুষ জখম হয়েছেন। বাস্তুচ্যুত হয়েছেন কমপক্ষে ৮০ লাখ মানুষ। গত শুক্রবার রাশিয়ার ইউক্রেন হামলার এক বছর পূর্তি হয়েছে। ইউক্রেনে নানা আয়োজনে পালন করা হয় দিবসটি।
বর্ষপূর্তির দিনে রুশ বিমান হামলার শঙ্কা থাকলেও, হামলা হয়নি। যুদ্ধের ময়দানও ঐ দিন ছিল শান্ত ও নিরুদ্বেগ যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ইতালি ও অস্ট্রেলিয়াসহ বিশ্বের নানা প্রান্তের মানুষরাও ঐ দিন ইউক্রেনের নাগরিকদের প্রতি সংহতি জানিয়েছেন। কিয়েভসহ ইউক্রেনের বিভিন্ন শহরের বাসিন্দারা বাইরে বেরিয়েছেন। মিসাইল ও বিমান হামলা থেকে বাঁচতে, ইউক্রেনের নাগরিকরা এক আশ্রয় শিবির থেকে অন্য আশ্রয় শিবিরে ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। তাই একটু স্বাভাবিক দিনের গন্ধ পেতে সড়কে ছিল যানবাহনের সারি, ফুটপাতে মানুষের মিছিল। জনপরিসর, শপিং মল, সুপার শপ ও রেস্তোরাঁগুলো মানুষের সংস্পর্শে প্রাণ ফিরে পেয়েছিল।
মানুষজনের চোখমুখে শঙ্কা, দ্বিধা, অনিশ্চয়তা ও শোকের পাশাপাশি সেদিন দেখা গিয়েছিল গর্ব ও প্রতিরোধের প্রত্যয়। কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ও সেদিন খুলেছিল। জাতীয় অপেরা থিয়েটারে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়েছে। শিরোনাম ছিল ‘ইউক্রেন :স্বাধীন ও অবিধ্বংসী।’
ঐ দিন যুদ্ধে নিহতদের প্রতি জানানো হয় ভালোবাসা ও সম্মান। ইউক্রেনের বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষ সেদিন, ২০১৪ সাল থেকে দখলকৃত ভূখণ্ড ফিরে পাবার অঙ্গীকার করেছে। ইউক্রেনের মানুষের প্রতি সংহতি জানিয়ে ও যুদ্ধ বন্ধের দাবিতে অভিনব সব কর্মসূচি দেখা গিয়েছিল বিশ্বের প্রধান প্রধান শহরে। ইউক্রেনের বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষ সেদিন, ২০১৪ সাল থেকে দখলকৃত ভূখণ্ড ফিরে পাবার অঙ্গীকার করেছে। আয়োজনের অভিনবত্বে ছিল চমক। যুক্তরাজ্যের লন্ডনের ট্রাফালগার স্কয়ারে বৃহস্পতিবার (২৩ ফেব্রুয়ারি) সমবেত হয়েছিল বহু মানুষ। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউক্রেনের দূতাবাস আয়োজন করে এ জমায়েতের।
লন্ডনে ইউক্রেনের ক্যাথলিক ক্যাথেড্রালের ছাদে ঝোলানো হয়েছিল কাগজ দিয়ে বানানো ৪৬১টি দেবতার ছবি। যুদ্ধে নিহত শিশুদের স্মরণে নেওয়া হয় এই থিম। লন্ডনে রাশিয়ার দূতাবাসের সামনে ভিন্নধর্মী প্রতিবাদ দেখা গেছে। এক্টিভিস্টরা ছোটো ছোটো ট্রলিতে করে নিয়ে আসে হলুদ ও নীল রং।
এরপর সেই রং সড়কের ওপর ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এভাবেই আঁকা হয় ইউক্রেনের পতাকা। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক তার অফিস ১০ ডাউনিং স্ট্রিটের বাইরে এসে ইউক্রেন যুদ্ধে নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করেছেন। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন ইউক্রেনের অ্যাম্বাসেডর।
জার্মানির বার্লিন শহরে প্রদর্শনীর জন্য রাখা হয়েছিল বিধ্বস্ত একটি রাশিয়ান ট্যাংক। ফ্রান্সের প্যারিসে ইউক্রেনের পতাকার আদলে নীল ও হলুদ রংয়ে আলোকসজ্জা করা হয়েছিল আইফেল টাওয়ারে।
বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে ইইউ ডিসট্রিক্টে অলাভজনক একটি প্রতিষ্ঠান মোমবাতি প্রজ্বালন করেছিল। সেদিন একটি গোলচত্বরে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল অসংখ্য টেডিবিয়ার খেলনা। ইউক্রেন যুদ্ধে হতাহতের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ফিনল্যান্ডের হেলসিংকি ক্যাথেড্রালের সিঁড়িতে মানুষ মোমবাতি প্রজ্বালন করে। ইতালি ও পর্তুগালের পার্লামেন্ট ভবনে ইউক্রেনের পতাকার মতো আলোকসজ্জা করা হয়।
ইউক্রেন যুদ্ধে হতাহতের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ফিনল্যান্ডের হেলসিংকি ক্যাথেড্রালের সিঁড়িতে মানুষ মোমবাতি প্রজ্বালন করে। যুদ্ধবিরোধী এক্টিভিস্টরা সার্বিয়ার বেলগ্রেডে রাশিয়ার দূতাবাসের সিঁড়ির সামনে রেখে গিয়েছিল একটি কেক। কেকটির ওপরে প্রতীকী রক্ত ও ক্রিম দিয়ে খুলি বানানো হয়েছিল। অস্ট্রেলিয়ার সিডনি অপেরা হাউজে ইউক্রেনের পতাকার মতো আলোকসজ্জা করা হয়েছে।
যুদ্ধবিরোধী এক্টিভিস্টরা সার্বিয়ার বেলগ্রেডে রাশিয়ার দূতাবাসের সিঁড়ির সামনে রেখে গিয়েছিল একটি কেক। ব্যাংকক, টোকিও ও সিওলেও যুদ্ধ বিরোধী সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। স্নায়ুযুদ্ধ শুরুর পর রাশিয়ায় নাগরিক অধিকার আন্দোলনের কর্মী বাহিনী গড়ে উঠেছিল। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশটিতে ভ্লাদিমির পুতিনের দমন পীড়নের কারণে ভিন্নমতাবলম্বী একেবারেই কোণঠাসা। রাশিয়ায় শুক্রবার সাধারণ ছুটি ছিল।
দেশটির নাগরিকরা ছুটির আমেজে দিন কাটিয়েছেন। কোনো ধরনের প্রতিবাদ যেন না হয়, সেজন্য পুলিশ আগেই কর্মীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে সতর্ক করে দিয়েছিল। ইউক্রেনের নিহত নাগরিকদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে শুক্রবার কিয়েভ গিয়েছিলেন পোল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী।
প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি কিয়েভের প্রাচীন সেন্ট সোফিয়া ক্যাথেড্রাল প্রাঙ্গণে সামরিক কুচকাওয়াজে সভাপতিত্ব করেন। বীর সেনাদের পদক পরিয়ে দেন। সম্মাননা জানান হতাহতদের স্বজনদের। টেলিভিশনে সম্প্রচারিত আবেগঘন এক বক্তৃতায় তিনি বলেছেন, ‘আমাদের প্রত্যেকের মোবাইল ফোন থেকে একটি নাম চিরদিনের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেছে। আমরা আর কখনোই ফোনে ঐ মানুষটির কণ্ঠ বা তার মেসেজ পাব না। আমরা তাদের নাম ফোন থেকে মুছে ফেলব না; হৃদয় থেকে তো নয়ই।’
প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি কিয়েভের প্রাচীন সেন্ট সোফিয়া ক্যাথেড্রাল প্রাঙ্গণে সামরিক কুচকাওয়াজে সভাপতিত্ব করেন। জেলেনস্কি আরও বলেছেন, ‘আমরা ভয় পাইনি, ভেঙেও পড়িনি। কারো কাছে মাথা নত করিনি। অবাক বিস্ময়ে পৃথিবীবাসী ইউক্রেনকে দেখেছে। বছরটি ছিল আমাদের তিতিক্ষা, দয়াশীলতার, সাহসের, যন্ত্রণার, আশাবাদিতার, সহ্যশীলতার, ঐক্য ও ভেঙে না পড়ার। নিষ্ঠুরতারও ছিল বছরটি। তবে শেষ কথা আমরা পরাজয় বরণ করে নেয়নি। এই বছর বিজয়ের আশায় আমরা আমাদের যা যা করার সবই করব।’ সূত্র : দৈনিক ইত্তেফাক
সুমি/হককথা