ইতিহাসের ভয়াবহতম উড়োজাহাজ দুর্ঘটনা

- প্রকাশের সময় : ০১:৪১:৩৯ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৫ এপ্রিল ২০২৩
- / ৫০ বার পঠিত
আন্তর্জাতিক ডেস্ক : উড়োজাহাজ একমাত্র বাহন, যেটি আকাশে চলন্ত অবস্থায় কোনো যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিলে, থামিয়ে মেরামত করার উপায় নেই। তাই প্রয়োজন হলেই বৈমানিকরা চেষ্টা করেন যত শিগগির সম্ভব কাছাকাছি কোনো বিমানবন্দরে অবতরণ করতে। সব দেশই শত্রু-মিত্র নির্বিশেষে যে কোনো বিপদে পড়া উড়োজাহাজকে অবতরণ করার অনুমতি দিয়ে থাকে। তবে ত্রুটি মারাত্মক হলে, সে উড়োজাহাজের পরিণতি অনেকটাই ভাগ্যের ওপর নির্ভর করে। যাত্রীবাহী উড়োজাহাজ চলাচলের ইতিহাসে বেশ কিছু দুর্ঘটনা ঘটেছে যেগুলোর পরিণতি ছিল বেদনাদায়ক। যান্ত্রিক ত্রুটি, ঝড়, বৈরী আবহাওয়া, বৈমানিকের ভুল এবং সংঘর্ষের কারণে দুর্ঘটনাগুলো ঘটেছে। ইতিহাসে সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনাটি ঘটেছে মাটিতে, রানওয়ের ওপর দুটি উড়োজাহাজের মধ্যে সংঘর্ষের ফলে।
আজ থেকে ৪৫ বছর আগে, ২৭ মার্চ ১৯৭৭ স্মরণকালের উড্ডয়ন ইতিহাসে ভয়াবহতম দুর্ঘটনাটি ঘটে দুটি উড়োজাহাজের মাটিতে অবস্থানকালীন সংঘর্ষে। এ দুর্ঘটনায় দুই উড়োজাহাজের মোট ৫৮৩ যাত্রী প্রাণ হারান। দুটি উড়োজাহাজই সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়ে যায়। ঘটনাস্থল টেনেরিফ উত্তর বিমানবন্দর, কেনেরি দ্বীপপুঞ্জ, স্পেন। এই দ্বীপমালার মধ্যে এটিই সবচেয়ে বড় ও জনবহুল। ১৯৭৭ সালের ২৭ মার্চের সেই দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত উড়োজাহাজ দুটি ছিল বৃহদায়তনের বোয়িং জাম্বো জেট ৭৪৭। একটি KLM নেদারল্যান্ডসের, অন্যটি যুক্তরাষ্ট্রের Pan Am বিমান সংস্থার। ১৯২৭ সালে প্রতিষ্ঠিত Pan Am ছিল যুক্তরাষ্ট্রের আন-অফিসিয়াল ফ্ল্যাগ ক্যারিয়ার; কিন্তু ১৯৯১ সালে সংস্থাটি বিলুপ্ত হয়ে যায়, যে কারণে বর্তমান প্রজন্ম সেটিকে চেনে না। KLM নেদারল্যান্ডসের ফ্ল্যাগ ক্যারিয়ার বিমান সংস্থা হিসেবে এখনো চলছে।
কখগ ফ্লাইটটি এসেছিল নেদারল্যান্ডসের রাজধানী আমস্টারডাম থেকে আর Pan Am উড়ে এসেছিল নিউইয়র্ক থেকে। দুটিরই গন্তব্যস্থল ছিল গ্র্যান কেনেরিয়ার লাসপামাস বিমানবন্দর, যা স্পেনের কাছাকাছি স্প্যানিশ কেনেরি দ্বীপপুঞ্জে অবস্থিত। উড়োজাহাজ দুটি দুপুর ১.১৫ মিনিটে লাসপামাস বিমানবন্দরের কাছাকাছি পৌঁছতেই বিমানবন্দরটিতে বোমার বিস্ফোরণ হয়।ফলে সেটিকে সাময়িক বন্ধ ঘোষণা করা হয় এবং কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে ওই উড়োজাহাজ দুটিসহ আগত সব ফ্লাইটকে কাছাকাছি টেনেরিফ উত্তর বিমানবন্দরে গিয়ে ল্যান্ড করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। উত্তরে Pan Am বলেছিল ‘আমাদের কাছে পর্যাপ্ত জ্বালানি আছে। বিমানবন্দর পুনরায় না খোলা পর্যন্ত আমরা আকাশে চক্কর দিতে থাকি।’ কিন্তু কন্ট্রোল টাওয়ার তাদের টেনেরিফ যেতে নির্দেশ দেয়। ওলন্দাজ বিমানটির ক্যাপ্টেন ছিলেন জ্যাকব ভেলধুই জেনভ্যান জ্যান্টেন। ককপিটে আরও ছিলেন ফার্স্ট অফিসার ও ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার। জ্যাকব ছিলেন একজন সিনিয়র পাইলট এবং
KLM-এর প্রধান ফ্লাইট ইনসট্রাক্টর। ওই ফ্লাইটটিতে ক্রুসহ মোট ২৪৮ যাত্রী ছিল। অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্রের বিমানটির ক্যাপ্টেন ছিলেন ভিক্টর গ্রুবস্ এবং সঙ্গে ফার্স্ট অফিসার ও ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার। এই ফ্লাইটে ক্রুসহ মোট যাত্রী ছিল ৩৯৬ জন। বেলা ২টার দিকে দুই উড়োজাহাজই নিরাপদে টেনেরিফ উত্তর বিমানবন্দর এসে অবতরণ করে। তবে এই বিমানবন্দরটি ছিল আয়তনে ছোট। সে কারণে বেশ কয়েকটি বৃহদায়তন উড়োজাহাজ হ্যান্ডল করার মতো পর্যাপ্ত জায়গা ছিল না। তাই দুটি উড়োজাহাজকেই রানওয়ের এক প্রান্তে পার্ক করে রাখা হয়।
কখগ-এর যাত্রীদের অনুরোধে তাদের বিশ্রাম নিতে বাসে করে টার্মিনালে নিয়ে যাওয়া হয়; কিন্তু ভেতরে পর্যাপ্ত জায়গা না থাকাতে Pan Am-এর যাত্রীদের সেখানে নেওয়া হয়নি। এদিকে প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও KLM-এর ক্যাপ্টেন জ্যাকব কিছু বাড়তি জ্বালানি নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সে অনুযায়ী বিমানবন্দর থেকে ৪০ টন জ্বালানি ওই উড়োজাহাজে ভরা হয়। বিকেল ৪টার দিকে লাসপামাস বিমানবন্দরে পুনরায় অবতরণের জন্য প্রস্তুতির ঘোষণা করা হয়। যাত্রীরা উড়োজাহাজের ভেতরে অবস্থান করাতে চধহ অস তখনই টেক-অফ করার জন্য তৈরি ছিল; কিন্তু তাদের সামনে পথ রোধ করে দাঁড়িয়েছিল KLM উড়োজাহাজটি। টার্মিনাল থেকে সেটির যাত্রীরা ফেরত আসা এবং জ্বালানি নেওয়ার কারণে সেটি আরও কিছু সময় সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে।
এই বিলম্বের সময়টিতে পরিবেশে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে- চারদিক হঠাৎ করেই ঘন কুয়াশায় ঢেকে যায়। KLM উড়োজাহাজটি পুরোপুরি তৈরি হওয়ার পর, তাদের মধ্যে উড্ডয়নের জন্য বিশেষ তাড়া দেখা দেয়। ক্যাপ্টেন জ্যাকব চাচ্ছিলেন তাড়াতাড়ি গিয়ে লাসপামাস পৌঁছতে, যাতে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই তারা আমস্টারডাম ফিরে যেতে পারেন; কিন্তু ঘন কুয়াশার মধ্যে সেই তাড়াটি ছিল আত্মঘাতী। ছোট বিমানবন্দর হওয়াতে কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে KLM-কে টেক-অফ করার উদ্দেশ্যে রানওয়ের ওপর দিয়েই ট্যাক্সিইং করে শেষ প্রান্তে গিয়ে ১৮০ক্ক টার্ন নিয়ে দাঁড়াতে বলা হয়। সে অনুযায়ী উড়োজাহাজটি সেদিকে রওনা দেয় এবং রানওয়ের শেষ প্রান্তে গিয়ে টার্ন নিয়ে দাঁড়ায়
অন্যদিকে Pan Am-কে একই পথ ধরে এগিয়ে গিয়ে বাঁদিকের ৩ নম্বর গলিতে ঢুকে অপেক্ষা করতে বলা হয়। সে অনুযায়ী তারা রওনা দেয় ঠিকই কিন্তু ঘন কুয়াশার কারণে ক্যাপ্টেন ও ফার্স্ট অফিসার সেই গলিটি দেখতে না পেয়ে সেটি পার হয়ে চলে যান। এর পর কন্ট্রোল টাওয়ার KLM-কে টেক-অফ পরবর্তী নির্দেশনা জানিয়ে দেয়; কিন্তু টেক-অফ ক্লিয়ারেন্স দেয়নি। ক্যাপ্টেন জ্যাকব মনে করেন তাদের টেক-অফ নির্দেশনা দেওয়া হয়ে গেছে। ফার্স্ট অফিসারও পরিষ্কার বুঝতে পারেননি যে, তাদের তখনো টেক-অফ ক্লিয়ারেন্স দেওয়া হয়নি। ক্যাপ্টেন জ্যাকব উড়োজাহাজটি নিয়ে টেক-অফ দৌড় শুরু করেন।
অনেকেই জানেন ও দেখেছেন টেক-অফের উদ্দেশ্যে উড়োজাহাজ অত্যন্ত তীব্র গতিতে রানওয়ের ওপর দিয়ে চলতে থাকে। তবে ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার ঠিকই বুঝেছিলেন যে, তাদের টেক-অফ করার পরিষ্কার ক্লিয়ারেন্স দেওয়া হয়নি এবং সে কথা তিনি ক্যাপ্টেনকে জানান। ক্যাপ্টেন জ্যাকব তা অবজ্ঞা করেন। অথচ তখনো উড়োজাহাজটি ব্রেক করে নিরাপদ দূরত্বে থামিয়ে দেওয়া সম্ভব হতো। ওদিকে Pan Am নিয়ে ক্যাপ্টেন গ্রুবস রানওয়ের ওপর দিয়ে ধীরে ধীরে পরবর্তী বাঁদিকের গলিতে ঢোকার জন্য এগোচ্ছিলেন। কুয়াশার কারণে তারা কেউই দূর থেকে দেখতে পাননি যে, দুটি উড়োজাহাজ পরস্পরের দিকে ধেয়ে চলেছে, একটি আস্তে আস্তে, অন্যটি তীব্র গতিতে। কন্ট্রোল টাওয়ার Pan Am-কে বলে তারা যেন গলিতে ঢুকে জানিয়ে দেয় যে, তারা রানওয়ে ত্যাগ করেছে। উদ্দেশ্য, সে খবর জানার পর টাওয়ার KLM-কে টেক-অফ করার ক্লিয়ারেন্স দেবে। বিমানবন্দরটি ছোট হলেও কুয়াশার কারণে টাওয়ার থেকেও কিছু দেখা যাচ্ছিল না।
বেতারযন্ত্রে তিন পক্ষের কথোপকথনে Pan Am-এর ফার্স্ট অফিসার সন্দেহ করেন কোথাও একটা গোলমাল হচ্ছে। কয়েক সেকেন্ড পরেই ক্যাপ্টেন ও ফার্স্ট অফিসার উভয়ে কুয়াশার মাঝে আবছাভাবে দেখতে পান কখগ তীব্র গতিতে তাদের দিকে ধেয়ে আসছে। তখন ক্যাপ্টেন গ্রুবস ধেয়ে আসা উড়োজাহাজটিকে একটি গালি দিয়ে প্রাণপণে নিজ উড়োজাহাজকে বাঁদিকে ঘাসের ওপর নামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। ওদিকে KLM-এর ক্যাপ্টেন জ্যাকবও সামনে Pan Am-কে রানওয়ের ওপর দেখতে পান। তখন তিনি টেক-অফ করার জন্য প্রয়োজনীয় সর্বোচ্চ গতি অর্জন না হওয়া সত্ত্বেও উড্ডয়নের উদ্দেশ্যে উড়োজাহাজটির নাক উঁচু করে দেন; কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি। আনুমানিক ৩৭৫ টন ওজনের সুবিশাল KLM জাম্বো জেটটি প্রায় ৩৬৭ টন ওজনের চধহ অস জাম্বো জেটকে ঘণ্টায় ১৬০ মাইল বেগে নজিরবিহীন ভয়াবহতায় আঘাত করে।
কখগ উড়োজাহাজের সামনের দিক ও চাকা Pan Am-এর ওপর দিয়ে উঠে গেলেও পেছনের চাকাগুলো ও শরীরের নিচের দিক Pan Am-এর মাঝ বরাবর সরাসরি আঘাত করে। এর পর সেটি কিছুটা দূরত্ব উড়ে গিয়ে মাটিতে আছড়ে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গেই তার তেলের ট্যাংক বিশাল অগ্নিগোলক সৃষ্টি করে বিস্ফোরিত হয়। Pan Am উড়োজাহাজটিও রানওয়ের ওপর বিধ্বস্ত হয়ে যায় শুধু, সামনের দিকটি অক্ষত থাকে। ফলে সেই দিকে বসা চার ক্রুসহ ৬১ যাত্রী বেঁচে যায়। আর KLM-এর একজন ছাড়া সব যাত্রী নিহত হয়। সেই একজন হচ্ছেন- এক তরুণী, যিনি টেনেরিফে আসার জন্যই উড়োজাহাজে চড়েছিলেন। উড়োজাহাজের গন্তব্য পরিবর্তন না হলে তাকে লাসপামাস নেমে টেনেরিফ আসতে হতো। তাই KLM-এর সব যাত্রী টার্মিনাল থেকে উড়োজাহাজে ফিরে গেলেও তিনি টেনেরিফে থেকে যান।
দুটি উড়োজাহাজ মিলিয়ে মোট ৫৮৩ যাত্রীর মৃত্যু ঘটে। এই বিয়োগান্তক ঘটনার পর বিভিন্ন সংস্থার উদ্যোগে ব্যাপক তদন্ত চালানো হয়। সবকিছুর বিবেচনায় কখগ-এর ক্যাপ্টেন জ্যাকবই এই দুর্ঘটনার জন্য মূলত দায়ী প্রমাণ হন। প্রমাণগুলোর কয়েকটি নিচে উল্লেখ করা হলো :
১. প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও ক্যাপ্টেন জ্যাকব উড়োজাহাজে ৪০ টন জ্বালানি নেন। সেটি নিতে বেশ কিছুটা সময় ব্যয় হয়। তা না হলে উড়োজাহাজটি কুয়াশায় ঢেকে যাওয়ার আগেই ভিজিবিলিটির মধ্যে টেনেরিফ ত্যাগ করতে পারত। উপরন্তু ওজন বেড়ে যাওয়ার কারণে উড়োজাহাজের
টেক-অফ দৌড়টির প্রয়োজনীয় দূরত্ব বেড়ে যায়। তা না হলে কখগ-কে আঘাত করার আগেই হয়তো আকাশে উঠে যেতে পারত। জ্বালানি নিতে তার সহকর্মীরা নিষেধ করেছিলেন; কিন্তু তিনি তা রূঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেন।
২. কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে টেক-অফ
করার পরিষ্কার ক্লিয়ারেন্স না পেয়েই তিনি টেক-অফ দৌড় শুরু করেন। জিজ্ঞেস করে কনফার্ম হওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেননি। এটি ছিল এয়ারলাইন্স কোড অব কন্ডাক্টের গুরুতর লঙ্ঘন।
৩. ঘন কুয়াশায় লো-ভিজিবিলিটির কারণে যেসব সাবধানতা অবলম্বন করা জরুরি ছিল, তার কোনোটিই তিনি করেননি। KLM এর ক্যাপ্টেন জ্যাকব দুর্ঘটনার জন্য দায়ী প্রমাণ হওয়ার ফলে এই উড়োজাহাজ সংস্থার পক্ষ থেকে সব যাত্রীর পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পর সূক্ষ্ন তদন্ত শেষে কন্ট্রোল টাওয়ার ও বিমানের কথোপকথনের ভাষায় ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়, যাতে কোনো অস্পষ্টতা না থাকে। পাইলটদের জন্য কিছু অতিরিক্ত প্রশিক্ষণের নিয়মও অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যাতে ক্যাপ্টেনরা অধস্তনদের পরামর্শ গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেন। বিমানভ্রমণের ইতিহাসে এটিই সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। সূত্র : সাম্প্রতিক দেশকাল
সুমি/হককথা