নিউইয়র্ক ১১:১০ অপরাহ্ন, রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

শিল্প-কৃষিতে বাড়বে খরচ ভোক্তার কপালে ভাঁজ

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০২:৫৩:৩৮ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২ মার্চ ২০২৪
  • / ১০২ বার পঠিত

গ্যাসের দাম বাড়ানোর দু’দিনের মাথায় বাড়ানো হয় পাইকারি ও খুচরা বিদ্যুতের দাম। পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম ৫ শতাংশ এবং খুচরা পর্যায়ে বেড়েছে ৮ দশমিক ৫ শতাংশ। প্রান্তিক গ্রাহক থেকে শুরু করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কৃষি, শিল্প– সব খাতেই বেড়েছে দাম। এ নিয়ে গত দেড় দশকে পাইকারি পর্যায়ে ১২ বার ও খুচরা পর্যায়ে ১৪ বার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলো। এমন পরিস্থিতিতে ছোট-বড় ও মাঝারি শিল্পকারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে তৈরি পোশাকের মতো রপ্তানিমুখী শিল্পে উৎপাদন হ্রাসে চাপ বাড়বে অর্থনীতিতে। অন্যদিকে দেশের কৃষি পড়েছে বড় সংকটে। এমনিতেই সার-ডিজেলসহ সব কৃষি উপকরণরে দাম বেড়েছে, তার ওপর বিদ্যুতের দাম বাড়ায় চলতি বোরো মৌসুমে আবাদ নিয়ে কৃষকের কপালে পড়েছে চিন্তার ভাঁজ।

বোরো আবাদ প্রায় পুরোটাই সেচনির্ভর। ফলে বিদ্যুতের দাম বাড়ায় সেচ নিয়ে বিপাকে কৃষক। গত বছর কয়েক দফা বিদ্যুৎ, সার, ডিজেল-কেরোসিনের নজিরবিহীন মূল্যবৃদ্ধির পর চলতি বছর আবারও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দেখা দিয়েছে। একই রকম চাপে পড়েছে পোলট্রি ও ডেইরি খাত। দেশের বাজারে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি কৃষি ও খাদ্যপণ্যের সরবরাহ চেইনে ঋণাত্মক প্রভাব ফেলবে বলে আশঙ্কা করছেন বাজার-সংশ্লিষ্টরা। সে ক্ষেত্রে গোটা অর্থনীতিতেই এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে অর্থনীতিবিদরাও আশঙ্কা করছেন।

খুচরা ও পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম ফের বাড়ানোয় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন শিল্পোদ্যোক্তারা। তারা বলেছেন, এর আগে কয়েক দফায় গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানো এবং ডলার সংকটসহ অন্যান্য কারণে অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠানের অবস্থা এমনিতেই ভালো নয়। বিদ্যুতের দাম আরেক দফা বাড়ায় উৎপাদন খরচ আরও বাড়বে। এটি আন্তর্জাতিক বাজারে দেশের রপ্তানিমুখী শিল্পের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমাবে। বাড়বে স্থানীয় বাজারের জন্য উৎপাদিত ভোগ্যপণ্যের দামও। বিদ্যুতের দাম বাড়ার কারণে পণ্যের উৎপাদন খরচ আরও ৫ থেকে ৭ শতাংশ বাড়তে পারে। সব মিলিয়ে এ মুহূর্তে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো মোটেই ঠিক হয়নি বলে মনে করেন শিল্পোদ্যোক্তারা।

ভুগছে শিল্প খাত
বিশ্লেষকদের মতে, ডলার সংকট ও উচ্চ মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতির কারণে প্রায় এক বছর ধরে ভুগছে শিল্প খাত। এর ওপর দফায় দফায় গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি শঙ্কায় ফেলছে শিল্পোদ্যোক্তাদের। ডলার সংকটের কারণে ২০২২ সালের জুলাই থেকে এলসি খোলায় কড়াকড়ি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাড়তি দর দিয়েও অনেকে এখন এলসি খুলতে পারছেন না। ডলারের অভাবে আমদানি কমার ধারা অব্যাহত আছে। এর প্রভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে নতুন শিল্প স্থাপন ও উৎপাদন।

শিল্প উৎপাদন, নতুন কারখানা স্থাপন ও বিনিয়োগের অবস্থা বোঝার অন্যতম একটি উপায় হচ্ছে কাঁচামাল ও মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানি পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জানুয়ারি পর্যন্ত সাত মাসে এলসি নিষ্পত্তি আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় কমেছে প্রায় সাড়ে ১৫ শতাংশ। এ সময়ে শিল্পে ব্যবহৃত কাঁচামালে এলসি নিষ্পত্তি কমেছে প্রায় ২৮ শতাংশ। আর মূলধনি যন্ত্রপাতিতে কমেছে সাড়ে ২৬ শতাংশ। যদিও নতুন এলসি খোলার পরিমাণ কিছুটা বেড়েছে।

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, বিদ্যুতের দাম বাড়লে তা উৎপাদন পর্যায়ে কিছুটা প্রভাব ফেলবে। উৎপাদন ব্যয় বাড়লে তা উৎপাদিত পণ্যের দরকেও বাড়িয়ে দেবে। যার চাপ পড়বে সরাসরি ভোক্তাসাধারণের ওপর।

সরকার পণ্যের দর কমানোর কথা বলছে, কিন্তু উৎপাদন ব্যয় বাড়লে পণ্যের দর কমবে কীভাবে– এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সরকার ভর্তুকি কমিয়ে আনতে চাইছে। ধীরে ধীরে সরকার ভর্তুকি দেওয়া থেকে বের হয়ে আসবে। সেই প্রক্রিয়া থেকেই বিদ্যুতের দর বাড়ানো হলো। তবে এফবিসিসিআই চায়, দাম বাড়লেও শিল্পকারখানায় যেন বিদ্যুৎ ও গ্যাসের নির্বিঘ্ন সরবরাহ থাকে। উৎপাদন পর্যায়ে যাতে কোনো বাধা তৈরি না হয়। উৎপাদন ঠিক থাকলে সরবরাহ ব্যবস্থায় ঘাটতি হবে না, যা দাম নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখবে।

শিল্প খাতে বিদ্যুতের সবচেয়ে বড় ভোক্তা তৈরি পোশাক খাত। এই খাতের রপ্তানিকারক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, এই মুহূর্তে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো একেবারেই ঠিক হয়নি। কারণ, এতে রপ্তানিমুখী শিল্পের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে। যার ফলে রপ্তানি বাজারে শিল্পের সক্ষমতা আরও কমে যাবে। আগে থেকেই দফায় দফায় গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কারণে শিল্পের পরিস্থিতি ভালো নয়। এ ছাড়া নতুন করে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কারণে স্থানীয় শিল্পের উৎপাদন ব্যয় বাড়বে।

দেশের অন্যতম শীর্ষ ভোগ্যপণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের জ্যেষ্ঠ সহকারী ব্যবস্থাপক তাসলিম শাহরিয়ার বলেন, শিল্পকারখানায় বৃহৎ আকারে বিদ্যুতের ব্যবহার হয়। বিদ্যুতের দাম বাড়ার কারণে পণ্যের উৎপাদন খরচ পাঁচ থেকে সাত শতাংশ বাড়তে পারে। তবে উৎপাদিত পণ্যে এর কী ধরনের প্রভাব পড়বে, তা পর্যালোচনা চলছে।

বস্ত্র খাতের উদ্যোক্তারা মনে করেন নতুন করে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কারণে বড় ধরনের সংকটে পড়বে শিল্প। এ বিষয়ে বস্ত্রকল মালিকদের সংগঠন বিটিএমএর পরিচালক খোরশেদ আলম বলেন, আমার একটি স্পিনিং কারখানায় প্রতি মাসে বিদ্যুৎ বিল আসে ৩৫ লাখ টাকা। বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির কারণে অতিরিক্ত ৩ লাখ টাকা বিল আসবে। এভাবে উইভিং, ডাইং– সব পর্যায়ে পৃথকভাবে ব্যয় বাড়বে। শেষ পর্যন্ত এতে এক গজ কাপড়ের উৎপাদন ব্যয় বাড়বে ৬ টাকা। অথচ বিদেশি ক্রেতারা এক পয়সাও দর বাড়াচ্ছে না। এমনিতেই ডলারের দাম, তুলার দাম, মজুরি– সবকিছুই বেড়েছে, যা উৎপাদন ব্যয় অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। এ অবস্থায় বস্ত্র খাত টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। এককালের প্রধান পণ্য পাটের মতো পরিণতি হতে যাচ্ছে বস্ত্র খাতের।

সংকটে কৃষি, ডেইরি ও পোলট্রি
দেশের বেশির ভাগ এলাকায় এখন চলছে বোরো ধান আবাদ। জমিতে চলছে সেচের কাজ। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানিয়েছে, দেশে উৎপাদিত ধানের প্রায় ৬০ শতাংশ আসে বোরো মৌসুম থেকে। এবার ৬৭ হাজার হেক্টর জমিতে এ ফসলের আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি লক্ষ্যমাত্রা। এর আগে গত বছর ২০২৩ সালে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬৫ হাজার ৫০০ হেক্টর জমি, তবে চাষাবাদ হয়েছে ৬৬ হাজার ৪০৫ হেক্টর জমিতে।

বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) বলছে, বোরো ধান ও রবিশস্য প্রায় পুরোটাই সেচনির্ভর। দেশে কৃষকের সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৯৭ লাখ ৭৯ হাজার। এর মধ্যে সেচযন্ত্রের আওতায় ১ কোটি ৯৬ লাখ ৪৬ হাজার ৬৪০ জন। শুধু বিদ্যুৎচালিত সেচভুক্ত কৃষক রয়েছেন ৭৩ লাখেরও বেশি। বাকিরা ডিজেলচালিত সেচভুক্ত। ২০২২ সালে ডিজেল, কেরোসিন ও সারের দাম বাড়ার ফলে বোরোতে খরচ বেড়েছে ২ হাজার ৯১৪ কোটি টাকা। এর সঙ্গে গত বছর নতুন করে বিদ্যুতের দাম বাড়ার ফলে প্রতি ইউনিটে খরচ বাড়ে গড়ে ৫ শতাংশ। এবার নতুন করে সেচে ৮৩ পয়সা পর্যন্ত দাম বাড়ানোর কারণে সেচের খরচ বেড়ে গেলে তা বাড়তি চাপ তৈরি করবে।

কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমানে প্রতিটি কৃষি উপকরণের দাম আকাশছোঁয়া। উৎপাদন খরচ বাড়লেও পণ্যের ন্যায্য দাম পান না কৃষক। কৃষিনির্ভর অর্থনীতির এ দেশে কৃষক না বাঁচলে উৎপাদন ব্যাহত হবে এবং হুমকিতে পড়বে খাদ্য নিরাপত্তা। তবে সরকার বলছে, তারা কৃষকের পাশে আছে। বিনামূল্যে বীজসহ নানা উপকরণ দেওয়া হচ্ছে। ভর্তুকি বাড়ানো হয়েছে। দাম বৃদ্ধির প্রভাব কৃষক পর্যায়ে পড়বে না। এ বিষয়ে কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুস শহীদ সমকালকে বলেন, কৃষককে নানা রকম সহায়তা দিচ্ছে সরকার। বোরো ধানের আবাদ ও উৎপাদন বাড়ানোর জন্য প্রায় ১০৮ কোটি টাকার প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে।

কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, অস্থির বৈশ্বিক খাদ্যবাজার পরিস্থিতিতে সেচের বিষয়টি আমাদের প্রধান খাদ্যশস্য ধানের উৎপাদন ও দেশের খাদ্য নিরাপত্তার সঙ্গে সম্পৃক্ত। তাই এ বিষয়ে সরকারের বিশেষ নজর দেওয়া উচিত। তা না হলে উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।

নতুন করে আবারও বিদ্যুতের দাম বাড়ার ফলে কৃষির পাশাপাশি সংকটে ফেলেছে পোলট্রি ও ডেইরি খামারিদের। তারা বলছেন, এমনিতেই পোলট্রি খাবারের দাম বাড়ার কারণে এ খাতের ব্যবসায়ীরা সংকটে রয়েছেন। বিদ্যুতের দাম বাড়ার ফলে সেই সংকট আরও বেড়ে গেছে। এতে শুধু খামারের উৎপাদন খরচ বাড়বে না, মুরগি পালনের অন্য কাঁচামালের দামও বাড়বে। এ চাপ সামাল দিতে হবে খামারিদের। তাতে অনেক খামার বন্ধও হয়ে যেতে পারে।

বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিডিএফএ) সভাপতি মোহাম্মদ ইমরান হোসেন বলেন, প্রাণিজ খাদ্য ও জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার চাপ সামলাতে না পেরে অনেক খামার বন্ধ হয়ে গেছে। ডেইরি ও পোলট্রি খাতে বিদ্যুৎ বিল কৃষি শ্রেণির আওতাভুক্ত করার দাবি জনালেও কেউ আমাদের কথা শুনছে না। আমরা বাণিজ্যিক শ্রেণিতে বিল পরিশোধ করে আসছি। এখন আমাদের বিপদ আরও বেড়ে গেল। সূত্র : সমকাল।

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

শিল্প-কৃষিতে বাড়বে খরচ ভোক্তার কপালে ভাঁজ

প্রকাশের সময় : ০২:৫৩:৩৮ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২ মার্চ ২০২৪

গ্যাসের দাম বাড়ানোর দু’দিনের মাথায় বাড়ানো হয় পাইকারি ও খুচরা বিদ্যুতের দাম। পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম ৫ শতাংশ এবং খুচরা পর্যায়ে বেড়েছে ৮ দশমিক ৫ শতাংশ। প্রান্তিক গ্রাহক থেকে শুরু করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কৃষি, শিল্প– সব খাতেই বেড়েছে দাম। এ নিয়ে গত দেড় দশকে পাইকারি পর্যায়ে ১২ বার ও খুচরা পর্যায়ে ১৪ বার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলো। এমন পরিস্থিতিতে ছোট-বড় ও মাঝারি শিল্পকারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে তৈরি পোশাকের মতো রপ্তানিমুখী শিল্পে উৎপাদন হ্রাসে চাপ বাড়বে অর্থনীতিতে। অন্যদিকে দেশের কৃষি পড়েছে বড় সংকটে। এমনিতেই সার-ডিজেলসহ সব কৃষি উপকরণরে দাম বেড়েছে, তার ওপর বিদ্যুতের দাম বাড়ায় চলতি বোরো মৌসুমে আবাদ নিয়ে কৃষকের কপালে পড়েছে চিন্তার ভাঁজ।

বোরো আবাদ প্রায় পুরোটাই সেচনির্ভর। ফলে বিদ্যুতের দাম বাড়ায় সেচ নিয়ে বিপাকে কৃষক। গত বছর কয়েক দফা বিদ্যুৎ, সার, ডিজেল-কেরোসিনের নজিরবিহীন মূল্যবৃদ্ধির পর চলতি বছর আবারও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দেখা দিয়েছে। একই রকম চাপে পড়েছে পোলট্রি ও ডেইরি খাত। দেশের বাজারে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি কৃষি ও খাদ্যপণ্যের সরবরাহ চেইনে ঋণাত্মক প্রভাব ফেলবে বলে আশঙ্কা করছেন বাজার-সংশ্লিষ্টরা। সে ক্ষেত্রে গোটা অর্থনীতিতেই এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে অর্থনীতিবিদরাও আশঙ্কা করছেন।

খুচরা ও পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম ফের বাড়ানোয় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন শিল্পোদ্যোক্তারা। তারা বলেছেন, এর আগে কয়েক দফায় গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানো এবং ডলার সংকটসহ অন্যান্য কারণে অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠানের অবস্থা এমনিতেই ভালো নয়। বিদ্যুতের দাম আরেক দফা বাড়ায় উৎপাদন খরচ আরও বাড়বে। এটি আন্তর্জাতিক বাজারে দেশের রপ্তানিমুখী শিল্পের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমাবে। বাড়বে স্থানীয় বাজারের জন্য উৎপাদিত ভোগ্যপণ্যের দামও। বিদ্যুতের দাম বাড়ার কারণে পণ্যের উৎপাদন খরচ আরও ৫ থেকে ৭ শতাংশ বাড়তে পারে। সব মিলিয়ে এ মুহূর্তে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো মোটেই ঠিক হয়নি বলে মনে করেন শিল্পোদ্যোক্তারা।

ভুগছে শিল্প খাত
বিশ্লেষকদের মতে, ডলার সংকট ও উচ্চ মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতির কারণে প্রায় এক বছর ধরে ভুগছে শিল্প খাত। এর ওপর দফায় দফায় গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি শঙ্কায় ফেলছে শিল্পোদ্যোক্তাদের। ডলার সংকটের কারণে ২০২২ সালের জুলাই থেকে এলসি খোলায় কড়াকড়ি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাড়তি দর দিয়েও অনেকে এখন এলসি খুলতে পারছেন না। ডলারের অভাবে আমদানি কমার ধারা অব্যাহত আছে। এর প্রভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে নতুন শিল্প স্থাপন ও উৎপাদন।

শিল্প উৎপাদন, নতুন কারখানা স্থাপন ও বিনিয়োগের অবস্থা বোঝার অন্যতম একটি উপায় হচ্ছে কাঁচামাল ও মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানি পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জানুয়ারি পর্যন্ত সাত মাসে এলসি নিষ্পত্তি আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় কমেছে প্রায় সাড়ে ১৫ শতাংশ। এ সময়ে শিল্পে ব্যবহৃত কাঁচামালে এলসি নিষ্পত্তি কমেছে প্রায় ২৮ শতাংশ। আর মূলধনি যন্ত্রপাতিতে কমেছে সাড়ে ২৬ শতাংশ। যদিও নতুন এলসি খোলার পরিমাণ কিছুটা বেড়েছে।

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, বিদ্যুতের দাম বাড়লে তা উৎপাদন পর্যায়ে কিছুটা প্রভাব ফেলবে। উৎপাদন ব্যয় বাড়লে তা উৎপাদিত পণ্যের দরকেও বাড়িয়ে দেবে। যার চাপ পড়বে সরাসরি ভোক্তাসাধারণের ওপর।

সরকার পণ্যের দর কমানোর কথা বলছে, কিন্তু উৎপাদন ব্যয় বাড়লে পণ্যের দর কমবে কীভাবে– এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সরকার ভর্তুকি কমিয়ে আনতে চাইছে। ধীরে ধীরে সরকার ভর্তুকি দেওয়া থেকে বের হয়ে আসবে। সেই প্রক্রিয়া থেকেই বিদ্যুতের দর বাড়ানো হলো। তবে এফবিসিসিআই চায়, দাম বাড়লেও শিল্পকারখানায় যেন বিদ্যুৎ ও গ্যাসের নির্বিঘ্ন সরবরাহ থাকে। উৎপাদন পর্যায়ে যাতে কোনো বাধা তৈরি না হয়। উৎপাদন ঠিক থাকলে সরবরাহ ব্যবস্থায় ঘাটতি হবে না, যা দাম নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখবে।

শিল্প খাতে বিদ্যুতের সবচেয়ে বড় ভোক্তা তৈরি পোশাক খাত। এই খাতের রপ্তানিকারক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, এই মুহূর্তে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো একেবারেই ঠিক হয়নি। কারণ, এতে রপ্তানিমুখী শিল্পের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে। যার ফলে রপ্তানি বাজারে শিল্পের সক্ষমতা আরও কমে যাবে। আগে থেকেই দফায় দফায় গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কারণে শিল্পের পরিস্থিতি ভালো নয়। এ ছাড়া নতুন করে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কারণে স্থানীয় শিল্পের উৎপাদন ব্যয় বাড়বে।

দেশের অন্যতম শীর্ষ ভোগ্যপণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের জ্যেষ্ঠ সহকারী ব্যবস্থাপক তাসলিম শাহরিয়ার বলেন, শিল্পকারখানায় বৃহৎ আকারে বিদ্যুতের ব্যবহার হয়। বিদ্যুতের দাম বাড়ার কারণে পণ্যের উৎপাদন খরচ পাঁচ থেকে সাত শতাংশ বাড়তে পারে। তবে উৎপাদিত পণ্যে এর কী ধরনের প্রভাব পড়বে, তা পর্যালোচনা চলছে।

বস্ত্র খাতের উদ্যোক্তারা মনে করেন নতুন করে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কারণে বড় ধরনের সংকটে পড়বে শিল্প। এ বিষয়ে বস্ত্রকল মালিকদের সংগঠন বিটিএমএর পরিচালক খোরশেদ আলম বলেন, আমার একটি স্পিনিং কারখানায় প্রতি মাসে বিদ্যুৎ বিল আসে ৩৫ লাখ টাকা। বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির কারণে অতিরিক্ত ৩ লাখ টাকা বিল আসবে। এভাবে উইভিং, ডাইং– সব পর্যায়ে পৃথকভাবে ব্যয় বাড়বে। শেষ পর্যন্ত এতে এক গজ কাপড়ের উৎপাদন ব্যয় বাড়বে ৬ টাকা। অথচ বিদেশি ক্রেতারা এক পয়সাও দর বাড়াচ্ছে না। এমনিতেই ডলারের দাম, তুলার দাম, মজুরি– সবকিছুই বেড়েছে, যা উৎপাদন ব্যয় অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। এ অবস্থায় বস্ত্র খাত টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। এককালের প্রধান পণ্য পাটের মতো পরিণতি হতে যাচ্ছে বস্ত্র খাতের।

সংকটে কৃষি, ডেইরি ও পোলট্রি
দেশের বেশির ভাগ এলাকায় এখন চলছে বোরো ধান আবাদ। জমিতে চলছে সেচের কাজ। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানিয়েছে, দেশে উৎপাদিত ধানের প্রায় ৬০ শতাংশ আসে বোরো মৌসুম থেকে। এবার ৬৭ হাজার হেক্টর জমিতে এ ফসলের আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি লক্ষ্যমাত্রা। এর আগে গত বছর ২০২৩ সালে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬৫ হাজার ৫০০ হেক্টর জমি, তবে চাষাবাদ হয়েছে ৬৬ হাজার ৪০৫ হেক্টর জমিতে।

বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) বলছে, বোরো ধান ও রবিশস্য প্রায় পুরোটাই সেচনির্ভর। দেশে কৃষকের সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৯৭ লাখ ৭৯ হাজার। এর মধ্যে সেচযন্ত্রের আওতায় ১ কোটি ৯৬ লাখ ৪৬ হাজার ৬৪০ জন। শুধু বিদ্যুৎচালিত সেচভুক্ত কৃষক রয়েছেন ৭৩ লাখেরও বেশি। বাকিরা ডিজেলচালিত সেচভুক্ত। ২০২২ সালে ডিজেল, কেরোসিন ও সারের দাম বাড়ার ফলে বোরোতে খরচ বেড়েছে ২ হাজার ৯১৪ কোটি টাকা। এর সঙ্গে গত বছর নতুন করে বিদ্যুতের দাম বাড়ার ফলে প্রতি ইউনিটে খরচ বাড়ে গড়ে ৫ শতাংশ। এবার নতুন করে সেচে ৮৩ পয়সা পর্যন্ত দাম বাড়ানোর কারণে সেচের খরচ বেড়ে গেলে তা বাড়তি চাপ তৈরি করবে।

কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমানে প্রতিটি কৃষি উপকরণের দাম আকাশছোঁয়া। উৎপাদন খরচ বাড়লেও পণ্যের ন্যায্য দাম পান না কৃষক। কৃষিনির্ভর অর্থনীতির এ দেশে কৃষক না বাঁচলে উৎপাদন ব্যাহত হবে এবং হুমকিতে পড়বে খাদ্য নিরাপত্তা। তবে সরকার বলছে, তারা কৃষকের পাশে আছে। বিনামূল্যে বীজসহ নানা উপকরণ দেওয়া হচ্ছে। ভর্তুকি বাড়ানো হয়েছে। দাম বৃদ্ধির প্রভাব কৃষক পর্যায়ে পড়বে না। এ বিষয়ে কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুস শহীদ সমকালকে বলেন, কৃষককে নানা রকম সহায়তা দিচ্ছে সরকার। বোরো ধানের আবাদ ও উৎপাদন বাড়ানোর জন্য প্রায় ১০৮ কোটি টাকার প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে।

কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, অস্থির বৈশ্বিক খাদ্যবাজার পরিস্থিতিতে সেচের বিষয়টি আমাদের প্রধান খাদ্যশস্য ধানের উৎপাদন ও দেশের খাদ্য নিরাপত্তার সঙ্গে সম্পৃক্ত। তাই এ বিষয়ে সরকারের বিশেষ নজর দেওয়া উচিত। তা না হলে উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।

নতুন করে আবারও বিদ্যুতের দাম বাড়ার ফলে কৃষির পাশাপাশি সংকটে ফেলেছে পোলট্রি ও ডেইরি খামারিদের। তারা বলছেন, এমনিতেই পোলট্রি খাবারের দাম বাড়ার কারণে এ খাতের ব্যবসায়ীরা সংকটে রয়েছেন। বিদ্যুতের দাম বাড়ার ফলে সেই সংকট আরও বেড়ে গেছে। এতে শুধু খামারের উৎপাদন খরচ বাড়বে না, মুরগি পালনের অন্য কাঁচামালের দামও বাড়বে। এ চাপ সামাল দিতে হবে খামারিদের। তাতে অনেক খামার বন্ধও হয়ে যেতে পারে।

বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিডিএফএ) সভাপতি মোহাম্মদ ইমরান হোসেন বলেন, প্রাণিজ খাদ্য ও জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার চাপ সামলাতে না পেরে অনেক খামার বন্ধ হয়ে গেছে। ডেইরি ও পোলট্রি খাতে বিদ্যুৎ বিল কৃষি শ্রেণির আওতাভুক্ত করার দাবি জনালেও কেউ আমাদের কথা শুনছে না। আমরা বাণিজ্যিক শ্রেণিতে বিল পরিশোধ করে আসছি। এখন আমাদের বিপদ আরও বেড়ে গেল। সূত্র : সমকাল।