নিউইয়র্ক ০১:০৩ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৬ মার্চ ২০২৫, ২ চৈত্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

এথেন্স থেকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০৭:৪৭:৫৯ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৩ জুলাই ২০২০
  • / ৯৮ বার পঠিত

সোহেল তাজ: বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম নায়ক তাজউদ্দীন আহমদের ৯৫তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে একটি লেখা দেওয়ার জন্য যখন আমার দীর্ঘদিনের পরিচিত একজন সাংবাদিক বন্ধু অনুরোধ করলেন, আমি তখন চিন্তায় পড়ে গেলাম। বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবীর মানুষ যখন করোনাভাইরাস মহামারিতে দিশাহারা, যখন অর্থনৈতিক ও মানসিকভাবে সবাই অনেকটা বিপর্যস্ত, যখন ভবিষ্যতের পথটা অনেকটাই অন্ধকার, ঠিক সেই মুহূর্তে কী লিখতে পারি আমার বাবা সম্পর্কে? ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মনে পড়ে গেল ৪৩০ খ্রিস্টপূর্ব এথেন্সের কথা। সে বছর এথেন্স আক্রান্ত হয় ভয়াবহ ‘প্লেগ’ মহামারিতে। ওদিকে তখন আবার ওদের যুদ্ধ চলছিল স্পার্টার সঙ্গে (পেলোপনেসিয়ান যুদ্ধ), যা থেকে আত্মরক্ষার জন্য সব মানুুষ শহরের দেয়ালঘেরা কেন্দ্রে আশ্রয় নেয়। তাতে হয় হিতে বিপরীত, এই ভয়াবহ ছোঁয়াছে রোগ আফ্রিকার ইথিওপিয়া থেকে এসে এথেন্সে ছড়িয়ে পড়ে। সেই সময় এথেন্সের নেতৃত্বে ছিলেন পেরিক্লেস, যাঁর নেতৃত্বে ৪৬১ খ্রিস্টপূর্ব থেকে পেরিক্লেসের নেতৃত্বে এথেন্সের ব্যাপক উন্নতি হয়। ইতিহাসবিদরা সেই সময়কে আখ্যায়িত করেছেন ‘পেরিক্লেসের যুগ’ নাম দিয়ে। কিন্তু মহামারি ছারখার করে দেয় সব কিছু, মৃত্যু ঘটে শতকরা ২৫ শতাংশ মানুষের, এমনকি পেরিক্লেস নিজেও মারা যান ৪২৯ খ্রিস্টপূর্বে। যুদ্ধ চলে আরো ২৫ বছর। এতে পুরোপুরিই বিধ্বস্ত হয়ে যাওয়ার কথা এথেন্সের। কিন্তু এর পরও ঘুরে দাঁড়ায় তারা। প্রশ্ন হচ্ছে যে এত বিপর্যয় আর প্রতিকূল পরিস্থিতি সত্তে¡ও কিভাবে তারা দৃঢ়তার সঙ্গে ভবিষ্যেক মোকাবেলা করতে এগিয়ে চলল? কেন তারা পরাজয় মেনে নিল না?
এর কারণ জানতে হলে বিশ্লেষণ করতে হবে তাদের সামাজিক মূল্যবোধ এবং জীবন বা জীবনব্যবস্থা সম্পর্কে তাদের চিন্তাধারা। তারা ছিল গর্বিত জাতি, তাদের গর্ব ছিল তাদের ইতিহাস, তাদের গর্ব ছিল ব্যক্তিস্বাধীনতার ইতিহাস, মুক্তচিন্তা-বাকস্বাধীনতার ইতিহাস, গণতন্ত্রের ইতিহাস, ভাষা-সাহিত্যের ইতিহাস, যুগান্তকারী বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের ইতিহাস, উন্নত সংস্কৃতির ইতিহাস। তাদের অনুপ্রেরণা ছিল সেই ইতিহাসের চরিত্ররা, যাঁদের দিয়ে তৈরি হয়েছিল সেই গর্বিত ইতিহাসের অধ্যায়।
স্ত্রী, পুত্র-কন্যাদের সাথে তাজউদ্দীন আহমেদ

আজ থেকে প্রায় দুই হাজার পাঁচ শ বছর আগে কেমন ছিল আমাদের এই পৃথিবী?
বর্তমান যুগে বাকস্বাধীনতা, মানবাধিকার, ন্যায়বিচার, আইনের শাসন, সম-অধিকার ইত্যাদি আমরা আমাদের প্রাপ্য অধিকার হিসেবে ধরে নিয়েছি, কিন্তু এমন একটা সময় ছিল যখন একজন মানুষের সামাজিক অবস্থান নির্ধারিত হতো তার জন্ম থেকেই- হয় রাজা নয়তো প্রজা। নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করার কোনো সুযোগ ছিল না। সেই সময় ভারত উপমহাদেশে ছিল রাজাদের রাজত্ব, মধ্যপ্রাচ্যে আধিপত্য বিস্তার করেছিল পারস্য সা¤্রাজ্য, মিসরে ফারাওদের রাজত্ব, বাদ বাকি আফ্রিকা তখনো সভ্যতার ছোঁয়া পায়নি। উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকায় তখন আদি মায়ান রাজত্ব এবং ছড়ানো-ছিটানো আদি মানুষ। বাকি ইউরোপের বেশির ভাগ মানুষ ছোট ছোট গোষ্ঠী দ্বারা ন্যূনতম জীবন যাপন করছে। চীন দেশে জু বংশের রাজত্ব। অস্ট্রেলিয়া মহাদেশে শুধু আদিবাসীদের বসবাস। এমন অবস্থায় এথেন্সে ঘটে যায় যুগান্তকারী কিছু ঘটনা, যা চিরকালের জন্য পাল্টে দেয় মানুষের ভবিষ্যৎ চলার পথ।
এথেন্সের কাহিনী থেকে জানা যায়, ৫৬১ খ্রিস্টপূর্বে সেই শহরে ব্যাপক অশান্তি হয়, যার কারণ ছিল সেই সময়ের ক্ষমতাবান অভিজাত পরিবারের শাসকগোষ্ঠীর অন্তর্দ্ব›দ্ব, অত্যাচার ও নির্যাতন। এর থেকে রেহাই পেতে যখন এথেন্সবাসী দিশাহারা, ঠিক তখন পাইসিসট্রাটাস নামের একজন শক্তিধর সুদর্শন ব্যক্তি হাজির হন এবং এথেন্সবাসীকে এই দুর্যোগ থেকে মুক্তিদানের প্রতিজ্ঞা করেন। এথেন্সবাসী তাঁকে গ্রহণ করে নেয় এবং পাইসিসট্রাটাস প্রথম ‘টাইরান্ট’ অর্থাৎ স্বৈরশাসক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। তাঁর জীবদ্দশায় তিনি তাঁর প্রতিজ্ঞা অটুট রাখেন এবং সাধারণ মানুষের জীবন উন্নয়নের লক্ষ্যে ব্যাপক কাজ করেন। পাশাপাশি অভিজাত গোষ্ঠীর ক্ষমতা ও প্রভাব অনেকটাই কমিয়ে আনেন। পাইসিসট্রাটাসের নেতৃত্বে এথেন্সের অর্থনীতির ব্যাপক উন্নতি হয় এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এথেন্স বেশ প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। এই সময় সামাজিক পরিবর্তনের একটি উল্লেখযোগ্য দিক ছিল মেধা ও যোগ্যতা। যেকোনো পেশা বা কাজে মেধা আর যোগ্যতাই ছিল সমাজে একজন নাগরিকের সবচেয়ে বড় পরিচয়। আর এই দুইয়ের প্রতিযোগিতাই হয়ে ওঠে সমাজের মূলমন্ত্র বা চালিকাশক্তি। ৫২৭ খ্রিস্টপূর্বে তাঁর মৃত্যুর পর তাঁরই দুই ছেলেসন্তান হিপ্পিয়াস ও হিপ্পার্কাস যৌথভাবে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। প্রথম দিকে তাঁরা বাবা পাইসিসট্রাটাসের পথ অবলম্বন করেন, কিন্তু ৫১৪ খ্রিস্টপূর্বে হিপ্পার্কাসকে ষড়যন্ত্রকারীরা হত্যা করলে তাঁর ভাই হিপ্পিয়াস প্রতিশোধের নেশায় মগ্ন হয়ে যান এবং ষড়যন্ত্রকারীদেরসহ অনেক নিরীহ মানুষকে হত্যা ও নির্যাতন করেন। এর ফলে এথেন্সের জনগণ তাঁর বিপক্ষে চলে যায় এবং একক শাসকচালিত প্রথার বিপক্ষে অবস্থান নেয়। অভিজাত পরিবারতন্ত্রের তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণে তারা সেই পদ্ধতিও প্রত্যাখ্যান করে। গড়ে ওঠে জনতার আন্দোলন এবং ৫১০ খ্রিস্টপূর্বে গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরাচার হিপ্পিয়াসের পতন ঘটলে তাঁকে এথেন্স থেকে প্রবাসে বিতাড়িত করা হয়। এই গণ-অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেন ক্লায়স্থেনিস। ক্লায়স্থেনিস যদিও অভিজাত পরিবারের সদস্য ছিলেন, তিনি তা প্রত্যাখ্যান করে জনতার কাতারে যোগ দিয়েছিলেন নাগরিক অধিকার ফিরে পাওয়ার লক্ষ্যে। কিন্তু অভিজাত পরিবারগোষ্ঠী তা মেনে নিতে পারেনি এবং তাদের প্রতিনিধি আইসাগরাস ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় এথেন্সের শত্রæ শহর স্পার্টার সঙ্গে মিলে। স্পার্টার রাজা ক্লিওমেনেসের সহযোগিতায় আইসাগরাস স্পার্টার সেনাবাহিনী নিয়ে ক্ষমতা দখল করে এবং ক্লায়স্থেনিসকে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেয়। ফলে আবারও এথেন্স ও এথেন্সের নাগরিকদের ওপর চেপে বসে স্বৈরাচারী শাসন।
কিন্তু এথেন্সবাসী ভুলতে পারেনি মুক্তির ঘ্রাণ, আর তাই দুই বছর যেতে না যেতেই ৫০৮ খ্রিস্টপূর্বে তারা আবারও বিক্ষোভে ফেটে পড়ে এবং আবারও গণ-আন্দোলন তৈরি করে। সাধারণ মানুষের তোপের মুখে আইসাগরাস এবং তার সমর্থকরা পাহাড়ের ওপর অবস্থিত এক্রোপলিসে আশ্রয় নেয়। দুই দিন সেখানে ঘেরাও অবস্থায় থাকার পর আত্মসর্পণ করলে তাকে নির্বাসনে পাঠানো হয়। সাধারণ জনতার দাবি অনুযায়ী ক্লায়স্থেনিসকে আবারও তারা ফিরিয়ে নিয়ে আসে তাদের নেতা হিসেবে। গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা সাধারণ জনগণের হাতে আসার ঘটনা মানব ইতিহাসে এই প্রথম।
এই পরিস্থিতিতে ক্লায়স্থেনিসের পরবর্তী যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত চিরকালের জন্য বদলে দেয় শুধু এথেন্সবাসীরই নয়, সঙ্গে সমগ্র মানবসমাজের ভবিষ্যৎ অগ্রযাত্রা। তিনি অনুধাবন করতে চেষ্টা করলেন এথেন্সবাসীর আশা-আকাংখা। বুঝতে পারলেন যে মুক্তিকামী, স্বাধীনচেতা এথেন্সবাসীর স্বপ্ন কোনো দিনও পূরণ করা সম্ভব হবে না পুরনো শাসনব্যবস্থা দ্বারা, তাদের ভবিষ্যৎ গড়ার দায়িত্ব তাদের হাতেই দিতে হবে। তিনি একটি নাগরিক সভার আয়োজন করলেন এক্রোপলিস পাহাড়ের পাশে। সেই সভায় সব মানুষকে আমন্ত্রণ করলেন তাদের বিভিন্ন সমস্যা তুলে ধরতে। ব্যবস্থা করলেন ইতিহাসের প্রথম ভোট ও নির্বাচন- ‘হ্যাঁ’র জন্য সাদা পাথরের টুকরা আর কালো পাথরের টুকরা ‘না’র জন্য। এভাবেই জন্ম হয় গণতান্ত্রিক নির্বাচন ও পদ্ধতির। এটাই হচ্ছে আমাদের বর্তমান যুগের পার্লামেন্ট, কংগ্রেস বা সিনেটের সূত্রপাত।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে আমি কেন আমার বাবা তাজউদ্দীন আহমদের জন্মদিন উপলক্ষে এথেন্সের কাহিনি উল্লেখ করছি। আমি এই ঐতিহাসিক কাহিনীগুলো উল্লেখ করেছি, কারণ আমাদেরও এথেন্সের মতো গৌরবের ইতিহাস আছে। আছে ইতিহাস গড়া চরিত্র, যাঁদের কীর্তি আমাদের দিতে পারে একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ার অনুপ্রেরণা।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পেছনে লুকিয়ে আছে শত শত বছরের অর্জনের ইতিহাস। লুকিয়ে আছে অনেক গৌরবের কীর্তি আর ব্যক্তিত্বের ইতিহাস এবং সেই ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু হওয়া এই যাত্রায় আমরা খুঁজে পাই খুদিরাম আর মাস্টারদা সূর্য সেনদের মতো স্বাধীনচেতা উদ্যমী চরিত্রদের। খুঁজে পাই মহাত্মা গান্ধীর মতো বিশাল চরিত্রকে, যিনি ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটান শান্তিকে হাতিয়ার করে। বাঙালী-বাংলা ভাষা, স্বাধীকার, স্বাধীনতার ইতিহাসে খুঁজে পাই হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, এ কে ফজলুল হক, মওলানা ভাসানীসহ আরো অনেককেই, যাঁদের অবদান আর ত্যাগ সৃষ্টি করে দেয় বাঙালী জাতির কাংখিত স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে যাওয়ার পথ।
পাইসিসট্রাস আর ক্লায়ন্থেনিস যেমন এথেন্সবাসীকে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন একটা সুন্দর ভবিষ্যতের, ঠিক একইভাবে বাংলার মানুষকে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন সম-অধিকারের, স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন বাংলার মানুষের ভাষা হবে বাংলা, স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন এমন একটা দেশের, যে দেশে সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত হবে, স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন স্বাধীনতার। তাই বাংলার মানুষ তাঁকে গ্রহণ করে নেয় তাদের জনক হিসেবে।
আবার এথেন্সেই ছিলেন থেমিস্টোক্লিসের মতো নেতা, যাঁর দূরদর্শিতা এথেন্সকে রক্ষা করেছিল পারস্য সা¤্রাজ্যের আক্রমণ থেকে। ঠিক একইভাবে বাঙালী জাতির ক্রান্তি—লগ্নে, যখন পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ধ্বংসের লীলাখেলা চালাল, বাংলার মানুষ যখন দিশাহারা তখন হাল ধরলেন তাজউদ্দীন আহমদ। মুক্তিপাগল বাঙালী জাতির স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে মহান মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বের দায়িত্ব নিলেন। তাজউদ্দীন আহমদের জীবনী পড়লে দেখা যায় যে তিনি বরাবরই খুব বিচক্ষণ, দূরদর্শী, আত্মবিশ্বাসী। সঙ্গে অর্থনীতি ও আইনের ওপর পড়াশোনা করায় তীক্ষ মেধাসম্পন্ন ছিলেন, যার স্পষ্ট প্রমাণ খুঁজে পাওয়া যায় মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ৯ মাসে এবং পরবর্তী চার বছর ১৯৭৫ সালে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে তাজউদ্দীন আহমেদ

১৯৭০ সালে পাকিস্তানের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে এবং সংবিধান অনুযায়ী সরকার গঠন করার অধিকার পায়। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক ও রাজনীতিক গোষ্ঠী এই রায় মেনে নিতে পারেনি। বিভিন্ন অসিলায় ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বিলম্ব ঘটাতে থাকে এবং ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। ক্ষমতা হস্তান্তরের লক্ষ্যে কিছু আলোচনা আর বৈঠকের আয়োজন করে; কিন্তু পর্দার আড়ালে ব্যাপক সামরিক প্রস্তুতি নেয়। ২৫ মার্চ ১৯৭১ ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামক বিদ্রোহী দমন অভিযান চালায়, শুরু হয় গণহত্যা। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের বিবেচনায় ছিল যে পশ্চিম পাকিস্তানীরা হয়তো শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না এবং সে জন্য তাদের একটা পূর্বপরিকল্পনা ছিল। কিন্তু এই অভিযানের ব্যাপকতা ও হিং¯্রতা পাল্টে দেয় সব হিসাব-নিকাশ। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাজউদ্দীনসহ অন্য নেতারা বাধ্য হন আত্মগোপনে যেতে। বাংলার মানুষের ওপর যখন চলছে অত্যাচার-নির্যাতন-গণহত্যা, যখন বাংলার মানুষ দিশাহারা, ২৬ মার্চ তারা পায় আশার আলো যখন রেডিওতে শুনতে পায় বঙ্গবন্ধুর নামে স্বাধীনতার ঘোষণা।
এই অবস্থায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তাজউদ্দীনের কাঁধে এসে পড়ে রাজনৈতিক নেতৃত্বের সব দায়িত্ব। গভীরভাবে সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে তিনি স্পষ্টভাবে বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর কী করণীয়। ১৯৭১ সালের ৩০ মার্চ সীমান্তবর্তী জীবনগরের টঙ্গী এলাকার একটা সেতুর নিজে সেই যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিলেন- স্বাধীনতা সংগ্রামকে সফল করতে হলে আইনের ভিত্তিতে (১৯৭০ সালের নির্বাচন সেই আইনগত ভিত্তির উৎস) সরকার গঠন করতে হবে। সেই সিদ্ধান্তে দৃঢ় থেকে সরকার গঠন করলেন কয়েক দিনের মধ্যেই।
১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠন করা হলো এবং স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র প্রকাশ করা হলো। ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশের প্রথম সরকার শপথ গ্রহণের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরু করল এবং সব প্রতিবন্ধকতা, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে মহান মুক্তিযুদ্ধের সফল নেতৃত্ব দিয়ে ৯ মাসে বিজয় ছিনিয়ে আনল। তাজউদ্দীনের এই অবিস্মরণীয় নেতৃত্বের (তিনি নিজে রণাঙ্গনে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের পরিদর্শন, দেখভাল এবং খোঁজখবর নেন) স্বীকৃতি হিসেবে তাঁকে সাধারণ জনতা ‘বঙ্গতাজ’ উপাধি দেয়। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারী ‘জাতির জনক’ স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করার পর পরই তাজউদ্দীন তাঁকে স্বাধীন বাংলাদেশ উপহার দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব ছেড়ে দেন এবং বঙ্গবন্ধুর সরকারের অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন ১৯৭৪ সালের অক্টোবর মাস পর্যন্ত। গ্রিক নায়ক থেমিস্টোক্লিসের মতো তিনিও ষড়যন্ত্রকারীদের শিকার হন এবং এক অর্থে নীরবে নির্বাসনে চলে যান। জীবদ্দশায় না হলেও ইতিহাস থেমিস্টোক্লিসকে তাঁর প্রাপ্য স্থান এবং সম্মান দিয়েছে- তাজউদ্দীন কি পাবেন তাঁর প্রাপ্য সম্মান?
আমরা যদি আমাদের ইতিহাসের দিকে তাকাই, তাহলে আমরা খুঁজে পাব অনেক অনুকরণীয় চরিত্রদের আর তার পাশাপাশি পাব খলনায়কও (নিশ্চিত করতে হবে যেন ইতিহাস থাকে সংরক্ষিত- ইতিহাস আড়াল বা বিকৃত করা মানে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা)। তাঁদের কীর্তি ও কর্ম থেকে অনুপ্রেরণা আর শিক্ষা নিতে হবে, যাতে আমরা আমাদের ভবিষৎ প্রজন্মের জন্য দিয়ে যেতে পারি একটা সোনার বাংলা। আমার বাবা যেই স্বপ্নের জন্য এত ত্যাগ করেছেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের সফল নেতৃত্ব দিয়েছেন, শেষ পর্যন্ত স্বেচ্ছায় নিজের জীবন দিয়েছেন, সেই স্বপ্নের মূলে ছিল এমন একটা সমাজব্যবস্থা, যেখানে মেধা আর যোগ্যতাই হবে মূলমন্ত্র এবং চালিকাশক্তি। নতুন প্রজন্ম মেতে উঠবে মেধা আর যোগ্যতার প্রতিযোগিতায়। বাকস্বাধীনতা, মুক্তচিন্তা, ন্যায়বিচার হবে সেই সমাজব্যবস্থার ভিত্তি এবং খুলে দেবে নতুন দিগন্তের জানালা। আর আমার বাবার জন্মদিনে এটাই হবে তাঁর সবচেয়ে বড় পাওয়া। (দৈনিক কালের কন্ঠ)
লেখক: তাজউদ্দীন আহমেদ-এর পুত্র। বাংলাদেশের সাবেক এমপি ও স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী।

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

এথেন্স থেকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ

প্রকাশের সময় : ০৭:৪৭:৫৯ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৩ জুলাই ২০২০

সোহেল তাজ: বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম নায়ক তাজউদ্দীন আহমদের ৯৫তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে একটি লেখা দেওয়ার জন্য যখন আমার দীর্ঘদিনের পরিচিত একজন সাংবাদিক বন্ধু অনুরোধ করলেন, আমি তখন চিন্তায় পড়ে গেলাম। বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবীর মানুষ যখন করোনাভাইরাস মহামারিতে দিশাহারা, যখন অর্থনৈতিক ও মানসিকভাবে সবাই অনেকটা বিপর্যস্ত, যখন ভবিষ্যতের পথটা অনেকটাই অন্ধকার, ঠিক সেই মুহূর্তে কী লিখতে পারি আমার বাবা সম্পর্কে? ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মনে পড়ে গেল ৪৩০ খ্রিস্টপূর্ব এথেন্সের কথা। সে বছর এথেন্স আক্রান্ত হয় ভয়াবহ ‘প্লেগ’ মহামারিতে। ওদিকে তখন আবার ওদের যুদ্ধ চলছিল স্পার্টার সঙ্গে (পেলোপনেসিয়ান যুদ্ধ), যা থেকে আত্মরক্ষার জন্য সব মানুুষ শহরের দেয়ালঘেরা কেন্দ্রে আশ্রয় নেয়। তাতে হয় হিতে বিপরীত, এই ভয়াবহ ছোঁয়াছে রোগ আফ্রিকার ইথিওপিয়া থেকে এসে এথেন্সে ছড়িয়ে পড়ে। সেই সময় এথেন্সের নেতৃত্বে ছিলেন পেরিক্লেস, যাঁর নেতৃত্বে ৪৬১ খ্রিস্টপূর্ব থেকে পেরিক্লেসের নেতৃত্বে এথেন্সের ব্যাপক উন্নতি হয়। ইতিহাসবিদরা সেই সময়কে আখ্যায়িত করেছেন ‘পেরিক্লেসের যুগ’ নাম দিয়ে। কিন্তু মহামারি ছারখার করে দেয় সব কিছু, মৃত্যু ঘটে শতকরা ২৫ শতাংশ মানুষের, এমনকি পেরিক্লেস নিজেও মারা যান ৪২৯ খ্রিস্টপূর্বে। যুদ্ধ চলে আরো ২৫ বছর। এতে পুরোপুরিই বিধ্বস্ত হয়ে যাওয়ার কথা এথেন্সের। কিন্তু এর পরও ঘুরে দাঁড়ায় তারা। প্রশ্ন হচ্ছে যে এত বিপর্যয় আর প্রতিকূল পরিস্থিতি সত্তে¡ও কিভাবে তারা দৃঢ়তার সঙ্গে ভবিষ্যেক মোকাবেলা করতে এগিয়ে চলল? কেন তারা পরাজয় মেনে নিল না?
এর কারণ জানতে হলে বিশ্লেষণ করতে হবে তাদের সামাজিক মূল্যবোধ এবং জীবন বা জীবনব্যবস্থা সম্পর্কে তাদের চিন্তাধারা। তারা ছিল গর্বিত জাতি, তাদের গর্ব ছিল তাদের ইতিহাস, তাদের গর্ব ছিল ব্যক্তিস্বাধীনতার ইতিহাস, মুক্তচিন্তা-বাকস্বাধীনতার ইতিহাস, গণতন্ত্রের ইতিহাস, ভাষা-সাহিত্যের ইতিহাস, যুগান্তকারী বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের ইতিহাস, উন্নত সংস্কৃতির ইতিহাস। তাদের অনুপ্রেরণা ছিল সেই ইতিহাসের চরিত্ররা, যাঁদের দিয়ে তৈরি হয়েছিল সেই গর্বিত ইতিহাসের অধ্যায়।
স্ত্রী, পুত্র-কন্যাদের সাথে তাজউদ্দীন আহমেদ

আজ থেকে প্রায় দুই হাজার পাঁচ শ বছর আগে কেমন ছিল আমাদের এই পৃথিবী?
বর্তমান যুগে বাকস্বাধীনতা, মানবাধিকার, ন্যায়বিচার, আইনের শাসন, সম-অধিকার ইত্যাদি আমরা আমাদের প্রাপ্য অধিকার হিসেবে ধরে নিয়েছি, কিন্তু এমন একটা সময় ছিল যখন একজন মানুষের সামাজিক অবস্থান নির্ধারিত হতো তার জন্ম থেকেই- হয় রাজা নয়তো প্রজা। নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করার কোনো সুযোগ ছিল না। সেই সময় ভারত উপমহাদেশে ছিল রাজাদের রাজত্ব, মধ্যপ্রাচ্যে আধিপত্য বিস্তার করেছিল পারস্য সা¤্রাজ্য, মিসরে ফারাওদের রাজত্ব, বাদ বাকি আফ্রিকা তখনো সভ্যতার ছোঁয়া পায়নি। উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকায় তখন আদি মায়ান রাজত্ব এবং ছড়ানো-ছিটানো আদি মানুষ। বাকি ইউরোপের বেশির ভাগ মানুষ ছোট ছোট গোষ্ঠী দ্বারা ন্যূনতম জীবন যাপন করছে। চীন দেশে জু বংশের রাজত্ব। অস্ট্রেলিয়া মহাদেশে শুধু আদিবাসীদের বসবাস। এমন অবস্থায় এথেন্সে ঘটে যায় যুগান্তকারী কিছু ঘটনা, যা চিরকালের জন্য পাল্টে দেয় মানুষের ভবিষ্যৎ চলার পথ।
এথেন্সের কাহিনী থেকে জানা যায়, ৫৬১ খ্রিস্টপূর্বে সেই শহরে ব্যাপক অশান্তি হয়, যার কারণ ছিল সেই সময়ের ক্ষমতাবান অভিজাত পরিবারের শাসকগোষ্ঠীর অন্তর্দ্ব›দ্ব, অত্যাচার ও নির্যাতন। এর থেকে রেহাই পেতে যখন এথেন্সবাসী দিশাহারা, ঠিক তখন পাইসিসট্রাটাস নামের একজন শক্তিধর সুদর্শন ব্যক্তি হাজির হন এবং এথেন্সবাসীকে এই দুর্যোগ থেকে মুক্তিদানের প্রতিজ্ঞা করেন। এথেন্সবাসী তাঁকে গ্রহণ করে নেয় এবং পাইসিসট্রাটাস প্রথম ‘টাইরান্ট’ অর্থাৎ স্বৈরশাসক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। তাঁর জীবদ্দশায় তিনি তাঁর প্রতিজ্ঞা অটুট রাখেন এবং সাধারণ মানুষের জীবন উন্নয়নের লক্ষ্যে ব্যাপক কাজ করেন। পাশাপাশি অভিজাত গোষ্ঠীর ক্ষমতা ও প্রভাব অনেকটাই কমিয়ে আনেন। পাইসিসট্রাটাসের নেতৃত্বে এথেন্সের অর্থনীতির ব্যাপক উন্নতি হয় এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এথেন্স বেশ প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। এই সময় সামাজিক পরিবর্তনের একটি উল্লেখযোগ্য দিক ছিল মেধা ও যোগ্যতা। যেকোনো পেশা বা কাজে মেধা আর যোগ্যতাই ছিল সমাজে একজন নাগরিকের সবচেয়ে বড় পরিচয়। আর এই দুইয়ের প্রতিযোগিতাই হয়ে ওঠে সমাজের মূলমন্ত্র বা চালিকাশক্তি। ৫২৭ খ্রিস্টপূর্বে তাঁর মৃত্যুর পর তাঁরই দুই ছেলেসন্তান হিপ্পিয়াস ও হিপ্পার্কাস যৌথভাবে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। প্রথম দিকে তাঁরা বাবা পাইসিসট্রাটাসের পথ অবলম্বন করেন, কিন্তু ৫১৪ খ্রিস্টপূর্বে হিপ্পার্কাসকে ষড়যন্ত্রকারীরা হত্যা করলে তাঁর ভাই হিপ্পিয়াস প্রতিশোধের নেশায় মগ্ন হয়ে যান এবং ষড়যন্ত্রকারীদেরসহ অনেক নিরীহ মানুষকে হত্যা ও নির্যাতন করেন। এর ফলে এথেন্সের জনগণ তাঁর বিপক্ষে চলে যায় এবং একক শাসকচালিত প্রথার বিপক্ষে অবস্থান নেয়। অভিজাত পরিবারতন্ত্রের তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণে তারা সেই পদ্ধতিও প্রত্যাখ্যান করে। গড়ে ওঠে জনতার আন্দোলন এবং ৫১০ খ্রিস্টপূর্বে গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরাচার হিপ্পিয়াসের পতন ঘটলে তাঁকে এথেন্স থেকে প্রবাসে বিতাড়িত করা হয়। এই গণ-অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেন ক্লায়স্থেনিস। ক্লায়স্থেনিস যদিও অভিজাত পরিবারের সদস্য ছিলেন, তিনি তা প্রত্যাখ্যান করে জনতার কাতারে যোগ দিয়েছিলেন নাগরিক অধিকার ফিরে পাওয়ার লক্ষ্যে। কিন্তু অভিজাত পরিবারগোষ্ঠী তা মেনে নিতে পারেনি এবং তাদের প্রতিনিধি আইসাগরাস ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় এথেন্সের শত্রæ শহর স্পার্টার সঙ্গে মিলে। স্পার্টার রাজা ক্লিওমেনেসের সহযোগিতায় আইসাগরাস স্পার্টার সেনাবাহিনী নিয়ে ক্ষমতা দখল করে এবং ক্লায়স্থেনিসকে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেয়। ফলে আবারও এথেন্স ও এথেন্সের নাগরিকদের ওপর চেপে বসে স্বৈরাচারী শাসন।
কিন্তু এথেন্সবাসী ভুলতে পারেনি মুক্তির ঘ্রাণ, আর তাই দুই বছর যেতে না যেতেই ৫০৮ খ্রিস্টপূর্বে তারা আবারও বিক্ষোভে ফেটে পড়ে এবং আবারও গণ-আন্দোলন তৈরি করে। সাধারণ মানুষের তোপের মুখে আইসাগরাস এবং তার সমর্থকরা পাহাড়ের ওপর অবস্থিত এক্রোপলিসে আশ্রয় নেয়। দুই দিন সেখানে ঘেরাও অবস্থায় থাকার পর আত্মসর্পণ করলে তাকে নির্বাসনে পাঠানো হয়। সাধারণ জনতার দাবি অনুযায়ী ক্লায়স্থেনিসকে আবারও তারা ফিরিয়ে নিয়ে আসে তাদের নেতা হিসেবে। গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা সাধারণ জনগণের হাতে আসার ঘটনা মানব ইতিহাসে এই প্রথম।
এই পরিস্থিতিতে ক্লায়স্থেনিসের পরবর্তী যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত চিরকালের জন্য বদলে দেয় শুধু এথেন্সবাসীরই নয়, সঙ্গে সমগ্র মানবসমাজের ভবিষ্যৎ অগ্রযাত্রা। তিনি অনুধাবন করতে চেষ্টা করলেন এথেন্সবাসীর আশা-আকাংখা। বুঝতে পারলেন যে মুক্তিকামী, স্বাধীনচেতা এথেন্সবাসীর স্বপ্ন কোনো দিনও পূরণ করা সম্ভব হবে না পুরনো শাসনব্যবস্থা দ্বারা, তাদের ভবিষ্যৎ গড়ার দায়িত্ব তাদের হাতেই দিতে হবে। তিনি একটি নাগরিক সভার আয়োজন করলেন এক্রোপলিস পাহাড়ের পাশে। সেই সভায় সব মানুষকে আমন্ত্রণ করলেন তাদের বিভিন্ন সমস্যা তুলে ধরতে। ব্যবস্থা করলেন ইতিহাসের প্রথম ভোট ও নির্বাচন- ‘হ্যাঁ’র জন্য সাদা পাথরের টুকরা আর কালো পাথরের টুকরা ‘না’র জন্য। এভাবেই জন্ম হয় গণতান্ত্রিক নির্বাচন ও পদ্ধতির। এটাই হচ্ছে আমাদের বর্তমান যুগের পার্লামেন্ট, কংগ্রেস বা সিনেটের সূত্রপাত।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে আমি কেন আমার বাবা তাজউদ্দীন আহমদের জন্মদিন উপলক্ষে এথেন্সের কাহিনি উল্লেখ করছি। আমি এই ঐতিহাসিক কাহিনীগুলো উল্লেখ করেছি, কারণ আমাদেরও এথেন্সের মতো গৌরবের ইতিহাস আছে। আছে ইতিহাস গড়া চরিত্র, যাঁদের কীর্তি আমাদের দিতে পারে একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ার অনুপ্রেরণা।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পেছনে লুকিয়ে আছে শত শত বছরের অর্জনের ইতিহাস। লুকিয়ে আছে অনেক গৌরবের কীর্তি আর ব্যক্তিত্বের ইতিহাস এবং সেই ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু হওয়া এই যাত্রায় আমরা খুঁজে পাই খুদিরাম আর মাস্টারদা সূর্য সেনদের মতো স্বাধীনচেতা উদ্যমী চরিত্রদের। খুঁজে পাই মহাত্মা গান্ধীর মতো বিশাল চরিত্রকে, যিনি ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটান শান্তিকে হাতিয়ার করে। বাঙালী-বাংলা ভাষা, স্বাধীকার, স্বাধীনতার ইতিহাসে খুঁজে পাই হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, এ কে ফজলুল হক, মওলানা ভাসানীসহ আরো অনেককেই, যাঁদের অবদান আর ত্যাগ সৃষ্টি করে দেয় বাঙালী জাতির কাংখিত স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে যাওয়ার পথ।
পাইসিসট্রাস আর ক্লায়ন্থেনিস যেমন এথেন্সবাসীকে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন একটা সুন্দর ভবিষ্যতের, ঠিক একইভাবে বাংলার মানুষকে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন সম-অধিকারের, স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন বাংলার মানুষের ভাষা হবে বাংলা, স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন এমন একটা দেশের, যে দেশে সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত হবে, স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন স্বাধীনতার। তাই বাংলার মানুষ তাঁকে গ্রহণ করে নেয় তাদের জনক হিসেবে।
আবার এথেন্সেই ছিলেন থেমিস্টোক্লিসের মতো নেতা, যাঁর দূরদর্শিতা এথেন্সকে রক্ষা করেছিল পারস্য সা¤্রাজ্যের আক্রমণ থেকে। ঠিক একইভাবে বাঙালী জাতির ক্রান্তি—লগ্নে, যখন পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ধ্বংসের লীলাখেলা চালাল, বাংলার মানুষ যখন দিশাহারা তখন হাল ধরলেন তাজউদ্দীন আহমদ। মুক্তিপাগল বাঙালী জাতির স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে মহান মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বের দায়িত্ব নিলেন। তাজউদ্দীন আহমদের জীবনী পড়লে দেখা যায় যে তিনি বরাবরই খুব বিচক্ষণ, দূরদর্শী, আত্মবিশ্বাসী। সঙ্গে অর্থনীতি ও আইনের ওপর পড়াশোনা করায় তীক্ষ মেধাসম্পন্ন ছিলেন, যার স্পষ্ট প্রমাণ খুঁজে পাওয়া যায় মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ৯ মাসে এবং পরবর্তী চার বছর ১৯৭৫ সালে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে তাজউদ্দীন আহমেদ

১৯৭০ সালে পাকিস্তানের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে এবং সংবিধান অনুযায়ী সরকার গঠন করার অধিকার পায়। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক ও রাজনীতিক গোষ্ঠী এই রায় মেনে নিতে পারেনি। বিভিন্ন অসিলায় ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বিলম্ব ঘটাতে থাকে এবং ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। ক্ষমতা হস্তান্তরের লক্ষ্যে কিছু আলোচনা আর বৈঠকের আয়োজন করে; কিন্তু পর্দার আড়ালে ব্যাপক সামরিক প্রস্তুতি নেয়। ২৫ মার্চ ১৯৭১ ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামক বিদ্রোহী দমন অভিযান চালায়, শুরু হয় গণহত্যা। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের বিবেচনায় ছিল যে পশ্চিম পাকিস্তানীরা হয়তো শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না এবং সে জন্য তাদের একটা পূর্বপরিকল্পনা ছিল। কিন্তু এই অভিযানের ব্যাপকতা ও হিং¯্রতা পাল্টে দেয় সব হিসাব-নিকাশ। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাজউদ্দীনসহ অন্য নেতারা বাধ্য হন আত্মগোপনে যেতে। বাংলার মানুষের ওপর যখন চলছে অত্যাচার-নির্যাতন-গণহত্যা, যখন বাংলার মানুষ দিশাহারা, ২৬ মার্চ তারা পায় আশার আলো যখন রেডিওতে শুনতে পায় বঙ্গবন্ধুর নামে স্বাধীনতার ঘোষণা।
এই অবস্থায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তাজউদ্দীনের কাঁধে এসে পড়ে রাজনৈতিক নেতৃত্বের সব দায়িত্ব। গভীরভাবে সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে তিনি স্পষ্টভাবে বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর কী করণীয়। ১৯৭১ সালের ৩০ মার্চ সীমান্তবর্তী জীবনগরের টঙ্গী এলাকার একটা সেতুর নিজে সেই যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিলেন- স্বাধীনতা সংগ্রামকে সফল করতে হলে আইনের ভিত্তিতে (১৯৭০ সালের নির্বাচন সেই আইনগত ভিত্তির উৎস) সরকার গঠন করতে হবে। সেই সিদ্ধান্তে দৃঢ় থেকে সরকার গঠন করলেন কয়েক দিনের মধ্যেই।
১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠন করা হলো এবং স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র প্রকাশ করা হলো। ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশের প্রথম সরকার শপথ গ্রহণের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরু করল এবং সব প্রতিবন্ধকতা, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে মহান মুক্তিযুদ্ধের সফল নেতৃত্ব দিয়ে ৯ মাসে বিজয় ছিনিয়ে আনল। তাজউদ্দীনের এই অবিস্মরণীয় নেতৃত্বের (তিনি নিজে রণাঙ্গনে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের পরিদর্শন, দেখভাল এবং খোঁজখবর নেন) স্বীকৃতি হিসেবে তাঁকে সাধারণ জনতা ‘বঙ্গতাজ’ উপাধি দেয়। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারী ‘জাতির জনক’ স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করার পর পরই তাজউদ্দীন তাঁকে স্বাধীন বাংলাদেশ উপহার দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব ছেড়ে দেন এবং বঙ্গবন্ধুর সরকারের অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন ১৯৭৪ সালের অক্টোবর মাস পর্যন্ত। গ্রিক নায়ক থেমিস্টোক্লিসের মতো তিনিও ষড়যন্ত্রকারীদের শিকার হন এবং এক অর্থে নীরবে নির্বাসনে চলে যান। জীবদ্দশায় না হলেও ইতিহাস থেমিস্টোক্লিসকে তাঁর প্রাপ্য স্থান এবং সম্মান দিয়েছে- তাজউদ্দীন কি পাবেন তাঁর প্রাপ্য সম্মান?
আমরা যদি আমাদের ইতিহাসের দিকে তাকাই, তাহলে আমরা খুঁজে পাব অনেক অনুকরণীয় চরিত্রদের আর তার পাশাপাশি পাব খলনায়কও (নিশ্চিত করতে হবে যেন ইতিহাস থাকে সংরক্ষিত- ইতিহাস আড়াল বা বিকৃত করা মানে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা)। তাঁদের কীর্তি ও কর্ম থেকে অনুপ্রেরণা আর শিক্ষা নিতে হবে, যাতে আমরা আমাদের ভবিষৎ প্রজন্মের জন্য দিয়ে যেতে পারি একটা সোনার বাংলা। আমার বাবা যেই স্বপ্নের জন্য এত ত্যাগ করেছেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের সফল নেতৃত্ব দিয়েছেন, শেষ পর্যন্ত স্বেচ্ছায় নিজের জীবন দিয়েছেন, সেই স্বপ্নের মূলে ছিল এমন একটা সমাজব্যবস্থা, যেখানে মেধা আর যোগ্যতাই হবে মূলমন্ত্র এবং চালিকাশক্তি। নতুন প্রজন্ম মেতে উঠবে মেধা আর যোগ্যতার প্রতিযোগিতায়। বাকস্বাধীনতা, মুক্তচিন্তা, ন্যায়বিচার হবে সেই সমাজব্যবস্থার ভিত্তি এবং খুলে দেবে নতুন দিগন্তের জানালা। আর আমার বাবার জন্মদিনে এটাই হবে তাঁর সবচেয়ে বড় পাওয়া। (দৈনিক কালের কন্ঠ)
লেখক: তাজউদ্দীন আহমেদ-এর পুত্র। বাংলাদেশের সাবেক এমপি ও স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী।