আসামই কি বাংলাদেশী হিন্দুদের ডাম্পিং গ্রাউন্ড?
- প্রকাশের সময় : ০৫:০৩:০৩ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৩ জুলাই ২০১৮
- / ৯৩৬ বার পঠিত
আবু জাফর মাহমুদ: গরীব বাঙালীদেরকে ডাম্পিং করছেন তারা। আবর্জনা যেমন ছুঁড়ে ফেলা হয়।ওভাবে সে কাজটাই করছেন তারা, অন্য পরিচিতি দিয়ে। বাংলাদেশে বার্মার রোহিঙ্গাদেরকে করার পর আসামে বাংলাদেশী হিন্দুদের ডাম্পিং করার কাজ চালু করছেন ভারতের মোদী সরকার। ভোট ব্যাংক এবং ডাম্পিং একসাথে দুই কাজ। বাঙালী ও বাংলাদেশকে এভাবেই রূপান্তর করা চলছে দুষণ কেন্দ্রে।
আসামে আন্দোলনকারীদের দাবি বাংলাভাষী হিন্দুদেরকে নাগরিকত্ব দিয়ে মূলতঃ ডাম্পিং করছে সরকার এবং মুসলমান দেরকে পরে বাংলাদেশে ডাম্পিং করার পরিকল্পনায় চলছে সরকারী অপর কার্যক্রম। এসব আবর্জনা ডাম্পিং করার তৎপরতা চলছে আসামে। হিন্দু ডাম্পিংধারা বাতিলের দাবিতেই আসামে হয়েছে এই ঐতিহাসিক বিক্ষোভ।
এভাবেই একটি “ডাম্পিং নিষ্ঠুরতার খেলা” চালু হয়েছে বঙ্গ অঞ্চলে। এই নারকীয় খেলার স্থানীয় দালালির কাজ নিয়েছে কিছু দাস প্রকৃতির রাজনৈতিক শক্তি। এই দাস ভারত, বাংলাদেশ, বার্মা জুড়ে আদেশ তামিল করছে বাহিরের প্রভূদের। বিভ্রান্ত করছে সরল মানুষদেরকে।
ভারতের আসাম আবার উত্তাল হয়ে উঠেছে। মানুষ নেমেছে রাস্তায়। গড়ছে উত্তাপ। মিছিলের গগণ বিদারী গর্জনে কাঁপছে পাহাড়-বন-নদী-উপত্যকা-সমতলের জনপদ। শ্লোগান তুলছে, “নাগরিকত্ব (সংশোধনী) বিল বাতিল করো”, “কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার গো ব্যাক”। “কেন্দ্রীয় সরকার,হায় হায়” ও “রাজ্য সরকার হায় হায়” ইত্যাদি ইত্যাদি। কেন্দ্রীয় সরকার এবং আসাম রাজ্য সরকারকে হুঁশিয়ারি দিয়েছে সাধারণ মানুষের এই বিক্ষোভ। ফোঁসে উঠেছে রাস্তার মানুষ,দোকান পাট, কারখানা বাড়ী ঘরের মানুষ। এরা নিজেরাও জানেনা এদের শত্রুর পেছনে শক্তির ডানাগুলো কতো বিশাল। কতো বিস্তৃত তাদের আধিপত্য।
১৯৭১ সনে আসামে অসম ভাষাভাষী লোক ছিলেন আসামের সমগ্র সমাজের ৬০.৮৯%। ২০১১সনের গণনায় দেখা গেছে, এই সংখ্যা কমে হয়েছে ৪৮.৩৮%। কমেছে ১২.৫১%। একবছরে আরো কমেছে আরো ব্যাপকহারে। ১৯৭১সনে লোক সংখ্যা ছিলো ৮৯,০৪,৯১৭জন। বাংলাভাষী ছিলেন ২৮,৮২,৬৩৯জন। হিন্দিভাষী ছিলেন ৭,৯২,৪৮১জন। ১৯৭১ সন থেকে ২০১১ সন পর্যন্ত এই সময়ের মধ্যে ১০.২১% বেড়েছে এবং হিন্দিভাষী বেড়েছে ১.৩১%। ১৯৭১সনে হিন্দিভাষী মানুষ ছিলেন ৫.৪২%। তা থেকে বেড়ে ২০১১সনে হয়েছে ৬.৭৩%। ১৯৭১সনে বাঙলাভাষী ছিলেন ১৯.৭০% এবং ২০১১সনে ২৯.৯১% বাড়ে বাংলাভাষী মানুষ। এই তথ্য দেয়া হয়েছে ২০১১সনের সেনসাসের ভিত্তিতে।
নিখিল আসাম ছাত্র সংসদ এবং ২৮ সংগঠনের আহবানে ২৯ জুন শুক্রবার গণসত্যাগ্রহ ও মহামিছিলের বিক্ষোভ করা হয়েছে আসামের লতাশীল থেকে চাঁদমারি পর্যন্ত দীর্ঘ রাস্তা পথে। নাগরিকত্ব (সংশোধনী) বিল-২০১৬ বাতিলের দাবিতে হয়েছে এই গণবিক্ষোভ। আসাম ছাত্র সংস্থা-আসু এখন জনতার আকাক্সক্ষার মূর্ত প্রতীক হয়ে উঠেছে পূর্ব বাংলায় ৬০-৭০দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের নেতৃত্বে সারা প্রদেশের ছাত্র আন্দোলনের মতো। ওরা চাইছে ৭১-এর ২৫মার্চের পরে আসামে অনুপ্রবেশকারীদেরকে বের করে দেয়া হউক, অনুপ্রবেশকারী যেদেশের যে জাতিরই হোক।
আসু’র মুখ্য উপদেষ্টা সমুজ্জ্বল কুমার ভট্টাচার্য্য শাসকদল বিজেপি ও তার শরিকদলের মন্ত্রীদের হুঁশিয়ারী দিয়ে বিক্ষুদ্ধ জনসমুদ্রে বলেছেন, আন্দোলন রাস্তায় থাকতে থাকতেই পদক্ষেপ গ্রহন করুন। নতুবা এই আন্দোলন আপনাদের বাড়ির দরজায় পৌঁছে যাবে। তখন যে কোন অপ্রীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্যে দায়ী থাকবেন রাজ্য সরকার। তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, ধর্মের নামে বিদেশীদেরকে বিভক্ত করা চলবেনা। তিনি বলেছেন, ১৯৭১সালের পরে আসা কোন হিন্দু বা মুসলমানকে রাজ্যে আশ্রয় দেয়া চলবেনা।
তিনি ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন, “নাগরিকপঞ্জি ও নাগরিকত্ব আইন সংশোধনী বিলকে এক করে দিয়ে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা চলছে। বাস্তবে দু’টি বিষয় সম্পুর্ণ আলাদা। বাংলাদেশী হিন্দুদেরকে নাগরিকত্ব দিতে নাগরিকত্ব আইনে সংশোধন করতে চাইছে কেন্দ্রীয় সরকার। অসম চুক্তির ভিত্তিতে হচ্ছে নাগরিকপঞ্জি উন্নীত করণের কাজ”।
তিনি বলেছেন, সরকারের এই বিল প্রত্যাহার করতে হবে। এটা গ্রহন করা যায়না। এই বিলের বিরোধীতা ক্রমশঃ বাড়তে থাকবে। এই বিল কিছু মানুষকে তাদের নিজ জন্মভূমিতেই সংখ্যালঘু হীনমন্যতায় ঠেলে দেবে। তাই এই বিল ভীষণ ভয়ানক ও আপত্তিকর। সমাজকে চিরদিনের জন্যে বিভেদ বিদ্বেষে ঠেলে দেয়ার ষড়যন্ত্র। স্বাভাবিক যুক্তিতেই হিন্দিভাষী অনেকগুলো সংগঠন এবং মারোয়ারীরা সরকারের এই উদ্যোগের বিরোধীতায় আন্দোলনকারীদের দাবির প্রতি সমর্থন দিয়েছে।
তিনি বলেন, কেবলমাত্র হিন্দুদের জন্যে এই সুবিধা দেয়ার লক্ষ্যে নাগরিকত্ব আইন সংশোধনের চেষ্টার সাভাবিক প্রতিক্রিয়াতেই অন্যান্যরা তাদের আপত্তি জানাচ্ছে। এই আপত্তির যুক্তি ও ভিত্তি অবশ্যই যথাযথ। সরকার সমাজের সকল মানুষের প্রতি ন্যায় বিচার করতে হবে। মনুষ্যত্বকেই দিতে হবে সম্মান।এক্ষেত্রে আসামে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার করছেন উল্টো। বিপরীত।
এদিকে কেন্দ্রীয় রেলপ্রতিমন্ত্রী রাজেন গোহাঁই আগের দিন বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদেরকে বলেছেন, “জাতীয় নাগরিক পঞ্জির চূড়ান্ত খসরার পরে বাংলাদেশী মুসলিমদের দাপটে পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠবে। বাংলাদেশী মুসলিমরা চিরদিনের মতো নাগরিকত্বের লাইসেন্স পেয়ে যাবেন। এজন্যে ভাষার সঙ্গে গোটা আসমিয়া জাতিকে সংকটের পড়তে হবে”। তার এই বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে বিতর্ক বেড়েছে। প্রতিক্রিয়ার উত্তাপ চলছে বেড়ে। সরকার এবং সরকারি রাজনৈতিক দলের সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ নিয়ে আপত্তি উঠছে। এসোসিএশন ফর প্রোটেকশান অফ সিভিল রাইটসে-(এপিসিআর)এর অসম রাজ্য কমিটির প্রভাবশালী সদস্য আহমদ বড় ভূঁইয়া পরদিন ৩০জুন শনিবার সংবাদ মাধ্যমের প্রশ্নের জবাবে বলেন,“ওটা আসলে মুসলিম বিদ্বেষী বক্তব্য ওদের। বিজেপি নেতাদের পক্ষ থেকে মাঝেমধ্যে এধরণের কথা বলা হচ্ছে। ঝামেলা ও উত্তেজনা সৃষ্টিই তাদের রাজনৈতিক লক্ষ্য”।
সমুজ্জ্বল বলেন,আসামের ন্যাশানাল রেজিষ্টার অব সিটিজেনস-এন.আর.সি আসাম একর্ড ১৯৮৫’র বিধান লংঘন করছে। ১৯৭১সনের ২৫ মার্চ হলো আসাম সনদে উল্লেখিত সময় সীমা।এসময়ের আগে যারা এসেছেন তারাই নাগরিকত্ব লাভে বিবেচিত হবেন। এখানে ধর্মের ভিত্তিতে কোন মানুষকে বিবেচনার কথা উল্লেখ নেই। তাই ধর্ম বিশ্বাসের অজুহাতে কাউকে ঠকানো বা জেতানোর কোন ধারা এই সনদে নেই। এই সনদ গড়ার আগে ৮৫৫ জন যুবকে প্রাণ হারাতে হয়েছিলো ন্যায় বিচার পাওয়ার আন্দোলনে। এওসব জীবনের আতœহুতির সাথে প্রতারণা করার অধিকার কে কাকে দিয়েছে? তিনি সাধারণ মানুষের ধৈর্য্যরে বিষয়কে তামাশা বা খেলার বিষয় মনে না করার জন্য সরকারের প্রতি আহবান জানিয়েছেন।
মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়াল জনগণকে উত্তেজনা সৃষ্টি না করার আহবান জানিয়েছেন উল্লেখ করে সমুজ্জ্বল বলেছেন, জনগণ উত্তেজজিত না হবার জন্যে কি যৌক্তিক নমুনা সরকার দেখিয়েছে? তারা তো মানুষকে মানুষ ভাবতে পারছেননা। তিনি সেনসাস গণনার কথা উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, এই অঞ্চলে আসামি ভাষাভাষীর চেয়ে বাংলাভাষী মানুষের সংখ্যা অনেক বেশী। এরা বাঙালী। তবে এতে বাঙালী হিন্দুদের যেভাবে বাড়ানো হচ্ছে তাতে ত্রিপুরার মতো পরিস্থিতির উদ্ভব করতে চাইছে সরকার। তা আমরা মানতে হবে কেনো?
বিজেপি তার ভোট ব্যাংক বাড়ানোর উদ্দেশ্যেই এই সামাজিক সমস্যা চাপিয়ে দিচ্ছে আসামে, যা পরিস্কার। কারো রাজনৈতিক অভিলাষের কাছে আসাম প্রদেশ এবং প্রদেশের জনমানবের জীবন ইচ্ছা এবং স্বপ্ন সুখ আমরা বিলিয়ে দিতে পারিনা। কোন ভারতীয় নাগরিকের বিরুদ্ধে সামান্যও আমাদের কথা নেই। আমরা অবৈধদের চাপের বোঝা বহনের দায় নেবোনা। বাংলাদেশী হিন্দুদের নাগরিক করে তাদেরকে বোঝা করার বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান পরিস্কার। আসাম ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক লুরিঞ্জ্যোতি গোগোই সমাবেশে বলেছেন, জনতার স্বতঃস্ফুর্ত প্রতিবাদের জোয়াড় দেখেও সরকার কোন সম্মান দেখাচ্ছেনা, এটা দুঃখজনক।
ভারতে বিজেপি সরকার নিজেদের রাজনৈতিক সমর্থনে ভোট ব্যাংক নিসচিত করার লক্ষ্যে সাম্প্রদায়িকতাকে উস্কিয়ে চলেছেন বলে খোলাখুলি অভিযোগ চারিদিকে। এদিকে বাংলাদেশের উপর চাপ প্রয়োগ অব্যাহত রাখার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদী নীতিও কার্যকর করছেন। এতে করে আসামে নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করে হিন্দু অনুপ্রবেশকারীদেরকে নাগরিক করা এবং মুসলমান অনুপ্রবেশকারীদেরকে বাংলাদেশে ঠেলে দেয়ার নীতি দেখে স্থানীয় ছাত্রসংগঠন ছাড়াও আদিবাসী সহ ২৮ সংগঠন বিক্ষোভে নেমে সরকারের প্রতিক্রিয়াশীল নীতির সাথে দ্বিমত প্রকাশ করেছে।
ভারত সরকারের এই নীতি সীমান্তঘেঁষা বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্যেও হুমকি বলে নিশ্চিত বলছেন বিশ্লেষকরা। বিশাল আসামে এই দরিদ্র মানুষরা আশ্রয় নিয়েছে এবং তাদের সন্তান সন্তুতি বেড়ে উঠেছে আসামে জন্মগত অধিকারে। কাউকে বিদ্বেষের দৃষ্টিতে না দেখে মানুষকে মানুষের পরিচয়ে বিবেচনায় নিয়ে সবাইকে নাগরিকত্ব পাওয়ার অধিকারে হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থাকা শান্তির জন্যে অপরিহার্য্য।
(লেখক আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও বাংলাদেশের স্বাধীনতাযোদ্ধা)।