নিউইয়র্ক ০৭:১৮ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৩ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

বিনিয়োগ কেন প্রত্যাশামতো বাড়ছে না

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০৬:৫৩:১৫ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩১ অক্টোবর ২০২৩
  • / ৬২ বার পঠিত

অর্থনীতি ডেস্ক :  বাংলাদেশ স্থানীয় এবং বিদেশি বিনিয়োগ আহরণের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নানাভাবে চেষ্টা করছে। কিন্তু এক্ষেত্রে সাফল্যের হার খুব একটা বেশি নয়। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাকালে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগের হার জিডিপির ২৮ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও তা অর্জিত হয়নি। ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের হার ছিল ২৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে জাতীয় বাজেটে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের হার ২৭ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু দেশের বর্তমান বিনিয়োগ পরিস্থিতিতে এক বছরের ব্যবধানে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের হার ৩ দশমিক ৩৬ শতাংশ বাড়ানো সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। জাতীয় নির্বাচন নিয়ে দেশে বর্তমানে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। এই অবস্থায় বিনিয়োগকারীরা ‘ধীরে চলো’ নীতি অনুসরণ করতে পারেন। বিনিয়োগের জন্য সার্বিক পরিস্থিতি ভালো হওয়া দরকার। রাজনৈতিক এবং আর্থসামাজিক পরিস্থিতি যদি ভালো না হয়, তাহলে বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগে আগ্রহী হবেন না। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা তো কোনো দেশে বিনিয়োগের জন্য বাধ্য নন। তারা যে দেশে বিনিয়োগ অনুকূল পরিবেশ পাবেন, সেখানেই বিনিয়োগ করবেন। স্থানীয় বিনিয়োগকারীরা হয়তো নানা আইনি প্রতিবন্ধকতার কারণে অন্য দেশে বিনিয়োগ করতে পারেন, তাই তারা নিজ দেশেই বিনিয়োগ করে থাকেন। কিন্তু অভ্যন্তরীণভাবে যদি বিনিয়োগ অনুকূল পরিবেশ না থাকে, তাহলে তারাও নতুন বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণে ধীরে চলো নীতি অনুসরণ করতে পারেন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নিবচন আসন্ন। এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে যে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, সেই অবস্থায় নতুন বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে উদ্যোক্তারা দ্বিতীয় বার চিন্তাভাবনা করবেন। কারণ বিনিয়োগ কোনো তাত্ক্ষণিক সিদ্ধান্তের ফল হতে পারে না। বিনিয়োগ করার পর দীর্ঘ দিন তার রেজাল্টের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। তাই কোনো উদ্যোক্তাই অনিশ্চিত পরিবেশে বিনিয়োগ করে তাদের পুঁজিকে ঝুঁকির মুখে ফেলতে চাইবেন না। তারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে চাইবেন। প্রয়োজনে আরো কিছু দিন পর বিনিয়োগ করার জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। পরিস্থিতির উন্নতি হলে তারা আবারও বর্ধিত পরিমাণে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন। দ্বিতীয়ত, বর্তমানে দেশের মুদ্রা বাজারে মার্কিন ডলারের সংকট চলছে। চাইলেই পর্যাপ্ত পরিমাণে মার্কিন ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। শিল্পে বিনিয়োগের জন্য প্রচুর ডলারের প্রয়োজন হয়। কারণ আমাদের দেশে যারা বিনিয়োগ করেন, তাদের বিদেশ থেকে কাঁচামাল আমদানি করতে হয়। ক্যাপিটাল মেশিনারিজ এবং মধ্যবর্তী পণ্য আমদানি করতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক উদ্যোক্তাদের চাহিদামতো ডলারের জোগান দিতে পারছে না। বড় বড় কোম্পানিগুলো আগে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে টাকার বিনিময়ে ডলার সংগ্রহ করতে পারত। কিন্তু ব্যাংকগুলো এখন নিজেরাই ডলার সংকটে রয়েছে।

কিছু উদ্যোক্তা আগে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ডলার ঋণ নিতেন কিন্তু এখন তারা ডলার ঋণ নিতে রাজি হচ্ছেন না। তারা মনে করছেন, আগামী দিনে যদি মার্কিন ডলারের বিনিময় হার আরো বৃদ্ধি পায়! অর্থাত্ স্থানীয় মুদ্রা টাকার মান কমে গেলে তাদের জন্য অসুবিধা হতে পারে। তাই উদ্যোক্তারা এখন মার্কিন ডলার ঋণ গ্রহণের পরিবর্তে স্থানীয় মুদ্রায় ঋণ গ্রহণে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। কিন্তু স্থানীয় মুদ্রা দিয়ে তো আর শিল্পের জন্য কাঁচামাল বা ক্যাপিটাল মেশিনারিজ আমদানি করা যাবে না। রিজার্ভ থেকে প্রতি মাসে গড়ে ১০০ কোটি মার্কিন ডলার কমে যাচ্ছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে ভবিষ্যতে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ নিয়ে আমাদের কঠিন সংকটে পড়তে হতে পারে। বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের এই সংকট বিনিয়োগের ওপর প্রভাব ফেলবেই। বিনিয়োগ করতে চাইলেই মার্কিন ডলারের প্রয়োজন হবে। কিন্তু সেই ডলার আমরা কোথায় পাব? তাই বিনিয়োগকারীরা এখন নতুন বিনিয়োগের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে অনেকটাই দ্বিধাগ্রস্ত। তারা বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নত হওয়ার জন্য অপেক্ষায় আছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক বর্তমানে রিজার্ভ স্বল্পতায় ভুগছে। এটা অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো বিনিয়োগের জন্য একটি বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করছে। জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়নবিষয়ক সংস্থা আঙ্কটাড তাদের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, ২০২২ সালে বাংলাদেশ মোট ৩৪৮ কোটি মার্কিন ডলার সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ আহরণ করেছে। গত ৩৩ বছরের মধ্যে এটা বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ আহরণ। কিন্তু অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের আহরিত বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ কিন্তু খুব একটা বেশি নয়। যদি ২০২২ সালের বিদেশি বিনিয়োগে আহরণের বিষয়টি বিশ্লেষণ করা হয়, তাহলে দেখা যাবে যে, বিনিয়োগ হয়েছে তার বেশির ভাগই পুনর্বিনিয়োগ বা রি-ইনভেস্টমেন্ট। বিদেশি কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে ব্যবসায় করে যে মুনাফা অর্জন করেছে তা দেশে নিতে পারেনি। তারা সেই মুনাফার অর্থ এ দেশেই বিনিয়োগ করেছে। মূলত এ কারণেই বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ বেড়েছে। গ্রিনফিল্ড ইনভেস্টমেন্ট যেটাকে আমরা বলি অর্থাত্ বাইরে থেকে নতুন বিনিয়োগ খুব একটা বাড়েনি। বিদেশি উদ্যোক্তারা নতুন প্রকল্প স্থাপনের জন্য বিনিয়োগ নিয়ে বাংলাদেশে এসেছে এমন ঘটনা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ঘটেনি। কাজেই ২০২২ সালে বাংলাদেশে যে বিদেশি বিনিয়োগ হয়েছে, তাকে সরল দৃষ্টিতে দেখলে চলবে না। একে একটু ভিন্ন আঙ্গিকে দেখতে হবে। আমরা সবাই চাই, বাংলাদেশে বিপুল পরিমাণে বিদেশি বিনিয়োগ আসুক। বাংলাদেশ বিদেশি বিনিয়োগের অন্যতম প্রধান লক্ষ্যে পরিণত হোক। কিন্তু সেটা তো হচ্ছে না। অনেকেই বলে থাকেন, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাই আমাদের দেশে বিনিয়োগের (স্থানীয় ও বিদেশি) সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এতদিন তো রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ছিল না। তাহলে বিনিয়োগ কেন কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় হয়নি। আসলে আমাদের দেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সমস্যা সব সময়ই ছিল। বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ সুশাসনের অভাব, সর্বস্তরে ব্যাপক দুর্নীতি-অনিয়ম এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতা আগেও ছিল, এখনো আছে। বিনিয়োগকারীরা প্রকল্প প্রস্তাব বাস্তবায়ন করতে গিয়ে নানাভাবে হয়রানির শিকার হয়ে থাকেন। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা অবশ্যই বিনিয়োগ কার্যক্রমকে প্রতিহত করে। কিন্তু এটাই বিনিয়োগ কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় না হওয়ার জন্য একমাত্র বা প্রধান প্রতিবন্ধক নয়। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা তো এখন শুরু হয়েছে। কিন্তু আগে তো রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তেমন কোনো অস্থিতিশীলতা ছিল না। তাহলে বিনিয়োগ কেনো উচ্চমাত্রায় হলো না? বাংলাদেশের সামগ্রিক বিনিয়োগ পরিবেশ স্থানীয় এবং বিদেশি বিনিয়োগের জন্য তেমন একটা অনুকূল নয়। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা কোন দেশে বিনিয়োগ করবেন আর কোন দেশে বিনিয়োগ করবেন না, এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তারা সম্পূর্ণ স্বাধীন। তাই তারা যদি তাদের পুঁজির সর্বোত্তম নিরাপত্তা এবং সর্বাধিক মুনাফা অর্জনের সম্ভাবনা না দেখেন, তাহলে একটি দেশে তারা কেন বিনিয়োগ করতে যাবেন? বাংলাদেশে বিনিয়োগ প্রস্তাব বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রচুর বিধিনিষেধ, প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হয়। তাই উদ্যোক্তাদের অনেকেই বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণের পরও প্রকল্প বাস্তবায়নকালে পিছিয়ে যান। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে যারা প্রকল্প প্রস্তাব নিয়ে আসেন, তাদের অনেকেই শেষ পর্যন্ত প্রকল্প বাস্তবায়ন না করেই চলে যান। রাষ্ট্রীয় সেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ম্যানেজ করে সেবাগ্রহণ করা অনেক সময়ই সম্ভব হয় না। প্রতি ক্ষেত্রেই ঘুষ-দুর্নীতির ব্যাপার রয়েছে। বিদেশি উদ্যোক্তারা সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে ঘুষ দিয়ে কাজ করানোর ব্যাপারটি পছন্দ করেন না। প্রশ্ন হচ্ছে, একজন বিদেশি বিনিয়োগকারী বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য কেন আসবেন? বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ আহরণের জন্য সবচেয়ে সম্ভাবনাময় দিক কোনটি? আমরা যদি আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধির গতিকে ধরে রাখতে পারি, তাহলে ভবিষ্যতে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগ প্রস্তাব নিয়ে আসবেন, এটা মোটামুটি নিশ্চিত করেই বলা যেতে পারে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বাংলাদেশ এতদিন উচ্চমাত্রায় প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। বর্তমানে প্রবৃদ্ধি কিছুটা মন্থর হয়েছে বটে, তবে ভবিষ্যতে আবারও বাংলাদেশ উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জন করবে বলে আশা করা যাচ্ছে। বাংলাদেশ দ্রুত উন্নয়ন অর্জনকারী একটি দেশ। বাংলাদেশে রয়েছে ১৭ কোটি মানুষের বিরাট এক বাজার। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশ উন্নত দেশগুলো থেকে বিভিন্ন রকম বাণিজ্যসুবিধা পেয়ে আসছে। কাজেই কোনো বিদেশি উদ্যোক্তা যদি বাংলাদেশে প্রকল্প স্থাপন করে পণ্য উত্পাদন করে, তাহলে তারা স্থানীয় বাজারের সুবিধা গ্রহণের পাশাপাশি বিদেশে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রেও শুল্কমুক্ত সুবিধা পেতে পারবে। এসব কারণে বিদেশি উদ্যোক্তারা বাংলাদেশে বিনিয়োগের ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করতে পারে। বাংলাদেশের মার্কেটে ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজের প্রয়োজন আছে। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে প্রতিকূলতাগুলো এখনো আমরা দূর করতে পারিনি। বাংলাদেশে ট্যাক্সের রেট অনেক বেশি। কর প্রশাসন ব্যবস্থা অত্যন্ত জটিল। বিদেশ থেকে শিল্পের কাঁচামাল আনতে ঝামেলা হয়। জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে একটি স্থিতিশীল সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে বিনিয়োগ পরিবেশ অনেকটাই উন্নত হবে। ভবিষ্যতে যারাই নির্বাচিত হয়ে আসুক না কেন, তাদের অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যাপক সংস্কার সাধন করতে হবে। বিশেষ করে, রাজস্ব আহরণের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়াতে হবে। বাংলাদেশ বর্তমানে যে রাজস্ব আদায় করছে, তা খুবই কম। এই স্বল্প পরিমাণ রাজস্ব দিয়ে উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। অর্থনীতির আরো নানা ক্ষেত্রে ব্যাপক সংস্কার প্রয়োজন। আগামী সরকার এটা করবেন কি না, তার ওপরই বিনিয়োগ আহরণের বিষয়টি নির্ভর করছে। সূত্র : দৈনিক ইত্তেফাক
লেখক : বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও নির্বাহী পরিচালক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই)
অনুলিখন : এম এ খালেক

হককথা/নাছরিন

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

বিনিয়োগ কেন প্রত্যাশামতো বাড়ছে না

প্রকাশের সময় : ০৬:৫৩:১৫ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩১ অক্টোবর ২০২৩

অর্থনীতি ডেস্ক :  বাংলাদেশ স্থানীয় এবং বিদেশি বিনিয়োগ আহরণের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নানাভাবে চেষ্টা করছে। কিন্তু এক্ষেত্রে সাফল্যের হার খুব একটা বেশি নয়। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাকালে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগের হার জিডিপির ২৮ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও তা অর্জিত হয়নি। ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের হার ছিল ২৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে জাতীয় বাজেটে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের হার ২৭ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু দেশের বর্তমান বিনিয়োগ পরিস্থিতিতে এক বছরের ব্যবধানে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের হার ৩ দশমিক ৩৬ শতাংশ বাড়ানো সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। জাতীয় নির্বাচন নিয়ে দেশে বর্তমানে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। এই অবস্থায় বিনিয়োগকারীরা ‘ধীরে চলো’ নীতি অনুসরণ করতে পারেন। বিনিয়োগের জন্য সার্বিক পরিস্থিতি ভালো হওয়া দরকার। রাজনৈতিক এবং আর্থসামাজিক পরিস্থিতি যদি ভালো না হয়, তাহলে বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগে আগ্রহী হবেন না। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা তো কোনো দেশে বিনিয়োগের জন্য বাধ্য নন। তারা যে দেশে বিনিয়োগ অনুকূল পরিবেশ পাবেন, সেখানেই বিনিয়োগ করবেন। স্থানীয় বিনিয়োগকারীরা হয়তো নানা আইনি প্রতিবন্ধকতার কারণে অন্য দেশে বিনিয়োগ করতে পারেন, তাই তারা নিজ দেশেই বিনিয়োগ করে থাকেন। কিন্তু অভ্যন্তরীণভাবে যদি বিনিয়োগ অনুকূল পরিবেশ না থাকে, তাহলে তারাও নতুন বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণে ধীরে চলো নীতি অনুসরণ করতে পারেন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নিবচন আসন্ন। এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে যে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, সেই অবস্থায় নতুন বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে উদ্যোক্তারা দ্বিতীয় বার চিন্তাভাবনা করবেন। কারণ বিনিয়োগ কোনো তাত্ক্ষণিক সিদ্ধান্তের ফল হতে পারে না। বিনিয়োগ করার পর দীর্ঘ দিন তার রেজাল্টের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। তাই কোনো উদ্যোক্তাই অনিশ্চিত পরিবেশে বিনিয়োগ করে তাদের পুঁজিকে ঝুঁকির মুখে ফেলতে চাইবেন না। তারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে চাইবেন। প্রয়োজনে আরো কিছু দিন পর বিনিয়োগ করার জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। পরিস্থিতির উন্নতি হলে তারা আবারও বর্ধিত পরিমাণে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন। দ্বিতীয়ত, বর্তমানে দেশের মুদ্রা বাজারে মার্কিন ডলারের সংকট চলছে। চাইলেই পর্যাপ্ত পরিমাণে মার্কিন ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। শিল্পে বিনিয়োগের জন্য প্রচুর ডলারের প্রয়োজন হয়। কারণ আমাদের দেশে যারা বিনিয়োগ করেন, তাদের বিদেশ থেকে কাঁচামাল আমদানি করতে হয়। ক্যাপিটাল মেশিনারিজ এবং মধ্যবর্তী পণ্য আমদানি করতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক উদ্যোক্তাদের চাহিদামতো ডলারের জোগান দিতে পারছে না। বড় বড় কোম্পানিগুলো আগে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে টাকার বিনিময়ে ডলার সংগ্রহ করতে পারত। কিন্তু ব্যাংকগুলো এখন নিজেরাই ডলার সংকটে রয়েছে।

কিছু উদ্যোক্তা আগে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ডলার ঋণ নিতেন কিন্তু এখন তারা ডলার ঋণ নিতে রাজি হচ্ছেন না। তারা মনে করছেন, আগামী দিনে যদি মার্কিন ডলারের বিনিময় হার আরো বৃদ্ধি পায়! অর্থাত্ স্থানীয় মুদ্রা টাকার মান কমে গেলে তাদের জন্য অসুবিধা হতে পারে। তাই উদ্যোক্তারা এখন মার্কিন ডলার ঋণ গ্রহণের পরিবর্তে স্থানীয় মুদ্রায় ঋণ গ্রহণে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। কিন্তু স্থানীয় মুদ্রা দিয়ে তো আর শিল্পের জন্য কাঁচামাল বা ক্যাপিটাল মেশিনারিজ আমদানি করা যাবে না। রিজার্ভ থেকে প্রতি মাসে গড়ে ১০০ কোটি মার্কিন ডলার কমে যাচ্ছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে ভবিষ্যতে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ নিয়ে আমাদের কঠিন সংকটে পড়তে হতে পারে। বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের এই সংকট বিনিয়োগের ওপর প্রভাব ফেলবেই। বিনিয়োগ করতে চাইলেই মার্কিন ডলারের প্রয়োজন হবে। কিন্তু সেই ডলার আমরা কোথায় পাব? তাই বিনিয়োগকারীরা এখন নতুন বিনিয়োগের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে অনেকটাই দ্বিধাগ্রস্ত। তারা বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নত হওয়ার জন্য অপেক্ষায় আছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক বর্তমানে রিজার্ভ স্বল্পতায় ভুগছে। এটা অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো বিনিয়োগের জন্য একটি বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করছে। জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়নবিষয়ক সংস্থা আঙ্কটাড তাদের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, ২০২২ সালে বাংলাদেশ মোট ৩৪৮ কোটি মার্কিন ডলার সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ আহরণ করেছে। গত ৩৩ বছরের মধ্যে এটা বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ আহরণ। কিন্তু অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের আহরিত বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ কিন্তু খুব একটা বেশি নয়। যদি ২০২২ সালের বিদেশি বিনিয়োগে আহরণের বিষয়টি বিশ্লেষণ করা হয়, তাহলে দেখা যাবে যে, বিনিয়োগ হয়েছে তার বেশির ভাগই পুনর্বিনিয়োগ বা রি-ইনভেস্টমেন্ট। বিদেশি কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে ব্যবসায় করে যে মুনাফা অর্জন করেছে তা দেশে নিতে পারেনি। তারা সেই মুনাফার অর্থ এ দেশেই বিনিয়োগ করেছে। মূলত এ কারণেই বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ বেড়েছে। গ্রিনফিল্ড ইনভেস্টমেন্ট যেটাকে আমরা বলি অর্থাত্ বাইরে থেকে নতুন বিনিয়োগ খুব একটা বাড়েনি। বিদেশি উদ্যোক্তারা নতুন প্রকল্প স্থাপনের জন্য বিনিয়োগ নিয়ে বাংলাদেশে এসেছে এমন ঘটনা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ঘটেনি। কাজেই ২০২২ সালে বাংলাদেশে যে বিদেশি বিনিয়োগ হয়েছে, তাকে সরল দৃষ্টিতে দেখলে চলবে না। একে একটু ভিন্ন আঙ্গিকে দেখতে হবে। আমরা সবাই চাই, বাংলাদেশে বিপুল পরিমাণে বিদেশি বিনিয়োগ আসুক। বাংলাদেশ বিদেশি বিনিয়োগের অন্যতম প্রধান লক্ষ্যে পরিণত হোক। কিন্তু সেটা তো হচ্ছে না। অনেকেই বলে থাকেন, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাই আমাদের দেশে বিনিয়োগের (স্থানীয় ও বিদেশি) সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এতদিন তো রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ছিল না। তাহলে বিনিয়োগ কেন কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় হয়নি। আসলে আমাদের দেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সমস্যা সব সময়ই ছিল। বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ সুশাসনের অভাব, সর্বস্তরে ব্যাপক দুর্নীতি-অনিয়ম এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতা আগেও ছিল, এখনো আছে। বিনিয়োগকারীরা প্রকল্প প্রস্তাব বাস্তবায়ন করতে গিয়ে নানাভাবে হয়রানির শিকার হয়ে থাকেন। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা অবশ্যই বিনিয়োগ কার্যক্রমকে প্রতিহত করে। কিন্তু এটাই বিনিয়োগ কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় না হওয়ার জন্য একমাত্র বা প্রধান প্রতিবন্ধক নয়। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা তো এখন শুরু হয়েছে। কিন্তু আগে তো রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তেমন কোনো অস্থিতিশীলতা ছিল না। তাহলে বিনিয়োগ কেনো উচ্চমাত্রায় হলো না? বাংলাদেশের সামগ্রিক বিনিয়োগ পরিবেশ স্থানীয় এবং বিদেশি বিনিয়োগের জন্য তেমন একটা অনুকূল নয়। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা কোন দেশে বিনিয়োগ করবেন আর কোন দেশে বিনিয়োগ করবেন না, এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তারা সম্পূর্ণ স্বাধীন। তাই তারা যদি তাদের পুঁজির সর্বোত্তম নিরাপত্তা এবং সর্বাধিক মুনাফা অর্জনের সম্ভাবনা না দেখেন, তাহলে একটি দেশে তারা কেন বিনিয়োগ করতে যাবেন? বাংলাদেশে বিনিয়োগ প্রস্তাব বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রচুর বিধিনিষেধ, প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হয়। তাই উদ্যোক্তাদের অনেকেই বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণের পরও প্রকল্প বাস্তবায়নকালে পিছিয়ে যান। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে যারা প্রকল্প প্রস্তাব নিয়ে আসেন, তাদের অনেকেই শেষ পর্যন্ত প্রকল্প বাস্তবায়ন না করেই চলে যান। রাষ্ট্রীয় সেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ম্যানেজ করে সেবাগ্রহণ করা অনেক সময়ই সম্ভব হয় না। প্রতি ক্ষেত্রেই ঘুষ-দুর্নীতির ব্যাপার রয়েছে। বিদেশি উদ্যোক্তারা সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে ঘুষ দিয়ে কাজ করানোর ব্যাপারটি পছন্দ করেন না। প্রশ্ন হচ্ছে, একজন বিদেশি বিনিয়োগকারী বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য কেন আসবেন? বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ আহরণের জন্য সবচেয়ে সম্ভাবনাময় দিক কোনটি? আমরা যদি আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধির গতিকে ধরে রাখতে পারি, তাহলে ভবিষ্যতে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগ প্রস্তাব নিয়ে আসবেন, এটা মোটামুটি নিশ্চিত করেই বলা যেতে পারে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বাংলাদেশ এতদিন উচ্চমাত্রায় প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। বর্তমানে প্রবৃদ্ধি কিছুটা মন্থর হয়েছে বটে, তবে ভবিষ্যতে আবারও বাংলাদেশ উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জন করবে বলে আশা করা যাচ্ছে। বাংলাদেশ দ্রুত উন্নয়ন অর্জনকারী একটি দেশ। বাংলাদেশে রয়েছে ১৭ কোটি মানুষের বিরাট এক বাজার। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশ উন্নত দেশগুলো থেকে বিভিন্ন রকম বাণিজ্যসুবিধা পেয়ে আসছে। কাজেই কোনো বিদেশি উদ্যোক্তা যদি বাংলাদেশে প্রকল্প স্থাপন করে পণ্য উত্পাদন করে, তাহলে তারা স্থানীয় বাজারের সুবিধা গ্রহণের পাশাপাশি বিদেশে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রেও শুল্কমুক্ত সুবিধা পেতে পারবে। এসব কারণে বিদেশি উদ্যোক্তারা বাংলাদেশে বিনিয়োগের ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করতে পারে। বাংলাদেশের মার্কেটে ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজের প্রয়োজন আছে। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে প্রতিকূলতাগুলো এখনো আমরা দূর করতে পারিনি। বাংলাদেশে ট্যাক্সের রেট অনেক বেশি। কর প্রশাসন ব্যবস্থা অত্যন্ত জটিল। বিদেশ থেকে শিল্পের কাঁচামাল আনতে ঝামেলা হয়। জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে একটি স্থিতিশীল সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে বিনিয়োগ পরিবেশ অনেকটাই উন্নত হবে। ভবিষ্যতে যারাই নির্বাচিত হয়ে আসুক না কেন, তাদের অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যাপক সংস্কার সাধন করতে হবে। বিশেষ করে, রাজস্ব আহরণের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়াতে হবে। বাংলাদেশ বর্তমানে যে রাজস্ব আদায় করছে, তা খুবই কম। এই স্বল্প পরিমাণ রাজস্ব দিয়ে উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। অর্থনীতির আরো নানা ক্ষেত্রে ব্যাপক সংস্কার প্রয়োজন। আগামী সরকার এটা করবেন কি না, তার ওপরই বিনিয়োগ আহরণের বিষয়টি নির্ভর করছে। সূত্র : দৈনিক ইত্তেফাক
লেখক : বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও নির্বাহী পরিচালক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই)
অনুলিখন : এম এ খালেক

হককথা/নাছরিন