সিডনীর বাঙালীপাড়া লাকাম্বা
- প্রকাশের সময় : ০৫:১৪:০১ অপরাহ্ন, শনিবার, ২২ জুন ২০১৯
- / ৬১৮ বার পঠিত
হাবিবুর রহমান: অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডে আমার অফিসিয়াল ট্যুর শেষ। কাল ফিরে যাব কর্মস্থল নিউইয়র্কে। দুজায়গায়ই চেস্টা করেছি দেশীয় হালাল খাবার খুঁজে বের করতে। না পারলে স্যালমন ডিস বা ভেজিটারিয়ান খাবার দিয়ে চাহিদা মিটিয়েছি। আমার ট্যুর গ্রুপের সদস্যদের বিদায় দিয়ে একদম ঝাড়া হাত পা হয়ে একটা ট্যাক্সি থামিয়ে বল্লাম-লাকাম্বা চলুন। মিটার অন করে গাড়ী ছুটে চল্লো রাজপথ ধরে। লাকাম্বা হলো সিডনীর বাঙালীপাড়া। নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটস, টরেন্টোর ডানফোর্থ বা লিসবনের মার্তিম মুনিজের মত যে সব এলাকা ঘিরে বাঙালীদের বসবাস এবং তাদের বাণিজ্য কেন্দ্র। সিডনী থেকে বেশ দূরে। ট্যাক্সি ভাড়া পড়বে ৬০ ডলারের মত। যদিও আমার হোটেল সিডনি হিলটনের সামনের রেল স্টেশন থেকে লাকান্বা ট্রেন যায়। খরচও কম। তার পরেও কব্জি ডুবিয়ে ডাল ভাত খাব তাই তর সইছিলনা। ট্যাক্সিই সই। এতক্ষন নিজের মাঝেই মগ্ন ছিলাম।ড্রাইভারের ডাকে চিন্তার সুতোটা ছিঁড়লো ।
ভাই কি বাঙালী?
কানে যেনো একরাশ মধু বর্ষিত হলো। হেসে বল্লাম, অবশ্যই ।
আপনি? বললো, শিবলী-ঢাকার নারায়নগঞ্জ বন্দরের ছেলে। আলাপ করে জানলাম অস্ট্রেলিয়া থেকে এম,বিএ করেছে। এখন ট্যাক্সি চালায়। স্বাধীন ব্যবসা। কাগজ হয়েছে। দেশে গিয়ে বিয়ে করে বউ নিয়ে এসেছে। দু’ ছেলে মেয়ে নিয়ে সুখের সংসার।
ভালোই হলো। গল্প করতে করতে চলছিলাম। শিবলি বল্লো কতক্ষণ থাকবেন। বললাম, ঘন্টা খানিক। সে বল্লো তাহলে আমি অপেক্ষা করে আপনাকে নিয়ে যাবো। ইচ্ছা ছিলো ট্রেনে ফিরবো। তার আগ্রহ দেখে বল্লাম, ঠিক আছে।
শিবলী বললো, কি খাবেন? বিরিয়ানী না ভর্তা ভাজি, গরু ভুনা। তাহলে ও ধরনের হোটেলে নামিয়ে দিয়ে আমি চুল কাটতে যাবো।
শিবলী থাকে সিডনীর সাবার্বে। ট্রেনে ঘন্টা খানিক লাগে সিডনি আসতে। তারপর সারাদিন গাড়ী চালিয়ে গাড়ী গ্যারেজে রেখে ট্রেনেই ফিরে যায় বাসায়। দেশীয় বাজার করা, গার্হস্থ্য সামগ্রী ক্রয়, চুল কাটা সবই করা হয় এখানে। যেহেতু এসেছে তাই গার্হস্থ্য কাজ গুলোও সেরে যেতে টায়।
শিবলী আমাকে নামিয়ে দিয়ে গেলো “খুশবু” নামে একটা রেস্তোরায়।
চমৎকার রেঁস্তোরা। আজ শনিবার ছুটির দিন। ক্রেতায় গমগম করছে। অবশ্যই সবাই খাঁটি বঙ্গসন্তান। খুশবু রেস্টুরেন্ট থেকে খাবারের সুগন্ধের পাশাপাশি রাজনীতির গন্ধও বেরুচ্ছিলো। অর্থাৎ রাজনীতি চর্চা। যা সারা বিশ্বেই হয়। এখানেও তা চলছে। আমি এতে মাথা না ঘামিয়ে কোনের দিকে একটা নিরিবিলি টেবিল বেছে নিয়ে বসলাম।
মাথায় স্কার্ফ পরা সুন্দরী একজন তরুণী বাঙালী আপা অর্ডার নিতে আসলেন।
জানতে চাইলেন কি খাবো? বললাম- ভর্তা ভাজি জাতীয় কিছু দেন। সাথে গরু ভুনা, আর ডাল। আপা মাথা নেড়ে চলে গেলেন। একটু পরেই ফিরে এলেন ৫ রকমের ভর্তা, গরু ভুনা, পাতলা ডাল সাথে ইয়া বড় প্লেট ভর্তি সালাদ। বুঝলাম এটা বোনাস। প্রবাসে বাঙালী মাত্রই স্বজন-কথাটার আর একবার প্রমাণ পেলাম।
খাওয়ার পর আয়েশ করে এক কাপ চা খেয়ে বাইরে বেরোলাম। শিবলি গেছে চুল কাটতে।
সারি সারি দোকান। সাইনবোর্ড গুলি কাছে টানছে। হাটবাজার, খুশবু, বঙ্গ বাজার, বাংলাদেশ প্যালেস, বনফুল রেস্টুরেন্ট, রহমান হালাল মিট, বাংলা বাজার, নার্গিস কাবাব, কাওরান বাজার আরো কত কি!
লাকাম্বায় বাংলাদেশী চিত্রনায়িকা শাবনূর গ্রোসারী দোকান
পাশের বাংলা বাজার গ্রোসারীতে ঢুকলাম। মিট কাটছেন একজন। জানতে চাইলেন কিছু লাগবে কিনা। না বললাম। জানালাম আমেরিকা থেকে এসেছি। চলে যাব কাল তাই বাঙালী পাড়া ঘুরে দেখতে এসেছি।
তিনি চা অফার করলেন। বললাম, এই মাত্র খেয়ে এসেছি। দোকানটা নিজের কিনা জানতে চাইলে বল্লেন, না কাজ করি। দোকানের মালিক বাংলাদেশ চলচ্চিত্রের নায়িকা শাবনুর। তার বাসাও কাছেই। এখন তিনি এখানেই। দোকান চালায় তার ভাই তমাল। এসময় তমাল দোকানে ঢুকলেন। পরিচয় হলো তার সাথে। তিনিও কিছু খাবার জন্য পীড়াপীড়ি করলেন। বিনীতভাবে তা প্রত্যাখান করলাম। তিনি কাউন্টারের ভিতর নিয়ে গিয়ে একটা ছবি তুললেন আমাকে নিয়ে। তমালের আন্তরিকতা মুগ্ধ করার মত।
দোকান দেখে বেরিয়ে আসছিলাম। প্রথম দেখা ভদ্রলোক যিনি মিট কাটছিলেন তিনি জানালেন নিউইয়র্কে তার ভাই থাকেন। সবাই তাকে চেনে। নাম জানতে চাইলে বললেন- আকবর হায়দার কিরন।
কিরনকে আমি চিনি। আগে ডুয়েন রিডে কাজ করতেন। মীর ওয়াজেদ শিবলী’র বাংলা টিভি’র সাথে জড়িত ছিলেন। এখন ভয়েস অব আমেরিকার নিউইয়র্ক প্রতিনিধি। তবে তাকে আমি চিনি সেই ছাত্র জীবন থেকেই। তিনি ইন্টারন্যাশনাল রেডিও ক্লাব করতেন। ডয়েচে ভেলে বা ভোয়ার ম্যাগাজিন বের করলে তাতে আমার ছবি থাকতোই। তবে তার সাথে আমার সম্পর্ক গাঢ় হয়েছিল বেলাল হায়দারের মাধ্যমে। বেলাল তার এলাকা নোয়াখালীর ফেনীর এবং সম্পর্কে তার মামা। বেলাল আমার ক্লাসমেট ছিলো। একসাথে বাংলায় অনার্স-মাস্টার্স করেছি। ফেনী তাকিয়া বাড়ীর সন্তান বেলাল ফেনী থেকেই ‘গ্রাম বার্তা’ নামে একটি পত্রিকা বের করতো। কর্মজীবনেও এটি চালু রাখে। রাজারবাগ পুলিশ লাইনের পাশে গ্রাম বার্তা নামে একটি প্রেসও চালু করে। পত্রিকাও বের করতো ওখান থেকে। সাপ্তাহিক স্বদেশেও দীর্ঘদিন কাজ করেছে বেলাল। পত্রিকাটি অনেক সুনাম কুড়িয়েছিল তখন। আমার অনেক লেখা স্বদেশে কভার স্টোরি হিসাবে ছাপা হয়েছে। কিরনের ভাই-এর কাছে বিদায় নিয়ে বাইরে বেরোলাম।
খাওয়া ছাড়াও লাকাম্বাতে আসা আমার অন্য একটি উদ্দেশ্য ছিলো। নিউইয়র্কে আমার সুহ্রদ, বিশিস্ট লেখক খলকু কামাল একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিয়েছিলেন নানু মিয়া নামক একজনকে দিতে। যিনি সিডনি জালালাবাদ এসোসিয়েশনের একজন কর্মকর্তা। এখানে অনেক সমাজকল্যাণমুলক কাজের সাথে জড়িত এবং কমিউনিটি ব্যক্তিত্ব।
লাকাম্বার বাংলাদেশী বাণিজ্যিক এলাকা
খলকু কামাল আমাকে অনেক ভালোবাসেন। তাই সম্ভবত তার কাছে আমার সম্পর্কে বেশী বেশী বলেছেন নানু মিয়াকে। নিউইয়র্কেও আমাকে বেশ কয়েকবার ফোন করেছিলেন। অস্ট্রেলিয়ায় আসার পরেও তিনি বার বার ফোন করে খোঁজ নিয়েছেন। কথা বার্তায় তাকে খুব আন্তরিক মনে হয়েছিলো। হোটেল ছেড়ে তার বাসার থাকার জন্য তিনি আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে ছিলেন। যেহেতু এটা আমার বিজনেস ট্যুর আর আগেই আমি সিডনী হিলটনে রুম বুকিং করে ফেলেছি তাই এ যাত্রা তার কাছে মাফ চেয়ে নিলাম। তিনি সন্ধ্যায় আমাকে হোটেল থেকে নিয়ে আসবেন বলেছিলেন। কিন্তু তাকে সারপ্রাইজ দিতে আমি নিজেই লাকাম্বা এসে তাকে ফোন দিই। আর তিনি আসছেন। আমাকে অপেক্ষা করতে বলেছেন এই খুশবু রেস্টুরেন্টে-ই।
লাকাম্বা এলাকাটা একটু ঘুরে ফিরে দেখে আবার এসে বসি খুশবু রেস্টুরেন্টে। এককাপ চায়ের অর্ডার দিই। শিবলী একবার দেখা দিয়ে আবার চলে গেছে কিছু গ্রোসারী কেনাকাটা করতে। একটু পর দেখলাম একজন এলেন। নাদুস নুদুস চেহারা। সাথে আরো কয়েকজন। নানু মিয়াকে চিনিয়ে দিতে হলোনা। কিছু লোক আছে যাদের চিনিয়ে দিতে হয়না। তাদের ব্যক্তিত্বই তাদের চিনিয়ে দেয়। উনিও আমাকে চিনলেন। দুজন দুজনকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম আপনজনের মত। বুকের মাঝে থাকতেই অনেক অভিযোগ ঝেড়ে দিলেন আগ্নেয়গিরির লাভার মত। সময় নিয়ে আসা উচিত ছিলো। তিনি গেট টুগেদার আয়োজন করেছিলেন। এখন বাসায় যেতে হবে। রাতে আমাকে হোটেলে পৌছে দিবেন ইত্যাদি। চেনা নেই, জানা নেই এমন একজন মানুষের জন্য তার এই আন্তরিকতা মুগ্ধ করার মত।
লাকাম্বায় প্রবাসী বাংলাদেশীদের সাথে লেখক
নানু মিয়া বৃহত্তর সিলেটের মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলার মানুষ। নিউইয়র্কে কুলাউড়ার অনেকে আমার পরিচিত। সর্বশেষে জানা গেল নিউইয়র্কে কুলাউড়া সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক তানউইর শামীম লোবানের বোনকে তিনি বিয়ে করেছেন। আর শামীমের সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা দীর্ঘদিনের। থাকিও ব্রঙ্কসে একই এলাকায়। এরই মধ্যে অনেকে জড়ো হয়েছেন। নানু মিয়া সবার মধ্যমনি।বুঝলাম প্রবাসী কমিউনিটিতে তার অবস্থান বেশ শক্ত।
স্বল্প সময়ে অনেক কথা হলো। কুলাউরার এম এম শাহীন-সুলতানের রাজনীতি সহ অনেক কথা। বদররুদ্দোজা চৌধুরীর রাজনীতি জীবনের শুরু থেকে এই এলাকায় আনাগোনা। কথা হলো তাদের সংগঠন জালালাবাদ এসোসিয়েশন অব নিউ সাউথ ওয়েলস নিয়ে। তিনি একসময় সভাপতি ছিলেন। এখন উপদেষ্টা। ক্যান্সার নিয়ে গবেষনা করছে এমন একটা সংগঠনের সাথেও তিনি কাজ করছেন কমিউনিটির অন্যান্যদের নিয়ে। এজন্য প্রতিবছর ফান্ড রাইজিং করেন। শুধু বাংলাদেশ কমিউনিটি থেকে ক্যান্সার কাউন্সিলের জন্য এযাবত ২ লক্ষ ১৭ হাজার ৮১২ ডলার উঠিয়ে দিয়েছেন।
কথা হলো সাংবাদিক শাহেদ আলমকে নিয়ে। তিনি ইউটিউব-এ শাহেদ আলমের রাজনৈতিক বিশ্লেষনের নিয়মিত শ্রোতা এবং ভক্ত। শাহেদ অস্ট্রেলিয়া এসেছিলেন তার ভাইয়ের বাসায় বেড়াতে। তিনি তার সাথে ব্যস্ততার জন্য দেখা করতে পারেননি বলে দু:খ প্রকাশ করলেন। শাহেদকে তার কথা বলবো বলে জানালাম। এ সময় তার সাথে আর এক কর্মকর্তা ফারুক হান্নান সহ আরো বেশ কয়েকজন উপস্থিত ছিলেন।
প্রবাসের ব্যস্ততম জীবন যাপন করেও এরা ক্যান্সার কাউন্সিলের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। কমিউনিটিকে শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড় করার চেস্টায় নিয়োজিত। সময় থাকলে আরো অনেক জানতে পারতাম। শিবলিওতাড়া দিচ্ছিলো। তাই অনিচ্ছা সত্বেও উঠতে হলো।
এসময় সবাইকে অবাক করে দিয়ে খুশবু হোটেলের মালিক শামীম মিয়া এক গামলা ভর্তি রসগোল্লা নিয়ে এলেন। বললেন- আমার হোটেলের তৈরি। এক্কেবারে গরম। খেতে হবে। হৈ হৈ করে সবাই গরম রসগোল্লা খেলাম। নানু মিয়া দাম দিতে চাইলেও তিনি নিলেন না। উপরন্তু তার সৌজন্যে সবাইকে নিয়ে ডিনারের জন্য আমন্ত্রণ জানালেন।
অবশেষে বিদায় নিলাম। নানু মিয়া, ফারুক হান্নান, শামীম মিয়া সহ সকলের ভালোবাসা বুকে বহন করে এসে বসলাম শিবলির গাড়ীতে। গাড়ী ছুটে চল্লো প্রশস্ত রাজপথ ধরে সিডনীর পথে। পথে যেতে যেতে ভাবলাম, এদের এই ভালোবাসার মূল্য দিতে আমাকে আবার আসতে হবে সময় নিয়েঅস্ট্রেলিয়ায়-সিডনীর লাকাম্বায়। ততদিন সবাই ভালো থাকুন। গুড বাই সিডনি, গুড বাই অস্ট্রেলিয়া।
সিডনী, অস্ট্রেলিয়া ।
৮ জুন’২০১৯ সাল।
হাবিবুর রহমান
সিইও, বাংলা ট্যুর
banglatourus@gmail.com