ত্রিমাত্রিক রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ও খাশোগি হত্যার বিচার
- প্রকাশের সময় : ০৬:২০:০৯ অপরাহ্ন, বুধবার, ৩১ অক্টোবর ২০১৮
- / ৬৫০ বার পঠিত
গাজীউল হাসান খান: তুরস্কের ইস্তাম্বুলস্থ সৌদি কনস্যুলেটে যুক্তরাষ্ট্রের ‘দ্য ওয়াশিংটন পোস্টে’ কর্মরত বৈরী সৌদি সাংবাদিক জামাল খাশোগির লোমহর্ষক হত্যাকান্ডে বিশ্ববাসী এখনো বিস্ময়াভিভূত। সে ঘটনার ওপর ভিত্তি করে কয়েকবার কূটনৈতিক বিধি-বিধান সংক্রান্ড জেনেভা কনভেনশনের উল্লেখ করে তুরস্কের মাটিতে হত্যাকারীদের বিচার দাবি করেছেন প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়িপ এরদোয়ান। ইস্তাম্বুলে অবস্থানরত তিনজন এবং রিয়াদ থেকে আগত ১৫জন অভিযুক্ত ব্যক্তিকে সেই হত্যাকান্ডের তদন্ত ও বিচারের জন্য অবিলম্বে তুরস্কের হাতে তুলে দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান। খাশোগির ওপর ঘটে যাওয়া বিষয়টিকে একটি সুপরিকল্পিত হত্যাকান্ড হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, কেউ এর দায়িত্ব এড়াতে পারবে না। ‘আমরা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছি, সে হত্যাকান্ড সৌদি কনস্যুলেটে সংঘটিত হলেও এটি তুরস্কের মাটিতে অবস্থিত।’ সে কারণেই এ ঘটনার তদন্ত ও বিচার তুরস্কেই সম্পন্ন হতে হবে।
প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান আগে খাশোগি হত্যার বিষয়ে নগ্ন সত্য বের করেই ছাড়বেন বলে ঘোষণা দিলেও ২৩ অক্টোবর আঙ্কারায় প্রদত্ত তাঁর বহু প্রতীক্ষিত ভাষণে কূটনৈতিক ও আন্তর্জাতিক আইনগত কারণে অনেক কিছুই পরিষ্কার করেননি। তবু তিনি এ হত্যাকান্ড নিয়ে বেশ কিছু বৈধ প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি জানতে চেয়েছেন, কার নির্দেশে হত্যাকারীরা ইস্তাম্বুলে এসেছিল, কে তাদের প্রাইভেট জেট বিমান দিয়েছে, কারা কনস্যুলেট থেকে হত্যাকান্ডের আগেই সিসিটিভি ক্যামেরা সরিয়েছে এবং খাশোগির মৃতদেহ এখন কোথায়? তিনি জানিয়েছেন, তুরস্ক এ হত্যাকান্ড বিচারের আইনি কর্তৃত্ব চায়। এ হত্যাকান্ডের তদন্তের জন্য তিনি কমিটিতে বাইরের সদস্য অন্তর্ভুক্ত করার সম্ভাবনার কথাও উল্লেখ করেছেন। এ বিষয়টি নিয়ে তিনি এরই মধ্যে সৌদি বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গেও বিস্তারিত ফোনালাপ করেছেন। তবে এ হত্যাকান্ডের তদন্ত ও বিচারের দায়িত্ব সৌদি আরব একতরফাভাবে তুরস্কের ওপর ন্যস্ত করবে কি না সেটি নিয়ে এরই মধ্যে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তদন্তের বিষয়টি তুরস্কের নেতৃত্বে হলেও অভিযুক্ত খুনিরা যেহেতু সৌদি নাগরিক, সেহেতু তাদের বিচার সৌদি আরবের মাটিতে করারই দাবি জানাতে পারেন বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ। তাতে বিচারের ক্ষেত্রে একটি অচলাবস্থা ও সংকট ঘনীভূত হতে পারে বলে গণমাধ্যম ও আইন বিশেষজ্ঞদের ধারণা।
অক্টোবরের ২ তারিখ ইস্তাম্বুলস্থ সৌদি কনস্যুলেটে সাংবাদিক জামাল খাশোগির হত্যাকান্ড সংঘটিত হলেও পরবর্তী ১৭ দিন পর্যন্ত সৌদিরা সে ঘটনা সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করে গেছে। ২ অক্টোবর সংঘটিত এ নৃশংস হত্যাকান্ডে সৌদি সরকার ও বিশেষ করে ক্ষমতাশালী যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের বিরূপ সমালোচনা বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ে। সে অবস্থায় পরিস্থিতি শান্ত করার জন্য সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আদেল আল-জুবায়ের যুক্তরাষ্ট্রের ফক্স নিউজের সঙ্গে প্রদত্ত এক সাক্ষাৎকারে সেই মর্মান্তিক হত্যাকান্ড এক ‘মারাত্মক ভুল’ বলে স্বীকার করেন। তিনি বলেছেন, সৌদি যুবরাজ (ক্রাউন প্রিন্স) এ ব্যাপারে কিছুই জানতেন না। নিজেদের ক্ষমতার বাইরে গিয়ে যে ব্যক্তিরা এ অপরাধটি সংঘটিত করেছে তাদের এখন কোনোমতেই আর ঢেকে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। কোনো সরকারই এমন অপরাধকে মেনে নেবে না। সৌদি সরকার দোষী ব্যক্তিদের যথাযথ শাস্তি বিধানে বদ্ধপরিকর। সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরো বলেছেন যে সৌদির ঊর্ধ্বতন গোয়েন্দা কর্মকর্তারাও নাকি এ বিষয়টি জানতে পারেননি। অথচ সৌদি রাজধানী রিয়াদ থেকে ১৫ ব্যক্তি (সঙ্গে দূতাবাসের আরো তিনজন) ইস্তাম্বুলে এসে সৌদি কনস্যুলেটে ঢুকে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী সৌদি সাংবাদিক জামাল খাশোগিকে ১০ মিনিটের কম সময়ের মধ্যে হত্যা করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সে ঘটনার পর তিন সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও আজও জামালের মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া যায়নি।
জানা গেছে, স্থানীয় কোনো এক অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির মাধ্যমে খাশোগির টুকরা টুকরা করা দেহ নিয়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে বসফরাস প্রণালির উত্তরে অবস্থিত এক গভীর জঙ্গলে। ১৫ জন অভিযুক্ত হত্যাকারী রিয়াদ থেকে দুটি প্রাইভেট জেট বিমানে করে ইস্তাম্বুলে এসে দিনে দিনে এক বিশিষ্ট ব্যক্তিকে খুন করে আবার অক্ষত অবস্থায় স্বস্থানে ফিরে গেছে। অথচ সৌদি সরকার বলেছে, এ ব্যাপারে তাদের দেশের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান কিছুই জানতেন না। কথিত আছে যে ‘এমবিএস’ নামে খ্যাত এ মহা ক্ষমতাশালী ক্রাউন প্রিন্সের সম্মতি কিংবা নির্দেশ ছাড়া সৌদি আরবের মাটিতে কোনো ঘটনা ঘটানো সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য ব্যাপার। তা ছাড়া এই সর্বমোট ১৮ জনের টিমে দুজন ছিলেন এমবিএসের বিশেষ দেহরক্ষী বাহিনীর সদস্য। কারা তাদের ইস্তাম্বুল যাওয়ার অনুমতি দিয়েছে, আর প্রাইভেট জেট বিমানই বা তারা কিভাবে সংগ্রহ করেছে, তা এখনো অজ্ঞাতই রয়ে গেছে। এ যেন হলিউডে নির্মিত দম বন্ধ করা এক দুর্ধর্ষ অপরাধমূলক অভিযানের অবিশ্বাস্য চিত্রনাট্য। যুক্তরাষ্ট্রের ‘দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট’ পত্রিকা থেকে শুরু করে গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ এবং হোয়াইট হাউসে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পর্যন্ত কেউ বিশ্বাস করেন না যে সে হত্যাকান্ডে সৌদি ক্রাউন প্রিন্স এমবিএসের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। এ ব্যাপারে সৌদি সরকার কিছুই জানত না, এটি সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য বলে যুক্তরাষ্ট্র ও তুরস্কের অনেকে মনে করে।
এ অবস্থায় চারদিকে যখন চরম অবিশ্বাস দানা বেঁধে ওঠে, তখন বিষয়টি তদন্ত করার জন্য গত ১৮ অক্টোবর আঙ্কারায় এসেছিলেন সৌদি সরকারের পক্ষ থেকে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন একজন প্রবীণ রাজপুত্র খালেদ আল ফয়সল। তিনি তুরস্ক সরকারের অত্যন্ত উচ্চপর্যায়ে বিষয়টি নিয়ে তদন্তের ব্যাপারে একটি যৌথ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন। তার পরদিন সৌদিরা সাংবাদিক জামাল হত্যার বিষয়টি স্বীকার করে নেয়। তার পরও যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রিত সৌদি বৈরী সাংবাদিক জামাল খাশোগিকে ইস্তাম্বুলের সৌদি কনস্যুলেটে নৃশংসভাবে হত্যা করার সাম্প্রতিক সময়ের ঘটনাবলি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র, তুরস্ক ও সৌদি আরবের মধ্যে একটি ত্রিমাত্রিক দ্বন্দ্ব ও বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে। এ হত্যাকান্ড নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র নিজেই একদিকে হোয়াইট হাউস প্রশাসন এবং অন্যদিকে ‘দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট’ ও কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। ‘দ্য পোস্ট’, সিআইএ এবং আমেরিকার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মনে করে, সে হত্যাকান্ডে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সরাসরি সম্পৃক্ততা রয়েছে। অথচ প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁকে কাভার করার অর্থাৎ ঢেকে রাখার চেষ্টা করছেন। তা ছাড়া ইস্তাম্বুল কনস্যুলেটে হামলা করে খাশোগিকে হত্যা করার পেছনে ট্রাম্প জামাতা জ্যারেড কুশনারেরও হাত রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের স্টাইলে সংঘটিত এ হামলার পরামর্শ ইহুদিবাদী জ্যারেড কুশনারের কাছ থেকে এসেছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়।
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও জ্যারেড কুশনারের আশকারাতেই এমবিএস এত লাগামহীন হয়ে উঠেছে বলে অনেকের ধারণা। সে কারণে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ বিষয়টি এখন আবার নতুন করে খতিয়ে দেখছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঊর্ধ্বতন উপদেষ্টা জ্যারেড কুশনার এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ মিত্র সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের মধ্যে ব্যক্তিগত পর্যায়ে স্বাধীন ও অত্যন্ত গোপনীয় সরাসরি টেলিফোন লাইন রয়েছে, যাতে প্রবেশ করা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। প্রভাবশালী সৌদি সাংবাদিক জামাল খাশোগি শুধু ‘দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের’ একজন কলাম লেখকই নন, তিনি দীর্ঘদিন ধরে জড়িত ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিশালী গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর সঙ্গে। আল-কায়েদা প্রতিষ্ঠাতা ওসামা বিন লাদেন যখন আফগানিস্তানের গভীর পার্বত্য অঞ্চলে আশ্রয় নিয়েছিলেন, তখনো তাঁর সঙ্গে একমাত্র যোগাযোগ ছিল জামাল খাশোগির। জামাল সৌদি রাজপরিবারের অত্যন্ত উচ্চপর্যায়ে যুক্ত ছিলেন এবং গণমাধ্যমের ক্ষেত্রে উপদেষ্টা বা পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছেন। শেষ পর্যন্ত ওয়াশিংটনে নিযুক্ত সৌদি রাষ্ট্রদূতের গণমাধ্যম উপদেষ্টার দায়িত্ব নিয়ে তিনি বছর খানেক আগে সৌদি আরব থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। তারপর এমবিএসকে নিয়ে সৌদি রাজপ্রাসাদে ক্ষমতার রদবদলকে জামাল সহজভাবে নিতে পারেননি। জামাল সাবেক ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন নায়েফের সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তা ছাড়া প্রিন্স নায়েফ তাঁর যোগ্যতার জন্য সিআইএ স্বীকৃতি ও সমর্থন পেয়েছিলেন অনেক আগেই। কিন্তু বর্তমান বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র নায়েফকে বিভিন্ন কারণে সরিয়ে দিয়ে নিজের তরুণ আইনজীবী পুত্র মোহাম্মদ বিন সালমানকে বেছে নিয়েছিলেন নিজের উত্তরসূরি হিসেবে। এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব থেকে একে একে ডেপুটি প্রধানমন্ত্রীর পদও প্রদান করেন তরুণ সালমানকে।
সেই থেকে বিভিন্ন অর্থনৈতিক সংস্কার, পরিবর্তন ও উচ্চাভিলাষী বিভিন্ন পরিকল্পনা নিতে শুরু করেছিলেন এমবিএস। এর মধ্যে লোহিত সাগরের তীরে তিন ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয়ে নতুন এক বাণিজ্য ও বিনোদন নগরী গড়ে তোলা এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১১০ বিলিয়ন ডলারের সমরাস্ত্র কেনার সিদ্ধান্ত বিভিন্ন মহলে চরম বিতর্কের সৃষ্টি করে। এই বিশাল অঙ্কের অস্ত্র বিক্রি করার সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত পুরনো মিত্রের সঙ্গে সম্পর্কটি আরো জোরদার করতে সচেষ্ট হন। অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্য ও মুসলিম বিশ্বের অপর ক্ষমতাধর সুন্নি অধ্যুষিত রাষ্ট্র তুরস্কের কাছে এফ-৩৫ জঙ্গি বিমান ও আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বিক্রি করার ব্যাপারে গড়িমসি শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র। শুধু তা-ই নয়, পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর দ্বিতীয় বৃহত্তম সেনাশক্তির অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও রাশিয়া এবং শিয়া অধ্যুষিত ইরানের সঙ্গে সুসম্পর্কের কারণে সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিভিন্ন ক্ষমতার দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, অভিযোগ রয়েছে যে তুরস্কের জনপ্রিয় নেতা রিসেপ তাইয়িপ এরদোয়ানকে এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সম্প্রতি ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টা হয়েছিল। তার পেছনে নাকি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের হাত এবং সৌদি আরবের সমর্থন। মধ্যপ্রাচ্যে তুরস্কের শক্তিশালী নেতা হিসেবে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের উত্থানকে ভালো চোখে দেখেনি তারা। ইসলামী ভাবধারার এক জাতীয়তাবাদী ও গণতান্ত্রিক নেতা তিনি। তা ছাড়া তাঁরা উভয়েই জানেন এরদোয়ান কারো কাছে মাথা নোয়াবার নন। সৌদি আরব নয়, সব দিক থেকে তুরস্ককেই সুন্নি মুসলিমরা বিশ্বব্যাপী তাদের নেতৃত্ব দেওয়ার উপযোগী রাষ্ট্র বলে মনে করে। এ দেশটি শুধু সামরিক শক্তিতে নয়, গণতান্ত্রিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও অনেকটা এগিয়ে গেছে। যার তুলনা সৌদি আরবের সঙ্গে হতে পারে না। এসব দ্বন্দ্ব নিয়ে সৌদি নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিল (জিসিসি)। এবং এর মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাববলয় থেকে তুরস্ক ও ইরানকে দূরে সরিয়ে রাখার সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা নিয়েছিল সৌদি আরব। কাতারের সঙ্গে সৌদি আরব ও আমিরাতের দ্বন্দ্বের কারণে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে তুরস্ক এবং সাহায্য করেছে ইরান। এটি কোনোমতেই সৌদি আরবের পছন্দ নয়। সৌদি আরব তার প্রতিবেশী দরিদ্র রাষ্ট্র ইয়েমেনের দুই লক্ষাধিক মানুষ হত্যা করেছে জঙ্গি বিমান থেকে নিক্ষিপ্ত বোমার আঘাতে। লাখ লাখ ইয়েমেনি মানুষ চিকিৎসাসেবা পাচ্ছে না কোথাও। অগণিত নারী, পুরুষ ও শিশু এখন অনাহারে দিন কাটাচ্ছে। এক চরম দুর্ভিক্ষাবস্থা বিরাজ করছে এখন ইয়েমেনে। ইয়েমেনে হুতিবিরোধী যুদ্ধে সৌদি আরবকে মদদ জোগাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য। মুসলমানদের তৃতীয় পবিত্রতম স্থান বায়তুল মাকদিস, যা জেরুজালেমে অবস্থিত, তা ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলের হাতে তুলে দিয়েছে ডোনাল্ড ট্রাম্প। তুরস্ক ছাড়া তার কোনো প্রতিবাদ করেনি প্রতিবেশী সৌদি আরব।
সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যায় সৌদিদের বক্তব্য আগাগোড়া মোটেও বিশ্বাসযোগ্য না হলেও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেছেন, তিনি সৌদি আরবের মতো ঘনিষ্ঠ মিত্র দেশের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করতে চাচ্ছেন না। যদিও প্রথম দিকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেছিলেন যে খাশোগি হত্যায় সৌদি প্রশাসনের সম্পৃক্ততা প্রমাণ হলে দেশটির বিরুদ্ধে তিনি কঠোর ব্যবস্থা অর্থাৎ অর্থনৈতিক ও অন্যান্য বিধি-নিষেধ জারি করতে পারেন। যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমা মিত্র দেশ যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মানিও দোষী প্রমাণিত হলে সৌদি আরবের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দিয়েছে। কিন্তু তাতে যুক্তরাষ্ট্রসহ সবাইকে পাল্টা হুমকি দিয়েছে সৌদি আরব। ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতে, ক্রাউন প্রিন্স এমবিএস ক্ষমতা পাওয়ার পর সৌদি আরবে এমন সব ঘটনা ঘটে যাচ্ছে, যা মানবাধিকারের চরম বরখেলাপ ও যুদ্ধাপরাধের শামিল। তা ছাড়া অন্যান্য সৌদি যুবরাজ, ব্যবসায়ী ও নেতৃস্থানীয় কর্মকর্তাদের সম্প্রতি রিয়াদের রিজ কার্লটন হোটেলে বন্দি করে হেনস্তা ও অর্থ আদায়কে পশ্চিমা গণতান্ত্রিক দেশগুলো সভ্য ব্যবস্থার চরম বরখেলাপ বলে মনে করেছে। কোনো কোনো দেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো দুর্নীতি সংঘটিত হলে তার বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে বলে গণতান্ত্রিক দেশগুলো মনে করে। তা ছাড়া এমবিএস কর্তৃক হেনস্তা করা সৌদি যুবরাজ ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে এমন অনেকে রয়েছেন, যাঁদের পশ্চিমা অর্থনৈতিক জগতে যথেষ্ট বিনিয়োগ রয়েছে।
সাবেক ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন নায়েফকে হঠাৎ করে সরিয়ে দেওয়া এবং সৌদি আরবজুড়ে একটি ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করার জন্য মুক্ত বিশ্ব সৌদি আরবের যথেষ্ট সমালোচনা করেছে। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকসমাজ স্পষ্টভাবেই বিভক্ত হয়ে পড়েছে। তারা ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তাঁর জামাতা জ্যারেড কুশনারের সঙ্গে বর্তমান ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের পক্ষপাতমূলক সম্পর্ককে গ্রহণ করতে রাজি নয়। কারণ এটি একটি সুবিধাবাদী ব্যাবসায়িক সম্পর্ক। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মাঝেমধ্যে সৌদি প্রশাসনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বললেও পরক্ষণেই সে অবস্থান থেকে সরে যান। এর অন্যতম প্রধান কারণ সৌদি আরবের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১১০ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রির প্রস্তাব অকার্যকর হওয়ার ভয়। ডোনাল্ড ট্রাম্প কোনোমতেই তা হারাতে চান না। অন্যদিকে সৌদি আরবের বিরুদ্ধে কোনো অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নিলে সৌদিরা জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয়ের বর্তমান ব্যবস্থাটি বাতিল করতে পারে। তাতে তেলের মূল্য ব্যারেল প্রতি ১৫০ থেকে ২০০ ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে। তা ছাড়া সৌদি আরব মার্কিন ডলারে তেলের দাম পরিশোধের বর্তমান ব্যবস্থা পরিবর্তন করে চীনের মুদ্রা ইউয়ানেও নির্ধারণ করতে পারে। সমরাস্ত্র খরিদের ব্যাপারে তারা রাশিয়াকেও বেছে নিতে পারে। অধিকন্তু সৌদিদের নিরাপত্তা ও অন্যান্য প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে তারা রাশিয়া এবং এমনকি তাদের চরম শত্রু ইরানের সাহায্য নিতেও পিছপা হবে না বলে হুমকি দিয়েছে। এতে বিস্ময়াভিভূত হয়েছে ট্রাম্পের হোয়াইট হাউস প্রশাসন।
ওপরে উল্লিখিত একটি অবস্থায় বিশ্বনেতাদের কাছ থেকে তাঁর হত্যার কতটুকু ন্যায্য বিচার পাবেন নিহত সাংবাদিক জামাল খাশোগি। তুর্কি নেতা এরদোয়ান বলেছেন, খাশোগি হত্যায় তিনি নগ্ন সত্য বের করেই ছাড়বেন। এরপর উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন এক সৌদি যুবরাজ যৌথ তদন্তের প্রস্তব নিয়ে এসেছেন এরদোয়ানের কাছে। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান এ পর্যন্ত দুবার কথা বলেছেন সৌদি বাদশাহর সঙ্গে। তা ছাড়া কথা হয়েছে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গেও। মার্কিন ও সৌদি নেতারা এরই মধ্যে বিভিন্ন প্রস্তাব দিতে শুরু করেছেন প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানকে। এ পরিস্থিতিতে খাশোগি হত্যার তদন্ত ও বিচার শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় তা কে জানে। কারণ বর্তমানে তুরস্কের অর্থনৈতিক অবস্থা এবং বাণিজ্য মোটেও সুবিধাজনক অবস্থানে নেই। সামরিক দিক থেকে নিয়মিত অর্থ পরিশোধ করেও যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান ও আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিতে পারছে না তুরস্ক। এ পরিস্থিতিতে খাশোগি হত্যার তদন্ত ও বিচার অনুষ্ঠানের ব্যাপারে কত দিন অনড় থাকতে পারবেন এরদোয়ান। এ ক্ষেত্রে ভরসা এখন যুক্তরাষ্ট্রের কিছু কংগ্রেস সদস্য, সিআইএ ও গণমাধ্যম। হতভাগ্য জামাল খাশোগি নিজের অজান্তেই আন্তর্জাতিক রাজনীতির দ্বন্দ্ব ও বিরোধের শিকারে পরিণত হয়েছেন। তার পরও আমরা একটি ন্যায্য বিচারের প্রতীক্ষায় রয়েছি।
লেখক: বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক
e-mail: gaziulhkhan@gmail.com