প্লাস্টিক ব্যবহার রোধে প্রয়োজন সমন্বিত পরিকল্পনা
- প্রকাশের সময় : ১২:১৭:৫৯ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৯ নভেম্বর ২০২৪
- / ৫৭ বার পঠিত
বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ হলো প্লাস্টিক দূষণ। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকারের সাম্প্রতিক পদক্ষেপ প্রশংসনীয়। অতীতেও প্লাস্টিকের ব্যাগ ব্যবহার নিষিদ্ধ করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল। তবে কার্যকরী ও বাস্তবসম্মত পরিকল্পনার অভাবে এসব উদ্যোগে তেমন কোনো সফলতা আসেনি।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় কর্তৃক কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নীতি, ২০২১ অনুযায়ী নির্দিষ্ট কিছু ‘একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক’ (এসইউপি) নিষিদ্ধের নির্দেশিকা জারি করাটা বলা যায় তেমনই একটি পদক্ষেপ। উদ্যোগটির উদ্দেশ্য প্রশংসনীয়, সন্দেহ নেই। তবে নির্দেশিকাটি কতটা বাস্তবসম্মত, তা সতর্কভাবে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিকের যে তালিকা তৈরি করা হয়েছে তা প্রকাশের আগে অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করা হয়নি। বর্তমান অন্তর্র্বতী সরকারের নেতৃত্বে রয়েছেন দেশের কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ পরিবেশবিদ ও অর্থনীতিবিদ। তাই আশা করি, একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক নিষিদ্ধের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে আরও কার্যকর ও কৌশলগত পরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে।
কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নীতি, ২০২১-এর ৯ নম্বর বিধিতে প্রদত্ত একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক (এসইউপি) পণ্যের সংজ্ঞার সঙ্গে বর্তমান ১৭টি এসইউপি পণ্যের তালিকা পুরোপুরি সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এই বিধি অনুযায়ী, এসইউপি হলো এমন কোনো প্লাস্টিক প্যাকেজিং বা পণ্য যা রিসাইকেল বা রিইউজ উপযোগী নয়। তবে তালিকার কিছু পণ্য রয়েছে যা আসলে পুনর্ব্যবহারযোগ্য বা পুনঃব্যবহারযোগ্য। উদাহরণস্বরূপ প্লাস্টিকের বোতল ও ছিপি পুনঃব্যবহার এবং পুনর্ব্যবহার উভয়ই করা যেতে পারে। বিশেষত, এমন অনেক প্লাস্টিকের বোতল রয়েছে যা মূলত একবার ব্যবহার করার উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছে, কিন্তু অপেক্ষাকৃত মজবুত প্লাস্টিক থেকে তৈরি হওয়ায় সেগুলোকে সহজেই পুনঃব্যবহার করা সম্ভব।
আবার এসইউপি তালিকায় রাখা হয়েছে এমন কিছু পণ্য যার বিশেষ অর্থনৈতিক মূল্য রয়েছে। অর্থাৎ দেশের অর্থনীতিতে এসব পণ্যের উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। ফলে অল্প সময়ের লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দিয়ে এসব পণ্য নিষিদ্ধ করা হলে তা রাজস্ব অর্জনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। তাই এসইউপি সমস্যা মোকাবিলায় কার্যকরী ও বাস্তবসম্মত অগ্রগতি নিশ্চিত করতে এ খাতের উৎপাদক ও অন্যান্য অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করা দরকার। এ নির্দেশিকার প্রত্যাশিত সুফল পেতে হলে একটি কাঠামোগত ও অপ্রাধিকারভিত্তিক কৌশলের কোনো বিকল্প নেই। সরকারকে আগে সেসব পণ্য নিষিদ্ধ করতে হবে যার বিকল্প সহজলভ্য। এর পর ক্রমান্বয়ে উদ্ভাবনী সমাধান ও পদ্ধতিগত পরিবর্তন প্রয়োজনÑ এমন সব জটিল পণ্যের দিকে যেতে হবে।
একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিকের বিকল্প চিহ্নিত করা ও মূল্যায়ন করা অত্যন্ত জরুরি। একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক পণ্যের বিকল্প উন্নয়নে একটি সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন, যাতে সহায়ক বিধির সঙ্গে শিল্পসংশ্লিষ্ট স্বার্থরক্ষার নীতির সামঞ্জস্য বজায় থাকে। এ লক্ষ্যে সরকারি ও বেসরকারি খাতের যৌথ প্রচেষ্টা গ্রহণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
লেখক জাহিদ দেওয়ান শামীম
একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক প্যাকেজিং, স্টাইরোফোমের পাত্র এবং প্লাস্টিকের মোড়কের জন্য কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন। কারণ এসব পণ্য ব্যাপক হারে ব্যবহার করা হয় এবং এর বিকল্প খুবই সীমিত। পুনঃব্যবহারযোগ্য বা পচনশীল প্যাকেজিংয়ের উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করতে পরীক্ষামূলক বা পাইলট প্রকল্পের মাধ্যমে কার্যকরী সমাধান দেওয়া যেতে পারে। তা হলে বোঝা যাবে এসব বিকল্প পণ্যকে কতটা সহজলভ্য ও সুলভ করা যাবে। সেটা যতদিন পর্যন্ত সম্ভব না হচ্ছে, ততদিন আসলে খাদ্যপণ্য শিল্পে ব্যবহৃত এসইউপির ওপর নির্ভর করা ছাড়া উপায় নেই।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, সস্তা ও ব্যবহারে সুবিধাজনক হওয়ায় এসইউপি প্যাকেজিং মূলত নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য খাতের জন্য অত্যাবশ্যক। তাই এটি দ্রæত নিষিদ্ধ করতে গেলে কিছু চ্যালেঞ্জ তৈরি হতে পারে। এ ক্ষেত্রে মূল চ্যালেঞ্জ হলো এর সম্ভাব্য অর্থনৈতিক প্রভাব। অনেক প্রতিষ্ঠান ও কর্মী এসব পণ্যের ওপর নির্ভরশীল। তাই রাতারাতি এসব পণ্য বাতিল করে দিলে তা বহু মানুষের জীবিকা ও অনেক প্রতিষ্ঠানের আয়কে প্রভাবিত করবে। তাই এ সংক্রান্ত সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক প্রভাব মূল্যায়ন ও প্রভাবিত জনগোষ্ঠীর জন্য লক্ষ্যভিত্তিক সহায়তার ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।
নেতিবাচক প্রভাব সামাল দিয়ে টেকসই পদ্ধতি গ্রহণ ও জীবিকা রক্ষা করতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ও আর্থিক সহায়তাসহ ব্যাপক কৌশল গ্রহণ করতে হবে। সহজেই বাতিল করা যায় এমন কম জটিল প্লাস্টিক পণ্য দিয়ে শুরু করে ধাপে ধাপে জটিল পণ্যের দিকে যেতে হবে। তা হলে এই পরিবর্তনকে বাস্তবায়ন করা সহজ হবে। পুনর্ব্যবহারযোগ্য বা পচনশীল উপকরণকে উৎসাহিত করার জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন যে নীতি গ্রহণ করেছে তা অনুসরণ করা আমাদের জন্য সহায়ক হতে পারে।
একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক নিষিদ্ধ করার ক্ষেত্রে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বেশ কিছু কার্যকর পদ্ধতি গ্রহণ করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের এসইউপি নির্দেশিকার লক্ষ্য হলো অপ্রয়োজনীয় একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিকের ব্যবহার কমিয়ে সমুদ্র দূষণ মোকাবিলার চেষ্টা করা। প্লাস্টিকের পরিবর্তে পুনঃব্যবহারযোগ্য বিকল্পে উপকরণ ব্যবহারকে বেগবান করতে আর্থিক প্রণোদনা প্রদান করছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। একইভাবে বাংলাদেশেও পরিবেশবান্ধব উপকরণকে উৎসাহিত করার জন্য অনুদান ও ভর্তুকির উদ্যোগ নেওয়া সুফল বয়ে আনতে পারে।
এশিয়ার মধ্যে জাপান ও সিঙ্গাপুর এসইউপি নিয়ন্ত্রণে একটি সুসংগঠিত ও পর্যায়ক্রমিক নিয়ন্ত্রণ কৌশল কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়েছে। মাস্টারপ্ল্যানের মাধ্যমে পুনর্ব্যবহারকে উৎসাহিতকরণ এবং প্লাস্টিকের বর্জ্য কমানোর উদ্যোগ নিয়ে কাজ করছে।
সফলভাবে এসইউপির নিষিদ্ধ করতে হলে কার্যকর ও সুসংগঠিত পদ্ধতি প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে সুস্পষ্ট নির্দেশিকা ও পর্যায়ক্রমিক লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা জরুরি। এ কাজে অংশীজনদের আরও ঘনিষ্ঠভাবে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, যাতে নিষিদ্ধকরণের প্রক্রিয়ায় কার্যকর অগ্রাধিকার নিশ্চিত করা যায়। পাশাপাশি আর্থিক প্রণোদনা, বাস্তবসম্মত মূল্যায়ন ও উদ্ভাবন প্রক্রিয়া পরিচালনা করতেও এই অন্তর্ভুক্তি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
মনে রাখতে হবে, কোনো জনস্বার্থ নীতির বাস্তবায়ন জনমত ও জনসম্পৃক্ততা ছাড়া সফল হতে পারে না। পরিবেশ রক্ষার্থে শিক্ষামূলক প্রচারের মাধ্যমে জনসাধারণের মনোভাব পরিবর্তন করতে হবে। ভোক্তাদের টেকসই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে অন্তর্ভুক্ত ও উদ্বুদ্ধ করা প্রয়োজন। কারণ একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিকের ব্যবহার কমানোর ক্ষেত্রে তাদের সমর্থন ও অংশগ্রহণই চূড়ান্ত অবলম্বন।
লেখক: সিনিয়র সায়েন্টিস্ট, নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র