নিউইয়র্ক ০৯:১৫ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৭ জুন ২০২৫, ৩ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

স্মৃতিতে ১৭ই মার্চ ১৯৭৪

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০২:২৯:১৪ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৭ মার্চ ২০২৫
  • / ৯৫ বার পঠিত

সাঈদ তারেক: আজ ১৭ই মার্চ। ১৯৭৪ সালের এই দিনে আওয়ামী লীগ সরকার খুনী রক্ষীবাহিনী দিয়ে জাসদের অনেক নেতাকর্মীকে হতাহত করেছিল। এ নিয়ে একটি প্রথম সাড়ির পত্রিকায় রিপোর্ট দেখলাম। এতে আমার নামও উল্লেখ আছে।
হ্যাঁ, সেদিন আমার অ্যাসাইনমেন্ট ছিল ওই রিপোর্ট কাভার করার। আমি তখন দৈনিক গণকন্ঠ পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার। ওইদিন বিকেলে পল্টন ময়দানে জাসদের এক জনসভা ডাকা হয়েছিল। সভার শেষে আকষ্মিকভাবেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসভবন ঘেরাওয়ের কর্মসূচী ঘোষণা করা হয়। এর আগে এমন কোন কর্মসূচী ঘোষনার আভাষ পাইনি। মিছিল শুরু হলে আমি একেবারে সামনে চলে আসি। সাথে ছিল আমাদের ফটো সাংবাদিক জালালুদ্দিন হায়দার। মিছিল মৎস্যভবনের (তখন মৎস্যভবন ছিল না) মোড় ঘুড়ে কাকরাইল মসজিদের দিকে এগোয়। এরপর তিন রাস্তার মোড় থেকে শেরাটনের দিকে রওনা দেয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসা পার করে সামনের দিকে এগুতে থাকে। মিছিল ছিল খুবই প্রানবন্ত। নেতারা সামনের কাতারে হাত ধরাধরি করে ছিলেন। আমি মন্ত্রীর বাসার গেটে কাউকে আগুন লাগাতে বা ধাক্কাধাক্কি করতে দেখিনি। হঠাৎ শেরাটনের দিককার মোড় ঘুড়ে রক্ষী বাহিনীর কয়েকটা ভ্যান ও জীপ এগিয়ে আসে। থমকে দাঁড়াই। গাড়ীগুলো এসে দাঁড়াতেই রক্ষী বাহিনী দ্রæত নেমে ফায়ারিংয়ের পজিশন নেয়। আমি চট করে পশ্চিম দিকে রমনা পার্কের প্রাচীরঘেষা ফুটপাথের ওপর উঠে যাই। আমরা কয়েকজন রিপোর্টার ছিলাম রক্ষীবাহিনী আর মিছিলের পুরোভাগের মাঝখানে। এ সময় শুরু হয় গুলী। একসাথে অনেকগুলো এসএলআর থেকে। সবাই হতচকিত হয়ে পড়ে। শুরু হয় ছোটাছুটি। মিছিলের সামনের দিকে যারা ছিলেন মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। মিছিল ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। আমি পাচিল টপকে রমনা পার্কের ভেতরে আশ্রয় নেই। পাচিলের ফোকর দিয়ে দেখতে থাকি দৃশ্যাবলী। কিছুক্ষণের মধ্যে গুলী থামে। আহতদের আর্ত চীৎকারের মধ্যে ঘাতকের দল মাটীতে পড়ে থাকা সবাইকে ট্রাকে ভ্যানে ওঠাতে থাকে। পার্কের ভেতর তখন অনেক লোক আশ্রয় নিয়েছে। রক্ষী বাহিনী তা লক্ষ্য করে সেদিকেও বন্দুক তাক করে। এ সময় আমি পার্কের ভেতরেই দক্ষিণ দিকে হাঁটা দেই। দ্রæত হেঁটে এসে দক্ষিণ-পূর্বদিকের গেট দিয়ে বের হয়ে প্রেসক্লাবে আসি। সেখানে কিছুক্ষণ কাটিয়ে ৩৫ বঙ্গবন্ধু এভিনিউস্থ জাসদ অফিসের দিকে রওনা দেই। ধারনা ছিল ওখানে নেতাদের কাউকে পাবো। কিন্তু জিপিওর সামনে এসে দাঁড়াতেই দেখি বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটের দিক থেকে জ্বলন্ত মশাল হাতে স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা আব্দুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে একদল লোক ছুটে এসে জাসদ অফিসে ঢুকে যায়। কিছু পর অফিসের ভেতর আগুন জ্বলতে থাকে। রাজ্জাক সাহেবের হাতেও একটা মশাল ছিল। মশালের আলোতে এক ঝলক তার ঘর্মাক্ত মুখটা দেখেছি। ছিল বিচিত্র এক পৈচাশিক হাসি। পরের দিন সম্ভবত: আওয়ামী লীগ আরও এক দফা অগ্নিসংযোগ করে। এতে অফিস পুরোপুরি ভষ্মীভূত হয়ে যায়। এরপর সে সন্ধ্যায় হেঁটে ওয়ারি টিপু সুলতান রোডে গনকন্ঠ অফিসে আসি। সবাই যথারীতি রিপোর্টও লিখি। কম্পোজ হয় পেজ মেকআপ হয়। ভোর রাতে পুলিশ এসে সব ম্যাটার ভেঙ্গে ফেলে। (তখন আমাদের পত্রিকা ছাপা হতো ফ্লাট অফসেট মেশিনে) ফলে পরের দিন আর কাগজ বের হয় না। রাতেই সম্পাদক কবি আল মাহমুদকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর বেশ কিছুদিন গণকণ্ঠের প্রকাশনা বন্ধ ছিল। ফাইনালি সীলগালা করে দেওয়া হয় যেদিন বাকশাল পাশ হয়, ’৭৫এর ২৫ জানুয়ারী রাতে।
সেদিনের ঘটনা নিয়ে অনেকেই যার যার মত করে লিখেছেন, আমার এই লেখা একজন প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান।

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

স্মৃতিতে ১৭ই মার্চ ১৯৭৪

প্রকাশের সময় : ০২:২৯:১৪ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৭ মার্চ ২০২৫

সাঈদ তারেক: আজ ১৭ই মার্চ। ১৯৭৪ সালের এই দিনে আওয়ামী লীগ সরকার খুনী রক্ষীবাহিনী দিয়ে জাসদের অনেক নেতাকর্মীকে হতাহত করেছিল। এ নিয়ে একটি প্রথম সাড়ির পত্রিকায় রিপোর্ট দেখলাম। এতে আমার নামও উল্লেখ আছে।
হ্যাঁ, সেদিন আমার অ্যাসাইনমেন্ট ছিল ওই রিপোর্ট কাভার করার। আমি তখন দৈনিক গণকন্ঠ পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার। ওইদিন বিকেলে পল্টন ময়দানে জাসদের এক জনসভা ডাকা হয়েছিল। সভার শেষে আকষ্মিকভাবেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসভবন ঘেরাওয়ের কর্মসূচী ঘোষণা করা হয়। এর আগে এমন কোন কর্মসূচী ঘোষনার আভাষ পাইনি। মিছিল শুরু হলে আমি একেবারে সামনে চলে আসি। সাথে ছিল আমাদের ফটো সাংবাদিক জালালুদ্দিন হায়দার। মিছিল মৎস্যভবনের (তখন মৎস্যভবন ছিল না) মোড় ঘুড়ে কাকরাইল মসজিদের দিকে এগোয়। এরপর তিন রাস্তার মোড় থেকে শেরাটনের দিকে রওনা দেয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসা পার করে সামনের দিকে এগুতে থাকে। মিছিল ছিল খুবই প্রানবন্ত। নেতারা সামনের কাতারে হাত ধরাধরি করে ছিলেন। আমি মন্ত্রীর বাসার গেটে কাউকে আগুন লাগাতে বা ধাক্কাধাক্কি করতে দেখিনি। হঠাৎ শেরাটনের দিককার মোড় ঘুড়ে রক্ষী বাহিনীর কয়েকটা ভ্যান ও জীপ এগিয়ে আসে। থমকে দাঁড়াই। গাড়ীগুলো এসে দাঁড়াতেই রক্ষী বাহিনী দ্রæত নেমে ফায়ারিংয়ের পজিশন নেয়। আমি চট করে পশ্চিম দিকে রমনা পার্কের প্রাচীরঘেষা ফুটপাথের ওপর উঠে যাই। আমরা কয়েকজন রিপোর্টার ছিলাম রক্ষীবাহিনী আর মিছিলের পুরোভাগের মাঝখানে। এ সময় শুরু হয় গুলী। একসাথে অনেকগুলো এসএলআর থেকে। সবাই হতচকিত হয়ে পড়ে। শুরু হয় ছোটাছুটি। মিছিলের সামনের দিকে যারা ছিলেন মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। মিছিল ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। আমি পাচিল টপকে রমনা পার্কের ভেতরে আশ্রয় নেই। পাচিলের ফোকর দিয়ে দেখতে থাকি দৃশ্যাবলী। কিছুক্ষণের মধ্যে গুলী থামে। আহতদের আর্ত চীৎকারের মধ্যে ঘাতকের দল মাটীতে পড়ে থাকা সবাইকে ট্রাকে ভ্যানে ওঠাতে থাকে। পার্কের ভেতর তখন অনেক লোক আশ্রয় নিয়েছে। রক্ষী বাহিনী তা লক্ষ্য করে সেদিকেও বন্দুক তাক করে। এ সময় আমি পার্কের ভেতরেই দক্ষিণ দিকে হাঁটা দেই। দ্রæত হেঁটে এসে দক্ষিণ-পূর্বদিকের গেট দিয়ে বের হয়ে প্রেসক্লাবে আসি। সেখানে কিছুক্ষণ কাটিয়ে ৩৫ বঙ্গবন্ধু এভিনিউস্থ জাসদ অফিসের দিকে রওনা দেই। ধারনা ছিল ওখানে নেতাদের কাউকে পাবো। কিন্তু জিপিওর সামনে এসে দাঁড়াতেই দেখি বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটের দিক থেকে জ্বলন্ত মশাল হাতে স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা আব্দুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে একদল লোক ছুটে এসে জাসদ অফিসে ঢুকে যায়। কিছু পর অফিসের ভেতর আগুন জ্বলতে থাকে। রাজ্জাক সাহেবের হাতেও একটা মশাল ছিল। মশালের আলোতে এক ঝলক তার ঘর্মাক্ত মুখটা দেখেছি। ছিল বিচিত্র এক পৈচাশিক হাসি। পরের দিন সম্ভবত: আওয়ামী লীগ আরও এক দফা অগ্নিসংযোগ করে। এতে অফিস পুরোপুরি ভষ্মীভূত হয়ে যায়। এরপর সে সন্ধ্যায় হেঁটে ওয়ারি টিপু সুলতান রোডে গনকন্ঠ অফিসে আসি। সবাই যথারীতি রিপোর্টও লিখি। কম্পোজ হয় পেজ মেকআপ হয়। ভোর রাতে পুলিশ এসে সব ম্যাটার ভেঙ্গে ফেলে। (তখন আমাদের পত্রিকা ছাপা হতো ফ্লাট অফসেট মেশিনে) ফলে পরের দিন আর কাগজ বের হয় না। রাতেই সম্পাদক কবি আল মাহমুদকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর বেশ কিছুদিন গণকণ্ঠের প্রকাশনা বন্ধ ছিল। ফাইনালি সীলগালা করে দেওয়া হয় যেদিন বাকশাল পাশ হয়, ’৭৫এর ২৫ জানুয়ারী রাতে।
সেদিনের ঘটনা নিয়ে অনেকেই যার যার মত করে লিখেছেন, আমার এই লেখা একজন প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান।