প্রশ্নের মুখে বিলিয়ন ডলারের যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ
ডিপসিকের অভিষেকে রাতারাতি টালমাটাল বৈশ্বিক পুঁজিবাজার
- প্রকাশের সময় : ১২:৪৭:১১ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩০ জানুয়ারী ২০২৫
- / ৩০ বার পঠিত
চীনা এআই চ্যাটবট ডিপসিক আর১ উন্মোচনের পর রীতিমতো টালমাটাল প্রযুক্তি দুনিয়া। অবশ্যম্ভাবীভাবে এর প্রভাব পড়েছে বৈশ্বিক পুঁজিবাজারে। কারণ গত কয়েক বছর পুঁজিবাজারের উত্থান-পতনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্রমবর্ধমান বিকাশ। এরই মাঝে কম খরচে চ্যাটবট বানিয়ে এ খাতের বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে চীন। যার ধাক্কায় রাতারাতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর সূচকের বাজারমূল্য ১ ট্রিলিয়ন বা ১ লাখ কোটি ডলার কমে গেছে। ইউরোপসহ বিশ্বের অন্যান্য স্থানের শীর্ষ প্রযুক্তি সূচকও নিম্নমুখী হয়েছে। খবর দ্য গার্ডিয়ান। অনলাইনে সোমবার ডিপসিক আর১-এর একটি উন্মুক্ত সংস্করণের অভিষেক হয়। প্রথম দিনেই ওপেনএআইর বহুল ব্যবহৃত চ্যাটজিপিটিকে পেছনে ফেলে অ্যাপল অ্যাপ স্টোরে ডাউনলোডের শীর্ষে উঠে আসে এটি। ডিপসিকের উত্থানকে ১৯৫৭ সালে স্পুটনিক স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের সঙ্গে তুলনা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ ভেঞ্চার পুঁজিপতি মার্ক অ্যান্ড্রিসেন। ওই স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মহাকাশ দ্বৈরথের সূচনা হয়েছিল।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ডিপসিকের উন্মোচনে যুক্তরাষ্ট্রের এআই শিল্পের উল্লম্ফন নিয়ে বিনিয়োগ আস্থা নড়ে গেছে। বিনিয়োগকারীরা চীনের এ আবিষ্কারের সম্ভাব্য প্রভাব বিশ্লেষণ করতে শুরু করেছেন। এরই প্রভাব পড়েছে শেয়ারবাজারে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর সূচক নাসডাক কম্পোজিট সোমবার ৩ দশমিক ১ শতাংশ কমে গেছে। গত সপ্তাহে এ সূচকের বাজারমূল্য ছিল ৩২ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ডলার, সোমবার যা প্রায় ১ ট্রিলিয়ন ডলার কমে যায়।
এতে যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ারবাজারের ইতিহাসে সর্বোচ্চ পতনের মুখে পড়ে বিশ্বের শীর্ষ এআই চিপ নির্মাতা এনভিডিয়া। শেয়ারদর ১৭ শতাংশ কমায় কোম্পানিটি বাজারমূল্য হারিয়েছে প্রায় ৬০ হাজার কোটি ডলার। একই সময়ে গুগলের প্যারেন্ট প্রতিষ্ঠান অ্যালফাবেটের বাজারমূল্য ১০ হাজার কোটি ডলার ও মাইক্রোসফটের বাজারমূল্য ৭০০ কোটি ডলার কমে গেছে। এ অবস্থায় ডিপসিকের উত্থান যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডাস্ট্রিগুলোর জন্য ‘জাগরণবার্তা’ হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি বলেন, ‘এ প্রতিযোগিতায় জেতার জন্য আমাদের আরো মনোযোগী হতে হবে।’
ডিপসিকের উত্থানকে ইতিবাচক হিসেবে দেখেন বলেও জানান ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি বলেন, ‘আমি চীন সম্পর্কে জানছি। একই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোম্পানিটির সম্পর্কেও জানছি, যারা এআইর একটি দ্রুত ও অনেক সাশ্রয়ী পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছে। এটি ইতিবাচক, কারণ এতে অনেক কম অর্থ ব্যয় করতে হয়। আমি একে একটি সম্পদ হিসেবে দেখি।’ এআই খাতে যুক্ত জাপানি প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর শেয়ারদর গতকাল টানা দ্বিতীয় দিনে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কমে গেছে। সেমিকন্ডাক্টর খাতের কোম্পানি এডভ্যান্টেন্টের ৯ শতাংশের বেশি দরপতন হয়েছে। ট্রাম্প ঘোষিত ৫০ হাজার কোটি ডলারের ‘স্টারগেট’ প্রকল্পের শীর্ষ বিনিয়োগকারী সফটব্যাংকের শেয়ারদরও একই দিন ৫ শতাংশের বেশি কমে গেছে। আগের দিন ৮ শতাংশ হারায় কোম্পানিটি।
তবে এশিয়ার বেশিরভাগ পুঁজিবাজারে লেনদেন সীমিত ছিল। সেখানে শেয়ারের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা গেছে। এর মধ্যে চান্দ্র নববর্ষের ছুটির প্রস্তুতি নিচ্ছে চীন। একই দিন প্যান-ইউরোপীয় স্টক্সক্স ৬০০ সূচকের পতন ঘটে ও প্রধান ইউরোপীয় প্রযুক্তি শেয়ারগুলোর দাম কমে যায়। ডাচ চিপমেকার এএসএমএলের শেয়ারদরে ৭ শতাংশ পতন দেখা যায়। জার্মানির সিমেন্স এনার্জির শেয়ারের দাম কমে প্রায় ২০ শতাংশ। ৯ দশমিক ৫ শতাংশ দাম হারায় ফ্রান্সের ডিজিটাল অটোমেশন কোম্পানি স্নাইডার ইলেকট্রিক। তবে গতকাল কিছুটা ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা যায় ইউরোপের বাজারে।
এদিকে উন্মোচনের দিনই সাইবার আক্রমণের শিকার হয়েছে ডিপসিক। ফলে সাময়িকভাবে নিবন্ধন সীমিত করে কোম্পানিটি। ডিপসিক জানায়, তারা সোমবার রাতে আক্রমণের বিষয়টি তদন্ত শুরু করে। দুই ঘণ্টা পর্যবেক্ষণের পর জানা যায় এটি বড় ধরনের আক্রমণের শিকার হয়েছে। ডিপসিকের নিবন্ধন সীমিত করলেও বিদ্যমান ব্যবহারকারীরা আগের মতো লগ ইন করতে পারছেন। উন্নত মানের চিপে প্রবেশাধিকার ঠেকাতে চীনের ওপর রফতানি নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। ফলে উচ্চ সক্ষমতার যুক্তরাষ্ট্রের চিপ ব্যবহার করতে পারছে না দেশটি। কিন্তু গত ডিসেম্বরে প্রকাশিত একটি গবেষণা নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়, এনভিডিয়ার তৈরি সীমিত সক্ষমতার এইচ৮০০ চিপ ব্যবহার করে ডিপসিক নিজস্ব অ্যালগরিদম তৈরি করেছে। ডিপসিকের উন্নত এআই মডেল তৈরির সাফল্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি খাতের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে। এখন হাই-টেক সেক্টরে চীনের মতো প্রতিদ্বন্দ্বীদের দমিয়ে রাখতে ওয়াশিংটনের ভূমিকার কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
ডিপসিকের দাবি, তাদের এআই মডেল তৈরিতে প্রতিদ্বন্দ্বীদের তুলনায় কম চিপ ব্যবহার হয়। ফলে এর উৎপাদন ব্যয় তুলনামূলক অনেক কম। প্রারম্ভিক মডেলটি তৈরি করতে ৫৬ লাখ ডলার ব্যয় হয়েছে। পক্ষান্তরে পশ্চিমা এআই মডেলগুলো তৈরিতে ব্যয় অনেক বেশি। গত বছর অ্যানথ্রপিকের সহপ্রতিষ্ঠাতা দারিও আমোদেই জানিয়েছিলেন, উন্নত মডেল প্রশিক্ষণের ব্যয় ১০-১০০ কোটি ডলার হতে পারে।
এ অবস্থায় সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এআই খাতে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলোর বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয়ের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ইন্টারঅ্যাক্টিভ ইনভেস্টর প্লাটফর্মের বাজার বিভাগের প্রধান রিচার্ড হান্টার বলেন, ‘ডিপসিকের উত্থান বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে। কারণ তারা মূল্যায়ন করতে চাইবেন, এটি উদীয়মান এআই খাতের ওপর কতটা প্রভাব ফেলতে পারে, যা গত কয়েক বছরে প্রধান সূচকগুলোর প্রধান চালিকাশক্তি ছিল।’ সূত্র : বণিক বার্তা।