ইসরায়েল ফিলিস্তিনের যত কথা
- প্রকাশের সময় : ০৭:৩৪:৪৫ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১২ অক্টোবর ২০২৩
- / ১৩১ বার পঠিত
আর্ন্তজাতিক ডেস্ক : অর্ধশতাব্দী আগে ১৯৭৩ সালে ‘ইয়ম কিপ্পুর’ যুদ্ধে যখন মিসর আচমকা ইসরায়েলে আক্রমণ করে, তখনো কেউ এতটা বিস্মিত হয়নি। এবারকার হামলায় ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো হতবাক হয়ে গেছে। ফিলিস্তিনিদের আচমকা জ্বলে ওঠাকে ইসরায়েলের জন্য বিশাল সামরিক ব্যর্থতা ও রাজনৈতিক বিপর্যয় বলা যেতে পারে। তাদের বিস্ময়ের ঘোর কাটছে না।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর প্রতি তাদের নাগরিকদের যে আস্থা ছিল, তাতেও ভয়ংকরভাবে চিড় ধরেছে। এদিকে জাতিসংঘ হুঁশিয়ারি বার্তা দিয়ে জানিয়েছে, ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী লড়াই যেরকম তীব্র হয়ে উঠেছে, তা ‘পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে’ রূপ নিতে পারে। চলুন জেনে নিই ইসরায়েল ফিলিস্তিনের অবস্থান, সংঘাত এবং অবস্থান নিয়ে যত কথা….
ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন ভৌগলিক অবস্থান
ফিলিস্তিন বা প্যালেস্টাইন মধ্যপ্রাচ্যের দক্ষিণাংশের একটি ভূখণ্ড, যা ভূমধ্যসাগর ও জর্ডান নদীর মাঝে অবস্থিত (যেখানে বর্তমান ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড অবস্থিত)। এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকা এই তিন মহাদেশের জন্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ ভৌগোলিক অবস্থানে রয়েছে ফিলিস্তিন। এটি ইহুদি ধর্ম ও খ্রিস্টধর্মের জন্মস্থান। ভৌগোলিক অবস্থান ও দুটি প্রধান ধর্মের সূতিকাগার হওয়ায় স্বভাবতই ফিলিস্তিন নামক ভূখণ্ডটির রয়েছে ধর্ম, সংস্কৃতি, বাণিজ্য ও রাজনীতির এক দীর্ঘ ও আলোড়ন সৃষ্টিকারী ইতিহাস। আদিকাল থেকে আজ পর্যন্ত ফিলিস্তিনের এই সম্পূর্ণ ভূ-খণ্ড বা এর কোন কোন অংশ ন ক্রুসেডার বা ধর্মযোদ্ধাগণ, শেষের দিকের মুসলিম খিলাফাত, ব্রিটিশ, জর্ডানি (পশ্চিম তীরের অংশটুকু), মিশরীয় (গাজা অঞ্চল), এবং হাল আমলের ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনিসহ এরকম বহু জাতি ও অঞ্চলের ব্যক্তি ও শাসকরা শ্বাসন করেছেন।
মূল সমস্যাগুলো কী?
ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনিরা কিছু ইস্যুতে মোটেই একমত হতে পারছে না। এর মধ্যে আছে ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের ব্যাপারে কী হবে; পশ্চিম তীরে যেসব ইহুদী বসতি স্থাপন করা হয়েছে সেগুলো থাকবে, নাকি সরিয়ে নেওয়া হবে; জেরুজালেম নগরী কি উভয়ের মধ্যে ভাগাভাগি হবে; আর সবচেয়ে জটিল ইস্যু হচ্ছে- ইসরায়েলের পাশাপাশি একটি স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনের প্রশ্ন। গত ২৫ বছর ধরেই শান্তি আলোচনা চলছে থেমে থেমে। কিন্তু সংঘাতের কোন সমাধান এখনো মেলেনি।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, সংঘাতের শুরু এবং বর্তমান ঘটনা
গত ৫০ বছর ধরেই ইসরায়েল এসব দখলীকৃত জায়গায় ইহুদী বসতি স্থাপন করছে। ছয় লাখের বেশি ইহুদী এখন এসব এলাকায় থাকে। ফিলিস্তিনিরা বলছে, আন্তর্জাতিক আইনে এগুলো অবৈধ বসতি এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার পথে অন্তরায়। তবে ইসরায়েল তা মনে করে না। কারণ বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ইউরোপে বসবাসকারী ইহুদীরা ব্যাপক বিদ্বেষ-নির্যাতনের শিকার হয়েছিল। সেখান থেকেই ‘জাওনিজম’ বা ইহুদীবাদী আন্দোলনের শুরু। ইহুদীবাদী আন্দোলন দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে ইউরোপের ইহুদীরা দলে দলে প্যালেস্টাইনে গিয়ে বসত গড়তে শুরু করে। কিন্তু তাদের এই অভিবাসন স্থানীয় আরব এবং মুসলিমদের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি করে। সেসময় আরব এবং মুসলিমরাই ছিল সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর তুর্কী অটোমান সাম্রাজ্য কার্যত ভেঙ্গে পড়ে। তখন যে লিগ অব নেশন গঠিত হয়েছিল, সেই বিশ্ব সংস্থার পক্ষ থেকে ব্রিটেনকে ‘ম্যান্ডেট’ দেয়া হয় প্যালেস্টাইন শাসন করার। এদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যেভাবে লাখ লাখ ইহুদীকে হত্যা করা হয় (হলোকাস্ট) তার পর ইহুদীদের জন্য একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় চাপ বাড়তে থাকে।
ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের অধীনে থাকা অঞ্চলটি তখন ফিলিস্তিনি আর ইহুদীদের মধ্যে ভাগ করার সিদ্ধান্ত হয়। এই সিদ্ধান্তের ভিত্তিতেই ১৯৪৮ সালের ১৪ মে প্রতিষ্ঠিত হয় ইসরায়েল। কিন্তু পরদিনই মিশর, জর্ডান, সিরিয়া এবং ইরাক মিলে অভিযান চালায় ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের অধীনে থাকা অঞ্চলে। সেটাই ছিল প্রথম আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ। ইহুদীদের কাছে এটি স্বাধীনতার যুদ্ধ হিসেবে পরিচিত।
জাতিসংঘ প্যালেস্টাইনে আরবদের জন্য একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় যে অঞ্চলটি বরাদ্দ করেছিল, এই যুদ্ধের পর তার অর্ধেকটাই চলে যায় ইসরায়েল বা ইহুদীদের দখলে। ফিলিস্তিনের জাতীয় বিপর্যয়ের শুরু সেখান থেকে। এটিকেই তারা বলে ‘নাকবা’ বা বিপর্যয়। প্রায় সাড়ে সাত লাখ ফিলিস্তিনিকে পালিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোতে আশ্রয় নিতে হয়। ইহুদী বাহিনী তাদেরকে বাড়ি-ঘর থেকে উচ্ছেদ করে।
১৯৬৭ সালের ছয় দিনের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ। ৫ জুন হতে ১০ জুন পর্যন্ত এই যুদ্ধে যা ঘটেছিল, তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়েছিল পরবর্তীকালে। ইসরায়েল বিপুলভাবে জয়ী হয় এই যুদ্ধে। তারা গাজা এবং সিনাই উপদ্বীপ দখল করে নেয় যা কিনা ১৯৪৮ সাল হতে মিশরের নিয়ন্ত্রণে ছিল। অন্যদিকে পূর্ব জেরুসালেম-সহ পশ্চিম তীরও তারা দখল করে নেয় জর্ডানের কাছ থেকে। সিরিয়ার কাছ থেকে দখল করে গোলান মালভূমি। আরও পাঁচ লাখ ফিলিস্তিনিকে তাদের বাড়ি-ঘর ফেলে পালাতে হয়।
এরপর ১৯৭৯ সালে মিশর প্রথম কোন আরব রাষ্ট্র যারা ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তি চুক্তি করে। এর পর তাদের পথ অনুসরণ করলো জর্ডান। কিন্তু তাই বলে ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে ইসরায়েলের যুদ্ধ শেষ হয়নি। গাজা ভূখণ্ড যেটি বহু দশক ধরে ইসরায়েল দখল করে রেখেছিল, সেটি ১৯৯৪ সালে তারা ফিলিস্তিনিদের কাছে ফিরিয়ে দিল। সেখানে ইসরায়েলি এবং ফিলিস্তিনিদের মধ্যে বড় ধরণের লড়াই হয় ২০০৮, ২০০৯, ২০১২, ২০১৪, ২০২১ এবং ২০২৩ সালে।
সম্প্রতি ৭অক্টোবর (শনিবার) গাজা থেকে ইসরায়েলে কয়েক হাজার রকেট নিক্ষেপ করা হলে দেশটির একজন নাগরিক নিহত এবং আরও কয়েকজনের আহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়। এর পরপরই ইসরায়েলের মূল ভূখণ্ডে প্রবেশ করে হামাস বাহিনী।
ফিলিস্তিনি গোষ্ঠী হামাস ইসরায়েলে রকেট হামলার দায় স্বীকার করে বলেছে, তারা ৫ হাজারেরও বেশি রকেট নিক্ষেপ করেছে। হামাসের সামরিক শাখা ইজ্জেদিন আল-কাসাম ব্রিগেড এক বিবৃতিতে বলেছে, আমরা দখলদারিত্বের (ইসরায়েল) সমস্ত অপরাধ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। জবাবদিহি না করে তাদের তাণ্ডব চালানোর সময় শেষ হয়ে গেছে। আমরা সেখানে অপারেশন ঘোষণা করছি। আমরা ২০ মিনিটের হামলায় ৫ হাজারেরও বেশি রকেট নিক্ষেপ করেছি।
এদিকে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, হামাস ইসরায়েলে রকেটের একটি ব্যারেজ ছুড়েছে এবং হামাসের সদস্যরা একাধিক স্থান দিয়ে ইসরায়েলি ভূখণ্ডে অনুপ্রবেশ করেছে। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, হামাস এই ঘটনার পরিণতি ও দায়-দায়িত্ব ভোগ করবে।
এদিকে এখন পর্যন্ত গাজা ভূখণ্ড নিয়ন্ত্রণকারী গোষ্ঠী হামাসের হামলার পর গত ৩ দিনে ইসরায়েল ও গাজায় নিহতের সংখ্যা ১ হাজার ৩০০ জন ছাড়িয়ে গেছে। নিহতদের মধ্যে ৮ শতাধিক ইসরায়েলের এবং ৫৬০ জন ফিলিস্তিনের। ইসরায়েলের নাগরিকদের পাশাপাশি আরও অন্তত ১০টি দেশের বেশ কয়েকজন নাগরিক হত্যা ও অপহরণের শিকার হয়েছেন বলে জানিয়েছে কয়েকটি গণমাধ্যম। এই দেশগুলো হলো যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, আয়ারল্যান্ড, মেক্সিকো, ব্রাজিল, নেপাল, থাইল্যান্ড এবং ইউক্রেন।
আবার লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলে বিমান হামলা চালিয়ে দেশটির সশস্ত্র ইসলামি গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর দুই সদস্যকে হত্যা করেছে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী। হামাসের সঙ্গে ইসরায়েলের চলমান যুদ্ধে ফিলিস্তিনের সমর্থনে হিজবুল্লাহর সদস্যদের ইসরায়েলে ঢুকে পড়া ঠেকাতে এই বিমান হামলা চালানো হয়েছে। এর ফলে হামাস-ইসরায়েল সংঘাতে হিজবুল্লাহর জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি বৃদ্ধি পেয়েছে বলে বিশ্লেষকরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
হামাস কারা?
ফিলিস্তিনের কট্টর ইসলামপন্থী সংগঠনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় সংগঠন হামাস। ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীর ও গাজা থেকে ইসরায়েলি দখলদারির অবসানের দাবিতে ‘ইন্তিফাদা’ বা ফিলিস্তিনি গণজাগরণ শুরুর পর ১৯৮৭ সালে হামাস গঠিত হয়। সংগঠনটির সনদ অনুযায়ী তারা ইসরায়েলকে ধ্বংস করতে অঙ্গীকারবদ্ধ। তাদের লক্ষ্য, ফিলিস্তিন রাষ্ট্র হবে বর্তমান ইসরায়েল, গাজা ও পশ্চিম তীর নিয়ে গঠিত একক ইসলামি রাষ্ট্র। সূত্র : এপি, এএফপি, আলজাজিরা, বিবিসি