স্মৃতিতে ড. আশরাফ সিদ্দিকী
- প্রকাশের সময় : ১২:০৬:৪১ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৪
- / ৬২ বার পঠিত
মীযানুল করীম: অনেক আগে চট্টগ্রাাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। পড়তাম ইংরেজি বিভাগে অনার্স। একদিন সিন্ডিকেটের মিটিং হচ্ছিল তদানীন্তন ভিসির দোতলা অফিসে। এখন সেটি বোধ হয় মেডিক্যাল সেন্টার। ইউনিভার্সিটির সিন্ডিকেট মিটিং চলছিল সেখানে। দেখলাম, ড. আশরাফ সিদ্দিকী হাঁপাতে হাঁপাতে উঠছেন উপরের দিকে। তার পায়ে ত্রæটি ছিল। এতদূর থেকে অসুস্থ শরীর নিয়েও তিনি হাজির হয়েছিলেন শহর থেকে ১২ মাইল দূরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। কয়েক বছর আগে ১৯ মার্চ, ২০২০ সালে ড. আশরাফ সিদ্দিকী ৯৩ বছর বয়সে মারা গেছেন ঢাকার ধানমন্ডি বাসায়। কেউ স্মরণ করে না তাকে। ধানমন্ডি ১৫ নম্বর বাসস্ট্যান্ড থেকে পূর্বদিকে তার বাসা। বাসস্ট্যান্ডের কাছে বলা চলে। একদিন ওখান দিয়ে যাচ্ছি। তার বাসার বিরাট গেট দেখে অবাক হলাম। তখন খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম তিনি অসুস্থ। তার বাসার গেট ছিল জাতীয় জাদুঘরের মতো কাঠের নকশা করা। আশরাফ সিদ্দিকীর জন্ম টাঙ্গাইল জেলায়। তিনি সাবেক রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ছিলেন, কিন্তু তিনি এ জন্য বাহবা নিতেন না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি আবু সাঈদ চৌধুরীকেও অবমাননাকরভাবে বিদায় করা হয়েছিল প্রেসিডেন্ট পদ থেকে। আবু সাঈদ চৌধুরী রবীন্দ্রনাথের গুণমুগ্ধ ছিলেন। আশরাফ সিদ্দিকীও স্কুলজীবনেই রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনে ভর্তি হয়েছিলেন এবং সেখানেই পড়াশোনা করেন। তারপরও তিনি ভারতপন্থী আওয়ামী লীগারের প্রিয় হতে পারেননি। আশরাফ সিদ্দিকী স্বাধীনতার পর ১৯৭৬ সালে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক নিযুক্ত হয়েছিলেন। আমরা তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। কবি আল মাহমুদ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে বলেছিলেন, ‘আশরাফ সিদ্দিকীর একমাত্র দোষ, তিনি আওয়ামী লীগের লোক নন। এ জন্যই তার বিরুদ্ধে এত বিবৃতি ও বক্তব্য।’ আসলে তিনি শান্তিনিকেতনের ছাত্র থাকা সত্তে¡ও তাকে আপন লোক মনে করা হতো না। বাংলা একাডেমির পরিচালকদের মধ্যে একমাত্র তিনিই শান্তি নিকেতনের ছাত্র ছিলেন। তিনি আত্মপক্ষ সমর্থন করলেও আওয়ামী লীগের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা ছিল না।
ড. আশরাফ সিদ্দিকী তার নানাবাড়ি টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার নাগবাড়ি গ্রামে ১৯২৭ সালের ১ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা আব্দুস সাত্তার সিদ্দিকী ছিলেন একজন সৌখিন হোমিও চিকিৎসক, সেই সাথে তিনি ইউনিয়ন পঞ্চায়েত ও ইউনিয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যানও ছিলেন। আর আশরাফ সিদ্দিকীর মাতা আমিরন নেসা ছিলেন একজন স্বভাব কবি।
আশরাফ সিদ্দিকীর শিক্ষাজীবন শুরু হয় তার নানাবাড়ির পাঠশালায়। দ্বিতীয় থেকে সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েন তার বাবার প্রতিষ্ঠিত রতনগঞ্জ মাইনর স্কুলে। সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হন ময়মনসিংহ জেলা স্কুলে। তার কাব্যপ্রতিভার বিকাশ ঘটে ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়াকালীন অবস্থায়, তার প্রথম কবিতা ‘নববর্ষা’র মাধ্যমে। সপ্তম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় লেখা ‘স্বগত’ ও ‘পূর্বাশা’ কবিতাদ্বয় সাহিত্য পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এ সময় তিনি কিছু আঞ্চলিক বাংলা ধাঁধা সংগ্রহ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে পাঠান এবং এতে রবিঠাকুরের প্রশংসা কুড়ান তিনি। এর কিছুদিন পর শান্তি নিকেতনে পড়ার জন্য ভারতে চলে যান। ১৯৪৭ সালে শান্তি নিকেতনে বাংলায় অনার্স পড়াকালীন দেশ বিভাগ হলে তিনি দেশে ফিরে আসেন। এরপর ১৯৫৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধীনস্থ টাঙ্গাইলের করটিয়া সরকারি সাদত কলেজ থেকে অনার্স সম্পন্ন করেন, যেখানে তিনি সম্মিলিত মেধা তালিকায় প্রথম স্থান অধিকার করেন। তিনি দুবার এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। প্রথমবার করেন ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, দ্বিতীয়বার করেন ১৯৫৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ১৯৬৬ সালে লোকসাহিত্যে পিএইচডিও করেন।
ড. আশরাফ সিদ্দিকীর কর্মজীবন শুরু হয় ১৯৫০ সালে টাঙ্গাইলের কুমুদিনী কলেজে অধ্যাপনার মধ্য দিয়ে। ১৯৫১ সালে এম এ পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন রাজশাহী সরকারি কলেজে। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সাথে গবেষণার জন্য ওই বছরের নভেম্বরে ডেপুটেশনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিলেও ১৯৫২ সালে আবার ফিরে যান রাজশাহী কলেজে। ১৯৫৭ সালে ঢাকা কলেজে যোগ দেন এবং সেখান থেকে উচ্চশিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে যান। পিএইচডি শেষে ১৯৬৭ সালে তিনি কিছু দিন ময়মনসিংহ আনন্দ মোহন কলেজে অধ্যাপনা করেন। একই বছর ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ারে প্রধান সহকারী সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৬৮ সালের তদানীন্তন কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ডের পরিচালকের দায়িত্ব পান। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ারের প্রধান সম্পাদক হিসেবে নিযুক্ত হন। ১৯৭৬ সালে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব পান এবং সেই দায়িত্ব পালন করেন ছয় বছর। ১৯৮৩ সালে জগন্নাথ কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেন এবং অধ্যক্ষ থাকাকালীনই তিনি কর্মজীবন থেকে অবসর নেন।
ব্যক্তি জীবনে তিনি ১৯৫১ সালে সাঈদা সিদ্দিকীকে বিয়ে করেন। তিনি ছিলেন আজিমপুর গার্লস হাইস্কুলের শিক্ষিকা। তাদের পাঁচ সন্তান সবাই উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত ও নিজ নিজ পেশায় সুপ্রতিষ্ঠিত।
বিংশ শতাব্দীর বাংলা সাহিত্যকে যেসব সাহিত্যিক সমৃদ্ধ করেছেন, আশরাফ সিদ্দিকী তাদের মধ্যে অন্যতম। তিনি একাধারে লোকসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, কবি এবং শিশু সাহিত্যিক। আশরাফ সিদ্দিকী ‘গলির ধারের ছেলেটি’ গল্পের অমর ¯্রষ্টা। খ্যাতিমান চলচ্চিত্র নির্মাতা সুভাষ দত্ত এই গল্পকে কেন্দ্র করে তার বিখ্যাত চলচ্চিত্র ‘ডুমুরের ফুল’ নির্মাণ করেছিলেন, যেটি একাধিক জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে। এই গল্পের মূল চরিত্র ‘লাড়–’ ছিল একজন গরিব এতিম ছেলে, যে ভুলক্রমে বেলাডোনা বিষ খেয়ে ফেলে এবং ফলে তার মৃত্যু ঘটে। আশরাফ সিদ্দিকীর আরেকটি উল্লেখযোগ্য গল্প ‘রাবেয়া আপা’; যেটি দিয়ে তার গল্পকার হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে।
দেশ বিভাগের পর অভাবের তাড়নায় এক স্কুলশিক্ষক তার পরিবারের সবাইকে নিয়ে আত্মহত্যা করে। ওই ঘটনা আশরাফ সিদ্দিকীকে নাড়া দেয়। তিনি লেখেন একটি কবিতা যার নাম ‘তালেব মাস্টার’, কবিতাটি ১৯৫০ সালে ‘তালেব মাস্টার ও অন্যান্য’; কাব্যসঙ্কলনে স্থান পায়। এরপর প্রকাশিত হয় কাব্যগ্রন্থ ‘সাত ভাই চম্পা’, ‘বিষকন্যা’, ‘উত্তরের তারা’ প্রভৃতি। তিনি পাঁচ শতাধিক কবিতা রচনা করেছেন। এ ছাড়া তিনি গভীর গবেষণা করেছেন বাংলার লোক ঐতিহ্য নিয়ে। যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি লোকসাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। বাংলাদেশের লোকসাহিত্য নিয়ে তিনি লেখেন ‘লোকসাহিত্য : প্রথম খন্ড’। এরই ধারাবাহিকতায় প্রকাশিত হয় ‘কিংবন্তির বাংলা’, ‘শুভ নববর্ষ’, ‘লোকায়ত বাংলা’, ‘আবহমান বাংলা’, ‘বাংলার মুখ’, ‘লোকসাহিত্য : দ্বিতীয় খন্ড’ বইগুলো ছোটবেলায় মায়ের কাছ থেকে শোনা রূপকথার গল্প থেকে। (দৈনিক নয়াদিগন্ত)