নিউইয়র্ক ০৭:৪৮ অপরাহ্ন, শনিবার, ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৩ ভাদ্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

ঈদুল ফিতরের তাৎপর্য

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০৯:৩৯:২৮ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৪ জুন ২০১৮
  • / ৯৫১ বার পঠিত

মওলানা আনোয়ার-উল-করিম: রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের সিঁড়ি বেয়ে আবার এলো পবিত্র ঈদুল ফিতর। ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ/তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানী তাগিদ’ বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুলের মনকাড়া এ ঈদসঙ্গীত সত্যিই দীর্ঘ এক মাসের সিয়াম সাধানা শেষে মুসলিম মনকে নাড়া দেয়। বছর ঘুরে আনন্দের সওগাত নিয়ে প্রতি বছর আমাদের দ্বারপ্রান্তে আসে পবিত্র ঈদুল ফিতর।
‘ঈদ’ আরবী শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ খুশি, আনন্দ, উৎসব, উৎসাহ, বিনোদন। মানবজীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রেই তারা বিভিন্ন আনন্দের আতিশয্যে উদ্বেলিত হয়। এসব আনন্দময় মুহূর্তকেই ঈদ বলে আখ্যায়িত করা যেতে পারে। কিন্তু সমগ্র বিশ্ববাসী ঈদ বলতে মুসলিম উম্মাহর দুটি বিশেষ উৎসবকেই বোঝে। অন্যভাবে একে মুসলমানদের জাতীয় উৎসব বলা হয়। ঈদ শব্দের আরেকটি অর্থ হলো ফিরে আসা, বার বার হাজির হওয়া। এ হিসাবে বলা যায়, যেই খুশি ও আনন্দ বার বার ফিরে আসে তাই ঈদ। তাই তো ইসলামী সংস্কৃতির মূর্ত প্রতীক ঈদ আনন্দের বারতা নিয়ে প্রতি বছর আমাদের হৃদয়ের দরোজায় করাঘাত করতে হাজির হয়।
দ্বিতীয় হিজরির ঘটনা। নবী করিম (সা.) দেখতে পেলেন যে, নবীন মুসলমানরা ‘নওরোজ’ ও ‘মেহেরজান’ নামক দুটি বিশেষ দিবসে লাগামহীন আনন্দোৎসবে মেতে আছে। তিনি তাদের জিজ্ঞেস করলেন, এটি কিসের উৎসব? তারা জানাল, ‘আমরা জাহেলি যুগে এ দুটি দিবসে উৎসব করতাম।’ রসুলুল্লাহ (সা.) সরাসরি নিষেধ না করে তাৎপর্যহীন এ খেল-তামাশা সম্পর্কে তাদের বললেন, ‘আলল্লাহ তায়ালা তোমাদের এ দুটি দিনের পরিবর্তে আরো দুটি আনন্দের দিন তথা ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা দান করেছেন। ঈদুল ফিতর একাধারে দীর্ঘ এক মাসের একনিষ্ঠ সিয়াম সাধনা ও কৃচ্ছসাধনের পর তা অবসানের আনন্দোৎসব। আর ঈদুল আজহা হজ আদায় করার পর আল্লাহর উদ্দেশে পশু কোরবানী করার অনুষ্ঠান।
বাংলাদেশে সর্বত্র ঈদ উদ্যাপিত হয়। এ উপলক্ষে সাধারণত তিন থেকে পাঁচ দিন সরকারি ছুটি থাকে। বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন ঈদ উপলক্ষে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। পত্রপত্রিকায় ঈদ উপলক্ষে থাকে বিশেষ আয়োজন। রসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনদর্শন, ঈদের তাৎপর্য, ইসলামের আদর্শভিত্তিক মূল্যবান প্রবন্ধসহ ঈদ সংখ্যা প্রকাশ করে বিভিন্ন পত্রপত্রিকা। ইলেকট্রনিক মিডিয়াগুলোও ঈদ অনুষ্ঠান নিয়ে কম মাতামাতি করে না। কে কার চেয়ে মানসম্মত অনুষ্ঠান দেখাতে পারে, তার প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। বর্তমানে ঈদ উৎসবে টিভি পর্দার অনুষ্ঠানগুলো বেশ আনন্দের সঙ্গে উপভোগ করে সব ধর্মের লোক। নাটকপাড়ায় নাটক তৈরির হিড়িক পড়ে যায়। এফডিসিতেও ঈদ উপলক্ষে নতুন ছবি নির্মাণ করা হয়। ফ্যাশন হাউস, টেক্সটাইল মিলগুলো নতুন পোশাক তৈরিতে ব্যস্ত থাকে। ঈদের বাজারে মার্কেটগুলোয় থাকে প্রচন্ড ভিড়। ঈদ উপলক্ষে মেহেদি উৎসব হয়। ধনী-গরিবনির্বিশেষে সবার মনে থাকে খুশির আমেজ।
ঈদের দিন সকালে দুই রাকাত ঈদের নামাজ পড়েই একে অন্যের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময়, কুশলাদি জিজ্ঞাসা করা, কোলাকুলিসহ সালাম বিনিময় করা হয়। জাতীয় ঈদগাহ, বায়তুল মোকাররমসহ দেশের সব মসজিদে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়। দেশের সর্ববৃহৎ ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয় কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া ময়দানে। ঈদের দিন মাথাপিছু নির্দিষ্ট হারে গরিবদের ফিতরা বা অনুদান বিতরণ ধর্মীয় দিক থেকে বাধ্যতামূলক। এ ছাড়া জাকাত, সাধ্যমতো খাদ্য ও বস্ত্র বিতরণ করা হয়। সবাই সাধ্যানুযায়ী ভালো কাপড় পরিধান করে, আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীদের বাসায় যায়। এদিন সব বাসায় বিশেষ খাবারের ব্যবস্থা থাকে। গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, নেতা-নেত্রী, রাজনীতিবিদসহ অন্যান্য সময় সহজে যাওয়া না গেলেও এদিন তাদের সঙ্গে অবলীলায় দেখা করা যায়। তারাও এ দিন জনগণের কাছে আসেন।
বিশ্বজুড়ে ঈদ সর্বজনীন উৎসব হিসেবে পালিত হয় প্রতি বছর দুবার। এর মধ্যে ঈদুল ফিতরকে বলা হয় মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব। সাধারণভাবে ঈদুল ফিতরকে বলা হয় রোজার ঈদ আর ঈদুল আজহাকে বলা হয় কোরবানির ঈদ। এ দুটি ঈদ সামাজিক উৎসব হিসেবে প্রতি বছর বিশ্বের অন্যান্য স্থানের মতো বাংলাদেশেও ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। বিশেষ করে বাংলাদেশসহ অন্যান্য মুসলিম প্রধান দেশগুলোয় ঈদ উৎসবকে ঘিরে সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয় অনির্বচনীয় এক প্রাণচাঞ্চল্য।
ঈদুল ফিতর শব্দগত দিক থেকে ‘ফিতরা’ আদায়কে কেন্দ্র করে। দীর্ঘ এক মাসের সিয়াম সাধনার পর বিত্তবানরা আনন্দোৎসব পালন করবে অথচ দীনহীন মানুষ ক্ষুধাক্লিষ্ট দেহ নিয়ে জ্বলে-পুড়ে মরবে, তা হয় না। এজন্যই ইসলামী শরিয়তের পক্ষ থেকে দুঃখী মানুষের মুখেও হাসি ফোটাতে ফিতরা ও জাকাতের বিধান রয়েছে। ‘কেউ খাবে আর কেউ খাবে না, তা হবে না’ সূত্রেই সাম্য-মৈত্রীর ধর্ম ইসলামে বিত্তবানদের জন্য জাকাত-ফিতরা আদায়ের নিয়ম প্রবর্তিত হয়েছে। ঈদুল ফিতরের দিন সুবহে সাদিকের সময় জীবিকা নির্বাহের অত্যাবশ্যকীয় সামগ্রী ছাড়া নিসাব পরিমাণ টাকা বা অন্য কোনো মালের মালিক থাকলেই তার ওপর নিজের ও নিজের নাবালক সন্তান-সন্ততির পক্ষ থেকে ফিতরা আদায় করা ফরজ। এখানে একটি কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, কোনো ব্যক্তির ওপর জাকাত ওয়াজিব হওয়ার জন্য তার অত্যাবশ্যকীয় সামগ্রী ছাড়া নিসাব পরিমাণ টাকা বা অন্য মাল বর্ষ অতিক্রম করা প্রয়োজন। পক্ষান্তরে ফিতরা ওয়াজিব হওয়ার জন্য শুধু ঈদুল ফিতরের দিবসের প্রত্যষে নিসাবের মালিক হলেই ফিতরা আদায় করা ওয়াজিব হয়ে যায়। একই সঙ্গে ফিতরা ওয়াজিবের জন্য মাল ব্যবসার জন্য হওয়াও শর্ত নয়।
ঈদের দিন বিত্তবানদের আনন্দের সঙ্গে অনাথ দুস্থদেরও শরিক করার নজির রসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনে বহু ঘটেছে বলে প্রমাণ মেলে। বিশেষত একটি ঘটনাই এর মধ্যে হৃদয়গ্রাহী হিসেবে আমাদের মাঝে প্রসিদ্ধি লাভ করে আছে। রসুলুল্লাহ (সা.) ঈদগাহে নামাজ পড়ে সবার সঙ্গে কুশল বিনিময় করতেন। একবার তিনি ঈদগাহের এক কোণে কান্নারত এক বালককে পেয়ে তাকে বাড়ি নিয়ে গোসল করিয়ে নতুন জামাকাপড় পরিয়ে ভালো খাবার খাইয়ে দেন। রসুলুল্লাহ (সা.)-এর আদরে অনাথ বালকটি পেয়েছিল ঈদ আনন্দ।
আজ আমাদের চারপাশে অসংখ্য শিশু-কিশোর। ডাস্টবিন থেকে কুকুরের উচ্ছিষ্ট খাবার খেয়ে টোকাই নাম ধারণ করে আছে অনেকে। ঈদ তাদের জন্য আদৌ কোনো আনন্দ বয়ে আনে বলে মনে হয় না। যেই ঈদ একদা মুসলমানের জীবনে সফলতা ও খুশি-আনন্দের ঢেউ এনেছিল, আজ সেই ঈদ আসে শত প্রশ্ন নিয়ে-শত বেদনা নিয়ে। মাওলানা আবুল কালাম আজাদ তাই তো বলেছেন, ‘ঈদ এসে বাড়িয়ে দেয় গরিবের আরো দুশ্চিন্তা, ঈদের আগমনে বৃদ্ধি পায় দুস্থদের করুণ আর্তনাদ।’
ঈদুল ফিতর একদিকে যেমন আনন্দের দিন, তেমন চিন্তারও। ঈদ কেন খুশির দিন তা আগেই আলোচনা করা হয়েছে। পক্ষান্তরে এটি মহাচিন্তার দিন এজন্য যে, মাহে রমজান ছিল একটি মহাগুরুত্বপূর্ণ মাস। রমজানের পরই এলো ঈদ। ঈদের চাঁদ উঁকি দেয়া মানেই রমজানের মতো একটি মহাপুণ্যবান মাসের বিদায়। তাই তো হজরত আবু বকর (রা.) একদা ঈদের দিনে বসে কাঁদছিলেন। অন্যান্য সাহাবি তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, জনাব! আপনি কাঁদছেন? আজকের খুশির দিনেও ক্রন্দন? জবাবে তিনি বললেন, ঈদ দিবসের তোমাদের উপলব্ধি অনুভূতি ঠিক আছে বটে; কিন্তু আমি এর অর্থ বুঝেছি অন্যভাবে। তা হলোথ এতদিন ভুল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের পয়গামসংবলিত রমজান আমাদের কাছে ছিল। ঈদের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে সেই মহিমান্বিত মাসের ইতি ঘটেছে। আবার এক বছর পর এর আগমন ঘটবে। কিন্তু আমার তো জানা নেই, আগামী বছর বাঁচব কিনা। হয়তো বা এটিই আমার জীবনের প্রাপ্ত শেষ রোজার মাস। সে চিন্তায় আমি কাঁদছি।
ঈদ আমাদের জন্য এক বিরাট নিয়ামত। এদিন চারদিকে খুশি আর আনন্দের ঢেউ বয়ে যায়। সবার মুখে থাকে হাসি। ফিরনি, সেমাই, পায়েসের ঘ্রাণে বাতাস হয় মুখরিত। সবার মন থাকে প্রফুল্ল। মনে থাকে না হিংসা-বিদ্বেষ। ঈদের দিনে আমরা ঈদগাহে গমন করি, সুন্দর সুন্দর পোশাক পরি। আতর মেখে মাথায় টুপি দিই। আহ! কত সুন্দর এক বেহেস্তি দৃশ্যের অবতারণা। আমাদের সারা দেহ থেকে যেন নুরের রশ্মি ঠিকরে পড়ে। ঈদের জামাতে আমরা আমাদের ইহকাল ও পরকালের মুক্তির জন্য আল্লাহর দরবারে প্রাণভরে মোনাজাত করি। তামাম বিশ্বের শান্তি কামনা করি। ঈদের জামাতে ধনী-গরিব, মনিব-দাসের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ থাকে না। একমাত্র মুসলিম ছাড়া অন্য কোনো জাতির মাঝে এমন নজির পাওয়া যায় না। আর এজন্যই ঈদ আমাদের জন্য মহানিয়ামত স্বরূপ।
রসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ঈদুল ফিতরের দিন ফেরেস্তারা রাস্তার মুখে মুখে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলতে থাকে : হে মুসলিম! নেক কাজের ক্ষমতাদাতা ও সাওয়াবের আধিক্যদাতা আল্লাহর কাছে অতি শিগগির চল। তোমাদের রাতে ইবাদত করার হকুম করা হয়েছিল, তোমরা তা করেছ, দিবসে রোজা রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল, তোমরা তা পালন করেছ। তোমরা তোমাদের সৃষ্টিকর্তাকে খাইয়েছ (অর্থাৎ গরিব-দুখীদের আহার দিয়েছ) আজ তার পুরস্কার গ্রহণ কর। অতঃপর মুসলমানরা যখন ঈদের নামাজ পড়ে তখন একজন ফেরেস্তা উচ্চৈঃস্বরে ঘোষণা করে তোমাদেরকে তোমাদের সৃষ্টিকর্তা ক্ষমা করে দিয়েছেন। এখন তোমরা তোমাদের পুণ্যময় দেহ-মন নিয়ে নিজ নিজ ঘরে প্রত্যাবর্তন কর। এ দিনটি পুরস্কারের দিন, আকাশে এই দিবসের নাম ‘উপহার দিবস’ নামে নামকরণ করা হয়েছে। (তিবরানি)।
ঈদের দিনে করণীয়: ঈদের দিন আমাদের অনেক কিছু করণীয় রয়েছে। প্রথমত ঈদের রাতে জাগ্রত থেকে ইবাদত-বন্দেগি ছাড়াও ঈদের দিন যে কাজগুলো আমাদের করণীয় তা বিশুদ্ধ হাদিস ও ফিকাহর আলোকে তুলে ধরা হলো: হজরত ইবনে উমর (রা.) দুই ঈদে উত্তম পোশাক পরিধান করতেন। ঈদুল ফিতরের দিন ঈদগাহে রওনা হওয়ার আগে উত্তমরূপে গোসল করতেন। তিনি দুই ঈদের দিন প্রত্যুষে ঈদগাহে পৌঁছা পর্যন্ত প্রকাশ্যভাবে তাকবির পাঠ করতেন। (বায়হাকি)। হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ (সা.) ঈদুল ফিতরের দিন খেজুর আহার না করে ঈদগাহের দিকে বের হতেন না (অর্থাৎ ঈদগাহে যাওয়ার আগে অবশ্যই কিছু খেতেন)। (বুখারি)। হজরত জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ (সা.) এক পথ দিয়ে ঈদগাহে যেতেন এবং অন্য পথ দিয়ে প্রত্যাবর্তন করতেন। (বুখারি)। হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ (সা.) ঈদের নামাজের আগে কোনো নামাজ (নফল) আদায় করেননি। ঈদের নামাজ শেষে ঘরে ফিরে দুই রাকাত নামাজ আদায় করতেন। (বুখারি, মুসলিম)। উপরোল্লিখিত হাদিস ও অন্যান্য হাদিসের ভিত্তিতে ঈদুল ফিতরের দিনে নিম্নোক্ত ১৩টি কাজ পালন করা উত্তম ও সুন্নাত। ১. মিসওয়াক করা, ২. খুব প্রত্যুষে শয্যা ত্যাগ, ৩. গোসল করা, ৪. যথাসাধ্য উত্তম পোশাক পরিধান, ৫. সুগন্ধি ব্যবহার, ৬. যথাসাধ্য সুসজ্জিত হওয়া, ৭. ঈদের মাঠে যাওয়ার আগে খুরমা বা মিষ্টান্ন দ্রব্য আহার, ৮. সময় হওয়া মাত্র ঈদগাহে যাওয়া, ৯. ঈদগাহে যাওয়ার আগে সদকায়ে ফিতর আদায়, ১০. যথাসম্ভব মসজিদে ঈদের নামাজ না পড়ে ঈদগাহে আদায়, ১১. পায়ে হেঁটে ঈদগাহে যাওয়া, ১২. ঈদগাহে এক পথে যাওয়া ও অন্য পথে ফিরে আসা, ১৩. ঈদগাহে যাওয়ার সময় নিচু স্বরে এই তাকবির পাঠ করাথ আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার ওয়াআল্লাহু আকবার ওয়ালিল্লাহিল হামদ।
দীর্ঘ এক মাসের সিয়াম সাধনার মাধ্যমে আমরা যে আদর্শ অর্জন করেছি, আল্লাহ তায়ালার যতটুকু নৈকট্য লাভ করেছি, তা যেন ঈদের আনন্দের মাঝে হারিয়ে না যায়। রোজার আদর্শ ভুলে গিয়ে আমরা যদি ঈদের আনন্দকেই মুখ্য বলে গ্রহণ করি, তাহলে এ আনন্দের কোনো সার্থকতা থাকবে না।
বিশেষত মাহে রমজানে আল্লাহ তায়ালা শয়তানকে বন্দি করে রাখেন। রোজা শেষেই তাকে আবার ছেড়ে দেয়া হয়। আমরা স্বাভাবিকভাবেই বুঝি যে, কোনো দুষ্কৃতকারীকে দীর্ঘদিন বন্দি করে রাখলে সে জেলের মধ্যে বসে নিরিবিলি আরো সূক্ষ্ম ফন্দি আঁটতে থাকে কীভাবে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা যাবে। ঠিক তেমনি মাহে রমজানে গ্রেপ্তার হওয়া শয়তান চিন্তাভাবনা করে নতুন কৌশল আয়ত্তে আনেথ কীভাবে তার প্রতিপক্ষ মানুষকে কুমন্ত্রণা দিয়ে রমজানে অর্জিত সব পুণ্য বরবাদ করে দেয়া যায়। তাই রোজার পর অর্থাৎ ঈদের দিন থেকেই আমাদের সতর্ক হতে হবে, যেন আনন্দের আতিশয্যে ফেলে শয়তান আমাদের অর্জিত পুণ্য ছিনতাই করে নিতে না পারে। এজন্যই ঈদের আনন্দ খুব সাবধানে পালন করতে হবে। কারণ, আমাদের অসতর্কতার ফাঁকে শয়তান আমাদের ঘাড়ে চড়ে বসতে পারে। এজন্যই পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেছেন, ‘নিশ্চয়ই শয়তান তোমাদের জন্য প্রকাশ্য শত্রু’।
লেখক: বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ, কলাম লেখক

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

About Author Information

ঈদুল ফিতরের তাৎপর্য

প্রকাশের সময় : ০৯:৩৯:২৮ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৪ জুন ২০১৮

মওলানা আনোয়ার-উল-করিম: রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের সিঁড়ি বেয়ে আবার এলো পবিত্র ঈদুল ফিতর। ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ/তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানী তাগিদ’ বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুলের মনকাড়া এ ঈদসঙ্গীত সত্যিই দীর্ঘ এক মাসের সিয়াম সাধানা শেষে মুসলিম মনকে নাড়া দেয়। বছর ঘুরে আনন্দের সওগাত নিয়ে প্রতি বছর আমাদের দ্বারপ্রান্তে আসে পবিত্র ঈদুল ফিতর।
‘ঈদ’ আরবী শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ খুশি, আনন্দ, উৎসব, উৎসাহ, বিনোদন। মানবজীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রেই তারা বিভিন্ন আনন্দের আতিশয্যে উদ্বেলিত হয়। এসব আনন্দময় মুহূর্তকেই ঈদ বলে আখ্যায়িত করা যেতে পারে। কিন্তু সমগ্র বিশ্ববাসী ঈদ বলতে মুসলিম উম্মাহর দুটি বিশেষ উৎসবকেই বোঝে। অন্যভাবে একে মুসলমানদের জাতীয় উৎসব বলা হয়। ঈদ শব্দের আরেকটি অর্থ হলো ফিরে আসা, বার বার হাজির হওয়া। এ হিসাবে বলা যায়, যেই খুশি ও আনন্দ বার বার ফিরে আসে তাই ঈদ। তাই তো ইসলামী সংস্কৃতির মূর্ত প্রতীক ঈদ আনন্দের বারতা নিয়ে প্রতি বছর আমাদের হৃদয়ের দরোজায় করাঘাত করতে হাজির হয়।
দ্বিতীয় হিজরির ঘটনা। নবী করিম (সা.) দেখতে পেলেন যে, নবীন মুসলমানরা ‘নওরোজ’ ও ‘মেহেরজান’ নামক দুটি বিশেষ দিবসে লাগামহীন আনন্দোৎসবে মেতে আছে। তিনি তাদের জিজ্ঞেস করলেন, এটি কিসের উৎসব? তারা জানাল, ‘আমরা জাহেলি যুগে এ দুটি দিবসে উৎসব করতাম।’ রসুলুল্লাহ (সা.) সরাসরি নিষেধ না করে তাৎপর্যহীন এ খেল-তামাশা সম্পর্কে তাদের বললেন, ‘আলল্লাহ তায়ালা তোমাদের এ দুটি দিনের পরিবর্তে আরো দুটি আনন্দের দিন তথা ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা দান করেছেন। ঈদুল ফিতর একাধারে দীর্ঘ এক মাসের একনিষ্ঠ সিয়াম সাধনা ও কৃচ্ছসাধনের পর তা অবসানের আনন্দোৎসব। আর ঈদুল আজহা হজ আদায় করার পর আল্লাহর উদ্দেশে পশু কোরবানী করার অনুষ্ঠান।
বাংলাদেশে সর্বত্র ঈদ উদ্যাপিত হয়। এ উপলক্ষে সাধারণত তিন থেকে পাঁচ দিন সরকারি ছুটি থাকে। বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন ঈদ উপলক্ষে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। পত্রপত্রিকায় ঈদ উপলক্ষে থাকে বিশেষ আয়োজন। রসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনদর্শন, ঈদের তাৎপর্য, ইসলামের আদর্শভিত্তিক মূল্যবান প্রবন্ধসহ ঈদ সংখ্যা প্রকাশ করে বিভিন্ন পত্রপত্রিকা। ইলেকট্রনিক মিডিয়াগুলোও ঈদ অনুষ্ঠান নিয়ে কম মাতামাতি করে না। কে কার চেয়ে মানসম্মত অনুষ্ঠান দেখাতে পারে, তার প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। বর্তমানে ঈদ উৎসবে টিভি পর্দার অনুষ্ঠানগুলো বেশ আনন্দের সঙ্গে উপভোগ করে সব ধর্মের লোক। নাটকপাড়ায় নাটক তৈরির হিড়িক পড়ে যায়। এফডিসিতেও ঈদ উপলক্ষে নতুন ছবি নির্মাণ করা হয়। ফ্যাশন হাউস, টেক্সটাইল মিলগুলো নতুন পোশাক তৈরিতে ব্যস্ত থাকে। ঈদের বাজারে মার্কেটগুলোয় থাকে প্রচন্ড ভিড়। ঈদ উপলক্ষে মেহেদি উৎসব হয়। ধনী-গরিবনির্বিশেষে সবার মনে থাকে খুশির আমেজ।
ঈদের দিন সকালে দুই রাকাত ঈদের নামাজ পড়েই একে অন্যের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময়, কুশলাদি জিজ্ঞাসা করা, কোলাকুলিসহ সালাম বিনিময় করা হয়। জাতীয় ঈদগাহ, বায়তুল মোকাররমসহ দেশের সব মসজিদে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়। দেশের সর্ববৃহৎ ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয় কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া ময়দানে। ঈদের দিন মাথাপিছু নির্দিষ্ট হারে গরিবদের ফিতরা বা অনুদান বিতরণ ধর্মীয় দিক থেকে বাধ্যতামূলক। এ ছাড়া জাকাত, সাধ্যমতো খাদ্য ও বস্ত্র বিতরণ করা হয়। সবাই সাধ্যানুযায়ী ভালো কাপড় পরিধান করে, আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীদের বাসায় যায়। এদিন সব বাসায় বিশেষ খাবারের ব্যবস্থা থাকে। গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, নেতা-নেত্রী, রাজনীতিবিদসহ অন্যান্য সময় সহজে যাওয়া না গেলেও এদিন তাদের সঙ্গে অবলীলায় দেখা করা যায়। তারাও এ দিন জনগণের কাছে আসেন।
বিশ্বজুড়ে ঈদ সর্বজনীন উৎসব হিসেবে পালিত হয় প্রতি বছর দুবার। এর মধ্যে ঈদুল ফিতরকে বলা হয় মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব। সাধারণভাবে ঈদুল ফিতরকে বলা হয় রোজার ঈদ আর ঈদুল আজহাকে বলা হয় কোরবানির ঈদ। এ দুটি ঈদ সামাজিক উৎসব হিসেবে প্রতি বছর বিশ্বের অন্যান্য স্থানের মতো বাংলাদেশেও ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। বিশেষ করে বাংলাদেশসহ অন্যান্য মুসলিম প্রধান দেশগুলোয় ঈদ উৎসবকে ঘিরে সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয় অনির্বচনীয় এক প্রাণচাঞ্চল্য।
ঈদুল ফিতর শব্দগত দিক থেকে ‘ফিতরা’ আদায়কে কেন্দ্র করে। দীর্ঘ এক মাসের সিয়াম সাধনার পর বিত্তবানরা আনন্দোৎসব পালন করবে অথচ দীনহীন মানুষ ক্ষুধাক্লিষ্ট দেহ নিয়ে জ্বলে-পুড়ে মরবে, তা হয় না। এজন্যই ইসলামী শরিয়তের পক্ষ থেকে দুঃখী মানুষের মুখেও হাসি ফোটাতে ফিতরা ও জাকাতের বিধান রয়েছে। ‘কেউ খাবে আর কেউ খাবে না, তা হবে না’ সূত্রেই সাম্য-মৈত্রীর ধর্ম ইসলামে বিত্তবানদের জন্য জাকাত-ফিতরা আদায়ের নিয়ম প্রবর্তিত হয়েছে। ঈদুল ফিতরের দিন সুবহে সাদিকের সময় জীবিকা নির্বাহের অত্যাবশ্যকীয় সামগ্রী ছাড়া নিসাব পরিমাণ টাকা বা অন্য কোনো মালের মালিক থাকলেই তার ওপর নিজের ও নিজের নাবালক সন্তান-সন্ততির পক্ষ থেকে ফিতরা আদায় করা ফরজ। এখানে একটি কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, কোনো ব্যক্তির ওপর জাকাত ওয়াজিব হওয়ার জন্য তার অত্যাবশ্যকীয় সামগ্রী ছাড়া নিসাব পরিমাণ টাকা বা অন্য মাল বর্ষ অতিক্রম করা প্রয়োজন। পক্ষান্তরে ফিতরা ওয়াজিব হওয়ার জন্য শুধু ঈদুল ফিতরের দিবসের প্রত্যষে নিসাবের মালিক হলেই ফিতরা আদায় করা ওয়াজিব হয়ে যায়। একই সঙ্গে ফিতরা ওয়াজিবের জন্য মাল ব্যবসার জন্য হওয়াও শর্ত নয়।
ঈদের দিন বিত্তবানদের আনন্দের সঙ্গে অনাথ দুস্থদেরও শরিক করার নজির রসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনে বহু ঘটেছে বলে প্রমাণ মেলে। বিশেষত একটি ঘটনাই এর মধ্যে হৃদয়গ্রাহী হিসেবে আমাদের মাঝে প্রসিদ্ধি লাভ করে আছে। রসুলুল্লাহ (সা.) ঈদগাহে নামাজ পড়ে সবার সঙ্গে কুশল বিনিময় করতেন। একবার তিনি ঈদগাহের এক কোণে কান্নারত এক বালককে পেয়ে তাকে বাড়ি নিয়ে গোসল করিয়ে নতুন জামাকাপড় পরিয়ে ভালো খাবার খাইয়ে দেন। রসুলুল্লাহ (সা.)-এর আদরে অনাথ বালকটি পেয়েছিল ঈদ আনন্দ।
আজ আমাদের চারপাশে অসংখ্য শিশু-কিশোর। ডাস্টবিন থেকে কুকুরের উচ্ছিষ্ট খাবার খেয়ে টোকাই নাম ধারণ করে আছে অনেকে। ঈদ তাদের জন্য আদৌ কোনো আনন্দ বয়ে আনে বলে মনে হয় না। যেই ঈদ একদা মুসলমানের জীবনে সফলতা ও খুশি-আনন্দের ঢেউ এনেছিল, আজ সেই ঈদ আসে শত প্রশ্ন নিয়ে-শত বেদনা নিয়ে। মাওলানা আবুল কালাম আজাদ তাই তো বলেছেন, ‘ঈদ এসে বাড়িয়ে দেয় গরিবের আরো দুশ্চিন্তা, ঈদের আগমনে বৃদ্ধি পায় দুস্থদের করুণ আর্তনাদ।’
ঈদুল ফিতর একদিকে যেমন আনন্দের দিন, তেমন চিন্তারও। ঈদ কেন খুশির দিন তা আগেই আলোচনা করা হয়েছে। পক্ষান্তরে এটি মহাচিন্তার দিন এজন্য যে, মাহে রমজান ছিল একটি মহাগুরুত্বপূর্ণ মাস। রমজানের পরই এলো ঈদ। ঈদের চাঁদ উঁকি দেয়া মানেই রমজানের মতো একটি মহাপুণ্যবান মাসের বিদায়। তাই তো হজরত আবু বকর (রা.) একদা ঈদের দিনে বসে কাঁদছিলেন। অন্যান্য সাহাবি তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, জনাব! আপনি কাঁদছেন? আজকের খুশির দিনেও ক্রন্দন? জবাবে তিনি বললেন, ঈদ দিবসের তোমাদের উপলব্ধি অনুভূতি ঠিক আছে বটে; কিন্তু আমি এর অর্থ বুঝেছি অন্যভাবে। তা হলোথ এতদিন ভুল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের পয়গামসংবলিত রমজান আমাদের কাছে ছিল। ঈদের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে সেই মহিমান্বিত মাসের ইতি ঘটেছে। আবার এক বছর পর এর আগমন ঘটবে। কিন্তু আমার তো জানা নেই, আগামী বছর বাঁচব কিনা। হয়তো বা এটিই আমার জীবনের প্রাপ্ত শেষ রোজার মাস। সে চিন্তায় আমি কাঁদছি।
ঈদ আমাদের জন্য এক বিরাট নিয়ামত। এদিন চারদিকে খুশি আর আনন্দের ঢেউ বয়ে যায়। সবার মুখে থাকে হাসি। ফিরনি, সেমাই, পায়েসের ঘ্রাণে বাতাস হয় মুখরিত। সবার মন থাকে প্রফুল্ল। মনে থাকে না হিংসা-বিদ্বেষ। ঈদের দিনে আমরা ঈদগাহে গমন করি, সুন্দর সুন্দর পোশাক পরি। আতর মেখে মাথায় টুপি দিই। আহ! কত সুন্দর এক বেহেস্তি দৃশ্যের অবতারণা। আমাদের সারা দেহ থেকে যেন নুরের রশ্মি ঠিকরে পড়ে। ঈদের জামাতে আমরা আমাদের ইহকাল ও পরকালের মুক্তির জন্য আল্লাহর দরবারে প্রাণভরে মোনাজাত করি। তামাম বিশ্বের শান্তি কামনা করি। ঈদের জামাতে ধনী-গরিব, মনিব-দাসের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ থাকে না। একমাত্র মুসলিম ছাড়া অন্য কোনো জাতির মাঝে এমন নজির পাওয়া যায় না। আর এজন্যই ঈদ আমাদের জন্য মহানিয়ামত স্বরূপ।
রসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ঈদুল ফিতরের দিন ফেরেস্তারা রাস্তার মুখে মুখে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলতে থাকে : হে মুসলিম! নেক কাজের ক্ষমতাদাতা ও সাওয়াবের আধিক্যদাতা আল্লাহর কাছে অতি শিগগির চল। তোমাদের রাতে ইবাদত করার হকুম করা হয়েছিল, তোমরা তা করেছ, দিবসে রোজা রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল, তোমরা তা পালন করেছ। তোমরা তোমাদের সৃষ্টিকর্তাকে খাইয়েছ (অর্থাৎ গরিব-দুখীদের আহার দিয়েছ) আজ তার পুরস্কার গ্রহণ কর। অতঃপর মুসলমানরা যখন ঈদের নামাজ পড়ে তখন একজন ফেরেস্তা উচ্চৈঃস্বরে ঘোষণা করে তোমাদেরকে তোমাদের সৃষ্টিকর্তা ক্ষমা করে দিয়েছেন। এখন তোমরা তোমাদের পুণ্যময় দেহ-মন নিয়ে নিজ নিজ ঘরে প্রত্যাবর্তন কর। এ দিনটি পুরস্কারের দিন, আকাশে এই দিবসের নাম ‘উপহার দিবস’ নামে নামকরণ করা হয়েছে। (তিবরানি)।
ঈদের দিনে করণীয়: ঈদের দিন আমাদের অনেক কিছু করণীয় রয়েছে। প্রথমত ঈদের রাতে জাগ্রত থেকে ইবাদত-বন্দেগি ছাড়াও ঈদের দিন যে কাজগুলো আমাদের করণীয় তা বিশুদ্ধ হাদিস ও ফিকাহর আলোকে তুলে ধরা হলো: হজরত ইবনে উমর (রা.) দুই ঈদে উত্তম পোশাক পরিধান করতেন। ঈদুল ফিতরের দিন ঈদগাহে রওনা হওয়ার আগে উত্তমরূপে গোসল করতেন। তিনি দুই ঈদের দিন প্রত্যুষে ঈদগাহে পৌঁছা পর্যন্ত প্রকাশ্যভাবে তাকবির পাঠ করতেন। (বায়হাকি)। হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ (সা.) ঈদুল ফিতরের দিন খেজুর আহার না করে ঈদগাহের দিকে বের হতেন না (অর্থাৎ ঈদগাহে যাওয়ার আগে অবশ্যই কিছু খেতেন)। (বুখারি)। হজরত জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ (সা.) এক পথ দিয়ে ঈদগাহে যেতেন এবং অন্য পথ দিয়ে প্রত্যাবর্তন করতেন। (বুখারি)। হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ (সা.) ঈদের নামাজের আগে কোনো নামাজ (নফল) আদায় করেননি। ঈদের নামাজ শেষে ঘরে ফিরে দুই রাকাত নামাজ আদায় করতেন। (বুখারি, মুসলিম)। উপরোল্লিখিত হাদিস ও অন্যান্য হাদিসের ভিত্তিতে ঈদুল ফিতরের দিনে নিম্নোক্ত ১৩টি কাজ পালন করা উত্তম ও সুন্নাত। ১. মিসওয়াক করা, ২. খুব প্রত্যুষে শয্যা ত্যাগ, ৩. গোসল করা, ৪. যথাসাধ্য উত্তম পোশাক পরিধান, ৫. সুগন্ধি ব্যবহার, ৬. যথাসাধ্য সুসজ্জিত হওয়া, ৭. ঈদের মাঠে যাওয়ার আগে খুরমা বা মিষ্টান্ন দ্রব্য আহার, ৮. সময় হওয়া মাত্র ঈদগাহে যাওয়া, ৯. ঈদগাহে যাওয়ার আগে সদকায়ে ফিতর আদায়, ১০. যথাসম্ভব মসজিদে ঈদের নামাজ না পড়ে ঈদগাহে আদায়, ১১. পায়ে হেঁটে ঈদগাহে যাওয়া, ১২. ঈদগাহে এক পথে যাওয়া ও অন্য পথে ফিরে আসা, ১৩. ঈদগাহে যাওয়ার সময় নিচু স্বরে এই তাকবির পাঠ করাথ আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার ওয়াআল্লাহু আকবার ওয়ালিল্লাহিল হামদ।
দীর্ঘ এক মাসের সিয়াম সাধনার মাধ্যমে আমরা যে আদর্শ অর্জন করেছি, আল্লাহ তায়ালার যতটুকু নৈকট্য লাভ করেছি, তা যেন ঈদের আনন্দের মাঝে হারিয়ে না যায়। রোজার আদর্শ ভুলে গিয়ে আমরা যদি ঈদের আনন্দকেই মুখ্য বলে গ্রহণ করি, তাহলে এ আনন্দের কোনো সার্থকতা থাকবে না।
বিশেষত মাহে রমজানে আল্লাহ তায়ালা শয়তানকে বন্দি করে রাখেন। রোজা শেষেই তাকে আবার ছেড়ে দেয়া হয়। আমরা স্বাভাবিকভাবেই বুঝি যে, কোনো দুষ্কৃতকারীকে দীর্ঘদিন বন্দি করে রাখলে সে জেলের মধ্যে বসে নিরিবিলি আরো সূক্ষ্ম ফন্দি আঁটতে থাকে কীভাবে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা যাবে। ঠিক তেমনি মাহে রমজানে গ্রেপ্তার হওয়া শয়তান চিন্তাভাবনা করে নতুন কৌশল আয়ত্তে আনেথ কীভাবে তার প্রতিপক্ষ মানুষকে কুমন্ত্রণা দিয়ে রমজানে অর্জিত সব পুণ্য বরবাদ করে দেয়া যায়। তাই রোজার পর অর্থাৎ ঈদের দিন থেকেই আমাদের সতর্ক হতে হবে, যেন আনন্দের আতিশয্যে ফেলে শয়তান আমাদের অর্জিত পুণ্য ছিনতাই করে নিতে না পারে। এজন্যই ঈদের আনন্দ খুব সাবধানে পালন করতে হবে। কারণ, আমাদের অসতর্কতার ফাঁকে শয়তান আমাদের ঘাড়ে চড়ে বসতে পারে। এজন্যই পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেছেন, ‘নিশ্চয়ই শয়তান তোমাদের জন্য প্রকাশ্য শত্রু’।
লেখক: বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ, কলাম লেখক