নিউইয়র্ক ১২:৫৯ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

ডলার সংকট কাটছে না, চাপ বেড়েছে ব্যবসায়

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০২:৫০:০৩ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৮ জানুয়ারী ২০২৪
  • / ৫১ বার পঠিত

ভাঙা পাথর আমদানির জন্য বেসরকারি ন্যাশনাল ব্যাংকে এলসি খুলেছিল ইনফ্রাটেক কনস্ট্রাকশন। এলসি খোলার সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনামতো গ্রাহকের কাছ থেকে শতভাগ নগদ মার্জিন হিসেবে দুই কোটি টাকা জমা নেয় ব্যাংক। তা নেওয়া হয় ব্যাংকেরই দেওয়া ঋণের টাকা থেকে। পণ্য দেশে আসার আগেই ফেব্রুয়ারিতে এলসি মার্জিনের পুরো টাকা তুলে নেওয়ার সুযোগ দেয় ব্যাংক। ব্যাংকের সঙ্গে ভালো সম্পর্কের সুবাদে ইনফ্রাটেকের মতো অনেক কোম্পানিই নানা কৌশলে আমদানি করছে বিলাসী পণ্য। অন্য সব পণ্যের চেয়ে মূলধনি যন্ত্রপাতি ও শিল্পে ব্যবহৃত কাঁচামাল আমদানি কমছে বেশি।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ব্যাংকগুলোর সহজে ব্যবসা আসে বিলাসী ও প্রস্তুত করা পণ্যের মতো ট্রেডিং খাত থেকে। এসব খাতের ব্যবসায়ীরা তুলনামূলকভাবে সমাজের প্রভাবশালী এবং ব্যাংকের মালিকপক্ষের সঙ্গে বেশি সম্পৃক্ত। আবার উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রভাব গাড়ি, টিভি, ফ্রিজের মতো ক্রেতাদের ওপর কম। ফলে এসব পণ্যের আমদানি কমানো যায়নি। আবার ডলার বাজার নিয়ন্ত্রণে অর্থ পাচার ও হুন্ডি ঠেকানোর চেয়ে অনেক ক্ষেত্রে ব্যাংকের ওপর বিভিন্ন সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে একের পর এক সিদ্ধান্ত নিলেও তেমন সুফল মেলেনি। অনেক ক্ষেত্রে সংকট বেড়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে কমে এখন ২০ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মধ্যস্থতায় আমদানিতে ডলারের দর ১১০ টাকা ঠিক করা হলেও ব্যবসায়ীদের কিনতে হচ্ছে ১২৩ থেকে ১২৪ টাকায়। বাড়তি টাকা পরিশোধ করতে হচ্ছে নানা অনৈতিক উপায়ে। সব মিলিয়ে ব্যবসায়ীদের ওপর চাপ আরও বেড়েছে।

ব্যবসা-বাণিজ্য ছাড়াও চিকিৎসা, শিক্ষা, ভ্রমণসহ বিভিন্ন কাজে দেশের বাইরে যাওয়ার সময় অনেকে ডলার পাচ্ছেন না। আবার হাতে থাকা কিংবা প্রবাসীদের ধরে রাখা ডলার ব্যাংকে আনতে প্রবাসীর সুবিধাভোগী ও বিদেশফেরতদের ডলার জমার ওপর উচ্চ সুদ দেওয়া হচ্ছে। তবে এসব ক্ষেত্রেও সাড়া নেই। এ রকম বাস্তবতায় আইএমএফের পরামর্শে আগামী দিনে ডলার বেচাকেনার নতুন পদ্ধতি ‘ক্রলিং পেগ’ চালুর ঘোষণা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ উপায়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের একটি মধ্যবর্তী দর ঠিক করবে। তার সঙ্গে সর্বোচ্চ বৃদ্ধি ও হ্রাসের একটি শতাংশ নির্ধারণ করা হবে।

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি আবুল কাশেম খান সমকালকে বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন উদ্যোগ নিলেও ডলার বাজারে স্বস্তি ফেরেনি; বরং দিন দিন সংকট আরও বাড়ছে। ব্যাংকের সঙ্গে যাদের ভালো সম্পর্ক, শুধু তারাই আমদানির জন্য ডলার পাচ্ছেন। ব্যক্তি পর্যায়ে ডলার কিনতেও বেগ পেতে হচ্ছে। তিনি বলেন, কৃত্রিমভাবে ডলারের দর নির্ধারণ করে রাখায় ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে অনেক বেশি দর পাওয়া যাচ্ছে। অনেকে এখন দেশের বাইরে থেকে ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে অর্থ নিয়ে আসছেন। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেসব উদ্যোগ নিয়েছে, সেখানে সংস্কার দরকার। রপ্তানি ও রেমিট্যান্স কীভাবে বাড়ানো যায়, সেদিকে জোর দেওয়া দরকার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থায় অর্থবছরের পর এবারও আমদানি কমছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে বিভিন্ন পণ্য আমদানির জন্য এলসি নিষ্পত্তি ১৮ শতাংশের বেশি কমে ৩ হাজার ৩৬৮ কোটি ডলারে নেমেছে। সবচেয়ে বেশি কমেছে শিল্পের কাঁচামাল ও মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানি। ডিসেম্বর পর্যন্ত শিল্পের কাঁচামালের এলসি ৩১ শতাংশের বেশি কমে ১ হাজার ৫৪ কোটি ডলারে নেমেছে। মূলধনি যন্ত্রপাতির এলসি নিষ্পত্তি প্রায় ২৭ শতাংশ কমে ১৪৩ কোটি ডলারে নেমেছে। অর্থবছর আমদানি ১৬ শতাংশের মতো কমে ৬ হাজার ৯৫০ কোটি ডলারে নেমেছিল। এর মধ্যে মূলধনি পণ্যের আমদানি ২৪ শতাংশের বেশি এবং মধ্যবর্তী পণ্যের আমদানি প্রায় ২২ শতাংশ কমেছিল। একটি দেশের উৎপাদন ও কর্মসংস্থান বাড়ছে কিনা, তা বোঝার সহজ উপায় বিবেচনা করা হয় মূলধনি যন্ত্রপাতি ও শিল্পে ব্যবহারিত কাঁচামাল আমদানি কেমন হচ্ছে, তার ওপর। সাম্প্রতিক সময়ে বিলাসী পণ্যের চেয়ে এ দুটি পণ্যের আমদানি কমছে বেশি হারে।

১৭ জানুয়ারি মুদ্রানীতি ঘোষণা অনুষ্ঠানে বিলাসী পণ্যের চেয়ে উৎপাদনশীল খাতের পণ্য আমদানি বেশি কমার বিষয়ে এক সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে আমদানি নিয়ন্ত্রণ ছাড়া বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার কারণে কোনো পণ্যের আমদানি সরাসরি নিষিদ্ধ করা অনেক কঠিন।

বেসরকারি একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, আমদানি কমিয়ে ডলার বাজার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা অর্থনীতির জন্য হিতে বিপরীত হয়েছে। এতে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমছে, সরকার রাজস্ব হারানোর পাশাপাশি ব্যাংকের আয়ও কমে যাচ্ছে। অনেক বড় কোম্পানি মুনাফা বা বিনিয়োগের অর্থ ফেরত নিতে পারছে না। এসব কারণে নতুন শিল্প গড়ে উঠছে কম। কাঁচামাল আনতে না পেরে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কোনো কোনো কারখানায় সক্ষমতার অর্ধেক কার্যক্রম চালাচ্ছে। আগামীতে এসব কারখানা খেলাপি হলেও কিছু বলার থাকবে না। আবার নতুন কর্মসংস্থান কমবে। নতুন করে অনেকে বেকার হবে। দীর্ঘ মেয়াদে রপ্তানি আয় কমবে। এ ছাড়া নগদ সহায়তা নেওয়ার জন্য নানা কৌশলে অনেকে ভুয়া রপ্তানি দেখাবে। ফলে শুধু আমদানি নিয়ন্ত্রণ না করে অর্থ পাচার ঠেকানোর ওপর জোর দিতে হবে। যে করেই হোক রপ্তানি ও রেমিট্যান্স বাড়াতে হবে।

জানতে চাইলে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ডলার বাজার তখনই ঠিক হয়েছে বলা যাবে, যখন আন্তঃব্যাংক কার্যকর হবে। তবে এখনও আন্তঃব্যাংকে ডলার বেচাকেনা হচ্ছে না। যে যার প্রয়োজন অনুযায়ী রেমিট্যান্স কিনছে বা রপ্তানি আয় দেশে আনছে।

গবেষণা সংস্থা পিআরআইর নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার বাজার ঠিক করতে একেক সময় একেক রকম সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে এসব সিদ্ধান্ত বাজারকে আরও অস্থিতিশীল করেছে। একবার ব্যাংকের মাধ্যমে দর ঠিক করে দেওয়া হচ্ছে। আবার বলা হচ্ছে, রেমিটার থেকে ব্যাংক যে দরে ডলার কিনবে, আমদানিকারকের কাছে তার চেয়ে কম দরে বিক্রি করতে পারবে। একটি ব্যাংক কেন দেখা চোখে লোকসানে বিক্রি করবে। তিনি বলেন, আমদানিকারকরা তো বাজারভিত্তিক ধরে ডলার কিনছে। ফলে পরিস্থিতি ঠিক করতে ডলারের দর বাজারভিত্তিক করতে হবে। একই সঙ্গে অর্থ পাচার ঠেকাতে কঠোর হতে হবে। বৈধ চ্যানেলে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স বাড়াতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. মেজবাউল হক অবশ্য বলেন, ডলার বাজারে চাপ অনেক কমেছে। রমজানে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১০ থেকে ১৫ শতাংশ বেড়েছে।

ডলার বাজারে সংকট শুরু হয় মূলত ২০২১ সালের আগস্টের পর। সংকট কাটাতে ওই সময় থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ২৯ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতেও কাজ না হওয়ায় ২০২২ সালের মাঝামাঝি থেকে আমদানি নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেয় সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক। প্রথমে শুল্ক বাড়ানো ও শতভাগ এলসি মার্জিন আরোপ করা হয়। এর পর প্রতিটি বড় এলসি যাচাই শুরু করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতেও কাজ না হওয়ায় ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মধ্যস্থতায় ডলারের একটি দর ঠিক করে দিচ্ছে এবিবি ও বাফেদা।

তবে বেশির ভাগ ব্যাংক এ দরে ডলার না পেয়ে বেশি দরে বেচাকেনা করছে। এ নিয়ে  সেপ্টেম্বরে ১০ ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধানকে ১ লাখ টাকা করে জরিমানা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর পর বাজারে আতঙ্ক ছড়িয়ে ডলার আয় আরও কমে যায়। শেষ পর্যন্ত তাতেও কাজ না হওয়ায় শেষ সময়ে ব্যাংকগুলো যে দরে রেমিট্যান্স কিনবে, তার চেয়ে কমে বিক্রির কথা বলা হয়। তবে এটিও বাস্তবসম্মত বা টেকসই না হওয়ায় তাতেও সাড়া মেলেনি। বেশির ভাগ ব্যাংক এখনও ঘোষণার চেয়ে বেশি দরে ডলার বেচাকেনা অব্যাহত রেখেছে। বরং এ সমস্যা দিনে দিনে প্রকট হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন-সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, আমদানি নিয়ন্ত্রণের কৌশল তেমন কাজে আসেনি। বরং আন্ডার ইনভয়েসিং বেড়ে সরকারের রাজস্ব আয় কমেছে। বাকি অর্থ অবৈধ উপায়ে পরিশোধের জন্য হুন্ডিতে ডলারের চাহিদা বেড়েছে। তিনি বলেন, ব্যাংকগুলোকে ব্যবসায়ীর নিজস্ব উৎস থেকে শতভাগ পর্যন্ত এলসি মার্জিন নেওয়ার কথা বলা হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তা কার্যকর করা যায়নি। গ্রাহক ধরে রাখতে ব্যাংকগুলো এসব ক্ষেত্রে নমনীয়তা দেখাচ্ছে। তিনি বলেন, নতুন শিল্প স্থাপন বা কারখানার পরিধি বাড়ানোর অন্যতম অনুষঙ্গ মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি। এটা ধারাবাহিকভাবে কমছে। শিল্পে ব্যবহৃত কাঁচামাল আমদানিও কমছে। বিভিন্ন নিয়মে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তুলনামূলক স্বচ্ছ উপায়ে ব্যবসা করেন এমন গ্রাহক। সূত্র : সমকাল।

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

ডলার সংকট কাটছে না, চাপ বেড়েছে ব্যবসায়

প্রকাশের সময় : ০২:৫০:০৩ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৮ জানুয়ারী ২০২৪

ভাঙা পাথর আমদানির জন্য বেসরকারি ন্যাশনাল ব্যাংকে এলসি খুলেছিল ইনফ্রাটেক কনস্ট্রাকশন। এলসি খোলার সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনামতো গ্রাহকের কাছ থেকে শতভাগ নগদ মার্জিন হিসেবে দুই কোটি টাকা জমা নেয় ব্যাংক। তা নেওয়া হয় ব্যাংকেরই দেওয়া ঋণের টাকা থেকে। পণ্য দেশে আসার আগেই ফেব্রুয়ারিতে এলসি মার্জিনের পুরো টাকা তুলে নেওয়ার সুযোগ দেয় ব্যাংক। ব্যাংকের সঙ্গে ভালো সম্পর্কের সুবাদে ইনফ্রাটেকের মতো অনেক কোম্পানিই নানা কৌশলে আমদানি করছে বিলাসী পণ্য। অন্য সব পণ্যের চেয়ে মূলধনি যন্ত্রপাতি ও শিল্পে ব্যবহৃত কাঁচামাল আমদানি কমছে বেশি।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ব্যাংকগুলোর সহজে ব্যবসা আসে বিলাসী ও প্রস্তুত করা পণ্যের মতো ট্রেডিং খাত থেকে। এসব খাতের ব্যবসায়ীরা তুলনামূলকভাবে সমাজের প্রভাবশালী এবং ব্যাংকের মালিকপক্ষের সঙ্গে বেশি সম্পৃক্ত। আবার উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রভাব গাড়ি, টিভি, ফ্রিজের মতো ক্রেতাদের ওপর কম। ফলে এসব পণ্যের আমদানি কমানো যায়নি। আবার ডলার বাজার নিয়ন্ত্রণে অর্থ পাচার ও হুন্ডি ঠেকানোর চেয়ে অনেক ক্ষেত্রে ব্যাংকের ওপর বিভিন্ন সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে একের পর এক সিদ্ধান্ত নিলেও তেমন সুফল মেলেনি। অনেক ক্ষেত্রে সংকট বেড়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে কমে এখন ২০ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মধ্যস্থতায় আমদানিতে ডলারের দর ১১০ টাকা ঠিক করা হলেও ব্যবসায়ীদের কিনতে হচ্ছে ১২৩ থেকে ১২৪ টাকায়। বাড়তি টাকা পরিশোধ করতে হচ্ছে নানা অনৈতিক উপায়ে। সব মিলিয়ে ব্যবসায়ীদের ওপর চাপ আরও বেড়েছে।

ব্যবসা-বাণিজ্য ছাড়াও চিকিৎসা, শিক্ষা, ভ্রমণসহ বিভিন্ন কাজে দেশের বাইরে যাওয়ার সময় অনেকে ডলার পাচ্ছেন না। আবার হাতে থাকা কিংবা প্রবাসীদের ধরে রাখা ডলার ব্যাংকে আনতে প্রবাসীর সুবিধাভোগী ও বিদেশফেরতদের ডলার জমার ওপর উচ্চ সুদ দেওয়া হচ্ছে। তবে এসব ক্ষেত্রেও সাড়া নেই। এ রকম বাস্তবতায় আইএমএফের পরামর্শে আগামী দিনে ডলার বেচাকেনার নতুন পদ্ধতি ‘ক্রলিং পেগ’ চালুর ঘোষণা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ উপায়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের একটি মধ্যবর্তী দর ঠিক করবে। তার সঙ্গে সর্বোচ্চ বৃদ্ধি ও হ্রাসের একটি শতাংশ নির্ধারণ করা হবে।

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি আবুল কাশেম খান সমকালকে বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন উদ্যোগ নিলেও ডলার বাজারে স্বস্তি ফেরেনি; বরং দিন দিন সংকট আরও বাড়ছে। ব্যাংকের সঙ্গে যাদের ভালো সম্পর্ক, শুধু তারাই আমদানির জন্য ডলার পাচ্ছেন। ব্যক্তি পর্যায়ে ডলার কিনতেও বেগ পেতে হচ্ছে। তিনি বলেন, কৃত্রিমভাবে ডলারের দর নির্ধারণ করে রাখায় ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে অনেক বেশি দর পাওয়া যাচ্ছে। অনেকে এখন দেশের বাইরে থেকে ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে অর্থ নিয়ে আসছেন। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেসব উদ্যোগ নিয়েছে, সেখানে সংস্কার দরকার। রপ্তানি ও রেমিট্যান্স কীভাবে বাড়ানো যায়, সেদিকে জোর দেওয়া দরকার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থায় অর্থবছরের পর এবারও আমদানি কমছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে বিভিন্ন পণ্য আমদানির জন্য এলসি নিষ্পত্তি ১৮ শতাংশের বেশি কমে ৩ হাজার ৩৬৮ কোটি ডলারে নেমেছে। সবচেয়ে বেশি কমেছে শিল্পের কাঁচামাল ও মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানি। ডিসেম্বর পর্যন্ত শিল্পের কাঁচামালের এলসি ৩১ শতাংশের বেশি কমে ১ হাজার ৫৪ কোটি ডলারে নেমেছে। মূলধনি যন্ত্রপাতির এলসি নিষ্পত্তি প্রায় ২৭ শতাংশ কমে ১৪৩ কোটি ডলারে নেমেছে। অর্থবছর আমদানি ১৬ শতাংশের মতো কমে ৬ হাজার ৯৫০ কোটি ডলারে নেমেছিল। এর মধ্যে মূলধনি পণ্যের আমদানি ২৪ শতাংশের বেশি এবং মধ্যবর্তী পণ্যের আমদানি প্রায় ২২ শতাংশ কমেছিল। একটি দেশের উৎপাদন ও কর্মসংস্থান বাড়ছে কিনা, তা বোঝার সহজ উপায় বিবেচনা করা হয় মূলধনি যন্ত্রপাতি ও শিল্পে ব্যবহারিত কাঁচামাল আমদানি কেমন হচ্ছে, তার ওপর। সাম্প্রতিক সময়ে বিলাসী পণ্যের চেয়ে এ দুটি পণ্যের আমদানি কমছে বেশি হারে।

১৭ জানুয়ারি মুদ্রানীতি ঘোষণা অনুষ্ঠানে বিলাসী পণ্যের চেয়ে উৎপাদনশীল খাতের পণ্য আমদানি বেশি কমার বিষয়ে এক সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে আমদানি নিয়ন্ত্রণ ছাড়া বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার কারণে কোনো পণ্যের আমদানি সরাসরি নিষিদ্ধ করা অনেক কঠিন।

বেসরকারি একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, আমদানি কমিয়ে ডলার বাজার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা অর্থনীতির জন্য হিতে বিপরীত হয়েছে। এতে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমছে, সরকার রাজস্ব হারানোর পাশাপাশি ব্যাংকের আয়ও কমে যাচ্ছে। অনেক বড় কোম্পানি মুনাফা বা বিনিয়োগের অর্থ ফেরত নিতে পারছে না। এসব কারণে নতুন শিল্প গড়ে উঠছে কম। কাঁচামাল আনতে না পেরে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কোনো কোনো কারখানায় সক্ষমতার অর্ধেক কার্যক্রম চালাচ্ছে। আগামীতে এসব কারখানা খেলাপি হলেও কিছু বলার থাকবে না। আবার নতুন কর্মসংস্থান কমবে। নতুন করে অনেকে বেকার হবে। দীর্ঘ মেয়াদে রপ্তানি আয় কমবে। এ ছাড়া নগদ সহায়তা নেওয়ার জন্য নানা কৌশলে অনেকে ভুয়া রপ্তানি দেখাবে। ফলে শুধু আমদানি নিয়ন্ত্রণ না করে অর্থ পাচার ঠেকানোর ওপর জোর দিতে হবে। যে করেই হোক রপ্তানি ও রেমিট্যান্স বাড়াতে হবে।

জানতে চাইলে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ডলার বাজার তখনই ঠিক হয়েছে বলা যাবে, যখন আন্তঃব্যাংক কার্যকর হবে। তবে এখনও আন্তঃব্যাংকে ডলার বেচাকেনা হচ্ছে না। যে যার প্রয়োজন অনুযায়ী রেমিট্যান্স কিনছে বা রপ্তানি আয় দেশে আনছে।

গবেষণা সংস্থা পিআরআইর নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার বাজার ঠিক করতে একেক সময় একেক রকম সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে এসব সিদ্ধান্ত বাজারকে আরও অস্থিতিশীল করেছে। একবার ব্যাংকের মাধ্যমে দর ঠিক করে দেওয়া হচ্ছে। আবার বলা হচ্ছে, রেমিটার থেকে ব্যাংক যে দরে ডলার কিনবে, আমদানিকারকের কাছে তার চেয়ে কম দরে বিক্রি করতে পারবে। একটি ব্যাংক কেন দেখা চোখে লোকসানে বিক্রি করবে। তিনি বলেন, আমদানিকারকরা তো বাজারভিত্তিক ধরে ডলার কিনছে। ফলে পরিস্থিতি ঠিক করতে ডলারের দর বাজারভিত্তিক করতে হবে। একই সঙ্গে অর্থ পাচার ঠেকাতে কঠোর হতে হবে। বৈধ চ্যানেলে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স বাড়াতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. মেজবাউল হক অবশ্য বলেন, ডলার বাজারে চাপ অনেক কমেছে। রমজানে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১০ থেকে ১৫ শতাংশ বেড়েছে।

ডলার বাজারে সংকট শুরু হয় মূলত ২০২১ সালের আগস্টের পর। সংকট কাটাতে ওই সময় থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ২৯ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতেও কাজ না হওয়ায় ২০২২ সালের মাঝামাঝি থেকে আমদানি নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেয় সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক। প্রথমে শুল্ক বাড়ানো ও শতভাগ এলসি মার্জিন আরোপ করা হয়। এর পর প্রতিটি বড় এলসি যাচাই শুরু করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতেও কাজ না হওয়ায় ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মধ্যস্থতায় ডলারের একটি দর ঠিক করে দিচ্ছে এবিবি ও বাফেদা।

তবে বেশির ভাগ ব্যাংক এ দরে ডলার না পেয়ে বেশি দরে বেচাকেনা করছে। এ নিয়ে  সেপ্টেম্বরে ১০ ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধানকে ১ লাখ টাকা করে জরিমানা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর পর বাজারে আতঙ্ক ছড়িয়ে ডলার আয় আরও কমে যায়। শেষ পর্যন্ত তাতেও কাজ না হওয়ায় শেষ সময়ে ব্যাংকগুলো যে দরে রেমিট্যান্স কিনবে, তার চেয়ে কমে বিক্রির কথা বলা হয়। তবে এটিও বাস্তবসম্মত বা টেকসই না হওয়ায় তাতেও সাড়া মেলেনি। বেশির ভাগ ব্যাংক এখনও ঘোষণার চেয়ে বেশি দরে ডলার বেচাকেনা অব্যাহত রেখেছে। বরং এ সমস্যা দিনে দিনে প্রকট হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন-সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, আমদানি নিয়ন্ত্রণের কৌশল তেমন কাজে আসেনি। বরং আন্ডার ইনভয়েসিং বেড়ে সরকারের রাজস্ব আয় কমেছে। বাকি অর্থ অবৈধ উপায়ে পরিশোধের জন্য হুন্ডিতে ডলারের চাহিদা বেড়েছে। তিনি বলেন, ব্যাংকগুলোকে ব্যবসায়ীর নিজস্ব উৎস থেকে শতভাগ পর্যন্ত এলসি মার্জিন নেওয়ার কথা বলা হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তা কার্যকর করা যায়নি। গ্রাহক ধরে রাখতে ব্যাংকগুলো এসব ক্ষেত্রে নমনীয়তা দেখাচ্ছে। তিনি বলেন, নতুন শিল্প স্থাপন বা কারখানার পরিধি বাড়ানোর অন্যতম অনুষঙ্গ মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি। এটা ধারাবাহিকভাবে কমছে। শিল্পে ব্যবহৃত কাঁচামাল আমদানিও কমছে। বিভিন্ন নিয়মে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তুলনামূলক স্বচ্ছ উপায়ে ব্যবসা করেন এমন গ্রাহক। সূত্র : সমকাল।