নিউইয়র্ক ০৬:০৩ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

কেন এই উল্টোগতি?

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ১২:০১:৫৮ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
  • / ৭০ বার পঠিত

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ প্রকাশিত কয়েকটি প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশের আর্থসামাজিক অধিকাংশ সূচকই নেতিবাচক ধারায় রয়েছে। ‘বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ২০২৩’-এর জরিপে দেখা গেছে, দেশের মানুষের প্রত্যাশিত গড় আয়ু কমেছে। সেই সঙ্গে শিশুমৃত্যু, বেকারত্ব, বাল্যবিবাহ আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে খাদ্যনিরাপত্তা পরিসংখ্যান ২০২৩’-এর তথ্য বলছে, দেশের এক-চতুর্থাংশ পরিবারকে খাদ্য, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষার মতো মৌলিক চাহিদা মেটাতে ঋণ করতে হচ্ছে। এ ছাড়া একবেলা খাবারের শেষে পরের বেলার চালের জোগান নেই দেশে এমন পরিবারও রয়েছে। আর জাতীয় শিশুশ্রম জরিপ-২০২২ অনুযায়ী, শ্রমে থাকা শিশুদের মধ্যে ১০ লাখ ৭০ হাজার শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত রয়েছে। অর্থাৎ বিবিএসের প্রকাশিত অধিকাংশ সূচকের ধারাই নেতিবাচক লক্ষ্য করা গেছে। গুরুত্বপূর্ণ সূচকগুলোর এই নেতিবাচক ধারা দেশের জন্য উদ্বেগের বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। গুরুত্বপূর্ণ সূচকগুলোর নেতিবাচক ধারার কারণ হিসেবে তারা কোভিড ও সরকারের নীতির ধারাবাহিকতা রাখার অভাবকে দায়ী করছেন।

জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমেছে: বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে দেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি কমেছে। এ সময় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ। আগের অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৮ দশমিক ৭৬ শতাংশ। অর্থাৎ চলতি প্রান্তিকে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমেছে ২ দশমিক ৬৯ শতাংশীয় পয়েন্ট।

প্রত্যাশিত গড় আয়ু কমেছে: ২০২৩ সাল শেষে দেশের মানুষের প্রত্যাশিত আয়ু কমে ৭২ দশমিক ৩ শতাংশে নেমেছে, যা ২০২২ সালে ছিল ৭২ দশমিক ৪ শতাংশ। বাংলাদেশে ১৯৬০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধির প্রতিবেদনে দেখা গেছে, প্রতিটি দশকেই এই হার বেড়েছে। এর মধ্যে কেবল ষাটের দশকের মাঝামাঝি, অর্থাৎ ১৯৬৫ সাল নাগাদ যে বৃদ্ধি ঘটেছে, দশক শেষে মানে ১৯৭০ সালে এসে তার কিছুটা অবনতি হয়েছে। পরবর্তী প্রায় সব দশকে, একটি মাত্র ব্যতিক্রম ছাড়া, পাঁচ বছর করে বেড়েছে দেশের মানুষের গড় আয়ু। এর মধ্যে ১৯৯০ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে গড় আয়ু বেড়েছে সাত বছর। যদিও ২০১০ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত গড় আয়ু বৃদ্ধি কিছুটা স্থবির হয়ে আছে।

আশঙ্কা বাড়িয়েছে শিশুমৃত্যু: স্বাধীনতার সময় বাংলাদেশে এক বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যু প্রতি হাজারে ছিল ১৪১ জন, সেটা থেকে উন্নতির ধারাবাহিকতার সর্বোচ্চ শিখরে বাংলাদেশ পৌঁছেছিল ২০২০ সালে, তখন হাজারে মৃত্যু ছিল ২১ জন। সেই সাফল্য ম্লান হতে শুরু করেছে ২০২১ সালের পর থেকে। ওই বছর থেকে ধারাবাহিকভাবে ২০২৩ সাল শেষে শিশুমৃত্যু বেড়ে হাজারে এখন ২৭ জনে ঠেকেছে। শিশুমৃত্যুর হার বেড়ে যাওয়াটা স্বাস্থ্য খাতের দুর্বলতাকেই ইঙ্গিত করে।

আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে বাল্যবিবাহ: এক বছরের ব্যবধানে দেশে বাল্যবিবাহের হার বেড়েছে। স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিক্স জরিপে দেখা যায়, ২০২৩ সালে দেশে ১৫ বছরের কম বয়সী নারীদের মধ্যে বিয়ের হার ছিল ৮ দশমিক ২ শতাংশ, ২০২২ সালেও এই হার ছিল ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। এ ছাড়া ১৮ বছরের আগে বিয়ের হারও বেড়েছে। গত বছর দেশে এই বয়সী নারীদের বিয়ের হার ছিল ৪১ দশমিক ৬ শতাংশ, অন্যদিকে ২০২২ সালেও এই হার ছিল ৪০ দশমিক ৯ শতাংশ।

কমেছে নারীর প্রজনন হার: প্রজনন হার বলতে বোঝায় ১৫ থেকে ৫৯ বছর বয়সী একজন নারী কতোজন সন্তান জন্ম দিতে পারেন। ২০২২ সালে নারীদের প্রজনন হার কিছুটা বেড়ে ২ দশমিক ২০ শতাংশে দাঁড়িয়েছিল, কিন্তু বছরের ব্যবধানে ২০২৩ সাল শেষে তা কিছুটা কমে দাঁড়িয়েছে ২ দশমিক ১৭ শতাংশ।

জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির ব্যবহার কমেছে: বিবিএসের তথ্য বলছে, দেশে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির ব্যবহার কমিয়ে দিয়েছেন দম্পতিরা। বর্তমানে দেশে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির ব্যবহারের হার ৬২ দশমিক ১ শতাংশ, ২০২২ সালেও যা ছিল ৬৩ দশমিক ৩ শতাংশ।

সন্তান জন্মদানে অস্ত্রোপচার বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে: এদিকে দেশে সিজারিয়ান সেকশন বা অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সন্তান জন্মদানের প্রবণতা আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে সিজারের ঘটনা ৪১ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে বেড়ে ৫০ দশমিক ৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। আর স্বাভাবিক পদ্ধতিতে সন্তান প্রসবের হার ২০২২ সালের (৫৮ দশমিক ৬ শতাংশ) তুলনায় কমে ২০২৩ সালে হয়েছে ৪৯ দশমিক ৩ শতাংশ।

কিশোরী নারীদের মধ্যে সন্তান জন্মের হার বৃদ্ধি পেয়েছে: ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী কিশোরীদের মধ্যে সন্তান জন্মের হার বৃদ্ধি পেয়েছে। এসভিআরএস জরিপে এই তথ্য উঠে এসেছে। জরিপ অনুযায়ী, ২০২২ সালে কিশোরী নারীদের মধ্যে সন্তান জন্মদানের হার ছিল ৪১ দশমিক ৮৭ শতাংশ আর ২০২৩ সালে সেটি বেড়ে ৪৩ দশমিক ৫৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়া ১৫ বছর বয়সী কিশোরীদের মধ্যে সন্তান জন্মদানের হার ১৫ দশমিক ৮৩ শতাংশ।

প্রতিবন্ধিতা বৃদ্ধি পেয়েছে: ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে আশঙ্কাজনক হারে প্রতিবন্ধিতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এসভিআরএসের প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২২ সালে দেশে প্রতিবন্ধিতার হার ছিল ২৫ দশমিক ৫ শতাংশ আর ২০২৩ সালে সেটি বেড়ে ২৮ দশমিক ২ শতাংশ হয়েছে।

দীর্ঘ হচ্ছে শিক্ষিত বেকারের মিছিল: দেশে গত বছরের শেষ তিন মাসে বেকার জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বেড়েছে ৪০ হাজার। অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিক শেষে দেশে বেকারের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে সাড়ে ২৩ লাখ। এর মধ্যে পুরুষ বেকারের সংখ্যা ১৫ লাখ ৭০ হাজার আর নারী বেকারের সংখ্যা ৭ লাখ ৮০ হাজার। বিবিএস’র সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপে এই তথ্য উঠে এসেছে। শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও কাজ নেই ৪০ শতাংশ তরুণের: বাংলাদেশের প্রায় ৪০ শতাংশ তরুণ নিষ্ক্রিয়। এসভিআরসি’র প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে শিক্ষা, কর্মে কিংবা প্রশিক্ষণে নেই- এমন তরুণের সংখ্যা ৩৯ দশমিক ৮৮ শতাংশ হয়েছে। এই জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই নারী। তরুণদের মধ্যে মাত্র ১৮ দশমিক ৩৫ শতাংশ অলস, আর তরুণীদের মধ্যে এই হার ৬০ দশমিক ৮৫ শতাংশ। জরিপের তথ্য বলছে, এই জনগোষ্ঠীর ৪১ দশমিক ৩ শতাংশই গ্রামে বাস করে। অন্যদিকে শহরের তরুণদের মধ্যে এমন অলস তরুণ জনগোষ্ঠী ৩৫ দশমিক ২১ শতাংশ।

মৌলিক চাহিদা মেটাতে ঋণ করে ২৬ শতাংশ পরিবার: বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খাদ্যনিরাপত্তা পরিসংখ্যান ২০২৩-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের এক-চতুর্থাংশ পরিবার খাদ্য, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষার মতো মৌলিক চাহিদা মেটাতে ঋণ করছে। এক্ষেত্রে শহরের চেয়ে গ্রামের মানুষই বেশি ঋণ করছে। শহর ও গ্রামের মানুষ এই ঋণের বড় অংশই নিচ্ছে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) থেকে চড়া সুদে।

খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় কোটি মানুষ: মাঝারি পর্যায়ে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় থাকা পরিবার বলতে বোঝানো হয়েছে নিয়মিত স্বাস্থ্যকর, সুষম খাবার গ্রহণে যারা অক্ষম তাদের। আর তীব্র খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় থাকা পরিবার বলতে বোঝানো হয়েছে খাদ্য কমানোর উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা পরিবারগুলোকে। বিবিএসের হিসাবে, জরিপকালে দেশে প্রায় ২২ শতাংশ পরিবার মাঝারি পর্যায়ের খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ছিল। আর শূন্য দশমিক ৮২ শতাংশ পরিবার তীব্র খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ছিল।

পরের বেলা ভাত জুটবে কিনা জানে না ৩৪ লাখ মানুষ: খাদ্যের মতো মৌলিক চাহিদা পূরণ বেশ কঠিন হয়ে উঠেছে অনেকের জন্য। একবেলা খাবারের শেষে পরের বেলার চালের জোগান নেই- দেশে এমন পরিবারের হার ২ শতাংশ। আটা মজুত থাকে না ৬০ শতাংশ পরিবারে। নিত্যপণ্যের মধ্যে ডালের সংস্থান নেই ১৯ শতাংশ পরিবারে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খাদ্য নিরাপত্তা-সংক্রান্ত জরিপের চূড়ান্ত প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে। এদিকে খানা আয় ও ব্যয় জরিপের চূড়ান্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে পরিবারের সংখ্যা এখন ৪ কোটি ১০ লাখ। আর জনশুমারি ও গৃহগণনার চূড়ান্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৮ লাখ ২৮ হাজার ৯১১ জন। সেই হিসাবে দেশের ৩৩ লাখ ৯৬ হাজার ৫৮০ জন মানুষের একবেলা খাওয়ার পর পরের বেলার চালের জোগান নেই।

ঝুঁকিপূর্ণ কাজে যুক্ত ১০ লাখ ৭০ হাজার শিশু: জাতীয় শিশুশ্রম জরিপ ২০২২ অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী ৩৫ লাখ ৪০ হাজার শিশু শ্রমজীবী। যার মধ্যে ১৭ লাখ ৮০ হাজার শিশুশ্রমে যুক্ত। শ্রমে থাকা শিশুদের মধ্যে ১০ লাখ ৭০ হাজার শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত রয়েছে। তাদের মধ্যে অটোমোবাইল ওয়ার্কশপে কাজ করে সবচেয়ে বেশি।

নেতিবাচক সূচক নিয়ে বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন: দেশের আর্থসামাজিক সূচকগুলোর নেতিবাচক ধারা উদ্বেগজনক বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান মানবজমিনকে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলোর তথ্য উদ্বেগজনক। বাংলাদেশ ধারাবাহিকভাবে যেসব আর্থসামাজিক সূচকে উন্নতি করছিল সাম্প্রতিককালে সেটা বাধাগ্রস্ত হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ সূচকগুলোর নেতিবাচক ধারার কারণ হিসেবে তিনি কোভিড ও সরকারের নীতির ধারাবাহিকতা রাখার অভাবকে দায়ী করেন। তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি মানুষের জীববনযাত্রার উপরে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। সেটি খাদ্য নিরাপত্তা হোক কিংবা পুষ্টি নিরাপত্তা হোক। এগুলোর প্রতিফলনই আমরা দেখতে পারছি। এটা আমাদের জন্য মোটেও স্বস্তিদায়ক নয়, বরং উদ্বেগজনক। সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে এগুলো সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। সুতরাং নেতিবাচক সূচকগুলোকে অগ্রাধিকার দিয়ে নীতিমালা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নের দিকে আমাদের নজর দিতে হবে। সূত্র : মানবজমিন।

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

কেন এই উল্টোগতি?

প্রকাশের সময় : ১২:০১:৫৮ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ প্রকাশিত কয়েকটি প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশের আর্থসামাজিক অধিকাংশ সূচকই নেতিবাচক ধারায় রয়েছে। ‘বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ২০২৩’-এর জরিপে দেখা গেছে, দেশের মানুষের প্রত্যাশিত গড় আয়ু কমেছে। সেই সঙ্গে শিশুমৃত্যু, বেকারত্ব, বাল্যবিবাহ আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে খাদ্যনিরাপত্তা পরিসংখ্যান ২০২৩’-এর তথ্য বলছে, দেশের এক-চতুর্থাংশ পরিবারকে খাদ্য, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষার মতো মৌলিক চাহিদা মেটাতে ঋণ করতে হচ্ছে। এ ছাড়া একবেলা খাবারের শেষে পরের বেলার চালের জোগান নেই দেশে এমন পরিবারও রয়েছে। আর জাতীয় শিশুশ্রম জরিপ-২০২২ অনুযায়ী, শ্রমে থাকা শিশুদের মধ্যে ১০ লাখ ৭০ হাজার শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত রয়েছে। অর্থাৎ বিবিএসের প্রকাশিত অধিকাংশ সূচকের ধারাই নেতিবাচক লক্ষ্য করা গেছে। গুরুত্বপূর্ণ সূচকগুলোর এই নেতিবাচক ধারা দেশের জন্য উদ্বেগের বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। গুরুত্বপূর্ণ সূচকগুলোর নেতিবাচক ধারার কারণ হিসেবে তারা কোভিড ও সরকারের নীতির ধারাবাহিকতা রাখার অভাবকে দায়ী করছেন।

জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমেছে: বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে দেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি কমেছে। এ সময় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ। আগের অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৮ দশমিক ৭৬ শতাংশ। অর্থাৎ চলতি প্রান্তিকে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমেছে ২ দশমিক ৬৯ শতাংশীয় পয়েন্ট।

প্রত্যাশিত গড় আয়ু কমেছে: ২০২৩ সাল শেষে দেশের মানুষের প্রত্যাশিত আয়ু কমে ৭২ দশমিক ৩ শতাংশে নেমেছে, যা ২০২২ সালে ছিল ৭২ দশমিক ৪ শতাংশ। বাংলাদেশে ১৯৬০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধির প্রতিবেদনে দেখা গেছে, প্রতিটি দশকেই এই হার বেড়েছে। এর মধ্যে কেবল ষাটের দশকের মাঝামাঝি, অর্থাৎ ১৯৬৫ সাল নাগাদ যে বৃদ্ধি ঘটেছে, দশক শেষে মানে ১৯৭০ সালে এসে তার কিছুটা অবনতি হয়েছে। পরবর্তী প্রায় সব দশকে, একটি মাত্র ব্যতিক্রম ছাড়া, পাঁচ বছর করে বেড়েছে দেশের মানুষের গড় আয়ু। এর মধ্যে ১৯৯০ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে গড় আয়ু বেড়েছে সাত বছর। যদিও ২০১০ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত গড় আয়ু বৃদ্ধি কিছুটা স্থবির হয়ে আছে।

আশঙ্কা বাড়িয়েছে শিশুমৃত্যু: স্বাধীনতার সময় বাংলাদেশে এক বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যু প্রতি হাজারে ছিল ১৪১ জন, সেটা থেকে উন্নতির ধারাবাহিকতার সর্বোচ্চ শিখরে বাংলাদেশ পৌঁছেছিল ২০২০ সালে, তখন হাজারে মৃত্যু ছিল ২১ জন। সেই সাফল্য ম্লান হতে শুরু করেছে ২০২১ সালের পর থেকে। ওই বছর থেকে ধারাবাহিকভাবে ২০২৩ সাল শেষে শিশুমৃত্যু বেড়ে হাজারে এখন ২৭ জনে ঠেকেছে। শিশুমৃত্যুর হার বেড়ে যাওয়াটা স্বাস্থ্য খাতের দুর্বলতাকেই ইঙ্গিত করে।

আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে বাল্যবিবাহ: এক বছরের ব্যবধানে দেশে বাল্যবিবাহের হার বেড়েছে। স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিক্স জরিপে দেখা যায়, ২০২৩ সালে দেশে ১৫ বছরের কম বয়সী নারীদের মধ্যে বিয়ের হার ছিল ৮ দশমিক ২ শতাংশ, ২০২২ সালেও এই হার ছিল ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। এ ছাড়া ১৮ বছরের আগে বিয়ের হারও বেড়েছে। গত বছর দেশে এই বয়সী নারীদের বিয়ের হার ছিল ৪১ দশমিক ৬ শতাংশ, অন্যদিকে ২০২২ সালেও এই হার ছিল ৪০ দশমিক ৯ শতাংশ।

কমেছে নারীর প্রজনন হার: প্রজনন হার বলতে বোঝায় ১৫ থেকে ৫৯ বছর বয়সী একজন নারী কতোজন সন্তান জন্ম দিতে পারেন। ২০২২ সালে নারীদের প্রজনন হার কিছুটা বেড়ে ২ দশমিক ২০ শতাংশে দাঁড়িয়েছিল, কিন্তু বছরের ব্যবধানে ২০২৩ সাল শেষে তা কিছুটা কমে দাঁড়িয়েছে ২ দশমিক ১৭ শতাংশ।

জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির ব্যবহার কমেছে: বিবিএসের তথ্য বলছে, দেশে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির ব্যবহার কমিয়ে দিয়েছেন দম্পতিরা। বর্তমানে দেশে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির ব্যবহারের হার ৬২ দশমিক ১ শতাংশ, ২০২২ সালেও যা ছিল ৬৩ দশমিক ৩ শতাংশ।

সন্তান জন্মদানে অস্ত্রোপচার বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে: এদিকে দেশে সিজারিয়ান সেকশন বা অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সন্তান জন্মদানের প্রবণতা আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে সিজারের ঘটনা ৪১ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে বেড়ে ৫০ দশমিক ৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। আর স্বাভাবিক পদ্ধতিতে সন্তান প্রসবের হার ২০২২ সালের (৫৮ দশমিক ৬ শতাংশ) তুলনায় কমে ২০২৩ সালে হয়েছে ৪৯ দশমিক ৩ শতাংশ।

কিশোরী নারীদের মধ্যে সন্তান জন্মের হার বৃদ্ধি পেয়েছে: ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী কিশোরীদের মধ্যে সন্তান জন্মের হার বৃদ্ধি পেয়েছে। এসভিআরএস জরিপে এই তথ্য উঠে এসেছে। জরিপ অনুযায়ী, ২০২২ সালে কিশোরী নারীদের মধ্যে সন্তান জন্মদানের হার ছিল ৪১ দশমিক ৮৭ শতাংশ আর ২০২৩ সালে সেটি বেড়ে ৪৩ দশমিক ৫৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়া ১৫ বছর বয়সী কিশোরীদের মধ্যে সন্তান জন্মদানের হার ১৫ দশমিক ৮৩ শতাংশ।

প্রতিবন্ধিতা বৃদ্ধি পেয়েছে: ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে আশঙ্কাজনক হারে প্রতিবন্ধিতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এসভিআরএসের প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২২ সালে দেশে প্রতিবন্ধিতার হার ছিল ২৫ দশমিক ৫ শতাংশ আর ২০২৩ সালে সেটি বেড়ে ২৮ দশমিক ২ শতাংশ হয়েছে।

দীর্ঘ হচ্ছে শিক্ষিত বেকারের মিছিল: দেশে গত বছরের শেষ তিন মাসে বেকার জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বেড়েছে ৪০ হাজার। অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিক শেষে দেশে বেকারের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে সাড়ে ২৩ লাখ। এর মধ্যে পুরুষ বেকারের সংখ্যা ১৫ লাখ ৭০ হাজার আর নারী বেকারের সংখ্যা ৭ লাখ ৮০ হাজার। বিবিএস’র সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপে এই তথ্য উঠে এসেছে। শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও কাজ নেই ৪০ শতাংশ তরুণের: বাংলাদেশের প্রায় ৪০ শতাংশ তরুণ নিষ্ক্রিয়। এসভিআরসি’র প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে শিক্ষা, কর্মে কিংবা প্রশিক্ষণে নেই- এমন তরুণের সংখ্যা ৩৯ দশমিক ৮৮ শতাংশ হয়েছে। এই জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই নারী। তরুণদের মধ্যে মাত্র ১৮ দশমিক ৩৫ শতাংশ অলস, আর তরুণীদের মধ্যে এই হার ৬০ দশমিক ৮৫ শতাংশ। জরিপের তথ্য বলছে, এই জনগোষ্ঠীর ৪১ দশমিক ৩ শতাংশই গ্রামে বাস করে। অন্যদিকে শহরের তরুণদের মধ্যে এমন অলস তরুণ জনগোষ্ঠী ৩৫ দশমিক ২১ শতাংশ।

মৌলিক চাহিদা মেটাতে ঋণ করে ২৬ শতাংশ পরিবার: বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খাদ্যনিরাপত্তা পরিসংখ্যান ২০২৩-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের এক-চতুর্থাংশ পরিবার খাদ্য, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষার মতো মৌলিক চাহিদা মেটাতে ঋণ করছে। এক্ষেত্রে শহরের চেয়ে গ্রামের মানুষই বেশি ঋণ করছে। শহর ও গ্রামের মানুষ এই ঋণের বড় অংশই নিচ্ছে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) থেকে চড়া সুদে।

খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় কোটি মানুষ: মাঝারি পর্যায়ে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় থাকা পরিবার বলতে বোঝানো হয়েছে নিয়মিত স্বাস্থ্যকর, সুষম খাবার গ্রহণে যারা অক্ষম তাদের। আর তীব্র খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় থাকা পরিবার বলতে বোঝানো হয়েছে খাদ্য কমানোর উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা পরিবারগুলোকে। বিবিএসের হিসাবে, জরিপকালে দেশে প্রায় ২২ শতাংশ পরিবার মাঝারি পর্যায়ের খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ছিল। আর শূন্য দশমিক ৮২ শতাংশ পরিবার তীব্র খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ছিল।

পরের বেলা ভাত জুটবে কিনা জানে না ৩৪ লাখ মানুষ: খাদ্যের মতো মৌলিক চাহিদা পূরণ বেশ কঠিন হয়ে উঠেছে অনেকের জন্য। একবেলা খাবারের শেষে পরের বেলার চালের জোগান নেই- দেশে এমন পরিবারের হার ২ শতাংশ। আটা মজুত থাকে না ৬০ শতাংশ পরিবারে। নিত্যপণ্যের মধ্যে ডালের সংস্থান নেই ১৯ শতাংশ পরিবারে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খাদ্য নিরাপত্তা-সংক্রান্ত জরিপের চূড়ান্ত প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে। এদিকে খানা আয় ও ব্যয় জরিপের চূড়ান্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে পরিবারের সংখ্যা এখন ৪ কোটি ১০ লাখ। আর জনশুমারি ও গৃহগণনার চূড়ান্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৮ লাখ ২৮ হাজার ৯১১ জন। সেই হিসাবে দেশের ৩৩ লাখ ৯৬ হাজার ৫৮০ জন মানুষের একবেলা খাওয়ার পর পরের বেলার চালের জোগান নেই।

ঝুঁকিপূর্ণ কাজে যুক্ত ১০ লাখ ৭০ হাজার শিশু: জাতীয় শিশুশ্রম জরিপ ২০২২ অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী ৩৫ লাখ ৪০ হাজার শিশু শ্রমজীবী। যার মধ্যে ১৭ লাখ ৮০ হাজার শিশুশ্রমে যুক্ত। শ্রমে থাকা শিশুদের মধ্যে ১০ লাখ ৭০ হাজার শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত রয়েছে। তাদের মধ্যে অটোমোবাইল ওয়ার্কশপে কাজ করে সবচেয়ে বেশি।

নেতিবাচক সূচক নিয়ে বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন: দেশের আর্থসামাজিক সূচকগুলোর নেতিবাচক ধারা উদ্বেগজনক বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান মানবজমিনকে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলোর তথ্য উদ্বেগজনক। বাংলাদেশ ধারাবাহিকভাবে যেসব আর্থসামাজিক সূচকে উন্নতি করছিল সাম্প্রতিককালে সেটা বাধাগ্রস্ত হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ সূচকগুলোর নেতিবাচক ধারার কারণ হিসেবে তিনি কোভিড ও সরকারের নীতির ধারাবাহিকতা রাখার অভাবকে দায়ী করেন। তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি মানুষের জীববনযাত্রার উপরে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। সেটি খাদ্য নিরাপত্তা হোক কিংবা পুষ্টি নিরাপত্তা হোক। এগুলোর প্রতিফলনই আমরা দেখতে পারছি। এটা আমাদের জন্য মোটেও স্বস্তিদায়ক নয়, বরং উদ্বেগজনক। সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে এগুলো সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। সুতরাং নেতিবাচক সূচকগুলোকে অগ্রাধিকার দিয়ে নীতিমালা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নের দিকে আমাদের নজর দিতে হবে। সূত্র : মানবজমিন।