ফরহাদ মজহার কাহিনী : জিপিএস ট্র্যাকিং,‘ব্যাগ আবিষ্কার’ ও আইনগত সচেতনতা!

- প্রকাশের সময় : ১২:২৮:০১ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৭ জুলাই ২০১৭
- / ১২২৬ বার পঠিত
মোহাম্মদ আলী বোখারী: কবি ও কলামিস্ট ফরহাদ মজহার উদ্ধার কাহিনী বিমূর্ত করেছে ২০০৫ সালের একটি ঘটনা। ওই বছরের ৪ মার্চ অপরাহ্নে একটি ‘হাই সাসপেন্স ড্রামা’র আগে কানাডার সাধারণ টরন্টোবাসী জানত না যে, সন্দেহভাজন ধরতে পুলিশ জিপিএস ট্র্যাকিং মেশিন ব্যবহার করে। এতে ওই ধরতে পারার সক্ষমতায় এক আত্মহননকারী বাবা মারা গেলেও দ্রুতই উদ্ধার করা সম্ভব হয় মৃত্যুমুখে নিক্ষেপিত তার পাঁচ বছরের কন্যাকে। ওই ঘটনাটি ঘটে টরন্টোর ডনমিলস রোডের ব্রিজের নিচে পৃথিবীর দ্বিতীয় ব্যস্ততম হাইওয়ে ৪০১-এর উপর, যেখানে দ্বিমুখী মোট আট লেনে ধাবমান গাড়ির গতি কমপক্ষে ১০০ কিলোমিটার।
পুলিশের ইন্সপেক্টর ব্রায়েন ও’কনোর তখন সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘মেয়েটি কোনো প্রকার গাড়ির আঘাতবিহীন বেঁচে গেছে, সেটি এক অলৌকিক ঘটনাই বটে’। জানা যায়, দাম্পত্য কলহে ওই আত্মহননকারী বাবা ঘটনার দিন বিকালে তার মেয়েকে কোলে নিয়ে সেলফোনে নিজের স্ত্রীকে উভয়ের আত্মহননের হুমকি দেন। ফলে তা দ্রুত জানাজানিতে পুলিশ সরাসরি বাবার ফোনে কল দিয়ে আপসের একপর্যায়ে জিপিএস সিগন্যাল ট্র্যাকিং থেকে উভয়কে উদ্ধার করে। ততক্ষণে বাবাটি মাথা থেতলে হাইওয়েতে মারা গেলেও নিক্ষেপিত মেয়েটি শীতের হুডি জ্যাকেট ও বরফের স্তপের কারণে দেহ অভ্যন্তরস্থ কিছু রক্তপাত ছাড়া হেলিকপ্টারে সিক কিডস হসপিটালে নেওয়া হলে অক্ষতভাবে প্রাণে বেঁচে যায়। তবে ওই সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ ইন্সপেক্টর ব্রায়েন ও’কনোর মর্মস্পর্শী ভাষায় বলেন, ‘লোকটি তার স্ত্রী, কন্যা ও একই সঙ্গে সন্তান আছে এমন পুলিশ অফিসারদেরই মর্মব্যথী করেছে’।
আপাতদৃষ্টিতে সেই কারণে ফরহাদ মজহার উদ্ধার কাহিনীটি র্যাব ৬-এর অতি প্রশংসনীয় কর্মতৎপরতার স্বাক্ষর হলেও সরাসরি তাকে কলবিহীন জিপিএস ট্র্যাকিং, যশোরে পরিত্যক্ত মাইক্রোবাস উদ্ধার, স্বেচ্ছায় ভ্রমণের কথিত ব্যাগ উদ্ধার, ‘গফুর’ নামে হানিফ পরিবহনে ঢাকায় ফেরার চেষ্টা, সবই যথেষ্ট উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার কারণ হয়েছে এবং আইনগত সচেতনতা ও নাগরিক অধিকারের স্বার্থে তা বিশ্লেষণ হওয়া জরুরি।
সংবাদে দৃশ্যমান, গত সোমবার ভোর ৫টায় কবি ফরহাদ মজহার যখন বাসা থেকে বের হন, সেখানে সিসিটিভির ফুটেজে তাকে শুধু পাঞ্জাবি ও লুঙ্গি পরিহিত অবস্থায় বের হতে দেখা যায়; হাতে কোনো ব্যাগ বা কিছুই ছিল না। বাসার নিরাপত্তা কর্মীও তা নিশ্চিত করেছেন। তা হলে ওই কথিত ‘ভ্রমণের ব্যাগ’ এলো কোত্থেকে, যেখানে ফোনের চার্জার ও শার্ট পাওয়া গেছে? অথচ তিনি কখনো শার্ট পড়েন না, এমনকী তার স্ত্রী ফরিদা আখতারের ভাষ্যানুযায়ী সচরাচর তিনি যে ব্যাগ ব্যবহার করেন সেটিতে পড়ার বই ও ব্লাড প্রেসারের ওষুধ থাকে, ওষুধ না খেলে অসুস্থ হয়ে পড়েন।
কবির কাছের মানুষ ওয়াহিদ ফারুকী বলেছেন, একটি মহল ফরহাদ মজহারের লেখালেখি নিয়ে অসন্তুষ্ট ছিল। হয়তো তারাই তাকে অপহরণ করেছিল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় বাধ্য হয়ে ছেড়ে দিয়েছে। নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করলে অপহরণকারীদের ধরা কঠিন হবে না। লক্ষণীয়, এই ছেড়ে দেওয়ার ক্ষেত্রেও শুরু থেকে শেষাবধি ফরহাদ মজহার একমাত্র নিজের স্ত্রীর সঙ্গে ফোনে যে কথোপাকথন করেছেন, তাতে ভয়ার্ত কণ্ঠে ‘ওরা আমাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে, ওরা আমাকে মেরে ফেলবে’ এবং ৩৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ জোগাড়ের তাগিদ ছিল। অন্যদিকে, ওই ধরে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি আদাবর থানায় জানানো হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোবাইল ট্র্যাকিং করে তার অবস্থান প্রথমে মানিকগঞ্জ ও পরে মাগুরায় পেয়েছে এবং পাটুরিয়া ফেরিঘাট দিয়ে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে। এরপর খুলনার সোনাডাঙা থানার ইব্রাহিম সড়কে পায়, যেখানে অভিযানে একটি পরিত্যক্ত মাইক্রোবাস উদ্ধার করে র্যাব। অতঃপর খুলনার নিউ গ্রিল হোটেলে রাতের খাবার খাওয়া, ওই হোটেল মালিক মান্নান কর্তৃক চিহ্নিত হওয়া ও র্যাবকে খবর দেওয়া এবং মোবাইল ট্র্যাকিং করে শিববাড়ী বাস কাউন্টার এলাকায় অবস্থান নির্ণয় সত্ত্বেও কোচ ছেড়ে দেওয়ার পর পথে অভয় নগরের নোয়াপাড়ায় বাস থামিয়ে তাকে উদ্ধার, যা পুলিশি ভাষায় ফরহাদ মজহার ‘নাটক’ সাজিয়েছেন।
কিন্তু সিসিটিভির ফুটেজে ‘ব্যাগহীন’ ফরহাদ মজহারের বাসা থেকে বের হওয়ার সঙ্গে এতসব ঘটনাবলির সঙ্গতি ও সামঞ্জস্যতা পরিপূরণে পুলিশেরই দায়িত্ব ওই ‘নাটক’ যথাযথভাবে তদন্ত করে প্রমাণ করা। একইসঙ্গে ওই ফোন ট্র্যাকিং কীভাবে সম্ভব হয়েছে, তা-ও জনসমক্ষে আইনগতভাবে বিশ্বাসযোগ্য করা দরকার। কেননা পুলিশ কলবিহীন ফোন ট্র্যাকিং করে ফরহাদ মজহারকে উদ্ধার করেছে, সরাসরি কল করে নয়; যা পশ্চিমা বিশ্বে নাগরিক সচেতনতা ও অধিকারের পরিপন্থী। পাশাপাশি এ কথাটি সত্য প্রতিপন্ন হলো যে, এখন বাংলাদেশে যে কোনো মোবাইল ফোন ন্যাশনাল আইডি ও ফিঙ্গারপ্রিন্টযুক্ত রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়াধীন হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই পুলিশি ট্র্যাকিংয়ের আওতাধীন। অথচ যেকোনো অত্যাধুনিক স্মার্ট ফোনের মালিক মাত্রই জানেন, তা হারিয়ে গেলে কীভাবে ট্র্যাকিং করা যায়, যেমনÑ আইফোন ‘ফাইন্ড মাই আইফোন’, গুগল ‘ফাইন্ড মাই ডিভাইস’ ও স্যামসাংয়ের ক্ষেত্রে ‘ফাইন্ড মাই মোবাইল’। কিন্তু এই মালিকেরা জানেন না যে, আইনগতভাবে তাদের ফোনটি পুলিশের নখদর্পনে এবং তা কীভাবে নখদর্পনে গেল, তা জানা তাদের আইনগত অধিকার। কেননা পশ্চিমা বিশ্বে এই ‘ট্র্যাকিং’ বিষয়টি ‘স্টকিং’ বা হয়রানি হিসেবে গণ্য, যখন তা ব্যক্তির অজ্ঞাতসারে ঘটে থাকে। তারা এটাও জানেন যে, ফোন ট্র্যাকিং মেশিন ‘রেডিও ওয়েভের মাল্টিলেটারেশন’ থেকে অথবা ‘আনআইডেন্টিফাইড নম্বর’ থেকে ‘মিস কল’ দিয়ে এক ধরনের ‘ক্লায়েন্ট সফ্টওয়্যার’ ছড়িয়ে বা ‘সার্ভিস প্রোভাইডারের’ মাধ্যমে ফোনের কর্মতৎপরতা ও কথোপকথন রেকর্ড করে থাকে। আবার ডেলিভারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরাও বাধ্যতামূলকভাবে নিজেদের ফোনে বিশেষ অ্যাপ ডাউনলোড করে কর্তৃপক্ষের কাছে নজরবন্দি থাকেন। অনেক ক্ষেত্রে তা ক্ষতিপূরণের মামলাতেও গড়িয়েছে, কারণ তাদের কর্মের বাইরে ব্যক্তিগত জীবনও নজরবন্দি হয়েছে। এসব তথ্য গুগল সার্চেও বিদ্যমান, যেখানে ‘এয়ারপ্লেন মোড’ বা সিম খুলেও সুরক্ষা নেই। তাই জানা দরকার, বাংলাদেশ পুলিশের ফোন ট্র্যাকিংয়ের কর্মপরিসর এবং পরিধিটি কতটুকু জনগণের জ্ঞাতসারে এবং কোন পর্যায়ে বিস্তৃত? আদৌ তা কোনো অ্যাপের মাধ্যমে নিরপরাধ মানুষের অজ্ঞাতসারে কোনো কিছু রেকর্ড করে কি না? কবি ফরহাদ মজহারের উদ্ধার কাহিনীটি খুবই প্রশংসনীয় হলেও এই বিষয়গুলোও প্রকারান্তরে প্রশ্ন হিসেবে উন্মোচিত। (আমাদের সময়)।
টরন্টো, কানাডা।