নিউইয়র্ক ০৩:৪২ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ০৩ অক্টোবর ২০২৪, ১৮ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

কাদের সিদ্দিকীর ইতিহাসের সমাপ্তি

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০৫:১৪:১১ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৩ নভেম্বর ২০১৮
  • / ১০০০ বার পঠিত

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী: একজন গড়পড়তা সাধারণ পরিবার থেকে আসা লোক। তার এক লেখায় পড়েছি ঢাকায় এসে নাকি প্রথম মিরপুরে রিকশাও চালিয়েছেন। ছোট করার জন্য এ কথা বলছি না। এভাবে সময়ের হাতে নিজেকে যে ছেড়ে দিতে পারে সে কিন্তু অসহায় নয় বরং গভীরভাবে আত্মবিশ্বাসী। একটা আত্মবিশ্বাসী লোক বিশ্বাস করে যে আত্মবিশ্বাসের জোরে সে একদিন উঠে আসবে। রাত যত গভীর হয় সকাল তত কাছাকাছি আসে। মুক্তিযুদ্ধ আরম্ভ হলে কাদের সিদ্দিকী তার জীবনের সব অনিশ্চয়তা আর সিদ্ধান্তহীনতাকে ঠেলে আত্মনিয়োগ করলেন মুক্তিযুদ্ধে। ভারতে না গিয়ে সাহসের পরিচয় দিলেন। নিজ এলাকা টাঙ্গাইলে থেকেই তিনি নিজে স্থানীয় যুবকদের একত্রিত করে বাহিনী গঠন করলেন।
সেই থেকে ‘কাদেরিয়া বাহিনীর’ উত্থান। তার বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকী ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন। তার কারণে পরিবারটি আওয়ামী ঘরানার পরিবার হিসেবে গণ্য হয়। কাদের সিদ্দিকী সেই কারণে মুক্তিযুদ্ধ আরম্ভ হলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি নেন। তার বাহিনীর বৈশিষ্ট্য ছিল তারা ভারতে যাননি। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থেকে সবকিছু সুসংগঠিত করে প্রতিরোধ যুদ্ধ দীর্ঘ নয় মাস চালিয়েছিলেন। এজন্য তাকে বঙ্গবীর, বীর উত্তম ইত্যাদি খ্যাতিতে ভূষিত করা হয়।
বীর উত্তম বীরত্বের জন্য প্রদত্ত সর্বোচ্চ খেতাব। তিনি নিয়মিত সামরিক বাহিনীর লোক না হয়েও এ খেতাব পেয়েছিলেন তার বীরত্বের স্বীকৃতি স্বরূপ। বঙ্গবন্ধু ১০ জানুয়ারি আসার পর যার যা পাওনা তার স্বীকৃতি প্রদানে কৃপণতা করেননি। আওয়ামী লীগ সরকার কাদের সিদ্দিকীকে কোনোভাবেই অমর্যাদা করেনি। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর শেখ হাসিনা যখন আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নির্বাচিত হন তখন তিনি কাদের সিদ্দিকীকে সংসদে মনোনয়ন দিয়ে সংসদ সদস্যও নির্বাচিত করেছিলেন।
এখন কাদের সিদ্দিকী প্রতি সপ্তাহে নিয়মিত একটি পত্রিকায় কলাম লেখেন। দীর্ঘ প্রতিরোধ যুদ্ধের অভিজ্ঞতা, বঙ্গবন্ধু শহীদ হওয়ার পর তার দেশত্যাগ এবং জিয়াউর রহমান সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ সূচনা করার নানা কাহিনি লিখে বেশ উপভোগ্য লেখা কখনও কখনও জাতির সম্মুখে পেশ করেন। তার লেখায় বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা ইত্যাদি নাম প্রায় পাওয়া যায়। শেখ হাসিনাকে তোয়াজ করে যারা লেখেন তাদের মধ্যে তিনি অন্যতম। এখন কিন্তু তিনি আওয়ামী লীগ করেন না। নিজে নতুন একটা কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ নামে রাজনৈতিক সংগঠন করেছেন। সংগঠনটার অস্তিত্ব রয়েছে টাঙ্গাইল ও ময়মনসিংহ জেলায়। মাঝে মাঝে তিনি বঙ্গবন্ধুর সমাধিতেও যান। দুই-তিন দিন সমাধিতে পড়েও থাকেন।
কাদের সিদ্দিকীর বড় ভাই লতিফ ছিদ্দিকী শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভার মন্ত্রী ছিলেন। বিদেশে গিয়ে হজরত মোহাম্মদ (সা.)-এর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কথাবার্তা বলায় শেখ হাসিনা তাকে ধর্ম প্রবর্তকের বিরুদ্ধে কটূক্তি করার অপরাধে অপরাধী মনে করায় মন্ত্রিসভা থেকে সরিয়ে দেন। আওয়ামী লীগও তাকে প্রাথমিক সদস্যপদ থেকেও বহিষ্কার করেন। সুখে-শান্তিতে মন্ত্রিত্ব করছিলেন। মাথা খারাপের মতো এ কাজটি করতে গেলেন কেন এ রহস্য এখনও উদঘাটিত হয়নি।
কাদের সিদ্দিকীও একবার হঠাৎ করে সংসদ সদস্যপদ থেকে পদত্যাগ করে ফেললেন। পরবর্তী সময়ে উপনির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আওয়ামী লীগ প্রার্থীর হাতে পরাজিত হলেন। কেন তিনি সদস্যপদ থেকে পদত্যাগ করলেন, কী বিরোধ ছিল আওয়ামী লীগের সঙ্গে প্রকৃত সত্য কথাটা এখনও কেউ জানে না। সম্ভবত পাগলামি করা সিদ্দিকী পরিবারের এটা সমস্যা। না হয় এক ভাই ধর্মের বিরুদ্ধে কথা বলে (যা ছিল অপ্রয়োজনীয়) মন্ত্রিত্ব আর দলীয় সদস্য পদ হারাবেন কেন? আর আরেক ভাই শুধু সংসদ সদস্যপদ ত্যাগ করে চলে যাবেন কেন?
স্ব-স্ব রাজনীতির মধ্যে বুদ্ধিভিত্তিক সংহতি থাকতে হবে। যদি কোনও রাজনৈতিক নেতাকর্মী নিজেকে রাজনৈতিক সংগ্রামের সত্যিকার মূল্যবোধের সঙ্গে যুক্ত না করে তবে সে জীবনের সঠিক অভিজ্ঞতার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারবে না। এদের অবস্থাটা হয়েছে তাই। কাদের সিদ্দিকী একসময় দিগন্ত টেলিভিশনে গিয়ে কাজ শুরু করলেন, যাদের অনুসৃত নীতির সঙ্গে তার সারা জীবনের অনুসৃত নীতি-আদর্শের কোনও মিল ছিল না। বুদ্ধিভিত্তিক প্রেরণার মতো আড়ম্বরপূর্ণভাবে পালন যোগ্য আর কিছুই থাকতে পারে না। কোন প্রেরণায় বশীভূত হয়ে তিনি তার সারা জীবনের অনুসৃত নীতি আদর্শের বিরুদ্ধে পরিচালিত একটা টেলিভিশনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হলেন।
‘যখন যা তখন তা’ অনুরূপ কাজ কাদের সিদ্দিকী করবে কেন? আমার মনে হয় কাদের সিদ্দিকীকে এসব অনিয়মিত কাজে টেনে নিয়েছে তার যা হওয়াই উচিত ছিল তারচেয়ে অতিরিক্ত আশা পোষণ করায়। তিনি ঠিকাদারি ব্যবসা করতে গিয়ে কয়েকটা ব্রিজের কাজ নিলেন অথচ ব্রিজগুলোর কাজ নাকি সম্পূর্ণ করেননি। বিলের টাকা নিয়ে গেছেন নাকি কাজের চেয়ে বেশি। এ দেশে বদনাম কুড়াতে সময় লাগে না। মুনতাসীর মামুন তার লেখায় দেখলাম কাদের সিদ্দিকীর বীরউত্তম খ্যাতি পরিবর্তন করে ‘ব্রিজ উত্তম’ দিয়েছেন।
কাদের সিদ্দিকীর যা অর্জন তা ১৯৭১-৭২ সালে অর্জন করেছিলেন। কিন্তু আমি যে পূর্বে বলেছি যা হওয়া উচিত ছিল তারচেয়ে অতিরিক্ত আশাই তাকে ডুবালো। এক জীবনে সবকিছু পাওয়ার সৌভাগ্য সবার হয় না। স্বাধীনতা যুদ্ধে তার ত্যাগের জন্য তাকে চূড়ান্তভাবে সম্মানিত করা হয়েছিল, যা নিয়ে তিনি সন্তুষ্ট থাকেন নি। ফল হলো তার খ্যাতি চূড়ান্তভাবে ম্লান হলো। বীর উত্তমকে লোকে তামাশা করে ‘ব্রিজ উত্তম’ বলতে আরম্ভ করল।
আমি নিজেও একজন মুক্তিযোদ্ধা। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তমের অধঃপতন দেখে মর্মাহত হয়েছি বলে তাকে নিয়ে লেখা।
তিনি জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে যোগদান করতে বিলম্ব করেছেন, মনে করেছিলাম হয়তো তার সাবেক দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে কোনও বিষয়ে কথাবার্তা বলছেন। অবশেষে শুনলাম তার খেলাপি ঋণ নিয়েই নাকি উভয় জোটের সঙ্গে কথাবার্তা বলছিলেন। তাকে যে ঋণ থেকে মুক্ত করবে তার দিকেই তিনি যাবেন।
অবশেষে বিএনপির ঐক্য জোটেই গেলেন।
কাদের সিদ্দিকীর মার্কা গামছা। সেই গামছা গলায় নিয়েই ঘোরেন তিনি। কিন্তু এখন শুনছি নির্বাচন করবেন ধানের শীষ নিয়ে। সেদিন ফেসবুকে তার ছবি দেখলাম মুজিব কোটের বুক পকেটের ওপরে ধানের শীষ নকশা করেছেন। একটি মানুষের আত্মা কতটুকু লোভে ধরলে সমস্ত নীতি আদর্শ এভাবে ফেলে দিয়ে পুরো উল্টো পথে হাঁটতে পারেন। যাকে বঙ্গবন্ধুর খুনি বলে বিচার চেয়ে, অভিযুক্ত করে এতদিন রাজনীতি করলেন, দেশ ছাড়লেন– তার দলের মার্কা নিয়ে নির্বাচন করতে যাওয়া কতটা দৈন্যতা কাদের সিদ্দিকী হয়তো বুঝবেন না, বুঝবেন তার ভক্তরা।
সেই রকম এক শীর্ষ ব্যক্তি তার উদ্দেশ্যে লেখা চিঠিতে এমনই আক্ষেপ করেছেন। ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার কৃতী সন্তান বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে ফাঁসির মঞ্চ থেকে বেঁচে যাওয়া প্রতিরোধ যোদ্ধা মুজিব সৈনিক ‘বিশ্বজিৎ নন্দীর’ কাদের সিদ্দিকীকে লেখা পত্রটি শেয়ার করা প্রাসঙ্গিক মনে করছি। তিনি লিখেছেন:
‘শ্রদ্ধেয় কাদের ভাই,
সালাম নিবেন। জানি, আমাকে এখন আপনি চিনতে পারবেন না। আমি মুক্তাগাছার গোবিন্দপুর গ্রামের বিশ্বজিৎ নন্দী। পিতা হত্যার প্রতিশোধ নিবো বলে, আপনার সাথে অস্ত্র হাতে প্রতিরোধ যুদ্ধে নেমেছিলাম। আপনি বলতেন, ‘পিতা হত্যার প্রতিশোধ না নিয়ে ঘরে ফিরবেন না’। অথচ আপনি আজ কেবল ঘরেই ফিরেন নি, আপনার ঘরে আজ ওই খুনিদের আনাগোনা। একত্রে বসে পরিকল্পনা করেন, কীভাবে মুজিব কন্যার পতন ঘটাবেন।
১৯৭৬ সালের ১৮ই আগস্ট দিনটির কথা কী মনে আছে। অপারেশনে পাঠিয়েছিলেন মুক্তাগাছায়! সেনাবাহিনী আমাদের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছিল।
আমাদের আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেয়। কিন্তু আত্মসমর্পণের মাধ্যমে আরেকটি কলঙ্কের ইতিহাস হোক, তা চাইনি বলে টানা ৮ ঘণ্টা যুদ্ধ চালাতে গিয়ে সহযোদ্ধা পাঁচজনের মৃত্যু হয়। হাতে-পায়ে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আমাকে গ্রেফতার করা হয়। অথচ আজ আপনিই ওদের কাছে আত্মসমর্পণ করে বসে আছেন।
যৌবনের ১৩টা বছর আমি কাটিয়েছি কারাগারে। ৭ বছর ছিলাম কনডেম সেলে। যে জিয়ার হয়ে আজ আপনি মাঠঘাট চষে বেড়াচ্ছেন, সে জিয়ার সামরিক আদালতে ১৯৭৭ সালের ১৮ মে আমার ফাঁসির রায় হয়।
আমি বিশ্বজিৎ ওদের চোখে অপরাধী হলেও আপনি এখন ওদের কাছে মহামানব। ভালো থাকবেন হে মহামানব। ক্ষমতায় গিয়ে, যদি পারেন, আমার জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া সেই ১৩টা বছর ফিরিয়ে দিবেন। তা না হলে, আপনি আমার কাছে বাকি জীবনটা বিশ্বাসঘাতক হয়েই থাকবেন।
ইতি-
বিশ্বজিৎ নন্দী
টাঙ্গাইল।
১৯ নভেম্বর ২০১৮ইং
ঋণ পরিশোধের কথাটা কতটুকু সত্য জানি না। তবে কথা যদি সত্য হয় তবে শেষ কলঙ্ক মাথায় তুলে নিলেন তিনি। কয়দিন আগে বলেছেন শেখ হাসিনা ২০ সিট পাবেন, এখন বলছেন ১৯ সিট পাবেন। এ প্রলাপ আনন্দের প্রলাপ না হতাশার প্রলাপ জানি না। তবে অভিজ্ঞতা থেকে এটা বলতে পারি যে কাদের সিদ্দিকীর ইতিহাসের সমাপ্তি ঘটেছে।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক
(বাংলাট্রিবিউন এর সৌজন্যে)

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

About Author Information

কাদের সিদ্দিকীর ইতিহাসের সমাপ্তি

প্রকাশের সময় : ০৫:১৪:১১ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৩ নভেম্বর ২০১৮

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী: একজন গড়পড়তা সাধারণ পরিবার থেকে আসা লোক। তার এক লেখায় পড়েছি ঢাকায় এসে নাকি প্রথম মিরপুরে রিকশাও চালিয়েছেন। ছোট করার জন্য এ কথা বলছি না। এভাবে সময়ের হাতে নিজেকে যে ছেড়ে দিতে পারে সে কিন্তু অসহায় নয় বরং গভীরভাবে আত্মবিশ্বাসী। একটা আত্মবিশ্বাসী লোক বিশ্বাস করে যে আত্মবিশ্বাসের জোরে সে একদিন উঠে আসবে। রাত যত গভীর হয় সকাল তত কাছাকাছি আসে। মুক্তিযুদ্ধ আরম্ভ হলে কাদের সিদ্দিকী তার জীবনের সব অনিশ্চয়তা আর সিদ্ধান্তহীনতাকে ঠেলে আত্মনিয়োগ করলেন মুক্তিযুদ্ধে। ভারতে না গিয়ে সাহসের পরিচয় দিলেন। নিজ এলাকা টাঙ্গাইলে থেকেই তিনি নিজে স্থানীয় যুবকদের একত্রিত করে বাহিনী গঠন করলেন।
সেই থেকে ‘কাদেরিয়া বাহিনীর’ উত্থান। তার বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকী ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন। তার কারণে পরিবারটি আওয়ামী ঘরানার পরিবার হিসেবে গণ্য হয়। কাদের সিদ্দিকী সেই কারণে মুক্তিযুদ্ধ আরম্ভ হলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি নেন। তার বাহিনীর বৈশিষ্ট্য ছিল তারা ভারতে যাননি। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থেকে সবকিছু সুসংগঠিত করে প্রতিরোধ যুদ্ধ দীর্ঘ নয় মাস চালিয়েছিলেন। এজন্য তাকে বঙ্গবীর, বীর উত্তম ইত্যাদি খ্যাতিতে ভূষিত করা হয়।
বীর উত্তম বীরত্বের জন্য প্রদত্ত সর্বোচ্চ খেতাব। তিনি নিয়মিত সামরিক বাহিনীর লোক না হয়েও এ খেতাব পেয়েছিলেন তার বীরত্বের স্বীকৃতি স্বরূপ। বঙ্গবন্ধু ১০ জানুয়ারি আসার পর যার যা পাওনা তার স্বীকৃতি প্রদানে কৃপণতা করেননি। আওয়ামী লীগ সরকার কাদের সিদ্দিকীকে কোনোভাবেই অমর্যাদা করেনি। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর শেখ হাসিনা যখন আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নির্বাচিত হন তখন তিনি কাদের সিদ্দিকীকে সংসদে মনোনয়ন দিয়ে সংসদ সদস্যও নির্বাচিত করেছিলেন।
এখন কাদের সিদ্দিকী প্রতি সপ্তাহে নিয়মিত একটি পত্রিকায় কলাম লেখেন। দীর্ঘ প্রতিরোধ যুদ্ধের অভিজ্ঞতা, বঙ্গবন্ধু শহীদ হওয়ার পর তার দেশত্যাগ এবং জিয়াউর রহমান সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ সূচনা করার নানা কাহিনি লিখে বেশ উপভোগ্য লেখা কখনও কখনও জাতির সম্মুখে পেশ করেন। তার লেখায় বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা ইত্যাদি নাম প্রায় পাওয়া যায়। শেখ হাসিনাকে তোয়াজ করে যারা লেখেন তাদের মধ্যে তিনি অন্যতম। এখন কিন্তু তিনি আওয়ামী লীগ করেন না। নিজে নতুন একটা কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ নামে রাজনৈতিক সংগঠন করেছেন। সংগঠনটার অস্তিত্ব রয়েছে টাঙ্গাইল ও ময়মনসিংহ জেলায়। মাঝে মাঝে তিনি বঙ্গবন্ধুর সমাধিতেও যান। দুই-তিন দিন সমাধিতে পড়েও থাকেন।
কাদের সিদ্দিকীর বড় ভাই লতিফ ছিদ্দিকী শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভার মন্ত্রী ছিলেন। বিদেশে গিয়ে হজরত মোহাম্মদ (সা.)-এর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কথাবার্তা বলায় শেখ হাসিনা তাকে ধর্ম প্রবর্তকের বিরুদ্ধে কটূক্তি করার অপরাধে অপরাধী মনে করায় মন্ত্রিসভা থেকে সরিয়ে দেন। আওয়ামী লীগও তাকে প্রাথমিক সদস্যপদ থেকেও বহিষ্কার করেন। সুখে-শান্তিতে মন্ত্রিত্ব করছিলেন। মাথা খারাপের মতো এ কাজটি করতে গেলেন কেন এ রহস্য এখনও উদঘাটিত হয়নি।
কাদের সিদ্দিকীও একবার হঠাৎ করে সংসদ সদস্যপদ থেকে পদত্যাগ করে ফেললেন। পরবর্তী সময়ে উপনির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আওয়ামী লীগ প্রার্থীর হাতে পরাজিত হলেন। কেন তিনি সদস্যপদ থেকে পদত্যাগ করলেন, কী বিরোধ ছিল আওয়ামী লীগের সঙ্গে প্রকৃত সত্য কথাটা এখনও কেউ জানে না। সম্ভবত পাগলামি করা সিদ্দিকী পরিবারের এটা সমস্যা। না হয় এক ভাই ধর্মের বিরুদ্ধে কথা বলে (যা ছিল অপ্রয়োজনীয়) মন্ত্রিত্ব আর দলীয় সদস্য পদ হারাবেন কেন? আর আরেক ভাই শুধু সংসদ সদস্যপদ ত্যাগ করে চলে যাবেন কেন?
স্ব-স্ব রাজনীতির মধ্যে বুদ্ধিভিত্তিক সংহতি থাকতে হবে। যদি কোনও রাজনৈতিক নেতাকর্মী নিজেকে রাজনৈতিক সংগ্রামের সত্যিকার মূল্যবোধের সঙ্গে যুক্ত না করে তবে সে জীবনের সঠিক অভিজ্ঞতার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারবে না। এদের অবস্থাটা হয়েছে তাই। কাদের সিদ্দিকী একসময় দিগন্ত টেলিভিশনে গিয়ে কাজ শুরু করলেন, যাদের অনুসৃত নীতির সঙ্গে তার সারা জীবনের অনুসৃত নীতি-আদর্শের কোনও মিল ছিল না। বুদ্ধিভিত্তিক প্রেরণার মতো আড়ম্বরপূর্ণভাবে পালন যোগ্য আর কিছুই থাকতে পারে না। কোন প্রেরণায় বশীভূত হয়ে তিনি তার সারা জীবনের অনুসৃত নীতি আদর্শের বিরুদ্ধে পরিচালিত একটা টেলিভিশনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হলেন।
‘যখন যা তখন তা’ অনুরূপ কাজ কাদের সিদ্দিকী করবে কেন? আমার মনে হয় কাদের সিদ্দিকীকে এসব অনিয়মিত কাজে টেনে নিয়েছে তার যা হওয়াই উচিত ছিল তারচেয়ে অতিরিক্ত আশা পোষণ করায়। তিনি ঠিকাদারি ব্যবসা করতে গিয়ে কয়েকটা ব্রিজের কাজ নিলেন অথচ ব্রিজগুলোর কাজ নাকি সম্পূর্ণ করেননি। বিলের টাকা নিয়ে গেছেন নাকি কাজের চেয়ে বেশি। এ দেশে বদনাম কুড়াতে সময় লাগে না। মুনতাসীর মামুন তার লেখায় দেখলাম কাদের সিদ্দিকীর বীরউত্তম খ্যাতি পরিবর্তন করে ‘ব্রিজ উত্তম’ দিয়েছেন।
কাদের সিদ্দিকীর যা অর্জন তা ১৯৭১-৭২ সালে অর্জন করেছিলেন। কিন্তু আমি যে পূর্বে বলেছি যা হওয়া উচিত ছিল তারচেয়ে অতিরিক্ত আশাই তাকে ডুবালো। এক জীবনে সবকিছু পাওয়ার সৌভাগ্য সবার হয় না। স্বাধীনতা যুদ্ধে তার ত্যাগের জন্য তাকে চূড়ান্তভাবে সম্মানিত করা হয়েছিল, যা নিয়ে তিনি সন্তুষ্ট থাকেন নি। ফল হলো তার খ্যাতি চূড়ান্তভাবে ম্লান হলো। বীর উত্তমকে লোকে তামাশা করে ‘ব্রিজ উত্তম’ বলতে আরম্ভ করল।
আমি নিজেও একজন মুক্তিযোদ্ধা। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তমের অধঃপতন দেখে মর্মাহত হয়েছি বলে তাকে নিয়ে লেখা।
তিনি জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে যোগদান করতে বিলম্ব করেছেন, মনে করেছিলাম হয়তো তার সাবেক দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে কোনও বিষয়ে কথাবার্তা বলছেন। অবশেষে শুনলাম তার খেলাপি ঋণ নিয়েই নাকি উভয় জোটের সঙ্গে কথাবার্তা বলছিলেন। তাকে যে ঋণ থেকে মুক্ত করবে তার দিকেই তিনি যাবেন।
অবশেষে বিএনপির ঐক্য জোটেই গেলেন।
কাদের সিদ্দিকীর মার্কা গামছা। সেই গামছা গলায় নিয়েই ঘোরেন তিনি। কিন্তু এখন শুনছি নির্বাচন করবেন ধানের শীষ নিয়ে। সেদিন ফেসবুকে তার ছবি দেখলাম মুজিব কোটের বুক পকেটের ওপরে ধানের শীষ নকশা করেছেন। একটি মানুষের আত্মা কতটুকু লোভে ধরলে সমস্ত নীতি আদর্শ এভাবে ফেলে দিয়ে পুরো উল্টো পথে হাঁটতে পারেন। যাকে বঙ্গবন্ধুর খুনি বলে বিচার চেয়ে, অভিযুক্ত করে এতদিন রাজনীতি করলেন, দেশ ছাড়লেন– তার দলের মার্কা নিয়ে নির্বাচন করতে যাওয়া কতটা দৈন্যতা কাদের সিদ্দিকী হয়তো বুঝবেন না, বুঝবেন তার ভক্তরা।
সেই রকম এক শীর্ষ ব্যক্তি তার উদ্দেশ্যে লেখা চিঠিতে এমনই আক্ষেপ করেছেন। ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার কৃতী সন্তান বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে ফাঁসির মঞ্চ থেকে বেঁচে যাওয়া প্রতিরোধ যোদ্ধা মুজিব সৈনিক ‘বিশ্বজিৎ নন্দীর’ কাদের সিদ্দিকীকে লেখা পত্রটি শেয়ার করা প্রাসঙ্গিক মনে করছি। তিনি লিখেছেন:
‘শ্রদ্ধেয় কাদের ভাই,
সালাম নিবেন। জানি, আমাকে এখন আপনি চিনতে পারবেন না। আমি মুক্তাগাছার গোবিন্দপুর গ্রামের বিশ্বজিৎ নন্দী। পিতা হত্যার প্রতিশোধ নিবো বলে, আপনার সাথে অস্ত্র হাতে প্রতিরোধ যুদ্ধে নেমেছিলাম। আপনি বলতেন, ‘পিতা হত্যার প্রতিশোধ না নিয়ে ঘরে ফিরবেন না’। অথচ আপনি আজ কেবল ঘরেই ফিরেন নি, আপনার ঘরে আজ ওই খুনিদের আনাগোনা। একত্রে বসে পরিকল্পনা করেন, কীভাবে মুজিব কন্যার পতন ঘটাবেন।
১৯৭৬ সালের ১৮ই আগস্ট দিনটির কথা কী মনে আছে। অপারেশনে পাঠিয়েছিলেন মুক্তাগাছায়! সেনাবাহিনী আমাদের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছিল।
আমাদের আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেয়। কিন্তু আত্মসমর্পণের মাধ্যমে আরেকটি কলঙ্কের ইতিহাস হোক, তা চাইনি বলে টানা ৮ ঘণ্টা যুদ্ধ চালাতে গিয়ে সহযোদ্ধা পাঁচজনের মৃত্যু হয়। হাতে-পায়ে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আমাকে গ্রেফতার করা হয়। অথচ আজ আপনিই ওদের কাছে আত্মসমর্পণ করে বসে আছেন।
যৌবনের ১৩টা বছর আমি কাটিয়েছি কারাগারে। ৭ বছর ছিলাম কনডেম সেলে। যে জিয়ার হয়ে আজ আপনি মাঠঘাট চষে বেড়াচ্ছেন, সে জিয়ার সামরিক আদালতে ১৯৭৭ সালের ১৮ মে আমার ফাঁসির রায় হয়।
আমি বিশ্বজিৎ ওদের চোখে অপরাধী হলেও আপনি এখন ওদের কাছে মহামানব। ভালো থাকবেন হে মহামানব। ক্ষমতায় গিয়ে, যদি পারেন, আমার জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া সেই ১৩টা বছর ফিরিয়ে দিবেন। তা না হলে, আপনি আমার কাছে বাকি জীবনটা বিশ্বাসঘাতক হয়েই থাকবেন।
ইতি-
বিশ্বজিৎ নন্দী
টাঙ্গাইল।
১৯ নভেম্বর ২০১৮ইং
ঋণ পরিশোধের কথাটা কতটুকু সত্য জানি না। তবে কথা যদি সত্য হয় তবে শেষ কলঙ্ক মাথায় তুলে নিলেন তিনি। কয়দিন আগে বলেছেন শেখ হাসিনা ২০ সিট পাবেন, এখন বলছেন ১৯ সিট পাবেন। এ প্রলাপ আনন্দের প্রলাপ না হতাশার প্রলাপ জানি না। তবে অভিজ্ঞতা থেকে এটা বলতে পারি যে কাদের সিদ্দিকীর ইতিহাসের সমাপ্তি ঘটেছে।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক
(বাংলাট্রিবিউন এর সৌজন্যে)