জাপান-বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব চুক্তি যেসব কারণে গুরুত্বপূর্ণ
- প্রকাশের সময় : ০১:০৮:৪৭ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৩১ জানুয়ারী ২০২৪
- / ৫২ বার পঠিত
জাপান ও বাংলাদেশ ২০২৫ সাল নাগাদ অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব চুক্তি চূড়ান্ত করতে আলোচনা শুরুর অপেক্ষায় আছে। ২০২৬ সালে জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশগুলোর তালিকা থেকে বেরিয়ে গেলে উন্নত দেশগুলোতে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত সুবিধা আর পাবে না। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশ ‘ক্ষয়িষ্ণু গণতন্ত্রের’ দেশ। কিন্তু এর মিত্র দেশ জাপানের কাছে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ১৭ কোটির বেশি জনসংখ্যার এই দেশের অবস্থান। বাংলাদেশ এমন এক দেশ, যার জিডিপি ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম ও মালয়েশিয়ার সম্মিলিত জিডিপির চেয়ে বড়।
সরকার নিয়ে আপত্তি থাকলেও চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠতর অর্থনৈতিক সম্পর্ক যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের দ্বিধায় ফেলছে। তারা বাংলাদেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে চাইলেও বাণিজ্য সম্প্রসারণ ও অবকাঠামো উন্নয়নে সহযোগিতার করার ব্যাপারে জাপানকে উৎসাহিত করেছে। আর এ সবই হচ্ছে ভারতের সহযোগিতায়। ২০২৩ সালের মার্চ মাসে জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদার নয়াদিল্লি সফরের পর মাতারবাড়ী বন্দর উন্নয়ন প্রকল্প, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক উন্নয়ন প্রকল্প এবং ঢাকার উত্তরে ছোট রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পের জন্য জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) বাংলাদেশকে ১১২ কোটি ডলার নতুন ঋণ দিতে সম্মত হয়েছে।
উত্তর-পূর্ব ভারতেও সক্রিয় আছে জাইকা। মহাসড়কসহ ত্রিপুরা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত শত শত কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণ ও উন্নয়নে অর্থায়ন করছে জাইকা। মাতারবাড়ী প্রকল্পের আওতায় আছে খননের মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রথম গভীর নৌবন্দর নির্মাণ এবং কক্সবাজারে বিদ্যুৎকেন্দ্র ও শিল্প পার্ক নির্মাণ। সেখান থেকে চট্টগ্রামে যাওয়ার রাস্তা উন্নত হলে ঢাকা ও বাংলাদেশের অন্যান্য অংশ এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্য থেকে পণ্য পরিবহন সহজতর হবে। সুমিটোমো করপোরেশন, তোশিবা ও আইএইচআই এই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে। গভীর নৌবন্দরটি ২০২৭ সালে চালু হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এপ্রিলে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলায় তৃতীয় ভারত-জাপান উচ্চপর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়, যাতে উত্তর-পূর্ব ভারত ও বাংলাদেশকে ঘিরে এই অঞ্চলের বাণিজ্যিক সম্ভাবনা উপলব্ধি করার উপায় নিয়ে আলোচনা করা হয়। ভারত ও বাংলাদেশের উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী, ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী এবং ভারতে জাপানের রাষ্ট্রদূত সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। পরে এপ্রিলে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদার সঙ্গে বৈঠকের জন্য জাপানে যান। তখন এক যৌথ বিবৃতিতে ২০১৪ সালে দুই দেশের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত অংশীদারত্বকে পরবর্তী ৫০ বছরের জন্য ‘কৌশলগত অংশীদারত্বে’ উন্নীত করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়।
অর্থনৈতিক দিক থেকে বাংলাদেশ এবং এর আশপাশের অঞ্চলের উন্নয়নে ‘স্বচ্ছ ও ন্যায্য’ অর্থায়নের মাধ্যমে উচ্চমানের অবকাঠামো নির্মাণের দিকে গুরুত্ব দিয়েছেন তারা। মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্পের ক্ষেত্রে লজিস্টিক, জ্বালানি ও শিল্পের দিকগুলো বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তিতে সহযোগিতার কথাও বলা হয়েছে।
২০২২ সালে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ৫০তম বার্ষিকীতে বে অব বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ বেল্ট উদ্যোগের অধীনে অগ্রগতি এবং বাংলাদেশের প্রথম বৈদ্যুতিক ট্রেন, ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট লাইন ৬-এর উদ্বোধনে উভয় রাষ্ট্রপ্রধানই তাদের সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট লাইন-৬ নির্মাণে সহযোগিতা করেছিল জাইকা। জাপান বাংলাদেশকে সাইবার সিকিউরিটিতে তার দক্ষতাও দেবে। ২২ জানুয়ারি ঢাকা সফরকালে জাপানের অর্থনীতি, বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রী ইয়াসুতোশি নিশিমুরা বলেন, জাপান পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপনের জন্য বাংলাদেশের সঙ্গে একটি অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব চুক্তি করতে চায়। বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ায় অনুকূল শুল্কব্যবস্থা চালু হয়েছে। এই মন্তব্যের সঙ্গে নির্বাচনের সম্পর্ক ছিল না, এটি ছিল দীর্ঘদিনের নীতির ধারাবাহিকতার প্রকাশ।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা ঘোষণার পর থেকে জাপান বাংলাদেশকে বৈদেশিক উন্নয়ন সহায়তার ক্ষেত্রে বৃহত্তম দাতা দেশ ছিল। কিন্তু জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে ২০১৪ সালে এই সম্পর্ককে নতুন উচ্চাতায় নিয়ে যান। উন্মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিক ধারণাও তার সৃষ্টি। সে বছরের মে মাসে টোকিওতে অনুষ্ঠিত এক শীর্ষ বৈঠকে জাপান-বাংলাদেশ সমন্বিত অংশীদারত্বের বিষয়ে সমঝোতায় পৌঁছেছিল। বে অব বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ বেল্ট নির্মাণসহ ভবিষ্যৎ প্রকল্পের বিষয়ে আলোচনা করতে জাইকার প্রেসিডেন্ট এরপর জুন মাসে বাংলাদেশ সফর করেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় নিরাপত্তা সহযোগিতা, উন্নয়ন সহায়তা, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ নিয়ে আলোচনা করতে ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে শিনজো আবে বাংলাদেশ সফর করেন। টেক্সটাইলের ওপর নির্ভরতা কমাতে এবং উৎপাদন মূল্যশৃঙ্খলে এগিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই বন্দর ও পানি নিয়ন্ত্রণ সুবিধা, সড়ক, রেলপথ, সেতু, বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং অন্যান্য অবকাঠামোগত উন্নয়নের কথা প্রচার করছে। বৈদেশিক সাহায্য অব্যাহত রেখে বাণিজ্য বৃদ্ধি এবং আরও অবকাঠামো চুক্তি স্বাক্ষরের ব্যাপারে আশাবাদী ছিল জাপান। জাপান এক্সটার্নাল ট্রেড অর্গানাইজেশন (জেট্রো) উল্লেখ করেছে যে, বাংলাদেশে কাজ করা জাপানি কোম্পানির সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে ৩৪০টিতে উন্নীত হয়েছে।
জাপানের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি বেশ। রপ্তানির চেয়ে আমদানি প্রায় ৬০ শতাংশ বেশি। বাংলাদেশের মাঝারি আকারের বাণিজ্য অংশীদার হচ্ছে জাপান। তবে অবকাঠামো, নকশা ও নির্মাণ পরিষেবাগুলোর ক্ষেত্রে জাপানই বাংলাদেশের বৃহত্তম সরবরাহকারী দেশ। জাপানের সঙ্গে সহযোগিতা চীনের ওপর বাংলাদেশের নির্ভরশীলতা কমাতে পারে। পাশাপাশি ভারত, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের সঙ্গে সম্পর্ক নতুন করে সাজানোর সুযোগও দেয়। জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর জাপানের সঙ্গে এই ভারসাম্যমূলক চুক্তি বাংলাদেশের জন্য আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। সূত্র : আজকের পত্রিকা।